০. অজানা কোন জগতে
রুজি নিজেকে আবিষ্কার করলো একটি উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে। আকাশের দিকে চেয়ে দেখলো কিছু সাদা মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। শরতের সময়ে গ্রামের আকাশে যেমনটি দেখা যায় ঠিক তেমনিই।
কেমন যেন বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। সময় ঠিক কয়টা বাজল সেটা একদমই বুঝা যাচ্ছে না কারণ আকাশে সুর্যের ভরা আলো থাকলেও কেন জানি সুর্যকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ আশপাশে উজ্জল আলোক পরাবাস্তবতা। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে সব। হরেক প্রকারের ঘন পাতার সবুজ পাহাড়, বেশ দুরে থই থই বয়ে চলা ছোট নদীর স্রোত, ঐ নদীতে ঝড়ের তান্ডবে মুল বৃক্ষ হতে বিচ্ছিন্ন গাছের ডাল ভেসে যাওয়া, নাম না জানা হরেক প্রজাতির পাখি, ঝোঁপের নিচে ওঁৎ পেতে থাকা কালো হুলোবিড়াল, অসম্ভব কিউট একটি খরগোশ ঝোঁপঝাড়ের নিচে নিচে সন্তপর্ণে ছুটে চলছে।
রুজি শরীরে কেমন কেমন যেন দূর্বলতা দূর্বলতা অনুভব করলো। মাথার চারপাশে মৃদু অথচ বিমোহিত ঝিনঝিন একটা শব্দও শুনা যাচ্ছে অনবরত একই রকমের কয়েকটি কম্পাঙ্কে বেজেই চলছে। ঝিঁ.......। ঝিঁ......। ঝিঁ......।
ডানদিকের কয়েকটি পর্বত পেরিয়ে অনেক দূরে একটি উঁচু গম্বুজ। নিচে বোধহয় কোন মসজিদ/শাহী বাড়ি হবে। কোন বাংলো হলেও হতে পারে।
সময় নির্ণয়ের নিস্ফল চেষ্টা আপাতত বাদ দিয়ে রুজি হাতের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ভিমড়ি খেল। চৈতন্যবোধ জেগে ওঠলো তাঁর মনে। একি সাদা কাপড় কোত্থেকে?
সারা শরীরে সাদা কাপড় জড়ানো একটা মেয়ে অবসন্ন পড়ে আছে। আশপাশে কোন মানুষের সাড়াশব্দও নেই। এ কি করে সম্ভব হতে পারে। তবে কি (!)
সহসাই রুজি নিজেকে নিয়ে ভয় পেল। তবে কি আমি মারা গেছি? কখন মারা গেলাম? আমার এতীম ভাইটার কি হচ্ছে? টেকস্পেসে আমার কত কাজ পড়ে রয়েছে। এছাড়া নারী আন্দোলন? তার কি হবে?
রুজির বিঃশ্বাস হচ্ছে না সে মরে গেছে। তাই নিজের শরীরের দিকে ভালভাবে চেখে দেখলো। এ্যাঁঃ কাফনই তো! কাপড় তো মাত্র একখানা। তাহলে সত্যিই কি মারা গেছি আমি?
