প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপগুলো যেন আরেক বাংলাদেশ। এখানকার নিঝুম দ্বীপ, নলের চর, কেয়ারিং চর, জাহাজের চরসহ বেশ কয়েকটি নতুন দ্বীপ যেন এরই জানান দিচ্ছে। এর মধ্যে নিঝুম দ্বীপে গড়ে উঠেছে ৫০ হাজার লোকের বসতি ও বনায়ন। এখানকার হরিণগুলো রক্ষা করে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার রপ্তানি করা সম্ভব। প্রতিটি হরিণের মূল্য ২৫ হাজার টাকা ধরা হলে নিঝুম দ্বীপ থেকে বছরে আয় হবে ৩০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া দ্বীপ হাতিয়ার পশ্চিমে ঢাল চর, মৌলভীর চর, তমরুদ্দির চর, জাগলার চর, ইসলাম চর, নঙ্গলিয়ার চর, সাহেব আলীর চর; দক্ষিণে কালাম চর, রাস্তার চরসহ অন্তত ১৫টি দ্বীপ ১৫-২০ বছর আগ থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে উঠেছে। যে মুহুর্তে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সিংহভাগ ভূখণ্ড সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে, ঠিক সে মুহূর্তেই দেশের এই অভাবনীয় সম্ভাবনা সীমাহীন আশা জাগিয়েছে জনমনে।
এদিকে নিঝুম দ্বীপে ৩০ হাজার হরিণ থাকলেও এখানে দেখা দিয়েছে প্রচণ্ড খাদ্য-সংকট। এখানকার শিয়াল-কুকুরেরা আক্রমণ করে খেয়ে ফেলছে হরিণগুলো। এ ছাড়া বনে গরু-মহিষ ঢুকে পড়ায় ভয়ে হরিণগুলো লোকালয়ে চলে যাচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে, জোয়ারের সময় হরিণগুলো ভেসে পার্শবর্তী ঢালচর ও কালামচরসহ নতুন দ্বীপগুলোয় আশ্রয় নিচ্ছে। নিঝুম দ্বীপে সীমানাপ্রাচীর না থাকায় ৩০ হাজার হরিণ থেকে কমে চার-পাঁচ হাজারে নেমে এসেছে।নিঝুম দ্বীপে ৫০ হাজার লোকের বসবাস।
এ ছাড়া ঢালচর, নলের চর, কেয়ারিং চর, মৌলভীর চরসহ কয়েকটি দ্বীপে জনবসতি গড়ে উঠেছে। এসব দ্বীপে বন বিভাগ সবুজ বনায়ন করেছে। তবে জলদস্যু-বনদস্যুদের ভয়ে বাকি দ্বীপগুলোতে এখনো বসবাস শুরু হয়নি। এখনো অন্তত ৪০-৫০টি ডুবোদ্বীপ রয়েছে, যা আগামী পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে জেগে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব ডুবোদ্বীপ ভাটায় দেখা গেলেও জোয়ার এলে ডুবে যাচ্ছে। নিঝুম দ্বীপে প্রায় ৪৫ হাজার একর সংরক্ষিত বন এলাকা। এখানে প্রায় ১ হাজার ২০০ বর্গমাইল আয়তনের ভূখণ্ড গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এ বছর যুক্ত হচ্ছে আরও প্রায় ২ হাজার ২০০ বর্গমাইল ভূমি। নিঝুম দ্বীপ থেকে মুক্তারিয়া ঘাটসহ কয়েকটি স্থানে ক্রস ড্যাম আর প্রযুক্তিগত বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলে কয়েক বছরের মধ্যে এ এলাকার আয়তন দাঁড়াবে প্রায় ১৫ হাজার বর্গমাইল। সবকিছু মিলিয়ে বঙ্গোপসাগরের বুকে দেখা দিয়েছে আরেকটি বাংলাদেশের হাতছানি।
নিঝুম দ্বীপের কাছাকাছি এলাকায়ও কয়েকশ বর্গমাইল নতুন দ্বীপ জেগে উঠেছে। রয়েছে ডুবোদ্বীপ। নিঝুম দ্বীপের দক্ষিণে ৪০-৫০ বর্গমাইল এলাকা ভাটার সময় জেগে উঠছে। তবে যে দ্বীপগুলো এরই মধ্যে পুরোপুরি জেগে উঠেছে, সেসব স্থানে এখনই বসবাসের উপযোগী এলাকা গড়ে তোলা সম্ভব।এদিকে বিশেষ একটি সিন্ডিকেট বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বন উজাড় করে জায়গাগুলো দখল করে নিচ্ছে।
