বাংলাদেশে তথাকথিত 'আদিবাসী' প্রচারণা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ প্রশ্নসাপেক্ষ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
বাংলাদেশে তথাকথিত 'আদিবাসী' প্রচারণা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ প্রশ্নসাপেক্ষ
ড. খুরশীদা বেগম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
তবে পর্যবেক্ষণের অবকাশ আছে যে মিশ্র রক্তের ঐতিহ্যে খোলা একটি মুক্ত হাওয়ার 'দখিন দুয়ারে' দাঁড়িয়ে বাঙালি কালো-সাদা-বাদামি (নিগ্রো-ককেশাস-মঙ্গোল-সিমেটিক, আবার আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দ্রাবিড়, কোল, মুণ্ডা, অস্ট্রিক ইত্যাদি রক্তউৎসজাত বিধায়) সব মানুষের প্রতিই মুক্ত হৃদয়। প্রতি ব্যক্তি বাঙালির নিজ ঘরেই তো সাদা-কালো-বাদামি অথবা নাক চ্যাপ্টা-নাক খাড়া অথবা কোঁকড়া চুল-সোজা চুল মানুষের সমাহার। বাংলাদেশের ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীর জন্য বাঙালির মনখোলা মনোভঙ্গি প্রযোজ্য। সম্প্রতি জমিজমা নিয়ে সাঁওতাল ও বাঙালির যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের খবর পত্রিকায় এসেছে, তা কতটা বস্তুস্বার্থগত ও কতটা নৃগোষ্ঠীগত নির্ণয়ের অপেক্ষা আছে। কেননা রোগ চিহ্নিত না করে ভুল চিকিৎসাপত্র প্রয়োগে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হিতে বিপরীত ঘটা অবধারিত। পরিষ্কার বক্তব্য এই যে জমি 'দখল' ইত্যাদি নিয়ে বাঙালির সঙ্গে বাঙালির মারামারি, লাঠালাঠিও নৈমিত্তিক ঘটনা এবং নিংসন্দেহে 'দখল' শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুতরাং প্রশ্ন, সাঁওতালদের সঙ্গে জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব কতটা নৃগোষ্ঠীগত উন্নাসিকতা এবং কতটা সুযোগসন্ধানীর বস্তুগত স্বার্থ হাসিলের 'উসিলা'? বাংলাদেশের কোর্ট-কাচারির মামলাগুলোর (খুনোখুনিসহ) বেশির ভাগই জমিজমাকেন্দ্রিক।
নৃগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালির সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে বাঙালি জনগণ নৃগোষ্ঠীগত বিদ্বেষ ধারণ করে না। পাশাপাশি ইতিহাসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে বাঙালি তার ভাষা ও ভূখণ্ডটির প্রতি প্রচণ্ড স্পর্শকাতর এবং আপসহীন, লড়াকু। গেল শতকেই ১৯০৫-১৯১১ থেকে ১৯৭০-৭১ পর্যন্ত মাত্র ৬০-৬৫ বছরের মধ্যেই দুইবার এই বাংলা ভূখণ্ডকেন্দ্রিক বাঙালির প্রলয়ঙ্করী রাজনৈতিক অভিব্যক্তি অবিস্মরণীয় বৈ নয়। এবং আরো লক্ষণীয় ১৯০৫-১৯১১ ও ১৯৪৮-১৯৭১ এই দুবারের রাজনৈতিক প্রলয়ের মধ্যেই জনজীবনে বিভাজনের উপাদান হিসেবে ধর্ম প্রবেশ করার প্রয়াস পেয়েছে, কিন্তু ঠাঁই পায়নি, রাজনৈতিক দর্শনে