এখন আরো বড় সমস্যা হলো রুজি কান্নাও করতে পারছে না। সে ভেতরের দুঃশ্চিন্তা ও বিপদসমুহকে পাশ কেটে যাবার জন্য চেয়েছিল কাঁদতে। কিন্তু তাও সম্ভব হচ্ছে না।
ধীরে ধীরে সে টের পেল অসহ্য গরম লাগছে। আবার মনে হলো আরেকটা কাপড় পেলে ভাল হতো। একটি মাত্র সাদা কাপড়ে কেন যেন সুবোধ হচ্ছে না। তারপরও এই অবসন্ন দেহে দুটি দূর্বল পা নিয়ে হাঁটতে লাগলো গম্বুজওয়ালা বাড়ির দিকে। যেতে যেতে একটা অজগর সাপ নজরে এলো। বিশালাকৃতির ভীম সবুজ অজগর সাপ।
বিস্ময়কর হলেও সত্য সেই সাপটি ভুলেও রুজির দিকে তাকাচ্ছে না। নিজের মতো করে তাঁর বিশাল দেহ নিয়ে বনের দিকে চলে যাচ্ছে। একটা রংরঙা পাখি ফু-ই ফু-ই করে গান গাচ্ছে উঁচু গাছের এক ডালে। আরো সামনে গিয়ে দেখা গেল একটি আপেল বাগান। ওর আপেল খেতে ইচ্ছে করছে।
একটা আপেল পেড়ে ঐ বাড়ির লৌহদরজার সামনে দাঁড়াল। একটা ভীম কালো কুকুর এসে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। রুজি আগে থেকেই কুকুরকে ভয় পেত যে তা না। অতএব ভয়াবহ কুকুরটি নিজ সীমানায় দাঁড়িয়ে তার কাজ করতে থাকল আর রুজি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল নতুন কোন বিভ্রান্তির।
অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তন্দ্রামগ্নতা এসে গিয়েছিল। ভাবতে ভাবতে যখন সে মনের সিপিইউ থেকে সিদ্ধান্ত পেল যে সে মৃত ঠিক তখনই সাদা নিকাবে মুখ ঢাকা একজন মহিলা আসলেন। তিনি কুকুরটিকে মৃদুস্বরে কিছু একটা বললেন আর তখনই বিরক্তিকর ঘেউ ঘেউটা বন্ধ করে লেজ নাড়িয়ে কুকুরটাও এগুতে থাকল। ঐ মহিলার পিছু অনুসরণ করে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় গেট অতিক্রম করল। এরপর বেশ কয়েকটি অভিজাত কক্ষ পেরিয়ে রুজি অন্দরমহলে প্রবেশ করল।
বিশাল বড় গোলাকার টেবিলে সাজানো হরেক রকমের ফলমুল, পোলাও, কোরমা, ফিরনি, সেমাই থেকে শুরু করে নাম না জানা হরেক রকমের খাবারের সমাহার। চমৎকার বিষয় হলো-
প্লেটগুলোর ডিজাইন ও রং একই রকমের। সাদা। ফিরনি ২ প্রকারের, সালাদ ৩ প্রকার, সাদা ভাত ৫ প্রকার, ৮ প্রকারের চালের পোলাও, ১৩ প্রকারের ফলমুল, ২১ প্রকারের মাংস, ৩৪ প্রকারের ভর্তা/ভাজি।
রুজি যারপরনাই অবাক হলো। ফিবোনাচ্চির রাশিমালা অনুসরণ করে সব ধরণের খাবার সাজানো হয়েছে। রহস্যটা কি? অনেক সময় চিন্তা করে রুজিও ফিবোনাচ্চির নিয়মে সর্বমোট ২১ প্রকারের খাবার গ্রহণ করলো। কিন্তু বাগান থেকে পেড়ে নিয়ে আসা আপেলটি এখনো খাওয়া হয়নি। সমস্যা হলো ওটা খেলে ফিবোনাক্কি রাশিমালার নিয়মটা ফলো করা আর হবে না। অবশ্য এত কিছু খাবার পর আপেলটা খাবার ইচ্ছেটাও মাটি হয়ে গেছে।
স্বর্ণ নির্মিত পাতের পাশ থেকে রুজি মৃদু হাতে আপেলটি নিয়ে পাশের কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। সুইচ টিপে আলো জালিয়ে সে আরেকবার বড় রকমের ভিমড়ি খেল। ওর চোখদুটোতে অপলক বিস্ময়ের দৃষ্টি।
দেয়ালে একটি তৈলচিত্র আঁকা। যেটিতে পাভেলের মুখে ছুরি বসানো। গলগলিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রুজির মনের আয়নায় ভেসে ওঠলো বেশ কয়েক বছর আগে একটা বখাটেকে ছুরি বসানোর কথা।
পাভেল ছিল ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারীর ছেলে। খারাপ কু-স্বভাবের ছিল শয়তানটা। মেয়েদের দেখলেই কেন যেন তাঁর কুপ্রভৃত্তি জেগে ওঠতো। ইভটিজিং করাটা তার কাছে ছিল সিগারেট ফুঁকার মত সাধারণ একটা ব্যপার।
মুর্হমুর্হ স্মৃতির টেপে একের পর এক আসতে লাগলো তাঁর মৃত্যুর পূর্বের শত শত ঘটনার দৃশ্য। ভালভাবেই মনে পড়ল জীবনের উদ্দেশ্যের কথা। সে তো তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিল ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে। তাহলে এতো তাড়াতাড়ি কেন শেষ হয়ে যাবে আমার জীবনটা।
রুজির মনে একই সাথে দ্রোহ ও অশান্তির আগুনের একটা তপ্ত প্রবাহ বইতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে দেহের মধ্যেও সেটার বিস্তার হলো। সে টের পেল মাথার ত্বক গরম হয়ে গেছে, বুকের বামপাশের একটা ছোট শিরায় চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়েছে। কিন্তু এই মৃতদের জগতে একা কি করবে সে?
