দূঁদে রাজনীতিক ভূপেন মন্ডল ভয় পাচ্ছেন। মারাত্মক ভয়। ভূপেন মন্ডল জানেন। ভয়কে পাত্তা দিলে সে আরও বেশি করে চেপে ধরে। এই একমাসে অনেকবার চেষ্টা করেছেন। ভয়কে ঝেড়ে ফেলতে। পারেননি। যতবার ঝাড়া মেরেছেন। ভয় যেন সাপের মত পেঁচিয়ে ধরেছে। আগের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তি দিয়ে। আরেকটা কারণে ভূপেন মন্ডল কাবু হয়ে পড়েছেন। এই ঘটনা কাউকে বলতে পারছেন না। বলবেন কি করে ? সাধারণ মানুষ হলেও ভূপেন মন্ডল পরিশ্রমী। পরিশ্রম করে রাজনীতিতে নিজের একটা জায়গা তৈরি করেছেন। দুই-দুইবার পঞ্চায়েত প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এবার তাঁর সামনে বড় সুযোগ আসতে চলেছে। আগামী বিধানসভা ভোটে টিকিট পাচ্ছেন ভূপেন মন্ডল। অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হবে এবার। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করেছেন। সেই প্রথম দিন থেকে স্বপ্ন দেখছেন। একদিন এম-এল-এ হবেন। অপেক্ষার পালা শেষ। এবার ভূপেন মন্ডলের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। আদাজল খেয়ে কাজে নামতে হবে। নির্বাচন এখনও বছরখানেক পরে। কিন্তু দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতায় ভূপেন মন্ডল জানেন। রাজনীতিতে খরগোশের মত দৌড়লে হবে না। দৌঁড়তে হবে কচ্ছপের মত। ধীরে সুস্থে। ধারাবাহিক ভাবে। কিন্তু সব শেষ করে দিচ্ছে এই ভয়। কাছের মানুষরা ভূপেন মন্ডলের ওপর বিরক্ত। দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। ভূপেন মন্ডলের কোন উৎসাহ নেই। ভোট নিয়ে। ওদিকে ভূপেন মন্ডলের সমস্যা তাঁর কাছের মানুষদের নিয়ে। যাঁদের তিনি ভালবাসেন। এবং বিশ্বাস করেন সেই মানুষগুলোও তাঁকে ভালবাসে।
কেউই তাঁকে ছাড়ছে না। প্রথম দিন দেখা হল থানার বড়বাবুর সঙ্গে। পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একা একা। হঠাৎ দেখতে পেলেন বড় দারোগা। আনন্দে মন ভরে গেল। নির্জন পাহাড়ি এলাকায় বোবা কালার মত ঘুরতে ভাল লাগছিল না। চেনা মানুষ পেয়ে মনে হল এবার কথাবার্তা বলা যাবে। যত সুন্দর জায়গায় হোক না কেন। একা একা ভাল লাগে না। আর দারোগাবাবু অল্প চেনা না। বড্ড বেশি চেনা। তাঁরা এক গ্লাসের বন্ধু। তুমুল গল্প শুরু হয়ে গেল। দুজনেই মনের কথা বলছেন। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে রাস্তা। রাস্তার পাশে গভীর খাঁদ। নীচে তাকালে মাথা ঘুরছে। গল্প করতে করতে হাঁটছেন দুই বন্ধু। হটাৎ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন দারোগাবাবু। গভীর খাঁদে পড়ে যাচ্ছেন ভূপেন মন্ডল। অনেক নিচে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ী নদী। সরু সুতোর মত নদীর চেহারা। শূন্যে ভাসছেন ভূপেন মন্ডল। পড়ে যাচ্ছেন পাহাড় থেকে। ঘুমটা ভেঙে গেল। ঠিক সেই সময়। পড়তে পড়তে। তখন শেষ রাত। বিছানায় উঠে বসলেন। ঘামে সারাদেহ জবজব করছে। একবার ভাবলেন। রমাকে ডাকবেন। তারপর আর ডাকলেন না। সারাদিন বড্ড ধকল যায় রমার ওপর দিয়ে। একাই সংসার সামলাতে হয় রমাকে। ভূপেন মন্ডল ব্যস্ত থাকেন। রাজনৈতিক কাজকর্ম নিয়ে।
সকালবেলা দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা। হেসে কথা বলছেন দারোগাবাবু। কিন্তু ভূপেন মন্ডল ঠিক তাল রাখতে পারছেন না। যদিও তিনি চেষ্টা করছেন। দারোগাবাবুর মতোই হাসি বজায় রাখতে। কিন্তু মাথার মধ্যে সেই দৃশ্যটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভয়ংকর দৃশ্য। পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছেন দারোগাবাবু। সেটাই শেষ না। প্রায় প্রতি রাতেই। বিশেষ করে ভোর রাতে। স্বপ্ন দেখছেন ভূপেন মন্ডল। ভয়ংকর সব স্বপ্ন। প্রতিবারই তাঁর মৃত্যু ঘটছে। এবং কোনবারেই মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে না। অপঘাতে মৃত্যু। খুব কাছের মানুষের হাতে খুন হচ্ছেন ভুপেন মন্ডল। বিশেষ করে যাদের সাহায্যে তিনি রাজনীতিতে আজ এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন। তাঁরা প্রতিদিনই তাকে খুন করছে। ভয় ভূপেন মন্ডলকে চেপে ধরেছে। আষ্টেপৃষ্ঠে। কিন্তু যখন দেখলেন নিখিল তাকে খুন করছে। তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। নিখিল ভূপেন মন্ডলের ছোটবেলার বন্ধু। একসঙ্গে বড় হয়েছেন। দুজনেই একসঙ্গে রাজনীতিতে এসেছেন। এখনো প্রতিদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন। ভুপেন মন্ডলের রাজনৈতিক সাফল্যের পিছনে যথেষ্ট অবদান আছে নিখিলের। নিখিলের সামনেই বহুবার স্বীকার করেছেন সেকথা। এবং সত্যি সত্যি বন্ধু নিখিলের প্রতি তার যথেষ্ট কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। এসব কথা নিখিলবাবু জানেন। সেই নিখিল তাঁকে জলে ডুবিয়ে মারল। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তিনি চিৎকার করলেন--"আমাকে বাঁচা নিখিল। আমাকে বাঁচা।" কিন্তু বন্ধু শুধু নৃশংস দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল না। মৃত্যু নিশ্চিত করল। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর ভূপেন মন্ডল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। আর পারা যাচ্ছে না। এবার কিছু একটা করা দরকার। এই গোপন ব্যাপার কাউকে জানানো দরকার। বুক ভার হয়ে আছে। কিন্তু কাকে বলবেন ?
