somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেভেন সিস্টার্স (পর্ব ১.১) - মনিপুরের অতীত

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মনিপুর কখনোই ভারতের অংশ ছিল না। তাদের হাজার বছরের নিজস্ব সত্ত্বা ও সংস্কৃতি আছে। মনিপুরী বা মৈতৈ সাম্রাজ্যের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় ৩৩ অব্দে। ইতিহাসের রাজনৈতিক পালাবদলে মনিপুরকে নানান সময়ে সার্বভৌম প্রদেশ রাষ্ট্র হিসেবে থাকা লেগেছে কিন্তু সেটা বার্মার দিকের কোনবাউং, টাউঙ্গু, মগাউং সাম্রাজ্যের সাথে, ভারতের সাথে না। আদি মনিপুরের অধিকাংশ মানুষ স্থানীয় ধর্মের থাকলেও বর্তমানে অধিকাংশ মনিপুরী সনাতন ধর্মালম্বী। এটার কারণ হচ্ছে ১৭১৭ সালের দিকে রাজা পামহেইবা সনাতনধর্ম গ্রহণ করে। তার শাসনামলে সনাতনধর্মকে রাষ্ট্রধর্মে পরিণত করেন এবং প্রায় সমস্ত মনিপুরী সম্প্রদায়কে হিন্দুধর্মে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেন। এমনকি মনিপুরী আদিধর্মের অনেক সাহিত্য, পুথিপুরাণ ধ্বংস করা হয়। তা সত্ত্বেও মনিপুরের অনেক উৎসব, রীতিনীতি ধর্মান্তরিত জাতিদের মাঝে এখনো উদযাপন হয়। মনিপুরীদের মধ্যে বর্তমানে ৮৩% সনাতন ধর্মালম্বী; এর বাইরে খ্রিষ্ঠান, লোকধর্ম, এমনকি মুসলিম মৈতৈ পাঙ্গাল রয়েছে

মনিপুরীদের সাথে আদি সময় থেকেই একটা দাকুমড়া সম্পর্কে ছিল নাগাদের। নাগারা পাহাড়ে থাকতো; আর অনেক সময়ে মৈতৈ রাজ্যে লুটপাত করতো। মনিপুর রাজ্যটা আসলে কতটুকু এখানে মৈতৈ-নাগাদের দ্বিমত আছে। মনিপুরীদের দাবি পাহাড়, সমতল সব মিলিয়েই মনিপুর রাজ্য; অন্যদিকে নাগাদের দাবি পাহাড়ে কখনোই মনিপুরীদের নিয়ন্ত্রন ছিল না সেগুলো আদিকাল থেকে নাগাদের অধীনে। নাগাদেরও আদি লোকধর্ম ছিল; কিন্তু ব্রিটিশরা এই জায়গায় নিয়ন্ত্রন নেয়া শুধু করলে আমেরিকান ব্যাপ্টিস্টদের হাত ধরে নাগারা খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হতে থাকে। বর্তমানে নাগাদের ৯০% এর বেশি ব্যাপ্টিস্ট খ্রিষ্ঠান

আঠারো শতকে ব্রিটিশ ও মৈতৈ রাজ্যের কমন শত্রু ছিল বার্মিজরা। বার্মার আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে ব্রিটিশদের সাথে ১৭৬২ সালে চুক্তি করে মনিপুরের রাজা জয় সিংহ। ব্রিটিশদের একটা রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে কোন একটা পক্ষকে কখনো বেশি শক্তিশালী হতে না দেয়া। তাই তারা মনিপুরীদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে ঠিকই; কিন্তু মনিপুরের পাহাড়ী অঞ্চলে কুকিদের অনুপ্রবেশের পথ করে দিয়ে। কুকিদের বাস ছিল মূলত বার্মার ভুখন্ডে। এখানে মনিপুরের লাভ ছিল যে নাগাদের লুটপাত থেকে কুকিরা তাদের নিরাপত্তা দিবে। মোট কথা, মনিপুরী লোকালয়ে আসার আগে বার্মা বা নাগাদেরকে কুকি বাহিনী হয়ে আসা লাগবে। এইখান থেকে মনিপুরের রাজনীতি জটিল হতে শুরু করে

“কুকি” শব্দটা আসলে ব্রিটিশদের দেয়া। মনিপুরের রাজদরবারের রেকর্ড “চৈথারোল কুম্মাবা” তে কুকিদের সবচেয়ে পুরাতন রেকর্ড পাওয়া যায় ১৪০৪ সালের। যেখানে তাদের “খংজাইস” নামে বলা হয়। কিন্তু কুকিদের বিশ্বাস তারা মনিপুরের এই অঞ্চলে আছে আড়াই হাজার বছর ধরে। তবে মূলত মায়ানমার অঞ্চলের চিন পাহাড়ে তাদের বসবাস ধরা হয়। সেখানে চিন ও মেজো গোত্রের মাধ্যমে নিপীড়িত হওয়ার কারণে তারা মূলত ব্রিটিশদের কৌশলের অংশ হতে রাজি হয়। নাগাদের মত কুকিদের একটা বড় অংশও এখন ধর্মান্তরিত ব্যাপ্টিস্ট খ্রিষ্ঠান।

ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি থাকা সত্ত্বেও বার্মিজদের থেকে মনিপুর রক্ষা পায়নি। একটা সময় মনিপুর বার্মার অধীনে চলে যায়। এরপর ব্রিটিশ-বার্মিজ যুদ্ধের মাধ্যমে মনিপুর বার্মা থেকে মুক্ত হয় আর ব্রিটিশদের অধীনে চলে আসে। মনিপুরের রাজারা হয়ে উঠে ব্রিটিশদের গোলাম। ব্রিটিশদের প্রতি মনিপুরের মানুষের ঘৃণা বাড়তে থাকে। সেই পথ ধরে ১৮৯১ সালে অভ্যুত্থান হয়। কিন্তু সেটা সফলতা পায়নি। মাত্র এক মাসের ব্যবহারে ব্রিটিশরা কুলচন্দ্র সিংহকে পরাজিত করে। আর ৫ বছরের চুরচান্দ সিংহকে মনিপুরের সিংহাসনে বসায়।

এইসবের মাঝে কুকিরা ব্রিটিশ রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। তাদের স্বার্থ না দেখার কারনে তাদের মাঝেও বিদ্রোহ শুধু হয়। যে কুকিদের দিয়ে মনিপুরের নিরাপত্তার চিন্তা করা হচ্ছিল সেই কুকিরাই একটা সময় লুটপাত শুরু করে। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মনিপুর ব্রিটিশদের সৈন্য সরবরাহ করলেও কুকিরা করেনি। একটা সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র ধরে; কিন্তু পরাজিত হয়ে একটা সময় আরও দুর্গম পাহাড়ে আশ্রয় নিতে হয়। উল্লেখ্য, কুকিদের অভিমান ছিল ব্রিটিশ ও তাদের সহযোগীদের প্রতি; মনিপুরের সাধারণ মানুষ অভিযোগ ছিল না। এমনকি মনিপুরের রাজপরিবারের দেহরক্ষক হিসেবেও ছিল অনেক কুকি।

ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর মনিপুর, নাগাল্যান্ড এর এরিয়াগুলো ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে যুক্ত করা হয়। যাদের সাথে হাজার বছরেও কোন একক সত্ত্বা ছিল না তাদের দেশের অংশও হতে চায় নাই এই এলাকার জনগোষ্ঠী; মনিপুরী, নাগা ও কুকি কেউই ভারতের সাথে থাকতে চায়নি। শুরু হয় তাদের স্বাধিকারের লড়াই। কুকিরা চায় কুকিল্যান্ড, নাগারা চায় নাগালিম আর মৈতৈরা চায় মনিপুর; অনেকক্ষেত্রে একই ভুখন্ডে। তাই ভারতের সাথে সাথে নিজেদের মাঝে চলে বিরোধ আর রক্তপাত।

{ ছবি: আম্বিকা করন্দিকা; মণিপুরের রূপকথা "সোনালী হরিণ, সোনালী টিয়া" গল্পের আলোকে}

পরের পর্বঃ
সেভেন সিস্টার্স (পর্ব ১.২) - মনিপুরের বর্তমান ও বাংলাদেশ

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৭
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রিয় কন্যা আমার- ৭৫

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৬ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১:৩৩



প্রিয় কন্যা আমার-
আজ শুক্রবার। তোমার স্কুল নেই। অথচ আজ তুমি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বসে আছো। বলছো, মেকাপ বক্স দাও। মাকে মেকাপ করে দিবো। যেদিন তোমার স্কুল থাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এক প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাকে ইসলামের হৃদয়ছোঁয়া আহ্বান

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২০

এক প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাকে ইসলামের হৃদয়ছোঁয়া আহ্বান

ক্যালিগ্রাফি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

প্রিয় যামিনী সুধা,

আপনার নাম আমাদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার এক অমলিন আলো জ্বালায়। একজন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে আপনি শুধু জীবনের অভিজ্ঞতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তদ্বির বানিজ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও এনসিপির নেতা

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ১৬ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭

জনপ্রিয় অনলাইন এক্টিভিস্ট জুলকারনাই সায়েরের এক পোস্ট ভাইরাল হয়েছে গতকাল যেখানে রেলভবনে, রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) এর একান্ত সচিবের কক্ষে তদ্বির বানিজ্যে দেখা গেছে এনসিপির সংগঠক (হবিগঞ্জ) নাহিদ উদ্দিন তারেক ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষগুলো কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে!

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ১৬ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:২১

আমি ঢাকার লালমাটিয়া এ ব্লক এলাকায় বড় হয়েছি। একদিন মায়ের সাথে স্কুলে হেঁটে যাচ্ছি। আমি তখন ক্লাস ওয়ান কি টুতে পড়ি। হঠাৎ ছিনতাইকারী আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো। উদ্দেশ্য আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

'লেখা আছে অশ্রুজলে’......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৬ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:৩৭

আমার গুম নির্যাতনের উপর লেখা 'গুম এবং অতঃপর' বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখেছেন এসোসিয়েট প্রফেসর ডক্টর মো: আদনান আরিফ সালিম( Md. Adnan Arif Salim) । লিংক পাঠিয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক Mesbah Shemul লিংক-... ...বাকিটুকু পড়ুন

×