তরুণী মেয়েটা অবাক হলো তাঁকে নিয়ে আসা নেকাবধারী মহিলাও নেই। খাবার কারা সাজাল, কারা কক্ষগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে, কারাইবা সব সাজিয়ে রাখল কিছুই জানা হলো না। আশেপাশেও কেউ নেই। কেবল তাঁর জরুরী প্রয়োজনে কেউ একজন আসে।
পাশের কক্ষে গিয়ে রুজি বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করল একটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিন। টাচপ্যাডও পাশেই। ম্যাক ওএস ইন্সটল করা। অবচেতনভাবেই মেয়েটা বলে ওঠলো- সব্বনাশ!!
চমকের পর চমক চলতেই থাকল। তাঁর ম্যাকবুকের সব তথ্য এ হলোগ্রাফিক সিস্টেমের কম্পিউটারে কি করে আসলো?? এটা কি রকমের স্বর্গ? কি রকমের পরাবাস্তবতা??
রুজির তৈরি করা প্রেজেন্টেশনগুলোর মধ্য হতে ইভ টিজিং প্রতিরোধমূলক পিপিটি ফাইলটি অপেন করল। এখানে ঠিক তেমনটিই আছে যেমনটি সে তাঁর ব্যক্তিগত ম্যাকবুক প্রো-তে সেভ রেখেছি।
ইভটিজিং প্রতিরোধ প্রকল্পঃ-
১। মানুষের সামাজিক মূল্যবোধের পুনরুত্থান ঘটাতে হবে।
২। ইভ টিজিংয়ের কারণে একটা মেয়ের কি রকমের ক্ষতি হয় সেটা অভিভাবকদের জানাতে হবে।
৩। ছেলেদের নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থার সঠিক পর্যালোচনা করতে হবে।
৪। শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবমুখী প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
৫। ধর্মীয় বেড়াজাল নয়, ছেলে ও মেয়ে উভয়ের নৈতিক শিক্ষার স্ফুরণ ঘটাতে হবে।
৬। পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব নয়। তাই ইভটিজিং স্পটগুলো চিহ্ণিত করে সারাদেশে ঐসব ওপেন স্পেসে গোপন ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। এবং সনাক্ত করে ঐ বখাটেদের বিরুদ্ধে মামলা করে জেলে পুরে রাখতে হবে কমপক্ষে ১ বৎসর।
৭। সুষ্টুভাবে আইন ও ক্ষমতার প্রয়োগ করতে হবে তা না হলে হয়রানি ও অবিচার বৃদ্ধির কোনই মানে হয় না।
৮। ইভ টিজিংয়ে যারা পড়ে সেইসব মেয়েকে সাহসী হতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের নৈতিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা বজায় রাখতেই হবে।
৯। ইভটিজারদের সামাজিকভাবে হেনস্থা করার উদ্যোগ নিতে হবে।
রুজি এতক্ষণ যা পড়লো তা তো পৃথিবীর জীবনের সাথে সম্পর্কিত। তাহলে এই জীবনের সাথে কি সম্পর্ক? তাহলে কি মারা যাইনি? আমি স্বপ্ন দেখছি?
মানুষের এইসকল ক্ষেত্রে নিজের বাস্তবতা উপলদ্ধির জন্য একটা ভাল বুদ্ধি হলো চিমটি কেটে দেখা। রুজিও তাই করতে চাইল। কিন্তু অাশ্চর্যের ব্যাপার হলো সে নিজের দুটি আঙুলের উর্ধাংশ দুটিকে একদমই পরস্পরের কাছাকাছি আনতে পারছে না।
অনেক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও যখন পারলো না তখন টের পেল তাঁর হাতের বাহুতে প্রচন্ড ব্যাথা। এতক্ষণ পরে গিরগির করে ব্যাথা অনুভুত হচ্ছে সারা শরীরে। এই প্রথম সে শুনতে পেল কোন মানুষের কন্ঠস্বর। "হোল্ড!!"