সবটা শোনার পর চামেলী ভুপেন মন্ডলকে জড়িয়ে ধরল। চামেলি বুঝতে পেরেছে ভুপেন মন্ডল ভয় পেয়েছে। মারাত্মক ভয়। ভূপেন মন্ডল চামেলীকে ধরেছে। সন্তান যেমন মাকে আঁকড়ে ধরে। খুব ভয় পেলে। চামেলি খারাপ পাড়ার মেয়ে। কিন্তু চামেলিও মানুষ। মানুষ হয়ে মানুষের কষ্ট বুঝতে পারাটাই স্বাভাবিক। চামেলী ভুপেন মন্ডলকে অনেক দিন ধরে দেখছে। আজ যেন লোকটা সত্যি সত্যিই ভয় পেয়েছে। শিশুর মতো করছে। এবং একসময় বুঝতে পারল। ভুপেন মন্ডল কাঁদছে। চামেলী ভূপেন মন্ডলকে বলল-"কোনো ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।" মা যেমন করে সন্তানকে সান্ত্বনা দেয়। এ যেন ঠিক সেইরকম। আশ্চর্য ব্যাপার। ভূপেন মন্ডলের বুকটা হালকা লাগছে। মাসখানেক ধরে পাথরের মতো ভারী এই ঘটনার ভার বয়ে বেড়াচ্ছেন। সম্পূর্ণ একা। মন শান্ত হয়েছে। এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। ভূপেন মন্ডল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
সিদ্ধান্তের কথা বাড়িতে জানিয়ে দিলেন। হইচই পড়ে গেল। অবশ্য এরকমটা হবে। আগেই তিনি জানতেন। প্রিয়জনরা বারবার তাকে অনুরোধ করছে। সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে। কিন্তু ভুপেন মন্ডল অনড়। শেষ পর্যন্ত রমা তাকে জিজ্ঞেস করল-"তুমি সারাজীবন ধরে রাজনীতি করছ। কিসের জন্য ? এম-এল-এ হবে বলে। আজ সেই সুযোগ নিজেই হাত ছাড়া করছ। ব্যাপার কি ?" ভূপেন মন্ডলকে বলতে হল। স্বপ্নের কথা। ভয়ের কথা। স্বামীর কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন রমাদেবী। এরকম ভীতু টাইপের লোকের সঙ্গে সংসার করছেন। ভাবতেই রাগ হয়ে গেল রমাদেবীর। কোন কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
বেশ কিছু জমি-জমা আছে। আজকাল ভুপেন মন্ডল চাষাবাদের কাজেই মন দিয়েছেন। ঠিক করেছেন ভবিষ্যতেও কোনো পদে থাকবেন না। হাসি মুখেই বেঁচে আছেন ভূপেন মণ্ডল। অবসরে পড়াশোনা করেন। দর্শন তার প্রিয় বিষয়। দর্শনের চর্চা করছেন আজকাল। ভূপেন মন্ডলের এই জীবনযাপনে চারপাশের লোকজন খুবই অবাক হয়েছে। নির্বাচনের ফল বেরিয়েছে কিছুদিন আগে। তাদের দলই জয়ী হয়েছে। তিনি নিজে গিয়ে নবনির্বাচিত বিধায়কের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। একটা কাজ বাকি আছে। ভূপেন মণ্ডল ঠিক করেছেন। একদিন চামেলীর কাছে যাবেন। চামেলী অবশ্য যাওয়ার কারণ শোনার পর অবাক হয়ে যাবে। চামেলীর কাছে তিনি সত্যি ঋণী। সেই ভয়ংকর সময়ে চামেলী তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিল। মায়ের মত।
....ছবি সৌজন্য:গুগল ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:১৮