somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেভেন সিস্টার্স (পর্ব ১.২) - মনিপুরের বর্তমান ও বাংলাদেশ

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মণিপুরের ভারতের অংশ হওয়ার ইতিহাস কিছুটা কাশ্মীরের মতো। ব্রিটিশদের গোলামি শেষে সবেমাত্র একটা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েছিল মনিপুর। রাজা বোধচন্দ্র সিংহ কোন কূটনৈতিক কাজে শিলং এসেছিল। এই সুযোগে তাকে গৃহবন্ধি করে রাখা হয় আর ভারতের অংশ হওয়ার জন্যে চাপ দিতে থাকে। প্রজাদের ইচ্ছাকে মাটিচাপা দিয়েই ভারতের মাপচিত্রের বর্ধিত অংশ করতে হয় মনিপুরকে। বিপরীতে ভারতের কাছে নিজস্ব সংবিধান রাখার প্রস্তাবও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। আর সেই রাজা বোধচন্দ্র ইতিহাসের অংশ হয়ে যায় শুধু ভারতের অংশ হওয়ার জন্যে না; সাথে সাথে মনিপুরের শেষ রাজা হওয়ার জন্যেও

ভারতের অংশ হতে বাধ্য করার প্রতিবাদে অনেক সংগঠিত গ্রুপই অস্ত্র হাতে ভারতের বিরুদ্ধে তাদের স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করে। মৈতৈদের মধ্যে ছিল UNLF, KCP, PLA, PREPAK আরও অনেকে। এদের অধিকাংশই মাওবাদী ধারার বিশ্বাসী আর দাবি করা হয় চায়না থেকে তাদের মদদ আসে। একই প্যাটার্ন পাওয়া যায় নাগা জাতিদের মধ্যেও। কিন্তু কুকিদের এখানে একটা পার্থক্য থাকে। তাদের একটা বড় অংশ ভারতের অধীনেই থাকতে চায়।

এটা বলে রাখা জরুরি যে মনিপুর ভারতের অংশ ১৯৪৯ সালে হলেও তাদের পূর্ণ অঙ্গরাজ্য করা হয়নি আরও দুই যুগ। তার আগে পন্ডিত নেহেরু ১৯৬০ সালে মনিপুর ভূমি সংস্কার আইন পাশ করে। যার ফলে পাহাড়ি অঞ্চলের কুকিরা মৈতৈদের অঞ্চলের জমি কিনতে পারত; কিন্তু মৈতৈরা পাহাড়ী অঞ্চল (যেটা কিনা মনিপুরের প্রায় ৯০ ভাগ এরিয়া) যেখানে জমি কিনতে পারবে না। এটার কারনে কুকিদের সাথে মনিপুরিদের বিভেদ আরও বেড়ে যায়। বিগত শতাব্দীর শুরুর দিকে মনিপুরে কুকিদের জনসংখ্যা ছিল ১% যেখানে এখন প্রায় ২৩% এর মত। অন্যদিকে যে সমস্যাটার কারণে আজকের দিনেও মনিপুরে রক্তপাত হচ্ছে। “Scheduled Tribes” বা তফসিলি জনজাতি।

Scheduled Tribes(ST) বা তফসিলি জনজাতি ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী সুবিধাবঞ্চিত আর্থসামাজিক জনগোষ্ঠীদের বুঝানো হয়। তফসিলি জাতি কারা এটা নির্ণয় করে লগুর কমিটি আর সিদ্ধান্ত দেয় স্বয়ং রাষ্ট্রপতি। এসটি ক্যাটাগরির জাতিদের চাকরি, শিক্ষা, ভূমিগত সুযোগের অগ্রাধিকার ইত্যাদি আছে যেটা অন্য ক্যাটাগরিতে নেই। তফসিলি জনজাতির মানদণ্ড হচ্ছে আদিমতা, পৃথক সংস্কৃতি, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, অনগ্রসরতা ইত্যাদি। কুকিরা তফসিলি জনজাতির তালিকাভুক্ত। উল্লেখ্য লগুর কমিটি নিয়মিত এই তালিকা হালনাগাদ করে থাকে। নানাবিধ কারণে অনেক জনজাতিদের বাদ দেয়া হয়, আবার যুক্তও করা হয়। এটা হচ্ছে একটা পলিটিকাল অস্ত্র; এটা ব্যবহার করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মনিপুর ও অন্যান্য জায়গায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে।

মৈতৈরা অনেক বছর ধরেই তফসিলি জনজাতির তালিকাভুক্ত হতে চাচ্ছে। যদিও এটার মানদন্ডের অনেক কিছুই আসলে তাদের সাথে মিলে না। ভারতের অংশ হওয়ার পর থেকে নানান সময়ই আবেদন করেছে আর প্রতিবারই রিজেক্ট হয়েছিল। আর যতবারই এটা নিয়ে কোন নিউজ আসে; তখনই কুকি আর মৈতৈদের মাঝে সংঘর্ষ লেগে থাকে। শেষবার সংঘর্ষ শুরু হয় ২০২৩ এ; যেটা এখনো চলছে।

মনিপুরের রিয়ালিটি এতটা বাজে যে সেখানে পুলিশ পর্যন্ত দুই জাতিতে বিভক্ত। সংঘর্ষ হলে পুলিশ পর্যন্ত নিজেদের জাতিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়; আর কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে যে অঞ্চলে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বেশি সেখানে চলে যায়। বিগত ১৬ মাসে শত শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, ৬০০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, প্রায় আড়াইশ মানুষ মারা গিয়েছে, ধর্ষণ ও লুটপাতেরও অসংখ্য কেস রয়েছে। এই যুদ্ধে ড্রোণ দিয়ে বোমা এমনকি রকেট পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে। এত কিছুর পরেও নরেন্দ্র মোদী এই পরিস্থিতি নিয়ে কোন কমেন্টই করছে না। যার কারণে বিশেষ করে মৈতৈদের মাঝে আর ও ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে।