ধীরে ধীরে নিঃসাড় হয়ে গেল সারা শরীর। উভয় চক্ষুর পাতাদ্বয় বন্ধ হতে চাইল। কেবল অনুভূতি হচ্ছে। যন্ত্রণার অনুভুতি। সারা দেহে। বিশেষত মাথার দুপাশে। পরক্ষণে মনে হচ্ছে কেউ যেন উপুড় করে কোলে করে কোন বেডে শুইয়ে দিল।
নিঃসাড় অবস্থায় কাঁচা রক্তের গন্ধ ঠেকল রুজির নাকে। শরীরের সব দূর্বলতার সাথে পাল্লা দিয়ে রুজির ভাবনারা বিদায় নিল। ওর চৈতন্যবোধ এখন পুরোপুরি মিইয়ে গেছে। সে কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পারছে না।
১. মিরপুর, ঢাকা
পাভেল মির্জা ব্যাগ গোছাচ্ছেন। তাঁকে সিংগাপূর যেতে হবে। ফ্লাইট আজই সন্ধ্যায়।
নিজের শয়ন কক্ষে শিকল দিয়ে স্ত্রীকে বেঁধে রেখেছেন। স্ত্রীর আশেপাশে ঘেঁষার উপর অন্য যেকোন লোকের জন্য ১৪৪ ধারা জারি রাখা আছে। কেবলমাত্র বিশ্বস্ত দুজন নার্স উনাকে সেবা করেন পালা দিয়ে ২৪ ঘন্টাই। এই দুজনের বাড়ির বাইরে বেরুনো নিষিদ্ধ। তাঁরাও সন্তুষ্টচিত্তে বিশাল মাপের টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন বললে অত্যুক্তি হবে না।
উনার নাম চয়নিকা চৌধুরী। ভাল বংশ দেখে বাবা বিয়ে করিয়ে দিয়েছিল পাভেল মির্জাকে। মেয়ের বাপেরও অঢেল টাকা পয়সা।
মির্জা সাহেবের স্ত্রীর নাকি মানসিক অসুখ হয়েছে। উনি খুব সহজে ক্ষেপে যান। যে কাউকে খুন করে ফেলবার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। তাই উনাকে লৌহশিকল দিয়ে ২৪ ঘন্টা রাখা হয়েছে। দুইদিকে দুই হাতে, দুই পায়ে ছড়ানো। ৪টি তালা দেয়া। অবস্থা ভয়াবহ নয় বললে মিছে বলাই হবে।
যাইহোক মহিলাকে যতই সেবা করা হউক উনার ব্যহ্যিক অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। চুলগুলো শৃংখলিত রাখা যায় না। মাথায় সবসময় চিন্তা করতে থাকেন। আবোল তাবোল বকতেই থাকেন। নার্সরা কেবল শুনে যায় আর সম্মতি দিতে থাকে।
আজ শেষ বিকেলে যখন পাভেল মির্জা রেডি হয়ে বৌকে ছুঁয়ে যাবেন তখনই বৌয়ের মুখে বকবক শুরু হল।
- শয়তানি করার সখটা গেল না? গেল না তোর? ঐ মেয়েটা ভাল আছে। ওর ইজ্জত না নিলে তোর হয় না?
তিনি স্ত্রীর কথা শুনে খানিক্ষণ হাঁ করে দাঁড়ালেন। টেলিপ্যাথি বলে যে একটা ব্যপার আছে সেটা মাথায় ৩৬০ ডিগ্রি চক্কর দিল। রুজি নামের সেই মেয়েটার ওপর শোধ নিতে যাবেন একথা এই পাগলি জানলো কেমন করে? সর্বনাশ! তাইলে?