প্রাধান্য পেয়েছে মাটি ও মানুষ; সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব নৃগোষ্ঠীর বাংলার মানুষ। ১৯৪৭ সালের ধর্মীয় পরিচিতির প্রাধান্য ১৯৭১-এ এসে এই মাটি ও মানব প্রেমের মধ্যে আরো বড় হয়ে উঠতে পারেনি। তবে এটি নিয়ে খুঁচিয়ে অপরাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। এর সঙ্গে এখন সংযুক্ত হচ্ছে আদিবাসীত্ব।
'আদিবাসী' পদটিকে পুঁজি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূখণ্ড, ভূমি, অরণ্য, নদ-নদী, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর বিশেষ কোনো দাবি কয়েক শ বছর আগে আগত কোনো গোষ্ঠীর জন্যই প্রযোজ্য নয়। তবে নিঃসন্দেহে তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাংলাদেশের সব অঞ্চলের সব সম্পদের ওপর সবার মালিকানা ও অধিকার সমান।
আদিবাসীত্বের নানা সংজ্ঞা
বাংলাদেশে নানাভাবে আদিবাসী পদের সংজ্ঞা এসেছে। যেমন (১) আদিবাসী হচ্ছে কোনো অঞ্চলের প্রাচীনতম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বংশধর; (২) অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতার শিকার জনগোষ্ঠীই আদিবাসী; (৩) 'আলাদা সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যের (যারা) অধিকারী' ইত্যাদি।
প্রতিটি সংজ্ঞার নানারূপ ব্যাখ্যা সম্ভব। যেমন ১ নম্বর সূত্রে ফরিদপুরের প্রাচীনতম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বিষয়ে ঐতিহাসিক বা নৃবিজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলের ওপর ঐকমত্যের ভিত্তিতে বলা আবশ্যক যে কোনো প্রাচীন সংখ্যালঘুর বংশধর আদিবাসী। সুতরাং ফরিদপুরের ভূখণ্ড- পদ্মা, মধুমতি তাদের। ২ নম্বর সূত্রে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশকিতার শিকার জনগোষ্ঠী বলতে যদি শোষণ, অপশাসন বোঝায়, তাহলে বাংলাদেশের ছোট-বড় নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে কোটি কোটি জনগণের বৃহদাংশই আদিবাসী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোন ভূখণ্ড কে পাবে, সেটা একটা সংঘাতঘন প্রশ্ন বটে। ৩ নম্বর সূত্রে আলাদা সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরা যদি আদিবাসী হয়, তাহলে বাংলাদেশে অভিবাসনকারী অবাঙালিরা (চলিত ভাষায় বিহারি) আদিবাসী, সে ক্ষেত্রে ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ দেশের ৮১টি (১৯৭২-এর হিসাবে) ক্যাম্পের ভূমি বা ভূখণ্ড তাদের। পাশাপাশি ৫০টি ছোট গোত্রজ নৃগোষ্ঠীর নাগরিকরা যদি আদিবাসী হয়, তাহলে তাদের বসবাসস্থলের ভূমি, ভূখণ্ড, সম্পদ, তাদের মালিকানা বা স্বায়ত্তশাসনে ছেড়ে দেওয়া সমীচীন(?)! পার্বত্যের অনুসরণে তারাও বাঙালি জনগণকে উচ্ছেদের দাবি তুলবে?