*মনিপুরের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ*
যুদ্ধের কারণে ইতমধ্যেই পাহাড়ি অঞ্চল থেকে মৈতৈরা সমতলে চলে এসেছে আর অনেক কুকিরা সমতল থেকে পাহাড়ি অঞ্চল, মিজোরাম, ত্রিপুরা চলে যাচ্ছে। এটা সহজেই অনুমিয় যে সামনে মনিপুরের জনবসতিগুলো আরও বিভক্ত হয়ে যাবে। তাই হয়ত কুকিদের দাবির ভিক্তিতে মনিপুরকে দুইটা আলাদা প্রশাসনে ভাগ করা হতে থাকে। পাহাড়ী অঞ্চলগুলো কুকিদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে আর তারা মনিপুরের রাজ্য সরকারের জায়গায় সরাসরি দিল্লীর কাছে জবাবদিহি করবে। অন্যদিকে চারিদিকে পাহাড়ে বেষ্টিত সমতল উপত্যকা মৈতৈদের কন্ট্রোলে থাকবে। মনিপুরের মাত্র ১০ ভাগ জায়গার নিয়ন্ত্রণ রেখে মৈতৈদের অতীতের সাম্রাজ্যের সোনালি ইতিহাস নিয়ে গল্প বলা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।

আর যদি ভারত পুরোপরি মনিপুর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তাহলেও কুকি আর মনিপুরের রক্তপাত বন্ধ হবে না। যে আসাম রাইফেলস এর মাধ্যমে দুই ভাগকে আলাদা রাখার চেষ্টা হচ্ছে সেই না থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মৈতৈরা কুকিদের উচ্ছেদের চেষ্টা করবে পুরো মনিপুর অঞ্চল থেকেই। কিন্তু পাহাড়ে আসলে নিয়ন্ত্রণ তৈরি করা একটা অসম্ভব কাজ; তাই স্বাধীন মনিপুরে কুকি আর মৈতৈদের যুদ্ধ চলতে পারে আরও কয়েক যুগ।

*বাংলাদেশের কূটনৈতিক পথ*
বাংলাদেশের সাথে মনিপুরের কোন সরাসরি সীমান্ত নাই। কিন্তু কুকিদের প্রভাব আর মাদকব্যবসা মিজোরাম হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাপ্লাই চেইন আছে। তাই পরোক্ষভাবে হলেও সেখানকার গন্ডগোলে বাংলাদেশ প্রভাবিত হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ভারসাম্যের জন্যে মৈতৈদের প্রতি সেন্টিমেন্ট কাজ করা স্বাভাবিক। আর সে অঞ্চলে তারা গনতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করার ক্ষমতা রাখে; ঐতিহাসিক প্রমাণও আছে। কিন্তু বাংলাদেশকে কখনোই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে অফিশিয়ালি কাউকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত হবে না। বরং এটা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে আরও দুর্বল করবে। অবশ্য যেকোন ন্যায্য রাজনৈতিক সংগ্রামকে মদদ দেয়ার অনেক বিকল্প পন্থা রয়েছে।


আগের পর্ব
- সেভেন সিস্টার্স (পর্ব ১.২) - মনিপুরের অতীত

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:০৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দীপনের দীপ নেভে না

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯


ছবিঃ সংগৃহীত
আজকে সামুর অন্ধকার ব্লগার নামে খ্যাত ফয়সাল আরেফিন দীপনের মৃত্যু দিবস। ২০১৫ সালে আজকের এই দিনে জঙ্গি হামলায় দীপন মারা যান নিজ প্রকাশনীর কার্যালয়ে । যে ছেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বজলুল হুদাকে জবাই করে হাসিনা : কর্নেল (অব.) এম এ হক

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৫৯

মেজর বজলুল হুদাকে শেখ হাসিনা জবাই করেছিলেন।

(ছবি ডিলিট করা হলো)

শেখ মুজিবকে হত্যার অপরাধে ২৮শে জানুয়ারী ২০১০ এ মেজর (অব.) বজলুল হুদা সহ মোট ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মি. চুপ্পুর পক্ষ নিয়েছে বিএনপি-জামাত; কারণ কী?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৬


বিএনপি গত ১৬ বছর আম্লিগের এগুচ্ছ কেশও ছিড়তে পারেনি অথচ যখন ছাত্ররা গণহত্যাকারীদের হটিয়েছে তখন কেন বিএনপি চু্প্পুর পক্ষ নিচ্ছে? অনেকেই বলছে সাংবিধানিক শুন্যতা সৃষ্টি হবে তার সংগে বিএনপিও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগারেরা প্রেসিডেন্ট চুপ্পুমিয়াকে চান না, কিন্তু বিএনপি কেন চায়?

লিখেছেন সোনাগাজী, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৪



**** এখন থেকে ১৯ মিনিট পরে (বৃহ: রাত ১২'টায় ) আমার সেমিব্যান তুলে নেয়া হবে; সামুটিককে ধন্যবাদ। ****

***** আমাকে সেমিব্যান থেকে "জেনারেল" করা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিকাহের পরিবর্তে আল্লাহর হাদিসও মানা যায় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪




সূরা: ৪ নিসা, ৮৭ নং আয়াতের অনুবাদ-
৮৭। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই। হাদিসে কে আল্লাহ থেকে বেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×