বেশিক্ষণ চিন্তা করলেন না তিনি। পকেট থেকে রিভলভার বের করে চয়নিকা'র মাথা লক্ষ্য করে ২টি গুলি ছুড়লেন।
উসকো খুসকো চুলে মহিলাকে এমনিতে দেখতে ভ্যাম্পায়ার টাইপ মনে হয়েছিল। গুলি খাবার পর যখন গলগলিয়ে রক্তের ধারা বইতে থাকল তখন আরো ভয়ংকর রুপে একেবারে রক্তমুখের ভ্যাম্পায়ারই দেখা গেল। ফ্লোরে ওৎ পেতে থাকা আজরাইল বোধহয় চলে এসেছে। জবাই করা পশুর মতো গোঁ গোঁ শব্দ বের হলো মুখগহব্বর থেকে। ব্যস। নিথর হয়ে গেল উনার দেহ।
মষ্তিষ্কের ঠিক মাঝ বরাবর গুলি করেছেন মি. মির্জা। জীবনে এইরকম ঠান্ডা মাথার খুন করার আরো অভিজ্ঞতা আছে। সিংগাপুর তিনি যাচ্ছেন আরেকটা খুন করতে। যদিও তার পেশা চোরাচালান ও আমদানি রপ্তানি।
নার্সদের বললেন এইগুলো সাফ করে ফেল। সিংগাপুর থেকে আসার পর ঠ্যালা সামলাবো। দেখি কি করা যায়।
পকেট থেকে আইফোনটা বের করে সিংগাপুরের লোকাল একটি নাম্বারে ফোন দিলেন।
- হ্যাই। কি হলো রাফিন? মাল ঠিকঠাক রাখছো তো?
- হুঁঃ বস। ঠিক মানে আলবৎ। এভরিথিং ইজ ওকে ইয়ার।
- হাঃ হাঃ হাঃ। তোরে আমি বিশাল একটা কিছু দিমু রাফিন্যা। তুই কোনো চিন্তা করিস না। আমার লাইফের সবচেয়ে বড়ো টার্গেট হাসিল করতাসি, কম দিলে কি চলবো??
- ঠিক আছে বস। আবনের যা ইচ্ছা। আমাগরে দেন।
যথারীতি পাভেল মির্জার ড্রাইভার এসে সবকিছু গাড়িতে তুলল। তিনি আরাম করে মনের সুখে গাড়িতে গিয়ে বসলেন। গাড়ি চলা শুরু করল। এয়ারপোর্ট রোড ধরে যাবার সময় বিলবোর্ডে বেশ কয়েকটা অর্ধনগ্ন মেয়ের ছবি দেখে পিশাচময় একটা হাসি দিলেন। লুকিং গ্লাসে সেই কালো মুখের ভীম হাসি দেখে ড্রাইভার ছেলেটার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠল।
পাভেল মির্জা এখন বিমানে, ঢাকা শহর দেখা যাচ্ছিল একেবারে খেলনা বাড়ির মতো। বিমানে ওঠার পর থেকে সীমাতিরিক্ত কিউট একটা মেয়ে বিমানবালা তাঁর আশপাশে বেশ কয়েকবার আসা যাওয়া করছে। চোখজোড়া উজ্বল হয়ে ওঠল মি. মির্জার। তিনি এই চান্সটাও ফেলতে চাইলেন না। একটু পর বিমান ৩২ হাজার ফুট উপরে ওঠল। সিটবেল্ট খুলে টয়লেটের পাশের জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা এয়ারহোস্টেস মেয়েটির পাশে গিয়ে পাভেল মির্জা দাঁড়ালেন। মুখে একটা বিশ্রী লাজুক হাসি।
২. সি-বিচ সংলগ্ন এলাকা, সিংগাপুর
বাংলাদেশী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার রুজি জান্নাত নিঁখোজ। টেকস্পেসের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ডাটাবেজ ইঞ্জিনিয়ার উনি। একটা মৃদু সাড়া পড়ে গেছে সারা সভ্য দুনিয়ায়। বাংলাদেশের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করা শুরু করেছেন। অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের কোন কনসার্ন চোখে পড়েনি।
বাংলাদেশের ঢাকার মিরপুরের অধিবাসী পাভেল মির্জা নামের এক স্মাগলার ওঁকে অপহরণ করে নিতে চেষ্টা করেছিল। সিংগাপুরের ২ বাংলাদেশির যোগসাজশে স্থানীয় ৮ গুন্ডা ভাড়া করে নির্জন একটি গুদাম ঘরে আটকে রাখে বাংলাদেশী ঐ যুবতীকে। পাভেল আসার পরে ওঁকে নিয়ে সমুদ্রপথে আন্দামানের উদ্দেশ্যে যাওয়ার কথা ছিল। ওখানেই পাভেলের স্মাগলিংয়ের মূল ঘাঁটি। বাংলাদেশে পাভেলের ৬টি ফ্ল্যাটবাড়ি থাকলেও ওখানে এই ধরণের কোন অপরাধ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব উনার রাজনৈতিক সমস্যার কারণে। সরকারী দলে থাকলে অবশ্য তাঁর জন্য বাংলাদেশই ভাল জায়গা ছিল।