বড় দুঃখে জিজ্ঞাসা, অতঃপর 'মাইক্রোসকোপিক' দৃষ্টিতে হাজার হাজার বছরের জন্মগত অধিবাসী কোটি কোটি বাঙালির জন্য দুই-এক টুকরো জমিন খুঁজে পাওয়া যাবে তো? তখনই বোধকরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হবে(?)। কেননা, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের একাংশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে কথিত আদিবাসীদের ভূখণ্ড বা ভূমির ওপর অধিকারদানের বিষয় চলে এসেছে। এ অবস্থায় নির্বিঘ্নে প্রবেশ করছে বহির্বিশ্বের স্বার্থবাদীরা। তাদের কৌশল ও শক্তিকে তুচ্ছ ভাবার কোনো কারণ নেই এবং তারা অনেক দূর এগিয়েছে বলে মনে হয়।
৭. পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্ন এ বড় অদ্ভুত যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সিদ্ধান্তে কাপ্তাই বাঁধ দ্বারা চাকমা নৃগোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে মর্মে নিজ চাকমা জনগণের দুঃখ-ক্ষোভকে গ্রাহ্যে না নিয়ে চাকমা অঞ্চলের তৎকালীন সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায় (বর্তমান সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়ের বাবা) ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান নেন। আবার উল্লেখ্য, সব চাকমা জনগণ নয়। যুদ্ধ শেষে তিনি নিজ নৃগোষ্ঠীর গরিব-দুঃখীকে ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং মৃত্যু পর্যন্ত অতি উচ্চপদে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনপূর্বক পাকিস্তানের সেবা করেছেন।
চাকমা নেতৃত্বের একটি ক্ষুদ্রাংশে (সবাই নয়) এইরূপ স্ববিরোধিতা আরো আছে। যেমন- সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রে নয়, ধর্মনিরপেক্ষ উদারনৈতিক বাংলাদেশে তাদের নানারূপ সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু হয়। প্রশ্ন, কেন মানবিক মূল্যবোধহীন সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি পরিচিতি লুপ্ত হওয়া মাত্র ক্ষুদ্র চাকমা নৃগোষ্ঠীগত পরিচিতির প্রশ্নটি 'তাৎক্ষণিকভাবে' এত বড় হয়ে উঠল, এত উত্তেজিত যে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিল? যুদ্ধবিধ্বস্ত নিজ মাতৃভূমির অগণিত ক্লিষ্ট, আহত-নিহত-পর্যুদস্ত জনগণের প্রতি দায়িত্ব ও দরদ থাকল না কেন? বাকি ৫০টি ছোট নৃগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তো এইরূপ দাবি ও সশস্ত্র তৎপরতা ঘটেনি। অনিবার্য রাজনৈতিক প্রশ্ন, এত অস্ত্র, রাতারাতিই বলা যায়, তারা কোথায় পেল? এই পরিচিতির বিষয়টি কি পাকিস্তানের উসকে দেওয়া? বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অশান্তি সৃষ্টি করে রাখার কোন নীল নকশা? বর্তমানে (২০১৩) বাংলাদেশের যেমন পারিভাষিক শব্দ 'গণহত্যা' ব্যবহারপূর্বক ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিশ্বনিন্দিত অতিকায় গণহত্যাকে ম্লান করার প্রচেষ্টা চলছে, সেইরূপ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে বিজয়ী বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ম্লান ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার প্রচেষ্টায় কি একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিচয় নিয়ে খেলা শুরু হয়েছে? পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে, বাংলাদেশের একটি মহল বাঙালি পরিচিতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে বড় কুণ্ঠায় রয়েছে। এটি ইতিহাস বিস্মৃতি, ইতিহাস অস্বীকৃতি, নাকি ইতিহাস বিকৃতি? পাকিস্তানে বসবাসকারী ত্রিদিব রায়কে পাকিস্তান কি ব্যবহার করেছে? সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান সরকার সুদূর পূর্ব বাংলার এবং অমুসলমান ও ছোট একটি নৃগোষ্ঠীর নেতাকে সারা জীবন অতি উচ্চপদে আসীন রাখে কেন? প্রশ্ন, অতি ধীশক্তিসম্পন্ন দূরদর্শী ও অতীব উচ্চমান রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু কোনো সন্দেহ পোষণ করেছিলেন কি? এই উদারতাবাদী মানুষটি বাংলাদেশের স্বার্থের ব্যাপারে চিরকাল ছিলেন আপসহীন এবং ইতিহাসের এই পর্বে তাঁকে অনড় দেখা যায়। লক্ষণীয়, পাকিস্তানি সৈনিক শাসকরা বলেছিল যে তাদের বাঙালি জনগণকে প্রয়োজন নেই, 'মিট্টি' (ভূমি/ভূখণ্ড/মাটি) চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি অতি ক্ষুদ্র কায়েমি স্বার্থবাদী অংশ বলছে, পার্বত্যের ভূমি বা ভূখণ্ড তাদের, বাঙালি সেখানে থাকতে পারবে না। প্রশ্ন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুক্ত করতে পাকিস্তানি দখলদারদের সঙ্গে যে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন, রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন তা কি পার্বত্য চট্টগ্রামকে 'বাঙালি মুক্ত' করার জন্য? তারা মরেছেন কি পার্বত্যের ভূখণ্ড ওই ক্ষুদ্রাংশকে দিয়ে দেওয়ার জন্য?