জানতে চাইলে নোয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ছানাউল্লাহ পাটোয়ারী এর সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘একটি বিশেষ রাজনৈতিক সিন্ডিকেট বন বিভাগ উজাড় করে জায়গা দখলের চেষ্টা করছে। বন বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কাজ চলছে।’ হরিণ বিলুপ্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খাদ্য-সংকট, শিয়াল-কুকুর ও গরু-মহিষের ভয়ে হরিণগুলো লোকালয়ে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের কারণে হরিণগুলো আশ্রয় নিচ্ছে পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলোতে। হরিণের বিলুপ্তি ঠেকাতে দ্বীপের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা। এ ছাড়া খাদ্য-সংকট ঠেকাতে অর্জুন ও আমলকী গাছ এবং ঘাস লাগানোর চেষ্টা চলছে। এতে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দের কথাও স্বীকার করেন তিনি।
নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত ইডিপির এক জরিপ সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল পর্যন্ত শুধু নোয়াখালী উপকূলে জেগে ওঠে সাড়ে ৯ বর্গমাইল ভূমি। ২০২০ সাল পর্যন্ত আরও দু-তিন গুণ ভূমি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এ দ্বীপগুলোকে পরিকল্পিতভাবে স্থায়িত্ব দিতে সরকারি উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ে না। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক গুরুত্ব পাচ্ছে না। সমুদ্রবক্ষে সম্ভাবনার বিশাল আশীর্বাদ এসব ভূখণ্ডের পরিকল্পিত ব্যবহার, বনায়ন ও সংরক্ষণে সমন্বিত কার্যক্রম নেওয়া হয়নি এখনো। নিঝুম দ্বীপে দীর্ঘদিন ধরে ডুবোচর হিসেবে পরিচিত এলাকাগুলোয় এখন জনবসতি গড়ে উঠেছে।
একই ধরনের আরও প্রায় ২০টি নতুন চর স্থায়িত্ব পেতে চলেছে। বঙ্গোপসাগরে দু-তিন বছর ধরে জেগে থাকা এসব দ্বীপখণ্ড ভরা জোয়ারেও ডুবছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিগগিরই বাংলাদেশের মানচিত্রে নতুন ভূখণ্ড ১৫-২০টি দ্বীপ যোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে নঙ্গলিয়া এলাকায় নতুন চর জেগে মেঘনা মোহনাজুড়ে বড় বড় আয়তনের নতুন ভূখণ্ড দেখা যাচ্ছে। এসব চরে গজাতে শুরু করেছে ঘাস, শণ। নিঝুম দ্বীপ থেকে মুক্তারিয়ার ঘাট, উড়ির চর থেকে জাহাজ্জার চর পর্যন্ত ক্রসবাঁধ নির্মাণ করে অনেক ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব। হাতিয়া-নিঝুম দ্বীপ-ধমার চর ক্রসবাঁধের মাধ্যমে মূল স্থলভূমির সঙ্গে সংযুক্ত করার চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ক্রসবাঁধ ঠিকভাবে করা গেলে অচিরেই এসব ভূমি অবিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে পরিণত হবে। সমুদ্রবক্ষে ভূমি উদ্ধার ও ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব প্রযুক্তির প্রয়োজন, সেগুলো বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে উদ্ভাবনও করেছেন। যে মুহূর্তে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সিংহভাগ ভূখণ্ড সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে, ঠিক সে মুহূর্তেই দেশের এই অভাবনীয় সম্ভাবনা জনমনে সীমাহীন আশা জাগিয়েছে।
কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে অন্তত ২০ বর্গমাইল নতুন চর জেগে ওঠে। আশির দশকের শেষ ভাগ থেকে জেগে ওঠা চরভূমির পরিমাণ পর্যায়ক্রমে বাড়তে দেখা যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মেঘনা মোহনা সমীক্ষায়ও এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়। পাউবো সমীক্ষায় বলা হয়, নদী ভাঙা-গড়ার খেলায় ভূমিপ্রাপ্তির হারই বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে নোয়াখালীর উপকূলেই সবচেয়ে বেশি ভূখণ্ড জেগে উঠছে। ইতিমধ্যে ক্রসবাঁধ পদ্ধতিতে বঙ্গোপসাগর থেকে লক্ষাধিক হেক্টর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। এরই মধ্যে পাওয়া গেছে প্রায় এক হাজার বর্গমাইল আয়তনের নতুন ভূখণ্ড। আরও কয়েকটি ক্রসবাঁধের মাধ্যমে নোয়াখালীর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ ও সন্দ্বীপের সংযুক্তির সম্ভাব্যতা নিয়েও গবেষণা চলছে। এটি সম্ভব হলে সূচনা হবে যুগান্তকারী অধ্যায়ের।
অন্যদিকে বন বিভাগের অবহেলায় নিঝুম দ্বীপে ৩০ হাজার হরিণের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গাছ উজাড় করছে দস্যু ও জনপ্রতিনিধিরা। সেখানে হরিণের আবাসন, খাদ্য-সংকট, অকারণে শিকার, বন্য কুকুরের আক্রমণ ও পানীয় জলের অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। দুই বছর আগে নিঝুম দ্বীপে বিস্তীর্ণ বনে, ফসলের মাঠে, রাস্তাঘাট ও লোকালয়ে দেখা যেত মায়াবী হরিণের পাল। কিন্তু এখন আর তা চোখে পড়ে না। লবণাক্ত পানির কারণে রোগাক্রান্ত হওয়া এবং বন কর্মকর্তাদের অবহেলা এর মূল কারণ।
নিঝুম দ্বীপের রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, সমস্যার সমাধান করা গেলে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার হরিণ রপ্তানি করা সম্ভব। প্রতিটি হরিণের মূল্য ২৫ হাজার টাকা ধরা হলে নিঝুম দ্বীপ থেকেই ৩০ কোটি টাকা আয় হবে বছরে। এ ছাড়া হরিণ রপ্তানি করা জরুরিও হয়ে পড়েছে। কারণ হরিণের সংখ্যা দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেখা দিয়েছে রাখার মতো জায়গার সংকট। স্থানীয়দের অভিযোগ, বনের আশপাশের খালি জমিতে ভূমিহীনদের বসবাস এবং স্থানীয় দস্যু ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশের ফলে গাছ কেটে পাচার করায় হরিণের অবাধ বিচরণে সমস্যা হচ্ছে। এতে আয়তন কমে যাচ্ছে বনের। নষ্ট হচ্ছে দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্য। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হচ্ছে মূল্যবান মায়াবী চিত্রাহরিণ। হরিণ রপ্তানির ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানোর পরও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। হরিণের চিকিৎসার জন্য এখানে বন বিভাগের নেই কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। নেই হাসপাতাল।
হাতিয়া উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন বঙ্গোপসাগরের উপকণ্ঠে প্রায় ২ হাজার ১০০ বর্গ কিলোমিটার ভূমির ওপর বেড়ে ওঠা নিঝুম দ্বীপে ১৯৭৩ সালে জনবসতি শুরু হয়। এলাকাটি কেওড়া, বাইন ও কেরপা গাছে বেষ্টিত। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এখানে ছেড়েছিলেন চার জোড়া হরিণ। সেই থেকে শুরু। বর্তমানে বসবাস করছে প্রায় ২৫ হাজার হরিণ। বছরের দুবার মা-হরিণ চারটি করে বাচ্চা দেয়। মা-হরিণের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার।
নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেরাজ উদ্দিন বলেন, বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দস্যু ও দু-তিন জন ইউপি সদস্য গাছ কেটে উজাড় করছে। এতে হরিণ বিচরণের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিষয়ে এখনই সরকারের দৃষ্টি দেওয়া উচিত
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:৪২