পর্দার পেছনের খবর হলো ২ দিন অপেক্ষার পরই রুজিকে উদ্ধার করেছে সিংগাপুর এসআইডির একটি কমান্ডো দল। এখনও কোমা অবস্থায় এলিজাবেথ হাসপাতালে।
আলেক্সান্ড্রা রোডের পাশে একটি গুদাম ঘরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় একটি সংগঠিত সন্ত্রাসী দল তাঁকে বন্দি রেখেছিল। এর পেছনে কে বা কারা জড়িত সেটাও ২ দিনের মাথায় বের করে ফেলেছে চৌকস গোয়েন্দারা। অপরাধীদের ১১ জনের ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেবল ১ জনের জন্য এই বিরাট সাফল্যের অপারেশনের খবর কোন মিডিয়ায় আসছে না। গোয়েন্দারা আশা করছেন ১-২ ঘন্টার মধ্যেই তাঁরা বাকি একমাত্র আসামী তথা পালের গোদা'কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হবেন।
জানা গেল, জীবন সংগ্রামে প্রতিষ্টিত রুজি জান্নাতের প্রতি তাঁর ক্ষোভ অনেক বছর আগে থেকেই। রুজিকে একবার উত্যক্ত করতে গিয়ে পাভেলের জিহবার এক টুকরো কেটে গিয়েছিল। আজ পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না পাভেল মির্জা এই ঘটনায়।
যাইহোক পাভেল মির্জা কিছুক্ষণের মধ্যেই সিংগাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে আসার কথা। গোয়েন্দারা নিশ্চিত তথ্য দিয়েছেন। ১০ জিম্মির দুজনকে দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক বলাতেও পেরেছেন তারা। নিঁখাদ পরিকল্পনা মোতাবেক ফ্লাইটেই একজন বিমানবালা ছদ্মবেশের গোয়েন্দা মি. মির্জাকে চোখে চোখে রাখছেন।
৩. মিডিয়া ব্রিফিং
বিমান অবতরণের পরপরই মি. পাভেল মির্জাকে এরেস্ট করা হয়েছে। সাথে সাথে এপি, রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন, সিনহুয়া আলজাজিরা সহ বিশ্বের তাবৎ প্রভাবশালী মিডিয়া ঘিরে ধরেছে সিংগাপুর ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টকে। অবশ্য সাথে আছেন সুহা মালহোত্রা যিনি নিজেকে ভিক্টিম রুজি জান্নাতের ঘনিষ্ট হিসেবে পুলিশে জানানো সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যপারে জড়িত ছিলেন।
অপরাধীর সাথে কথা বলার কোনই সূযোগ দেয়া হলো না। কেবল গ্রেফতারকৃত অপরাধী মি. মির্জা'কে বেশ রাগাম্বিত অবস্থায় কয়েক সেকেন্ড ভিডিওচিত্রে ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।
সংবাদসমুহে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে কেবল ঘটনাটিকে তুলে ধরা হয়নি। তুলে ধরা হয়েছে রুজি ও সুহার কিছু কল্যাণমূলক কর্মকেও। রুজি সেই স্কুল লাইফ থেকে নারীর প্রতি উত্যক্তকরণ রোধের চিন্তা করে আসছেন এবং বর্তমানেও আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা ও তহবিল তৈরিতে তারা যে রোডম্যাপ করেছিলেন সেগুলোও উঠে আসল।
রুজিকে চেতনানাশক হাশীশ নামক একটি মাদক সেবণ করানো হয়েছিল যেখানে সে নিজের মষ্তিষ্ক সচল রেখে সারা দেহের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
ফরেনসিক রিপোর্টে আরও উঠে আসল রুজির সাথে অসদাচরণ করা হয়েছিল যা ধর্ষণের শামিল। দ্রুতই মামলা রুজু করা হলো।
৪. রুজির জন্য ভালবাসা ও জাগরণ