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাষ্ট্রের ভূখণ্ড অতিশয় স্পর্শকাতর বিষয় এবং বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস আলোকিত প্রেম বিষয়ে এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক দাবি-দাওয়া প্রশ্নে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষাবিদরা যখন দেশের জন্য উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, যখন নানারূপ তথ্য-উপাত্ত হাতে শ্রেণীকক্ষে উত্তেজিত এমএস পর্বের শিক্ষার্থী বলেন যে, '...দেশের এক ইঞ্চি মাটি দেব না।' যখন অন্য একজন শিক্ষার্থী সাংবাদিক বলেন, 'ঘেন্না (ঘৃণা) করি ওইসব বিদেশি টাকানির্ভর এনজিও করা বুদ্ধিজীবী ও অপরিণামদর্শী রাজনীতিকগণকে, যাঁরা দেশের ও মানুষের স্বার্থ নিয়ে খেলা করেন' অথবা 'গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে' বলে ওঠে দাঁড়ায় কেউ, তখন অনুমান করা যায়, বিষয়টি জনগণের কাছে পরিষ্কার হলে কী ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। মনে পড়ে, প্রায় ১০ বছর আগে বর্তমান লেখিকার তত্ত্বাবধানে "Nation Building Problems in Bangladesh" বিষয়ে পিএইচডি গবেষণাকালে সরকারি কলেজের একজন সাবেক প্রবীণ অধ্যক্ষ শান্তি চুক্তির জন্য পার্বত্যের দাবি-দাওয়াগুলোর 'অস্বাভাবিকতা' নির্দেশ করে সেসবের কী ব্যাখ্যা করবেন নির্দেশনা চেয়েছিলেন। এই সূত্রে তিনটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ :
* শান্তি চুক্তি ১৯৯৭ ওই সব অস্বাভাবিক দাবি-দাওয়ার সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের কতটা সমন্বয় সাধন করতে পেরেছে?
* শান্তি চুক্তির সফলতা ও সীমাবদ্ধতা কী?
* শান্তি চুক্তি মূল্যায়নে (১৯৯৭-২০১৩) কোনো গবেষণা বা সমীক্ষা কি হয়েছে?
উল্লেখ্য, পার্বত্যের ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর সমসংখ্যক বাঙালি নাগরিকদের মধ্যে শান্তি চুক্তি সত্ত্বেও নিচের মৌলিক কয়েকটি বিষয়কেন্দ্রিক ব্যাপক রাগ-ক্ষোভ-অসন্তোষ লক্ষ করা গেছে- (এক) ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর একাংশের পার্বত্যের ভূখণ্ডকেন্দ্রিক তৎপরতা, (দুই) জনজীবন থেকে ত্রাসের মাধ্যমে ওই ক্ষুদ্রাংশ কর্তৃক নির্বিচারে চাঁদা তোলা, (তিন) বিদেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর 'অদ্ভুত' মনোভাব ও আচরণ, যা চাকমা (প্রধানত) পক্ষে বাঙালির প্রতি বৈষম্যমূলক, (চার) বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ভবিষ্যৎ, (পাঁচ) পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের দেশ কল্যাণমূলক কাজে নানা বিঘ্ন ও সংকুচিত অবস্থা, (ছয়) বাঙালি জীবনের দুঃখ, বঞ্চনা ইত্যাদি।
