আসুন দেখে নেই বিভিন্ন উৎস হতে তাপ উৎপাদনে মাসিক খরচঃ
উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে কয়লা থেকে তাপ উৎপন্ন করতে সব চাইতে কম খরচ করতে হয় । এই কারণে আমেরিকার ৫০% বিদ্যুৎ আসে ৩৫০০০০ এর চেয়েও বেশী মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে । এছাড়া চীন, জাপান , রাশিয়া ,জার্মানি, কানাডা , ব্রাজিল,ভিয়েতনাম এবং ডেনমার্কের মত দেশেরও বিদ্যুতের মূল উৎস হচ্ছে কোল ফুয়েল বেইসড পাওয়ার প্ল্যান্ট ।
পৃথিবীতে কোন ভালো কিছুই খুব সহজে পাওয়া যায় না , বিদ্যুৎ তো নয় ই । আর সেই বিদ্যুৎ যদি হয় কয়লা থেকে তাহলে তো আর কথাই নেই ।
কারণ এই কয়লা পুড়িয়ে যখন তাপ উৎপন্ন হয় তখন তাপ উৎপন্ন হবার পাশাপাশি পরিবেশে প্রচুর পরিমানে ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন, কার্বন ডাই অক্সাইড , সালফার ডাই অক্সাইড , নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড , মার্কারি এবং আরো অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসৃত হয় । যা শুধু পরিবেশেরই না , পরিবেশে বসবাস কারী প্রত্যেকটা জীবের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর ।
এই জন্য কয়েকবছর আগেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে(বিশেষ করে ডেনমার্কের মত পরিবেশ সচেতন দেশে) কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা নিষিদ্ধ ছিলো ।
যাই হুক বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলোজি( এস সি) এবং সর্বশেষ আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলোজি (ইউ এস সি ) ব্যবহারের ফলে ডেনমার্ক সহ পৃথিবীর কোন দেশেই এখন আর সেই নিষেধাজ্ঞা বহাল নেই ।
এইখানে উল্লেখ্য যে সনাতনি যে পদ্ধতিতে কয়লা ভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো বিজ্ঞানের ভাষায় সেটাকে বলা হয় সাব ক্রিটিকাল টেকনোলজি ।
নীচে একটি ডায়াগ্রামের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড,সালফার ডাই অক্সাইড সহ অন্যান্য দূষণ প্রতিরোধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন টেকনোলজির প্রভাব দেখানো হলোঃ
এতে দেখা যাচ্ছে যে একবিংশ শতাব্দীতে এসে নতুন উচ্চ কর্মক্ষম সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলজি ব্যবহার করে এক্সোস্ট গ্যাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড সহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস সংগ্রহ করার কোন সিস্টেম এপ্লাই না করেই ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের হারকে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসা সম্ভব ।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলজিতে থার্মাল এফিসিয়েন্সি সব চাইতে বেশী এবং কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের হার সব চাইতে কম ।
সনাতন পদ্ধতির সাথে আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলজি অথবা ক্লিন কোল টেকনোলজির পার্থক্য কি?? অথবা কিভাবে কাজ করে আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলজি(ইউএসসি) ??
কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে সাধারণত কয়লাকে একটি নির্দিষ্ট চাপে পাল্ভিরাইজড(পাউডার) করে একটি নির্দিষ্ট তাপে পুড়িয়ে তা থেকে যে তাপ উৎপন্ন হয় সে তাপকে পানি দ্বারা কন্ডেন্স করে তা থেকে উৎপন্ন বাষ্প দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ।
এখানে কয়লাকে পোড়ানোর মধ্যেই আসলে বিদ্যুৎ উৎপাদন জনিত সকল মেকানিজম জড়িত যা মূলত পরিবেশ ক্ষতির কারণ হতে পারে । কয়লা পোড়ানোর তাপমাত্রা এবং চাপ যত বাড়ানো হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদ্ধতি ততই সাব ক্রিটিকাল থেকে সুপার ক্রিটিকাল এবং আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল হবে ।
সাব ক্রিটিকাল টেকনোলজিতে কয়লাকে পোড়ানো হয় ২৪০০ পিএসআই (১৬.৬ মেগা প্যাসকেল) চাপে এবং ১০০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপে ।
সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলজিতে চাপ ৩৫০০ পিএসআই এবং তাপ ১০৫০ ডিগ্রী ফারেনহাইট । আর আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলজিতে এই চাপ প্রায় ৪৫০০ পিএসআই এবং তাপ ১১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট ।
সুপার ক্রিটিকাল এবং আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলিজেতে কয়লা পোড়ানোর পর যে ফ্লু গ্যাস নির্গত হয় চিমনী দিয়ে তা পরিবেশে বের করে দেয়ার আগে সেটাকে আবার সারকুলেটিং ফ্লুইড বেডে লাইমস্টোনের সাথে বিক্রিয়া করানো হয় ।
বিক্রিয়াটি অপেক্ষাকৃত নিম্ন তাপমাত্রায় ঘটানো হয় যা সাহায্য করে ফ্লু গ্যাসে বিদ্যমান সালফার ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড গ্যাসকে ওয়েট সলিডে পরিণত করতে। এই প্রক্রিয়া ফ্লু গ্যাস থেকে ৯০% নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড এবং ৯৮% ক্ষতিকর সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাসকে আলাদা করে ফেলে ।
তারপর ফ্লু গ্যাসে বিদ্যমান অতিরিক্ত ৯০% কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসকে কার্বন ক্যাপচার এন্ড স্টোরেজ সিস্টেম(সিসিএস) পদ্ধতিতে ক্যাপচার করে অতিরিক্ত চাপে কম্প্রেস করে মাটির নীচে সংরক্ষন করে রাখা হয় ।
পুরো বিষয়টি আপনাদের সহজে বুঝানোর জন্য নীচের ডায়াগ্রামটা ব্যবহার করলাম । ডায়াগ্রামটি মাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি(এম আই টি) তে ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত ফিউচার অব কোল শীর্ষক সেমিনারের অনলাইন কপি থেকে সংগ্রহ করাঃ
ছবিটি পরিস্কার করে দেখতে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন ।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চিমনী থেকে নির্গত বিষাক্ত ফ্লু গ্যাসের কারণে পরিবেশের যে ক্ষতি হতে পারতো সুপার ক্রিটিকাল এবং আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলজি ব্যবহার করে সেই ক্ষতিকে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসা সম্ভব ।
এতোগুলো কথা যেকারণে বললাম ......
সুন্দরবনের বাফার জোন থেকে ১৪ কিমি দূরবর্রাতী রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি হবে বলে অনেকেই আশংকা করছি । অনেকের আশঙ্কাই যে ভুল এবং অনুমান সাপেক্ষ তা বুঝানোর জন্যই এতো গুলো কথা বলতে হলো এবং কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পুরো প্রসেসটি সহজ ভাষায় বুঝাতে হলো ।
বিশ্বের অন্যান্য কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো রামপালেও আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে । শুধু তাই নয় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য চিমনীর উচ্চতা ২৭৫ মিটার করা হবে যার ফলে অবশিষ্ট ক্ষতিকর ফ্লু গ্যাস বাতাসের ইনভার্সন লেয়ারের উপর চলে যাবে ।
ইনভার্সন লেয়ার কি ?
আবহাওয়া বিজ্ঞান অনুযায়ী ইনভার্সন লেয়ার হচ্ছে বাতাসের এমন একটি স্তর যার উপর দিয়ে কোন কিছু প্রবাহিত হলে নীচের লেয়ারের উপর তা কোন প্রভাব ফেলে না । ফলে বাস্তবে সুন্দরবনের গাছগাছালির উপর কিংবা পরিবেশের উপর নির্গত ক্ষতিকর ফ্লু গ্যাসের কোন প্রভাবই থাকবে না ।
চলবে............