রুজির কারণে বিশ্বব্যপী সাড়া পড়ে গেছে নারী উত্যক্তকরণের বিরুদ্ধে। রুজির ত্যাগের কারণে হাজার হাজার মেয়ে ও বিবেকমান মানুষ ফেসবুকে ও গুগল প্লাস পেজে রুজির জন্য শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। রুজির ম্যাপলস্ট্রিটের ফ্ল্যাটে ভরে গেছে হাজার হাজার চিঠি, শুভকামনা ও উপহারে। সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণার জন্য আরেকবার আবশ্যকতা অনুধাবন করলেন নারী ও শিশু উত্যক্তকরণের প্রতিরোধে।
কয়েকদিন পর বরিশালে একটি বড় ঘটনা ঘটেছে। ১৮-১৯ বছরের কলেজ পড়ুয়া একটি মেয়েকে দানেশ নামের একটি ছেলে উত্যক্ত করে। এক মুদি দোকানদার দোকান খোলা রেখেই এগিয়ে আসে ঐ মেয়েটির দিকে। এরপর ছেলেটি ভয়ানক রেগে গেলে মুদি দোকানদার জুতা খুলে পেটায় ঐ ছেলেকে।
ঐ সময় মেয়েটা নিজেই কমদামি সেলফোনে কয়েকটা ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে। আর এতেই সাড়া পড়ে যায় দেশব্যপী। ঘটনাচক্রে ঢাকার গাজিপুরের রেলস্টেশনে একটি টিনএজার মেয়ে একটা ছেলেকে জুতা দিয়ে চপেটাঘাত করে। আর সাথে সাথে পাবলিক ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বখাটের ওপর। ঐটাও খবরের বড় শিরোনাম হয়।
বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনাও যে ঘটেনি তাও নয়। কিছু কিছু ঘটনায় মেয়েরা জিদের চোটে সূযোগের সদ্যব্যহার করে নির্দোষ ছেলেকেও অপমানিত করার ঘটনাও ঘটল।
তবে আর যাইহোক ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে একটা ভাল সাড়া পড়ে গেছে বাংলাদেশে।
৫. সিংগাপুর, ম্যাপলট্রি অ্যানসন
ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমবেত হয়েছেন ৭টি দেশের সাতজন স্বেচ্ছাসেবী নারী। যুক্তরাষ্ট্রের গিট্রি অ্যালিসন, যুক্তরাজ্যের এলিসা বিউটি, ভারতের সুহা মালহোত্রা, বাংলাদেশের রুজি জান্নাত, সিংগাপুরের কিম উন, চীনের জুং চু, মালেশিয়ার খিমার জান্নাহ।
রুজি জান্নাত ও সুহা মালহোত্রা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তাদের দাতব্যকাজে নিজের সব উপার্জন দিয়ে ও অনুদানের টাকায় ভালই চলছেন তারা।
আগের পর্বসমুহঃ
(যদিও সিরিজ গল্প বলতে রাজি নই আমি)
রুজি এবং একজন জিনিয়াস
রুজি একটি নষ্টা মেয়ে
রুজির বাসায় পুলিশ
রুজি ও একটা বখাটের গল্প
বিঃদ্রঃ ছবি গুগল ও উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া এবং পরে ফোটোশপে এডিটকৃত।
পাদটিকাঃ
হাশীশঃ এটি একটি মাদকবিশেষ অথবা মাদকেরই অপর নাম। তবে এমনও হাশীশের কথা শুনা যায়, যা মানুষকে হিপনোটাইজ করে, বিভ্রমে ফেলে দেয়।
সতর্কতাঃ
উপরের ঘটনাটি সম্পুর্ণতই এই লেখকের মষ্তিষ্ক উদ্ভুত জঞ্জাল বৈ কিছু নয়। কারো বাস্তব জীবনের সংগে সামান্য বা বহুলাংশ এমনকি পুরোটা মিলে গেলে নিতান্তই কাকতালীয় বলে ভেবে ক্ষ্যান্ত দিবেন। আর লেখকের অনুমতি ব্যতিরেকে অন্য কোনও অনলাইন পেজ বা অফলাইন যেকোন কিছুতে প্রকাশ করা যে সিদ্ধ নয় তা কড়াভাবে বলা হলো।
বড়ো কথাঃ
ইভ টিজিং সমাজের ক্যান্সার। এটা সংক্রমিত হয় অণু হিসেবে খুব দ্রুত আর বড়ো সময়ের হিসেবে মারাত্মভাবে ও ধীরে। ইভ টিজিং একেকটা স্বর্ণালী প্রতিভা ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। পাঠকের নিকট প্রশ্ন থাকল- আপনার মতামত কি? কিভাবে ইভটিজিং নির্মূল/হৃাস (সন্তোষজনক পরিমাণে) করা যায়?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:০৮