পার্বত্যের সমাজসেবী ও দেশপ্রেমী সচেতন 'এলিট' বাঙালি নেতাদের বক্তব্য বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে শান্তি চুক্তিটিকে ব্যবহারপূর্বক সশস্ত্র সন্ত্রাসের পরিবর্তে এবার শান্তিতে সুপরিকল্পিতভাবে এমন সব কর্মকাণ্ড এখানে পরিচালিত, যা বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের অনুকূল নয়। জানা যায়, এর মধ্যে সশস্ত্র ভিন্নমতাবলম্বী গ্রুপও আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি ভূমি বন্দোবস্তের পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে গত জুন, ২০১৩ বাঙালি নাগরিকদের আন্দোলন-ধর্মঘটে উপরে নির্দেশিত রাগ-ক্ষোভের তীব্র প্রতিফলন ঘটে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক ছোট-বড় সব নৃগোষ্ঠীর সব জনগণ। সুতরাং জনগণকে জানতে হবে পার্বত্যের ভূখণ্ড ও ভূমি নিয়ে কী শুরু হয়েছে? বিদেশিদেরই বা এত আগ্রহ ও একপেশে অন্তর্ভুক্তি (involvement) কেন? সন্দেহ এত দূর গড়িয়েছে যে উত্থিত প্রশ্ন, বাংলাদেশের ভূমির অখণ্ডতার ওপর আঘাত আসছে না তো? পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূখণ্ডের ওপর কোনো 'কাল থাবা' প্রসারিত হচ্ছে কি? প্রশ্ন যখন উঠেছে বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে, সত্য-মিথ্যা যাচাই করতেই হবে। এখানে 'আদিবাসী' পদ প্রসঙ্গে পুনরায় উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের জন্মের পরপরই পার্বত্যে সহিংস-সশস্ত্র তৎপরতা শুরু হলেও আগু-পিছু ২০০৮-০৯ থেকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য আদিবাসী শব্দের আশ্রয়ে এখন সব 'অস্বাভাবিক' দাবি-দাওয়া বৈধতা লাভের প্রয়াসে নতুন মাত্রা পেয়েছে। এ দেশে ভিত্তিহীন আদিবাসী এই পদ-প্রবঞ্চনায় দ্রুত প্রভাবিত হচ্ছে সারা বাংলাদেশের অন্যান্য ছোট নৃগোষ্ঠীগুলো, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ‘ethnic conflict' এর অহিতকর ভবিষ্যৎ নির্দেশ করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে গবেষণায় ক্রমে স্পষ্ট হয় যে এখানকার সমস্যা মূলে ভূমি ও ভূখণ্ডকেন্দ্রিক। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত কি জনগণের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে? বাংলাদেশের ভূমি, নদী, পাহাড়, পর্বত, অরণ্য, সাগর, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে জনগণের রায় নেওয়া কর্তব্য এবং এর কোনো বিকল্প নেই, থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের মালিক জনগণকেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
বহু ভোটে নির্বাচনে জয়লাভ করলেও উপরোক্ত সব বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের 'ব্ল্যাংক চেক' (Blank Cheque) জনগণ কাউকে দেয়নি, দেয় না। এর অন্যথায় দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য।
সব কিছু স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান (২০০৮-২০১৩) ১৪ দলীয় সরকারকে এই মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির ব্যাপারে যেকোনোরূপ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বন্ধ করতে হবে। দুর্ভাগ্য, গত জুন, ২০১৩-এ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিবিরোধ নিরসন কমিশন আইন ২০১৩-এর খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিপরিষদ যখন স্বাক্ষর দেয়, তখন একজনও কি মন্ত্রি ছিলেন না যিনি দ্বিমত পোষণ করেন?
এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছে পার্বত্যে মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘকাল কর্মরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সংবাদপত্রে তাদের ভিন্নমতের প্রতিবেদন এসেছে। সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সচেতনতাদৃষ্টে বলার কথা এই যে আজ প্রায় চার দশক ধরে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূখণ্ডে সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা প্রতিরোধ এবং সব অপপ্রয়াস থেকে এই ভূখণ্ডটিকে আগলে রেখেছে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নয়, নিজেদের বুদ্ধি-মেধা-কৌশল-পরিকল্পনা-শ্রম এবং সর্বোপরি দেশের মাটির প্রতি অকুণ্ঠ প্রেম দিয়ে। বর্তমান গবেষণা হাতে নিয়ে বিষয়টি ক্রমে স্পষ্ট হয়েছে লেখিকার কাছে। একদিকে দেশে একের পর এক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জটিলতার পর্ব এবং রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনার অভাব, অন্যদিকে পুস্তক-পুস্তিকা, পত্র-পত্রিকায় পার্বত্যে সেনাবাহিনীর আচরণ বিষয়ে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে সমালোচনার অব্যাহত ঝড় এরই মধ্যে দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় অবিচল দায়িত্ব পালন করে গেছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির তোয়াক্কা না করে এবং জাতীয় স্বার্থরক্ষায় তাদের নিবেদনকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন না করে প্রধানত এই ধারণাই জনগণকে দেওয়া হয়েছে যে সেনাসদস্যরা পার্বত্যে কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নারী নির্যাতন করে বেড়াচ্ছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ফেব্রুয়ারি ২০১৩, রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের অফিসের অদূরে যে দরিদ্র বৃদ্ধা বাঙালি নারী ভিক্ষা করছিলেন, জানা গেল তাঁর স্বামীকে শান্তিবাহিনীর লোক গলা কেটে খুন করে রেখে যায়। সেই থেকে তিনি সংসারহীনা, ভিক্ষে করে বেড়ান। এইরূপ অসংখ্য ঘটনা কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? বলার অপেক্ষ রাখে না, যেকোনো পক্ষেরই এসব অপরাধ-অপকর্মের জন্য জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে সেনাবাহিনীর নিষ্ঠ অবদানকে ক্রমাগত অবমূল্যায়ন করে দেখা সংগত নয়। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যগুলো নির্দেশ করছে, পার্বত্যে সশস্ত্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে কিভাবে শহীদ হয়েছেন কতজন সেনাসদস্য, দুর্গম গহিন জঙ্গলে-পাহাড়ে, খাড়া-ঢালে গভীর রাতের অন্ধকারে, ঝড়-জল, সাপখোপ ইত্যাদির মধ্যে কিভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ও নিরলস শ্রম দিয়েছেন তাঁরা। জনগণকে তার কতটুকু জানানো হয়েছে? জনগণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের এই প্রহরী প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বিদেশি কিছু মিশন বা কমিশনের বিরূপ ভাব চোখে পড়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন, পার্বত্যে সক্রিয় দেশি-বিদেশি স্বার্থবাদীদের অপকার্যক্রমের প্রাত্যহিক প্রধান অন্তরায় সেনাবাহিনী। সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানটিকে হেয় করার প্রবণতা তাদের জন্য কৌশলগত। অন্যথায় 'শান্তি-মিশন' ইত্যাদি ভাবনা ক্ষেপণের সুযোগ হবে কিভাবে? কিন্তু সেইরূপ কোরাসে বাংলাদেশের কণ্ঠ মেলানোর আগে ভালোমন্দ আরো জেনে ও বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষণে দেশের স্বার্থ রক্ষায় জনগণকে সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়াতে হবে। এতে (১) গণসমর্থনে বা গণশক্তিযোগে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না, (২) জনগণ পার্বত্য সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে পারবে, (৩) বিদেশি স্বার্থবাদীর সংহত হবে, (৪) সেনাসদস্য কারো অনৈতিক অপরাধপ্রবণতা থাকলে তা নিয়ন্ত্রিত হবে।
পারিভাষিক পদভ্রম (Terminological-inexactitude) ও পরিণাম : একটি দৃষ্টান্ত নিবন্ধের আদিবাসী পদকেন্দ্রিক আলোচ্য সূত্রে বলা প্রয়োজন যে পারিভাষিক পদ ভ্রম ঘটলে কী হতে পারে, তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান স্বার্থ-দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে নির্মিত 'দ্বিজাতিতত্ত্ব।' ব্রিটিশ-ভারতে হিন্দু-মুসলমান সমস্যাকে গ্রাহ্যে নিয়েই 'দ্বি-ধর্মসম্প্রদায় তত্ত্ব' নির্মাণপূর্বক সমস্যা সমাধানে অগ্রসর না হয়ে বহুধর্মী অধ্যুষিত একই অঞ্চলের দুটি বিশেষ ধর্মানুসারী জনগণকে 'জাতি' বলার খেসারত এই উপমহাদেশকে অনেক দিতে হয়েছে, আজও হচ্ছে। ১৫ জুলাই ২০১৩, ঠিক এই মুহূর্তেই পাকিস্তানপন্থী যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় ভাঙচুর, আগুন জ্বলছে। এক পথচারীর দেহ থেকে পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মৌলবাদী বোমার আঘাতে। ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে রক্তে ভেসে গেছে ইতিহাসের একেকটি পর্ব। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষাক্ত ছোবল থেকে একটি ছোট শিশু পর্যন্ত রক্ষা পায় না। বাংলাদেশেই বিগত ৪২ বছর ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছে বিহারিরা। পাকিস্তানে সিন্ধি-মোহাজের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রক্তপাত প্রাত্যহিক ঘটনা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সংঘটিত হত্যা, মৃত্যু-ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ উপমহাদেশকে আজও কলঙ্কিত করে রেখেছে।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের নেতৃত্ব এম এ জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় তাঁর অনুসারী আন্দোলনকারী সংখ্যালঘিষ্ট মুসলমানদের ভারতের 'অনুগত নাগরিক' হয়ে থাকার পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মওলানা আযাদের কাছে তখন ছুটে গিয়েছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসীরা এবং জিন্নাহ সাহেবকে তাঁরা বিশ্বাসঘাতক বলেছিলেন। কিন্তু সময় তখন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায় বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার আগে চাকমা জনগণ ও তাদের নেতাদের কী পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন জানা নেই। তবে চাকমা নেতা হিসেবে তাঁর অবস্থান এবং অন্য নেতাদের কর্মকাণ্ড অগণিত গরিব-দুঃখী চাকমাসহ অন্যান্য কোনো নৃগোষ্ঠীর জন্য শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনেনি। সন্ত্রাস-সংঘাত-চাঁদা ইত্যাদির মধ্যে বাংলাদেশের এই নাগরিকরা যে ভালো নেই তা বলাই বাহুল্য।
৯. সব নৃগোষ্ঠীর নাগরিকতার মূল্যবোধ আবশ্যক বাংলাদেশে সব নৃগোষ্ঠীর মঙ্গলার্থে যা প্রয়োজন, নাগরিকতার মূল্যবোধের বিকাশ, নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতি দরদ ও দায়িত্ববোধ এবং পরস্পরের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা। প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় ধারণের অধিকার রয়েছে। নরগোষ্ঠী বা নৃগোষ্ঠী পদটি মানুষের স্বতন্ত্র গোষ্ঠীবদ্ধতা নির্দেশ করে। ব্যাকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে এই শব্দার্থ নিয়ে কোনো মতপার্থক্যের অবকাশ নেই। কিন্তু এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে আদিবাসী পদটির অর্থ আদিম বা আদি মানুষ নয়, এটি স্থানিক ও কালিক যোগসূত্রগত বিষয়। সুতরাং বাংলাদেশের ইতিহাস অগ্রাহ্য করে ঢালাওভাবে ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী বলার অর্থ একটি অসত্য চর্চাজাতীয় স্বার্থে, যা অহিতকর। লক্ষণীয়, বাংলাদেশে সম্প্রতি জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে অসত্য ও বিভ্রান্তি বিস্তৃততর হচ্ছে। এখানে অন্য কোনো নির্ধারিত দিনে 'গোত্রজ নৃগোষ্ঠী দিবস' অথবা 'ছোট নৃগোষ্ঠী দিবস' অথবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কেবল 'নৃগোষ্ঠী দিবস' পালন করা যেতে পারে, যেখানে বিশাল বাঙালিরও অংশগ্রহণ থাকবে এবং তা মানুষে মানুষে সম্প্রীতিকে দৃঢ়তর করতে সহায়ক হবে।
ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর গোত্রজ সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, ইংরেজি ও বাংলার পাশাপাশি মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ ইত্যাদির অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো বিশেষ নৃগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ভূখণ্ড ইত্যাদির দাবি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি/অরণ্য/ পাহাড়/সাগর/নদীনালা/শস্য ক্ষেত/প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদির ওপর বাংলাদেশের সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা আবশ্যক। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য একটি ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে সমতলে নৃগোষ্ঠীগুলো আলাদা ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে। বাঙালি নৃগোষ্ঠী কী দাবি জানাবে? একটি ছোট্ট দেশের সামান্য ভূমি বা ভূখণ্ড নিয়ে এত সব দাবি ও কমিশনও কতটা বাস্তব ভেবে দেখার অবকাশ আছে। একটি সুপরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট অভিন্ন আইনি শৃঙ্খলার মধ্যে এসবের ব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন। এ জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ ও বিস্তৃত গবেষণা প্রয়োজন। অন্যথায় দ্বন্দ্ব ও জটিলতা অবধারিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য প্রায়ই যে ১৯০০ সালে বিধিবিধানের কথা বলা হয়, তার কতটুকু গ্রহণযোগ্য অথবা গ্রহণযোগ্য নয়, তা গভীর গবেষণার মাধ্যমে খতিয়ে দেখা আবশ্যক। মনে রাখা প্রয়োজন, বিগত ১০০ বছরের অধিক পৃথিবীর অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতি বদলে গেছে, বদলে গেছে উপমহাদেশের মানচিত্র, বদলে গেছে চাকমাসহ অন্যদের জীবনের চালচিত্র, বদলে গেছে বাংলাদেশের আইনকানুন, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি। সুতরাং ১৯০০ সালের নিয়মনীতিও বদলাতে হবে আজকের বাস্তবতায়।
বাংলাদেশে মিলেমিশে পাশাপাশি বাস করছে ছোট-বড় নৃগোষ্ঠীভুক্ত জনগণ। বাংলাদেশে অপ্রযোজ্য আদিবাসী তত্ত্ব দ্বারা এবং ইতিহাস বিকৃত করে এই শান্তিপূর্ণ মিলিত জীবনস্রোতকে বিভাজিত করার পরিণাম ভয়াবহ। এ বিষয়ে বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, গণমাধ্যম প্রত্যেকের সতর্কতা আবশ্যক। পরম নাগরিক সচেতনতায় ছোট-বড় সব নৃগোষ্ঠীর সবাই নিজ মাতৃভূমির রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান এমনভাবে বিন্যস্ত করে নিতে মিলিত পদক্ষেপ রাখুক যেন 'একদানা ভাত' কেউ কারো চেয়ে বেশি না খায়।
এ পথটি দুর্গম ও কর্মটি দুষ্কর। তবু সেটাই সভ্যতা সমর্থিত উন্নতির পথ। বাংলাদেশের ছোট-বড় সব নৃগোষ্ঠীর যৌথ কর্মযজ্ঞের প্রণোদনায় এই রাজনৈতিক শিক্ষা ও দীক্ষা প্রতিভাসিত হবে, সেটাই প্রত্যাশা এবং সেটাই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, 'বাংলাদেশ' নামের অসাধারণ রাজনৈতিক সর্বজনীনতা। (সমাপ্ত)
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস : দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৩০ জুলাই, ২০১৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
এখানে সেরা ইগো কার?
ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।
‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন
মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন