টেকস্পেস ইনকরপোরেশন অফিস, সিংগাপুর
টেকস্পেসে ইন্ডিয়ান এবং চায়নাদের ইগনোর করা হয় বেশ খেয়াল করেই। তাদের ভাষায়, এক্সট্রা অরডিনারি ট্যালেন্ট কাউকে পেলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তাদেরকে খুব টেক কেয়ার করা হয় যাতে প্রতিষ্টানকে ভালবেসে কাজ করে যায়।
দক্ষিন ভারতের সুহা মালহোত্রা একজন ডাটাবেজ ইঞ্জিনিয়ার। সুহার সাথে আর একজন এশিয়ান কাজ করছেন গেল ১৫ দিন থেকে। ভদ্রমহিলার বয়স ২৬, বাংলাদেশের। নাম রুজি জান্নাত। এটা তাঁর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি। যেহেতু এই উন্নত শহরে নতুন এসেছেন অতএব তাঁর একমাত্র ছোটভাইকেও নিয়ে এসেছেন সাথে করে। পড়ালেখা বন্ধ করলে তো চলবে না। এখন সে নতুন স্কুলে ভর্তি হবে। বয়স ১২ বছরের মত।
সুহা মালহোত্রার শৈশব কৈশোর কেটেছে ফ্রান্সের বরদেয়াখস শহরে। ঐ সময়গুলোতে তেমন বৈচিত্র বলতে কিছু ভাগ্যে জোটিনি তাঁর। উন্নত জীবন ব্যাবস্থা ছিল। মেধা বিকাশের সব ব্যাবস্থাই ছিল। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে পড়েছেন নামিদামি সব প্রতিষ্টানে।
তবে রুজি জান্নাতের ব্যাপারটা আলাদা। তাঁকে টিউশন করে পাস করতে হয়েছে কলেজের এইচএসসি। গ্যাদা ছোটভাইকে কোলেপিঠে মানুষ করতে হয়েছে। তাই রেজাল্টটাও আহামরি কিছু ছিলনা। অনার্সটাও করতে পারেননি সময়মত। একটা প্রাইভেট কলেজে ঢুকেন অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং জানার পর। ঐটা দিয়েই চলে সংগ্রাম। পরে এত বেশি ইনকাম হলো যে ইউএসএতে নিজের টাকায় অনার্স করতে সাহস করেন। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ায় কম্পিউটার এন্ড ইনফরমেশন টেকনোলজিতে আন্ডারগ্রাজুয়েট কোর্স শেষ করেন। গ্রাজুয়েশনও করেন ওখান থেকে।
সিংগাপুর, নতুন অফিস। কাজের ফাঁকে কফি আর আড্ডা দেওয়া সুহার অনেক আগের অভ্যাস। আজও সেরকম বসছেন নয়নাভিরাম নীল কাঁচ দিয়ে সাজানো বিশাল অফিসের ঠিক মাঝে অবস্থিত ক্যান্টিনে। দুজনেই ডাটাবেজ ইঞ্জিনিয়ার হলেও তাঁদের আড্ডায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার অনেক বিষয়বস্তুই থাকে। যেমন ক্রিকেট নিয়ে উভয় দেশের উত্তেজনা, ট্রলিং, কাঁদা ছোঁড়াছুড়ির ব্যাপারটা, সামাজিক অগ্রগতির তূলনা, ধনী গরিব বৈষম্য কতটুকু, সামরিক, রাজনৈতিক, ট্রানজিট, পানির বাঁধ মোটামুটি সবই।
সুহার বয়স ২৫। টাকা পয়সার চিন্তা নেই কারোরই। দুজনের মধ্য অল্পবিস্তর যে মিলগুলো আছে তার মধ্যে একসাথে কফি পান করা, মোটামুটি সবার সাথে মিশতে পারা, প্রোগ্রামিংয়ের সময় খটমট হয়ে যাওয়া অন্যতম। আরেকটা বিষয়ে দুজনেরই সবচেয়ে ভাল মিল আছে। তাঁদের দুজনেই বিয়ে করেননি। ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়াতে দুজনেই ফ্লাটও নিয়েছেন পাশাপাশি ৪ দিন হল।
রবিন, রবিউল ইসলাম রবিন। হ্যান্ডসাম, ফর্সা চেহারা, সুদর্শন যুবক। বিয়ে করেননি। বয়স চল্লিশের কোটায় থাকলেও দেখতে ৩০'র বেশি মনে হবে না সহসা। অনলাইনে ঢং করতে করতে এই ছেলেটাকেই মন থেকে ভালবেসে ফেলেছেন সুহা। অবশ্য তিনি যে বাংলাদেশী ছেলের সাথে অনলাইনে প্রেম করেন সেটা এখনো শেয়ার করা হয়নি সেইভাবে। দুজনেরই আর সময় কত।
রুজির ফ্ল্যাটে সুহা বেড়াতে আসেন ২ দিনে একবার অন্তত হলেও। বিপরীত কাজটাও হয় প্রায়ই। একাকিত্ব বর্জনের জন্য আজও চলে এসেছেন সুহা। তিনি নিজের পারসোনাল কথাগুলিই শেয়ার করতে চাইছিলেন আজকে।
রাজ, রুজির ছোটভাই, খুব কিউট। ও দরজা খুলে দিল। কিন্তু বেডরুমে এসে ভুল করলেন না তো। উনার চোখ ভড়কে গেছে একটা বিশেষ কারনে। স্কাইপিতে চ্যাট করছেন রুজি বাংলাদেশেরই একজন মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে।
অন্য কোন মেয়ে হলে নির্ঘাত প্রেমের বারোটা বাজিয়ে দিত। কিন্তু সুহা শিক্ষিত মেয়ে। উনি ধৈর্য ধরলেন ওঁদের স্কাইপি আলাপ শেষ হবার আগ পর্যন্ত। অবশ্য মনের দূর্বলতার কারনে কান পেতে রুজির আলাপ শুনছিলেন। বাংলাও বুঝেন না অতোটা। তবে বেশ কষ্ট হচ্ছিল হাসির শব্দগুলো শুনে।
ঘড়িতে দেখলেন ঠিক ৬ মিনিট অপেক্ষার পর রুজি কান থেকে হেডফোনটা খুলেছেন। মুচকি হাসি এখনো তাঁর ঠোঁটে লেগে আছে। হয়তো লং-টাইম ধরেই আলাপ হচ্ছিল। যাইহোক ধরা গলায় তিনি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন রুজিকে-
> আপনার বয়ফ্রেন্ড বুঝি।
> হাঃ হাঃ
> কি হলো? বলেন।
> কি বললে খুশি হবেন?
ধীরে ধীরে সুহার রক্তচাপ বেড়েই চলছিলো। ইতিমধ্যেই ফর্সা চেহারায় সুর্যাস্তের লাল আভা ধারণ করছে। অথচ তাঁর সহকর্মী কেন বুঝতে পারছেন না এই লোকটির সাথেই যে সুহার বিশেষ সম্পর্ক আছে। যখন ফান শেষ করে সিরিয়াসলি না শব্দটা বলেন তখন অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন দক্ষিণ ভারতের এই সুন্দরী।
রুজি সুহাকে জানান জাস্ট টাইম পাস করেন উনার সাথে। ওঁর বউও জানে। তবে কোন যৌন সম্পর্ক নেই। ধীরে ধীরে জানা হলো অনেক অজানা কথার।
যে ছেলেটার সাথে সুহা প্রেমে মজেছেন সে একটা ডেঞ্জারাস টাইপ জিনিয়াস এবং একই সাথে সাইকো প্রকৃতির লোকও। সুন্দরী মেয়েদের পটিয়ে ছ্যাঁক দিতে ভারী মজা পায় এই লোকটা। যদিও বিয়ে করে বাচ্চাও ২ টা আছে। একটা তো কিন্ডার গার্ডেনে নার্সারিতেই পড়ে।
বান্ধবীর কারনে সম্ভবত ভবিষ্যৎ ভয়ানক মানসিক পীড়নের হাত থেকে বেঁচে গেলেন যেন সুহা। অবশ্য রুজির এই অবস্থানে আসার পেছনে এই লোকটির যে অবদান আছে সেকথা ইচ্ছে করেই চেপে গেল। এমনও হতে পারত রুজি আজ রাস্তার মেয়ে হয়ে ঢাকায় পথে পথে ঘুরতে হতো।
ওঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃসময় ছিল ঐটা। ফিরে গেলেন রুজি ১০ বছর আগের কালো সময়গুলিতে।
ঐ সময়ের এলাকার বটিয়া বাজার ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ী সমিতির সেক্রেটারীর ছেলে পাভেল'কে হত্যাচেষ্টার মামলায় জেলে যেতে হয় রুজিকে। দেশব্যাপী ক্ষোভ শুরু হয়েছিল ওর বিরুদ্ধে। প্রকাশ্যে দিবালোকে একটা ছেলেকে কুপানো, সে-কি কম কথা। যদিও রুজি সাংঘাতিক মেয়ে ছিল না, কিন্তু কেন যেন দিন দিন ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠতে থাকে।
যাইহোক রুজি তখন জেলের মহিলা সেলে বন্দি জীবন যাপন করছে। তখনও সে ভীষণ আশাবাদী একটা মেয়ে মানুষ। তবে যতই আশাবাদী মানুষই হোক নিজের মন্দ পরিণতির ব্যাপারটা ভাবতেও হয় স্বয়ংক্রীয়ভাবে। রুজিও তখন তাই ভাবছে। বরং তাঁর নিজেরও লজিক বলছিল শাস্তি হওয়াটাই যেন অবধারিত।
জেলে যাবার পর ৪ দিন হয়ে গেছে। রুজির মা বাবা কেউই আসেনি। জেলের মেয়েলোকেরা ভাবছে ওর কেউ নেই বলেই হয়তো আসছে না। অনেক মহিলাই রুজিকে ঠাট্টা করলেন। সেও মনে মনে কেবল দুঃখগুলিকে সরিয়ে মা বাবার ভালবাসাটুকু আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।
জেলের নিঃসংগতা নিয়ে দিনে দিনে অস্থির রুজির জন্য খোদা মুখ তুলে চাইলেন একটানা আটদিন খাঁচায় বন্দিত্বের স্বাদ ভোগ করবার পরে।
কিন্তু যাদের জন্য আশা করছিল, যাদের পথপানে চেয়ে গলা শুকিয়েছিল সেই মা বাবা নয় এসেছেন তাঁদের স্কুলের বিজ্ঞানের রুবায়েত স্যার আর ৪ জন শিক্ষার্থী। তাও লুকিয়ে আসছেন কারন সারাদেশ রুজির ওপর ক্ষেপে আছে। এলাকার লোকদেরও বেশিরভাগ মানুষই রুজির দোষ দেখছে। অতএব সাবধানতা অবলম্বন করাটাই তাদের দরকার ছিল।
সিমি, রুজেল, বাপ্পি, জাবি। এদের মধ্যে সিমিই রুজির সবচেয়ে ঘনিষ্ট। রুজেল ক্লাসের ফার্স্ট বয়, বাপ্পি তুখোড় মেধাবি ও রসিক, জাবি রুজির ভাল বন্ধু।
রুজির একাকিত্ববোধ মানসিকভাবেই হয়ত বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। দেখতেও তেমন লাগছে রুবায়েত স্যারের। চুলগুলো অগোছালো, কোনমতে বাঁধা, ফুলে রয়েছে অদ্ভুত-ভাবে, চোখ ফোলা ফোলা, লাল হয়ে গেছে, চোখের নিচে কাজলরেখা। তাঁদেরকে দেখেই কারাগারের শক্ত লৌহপ্রকোষ্টের বড় বড় ফাঁক দিয়ে সবাইকে ছুঁয়ে দেখলো। কাঁদল, অঝোর ধারায়। রুবায়েত স্যারের টাইম লিমিটের কথা বারবার মনে এলার্ট করতে থাকলেও তিনি ওকে থামাতে পারলেন না। ১০ মিনিটের মধ্যে ৬ মিনিটই গেল ওর কান্নাকাটিতে। এরপর নিজে থেকেই থামলো। মা বাবার কথা জানতে চাইল। রুবায়েত স্যার ইতস্ত করতে থাকলেন। তবে রুজেল মুখে হালকা হাসি নিয়ে বলল "ব্যাপারটা একটু জটিল। তাঁরা পালিয়ে আছেন। পুলিশ তোমার মা বাবাকেও খুঁজছে এখন। তবে তাঁরা ভালই আছেন। গ্রামে ফিরে গেছেন"
রুজেল কেন মিথ্যে কথা বলছে সেটা রুজি চিন্তা করতে থাকল। ওর ভাবান্তর দেখে রুবায়েত স্যার স্মিত হেসে বললেন
"চিন্তা করো না মা। তোমার মুক্তির পর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।"
> কিন্তু। সারা দেশের মানুষ তো স্যার আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপে আছে।
< আমরা প্লান করে তোমাকে বের করে আনব। কোন চিন্তা করবে না। আর শোন। তোমাকে কয়েকটি খাবার ওষুধ দিয়েছি সেন্ট্রির নিকট। প্রায় ২০ টির মতো। ওগুলো তোমার জেল জীবনটা স্বস্তির কারণ হয়ে যেতে পারে। দিনে ২টার বেশি খাওয়া নিষেধ। মন খারাপ লাগলেই একটা খেতে পারো।
রুজিকে ভাবান্তরিত অবস্থায় রেখে রুবায়েত স্যার ৪ ছেলেমেয়েকে নিয়ে সন্তপর্নে একটা সিএনজিতে করে ফিরে গেলেন তাঁর বাসায়। রুবায়েত স্যারের স্ত্রী রেহা খুব ভাল একজন মানুষ। রুজিকে কিভাবে জেল থেকে বের করে আনা যায় সে প্রোগ্রামে নিজে থেকেই আগ্রহী হলেন।
রুবায়েত স্যারের স্ত্রীকে স্কুলের ছেলেমেয়েরা আপা বলে ডাকায় উনি কেমন যেন ওদের আপন আপন ভাবতে থাকলেন।
যাইহোক ওঁদের প্লান প্রোগ্রাম চলল ১ থেকে দেড় ঘন্টা করে ৪ দিন। কিন্তু ফলপ্রসু কোন প্লানই হলো না। আজ ৫ম দিন। রেহা আজ একটি কবিতা পড়ে শুনাবেন। বলা যায় রেহার ১ম স্বরচিত কবিতা গত ২ বছরে।
সবার মধ্যে রুজেলকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে ১ম দিন থেকেই। স্যার জিজ্ঞেস করলে সে বলে তেমন কিছুই না।
কিন্ত উপস্থিত সবাই-ই বিষয়টা সিরিয়াস কিছু মনে করে আরো বেশি করে ভাবতে থাকলেন। কিছু একটা কিছু সে এমনভাবে চেপে রাখতে চাইছিল যে আর কেউ চাপাচাপিই করলো না।
আজ রেহা আপা রুজির দুঃখ নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করে শোনালে রুজেলের বিমর্ষ অবস্থা দেখে সবার চোখ কপালে ওঠল।
মাথা নিচু করে আছে ট্যালেন্ট বয় রুজেল। মনে হচ্ছে কেউ মাথায় যেন অদৃশ্য ভারি কিছু দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে।
রেহা আপা বেশ কিছুক্ষন পর ওর মাথাটা নিজে গিয়ে ডানহাতের চার আঙুল দিয়ে তুললেন। রুজেল কাঁদতে লাগল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল - আমার কারণেই রুজি আজ জেলে গেছে।
- তোমার কারনে?
- হ্যাঁ আমার কারনে। আমিই ভিডিও করেছিলাম আমার চাচার ডিএসএলআর দিয়ে। আমি যদি বিনি চাচাকে না দিতাম তবে ঐ ভিডিওটা ফেসবুকে আপলোড হতো না।
- কি বলিস রুজেল?
- হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ আপু।
এই অবস্থা দেখার মতো। টিউব লাইটের আলোয় ঘরটা ঝলমলে থাকলেও সবাই বিদ্যুতে শক খাওয়ার মতো কতক্ষণ বসে রইলেন। রুবায়েত স্যার হা করে থাকলেন অবচেতনভাবেই। বাচ্চারা চোখ বড় বড় করে রুজেলের দিকে তাকাল। এইজন্যই বুঝি বলে ঘরের শত্রু বিভীষন।
রেহা আপু নিরবতা ভেঙে বললেন একটা ভিডিও তো এত সহজে ছড়ায় না। মানসম্মত কোন অ্যাকাউন্ট না হলে অথবা ভাল পেজ না হলে এত চেইন বিস্ফোরণ তো সম্ভব না।
- না আপু। বিনি চাচা একজন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। উনার ফলোয়ার কয়েক লাখ।
রুবায়েত স্যারও সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন তাহলে তো প্লান খুবই ইজি। তোমার বিনি চাচাকে দিয়েই তো সমাধানটা বের করা যায়।
রুজেল চোখ মুছতে মুছতে বলল
- না স্যার। রাজি হবেন মনে হয়না। আমার চাচা খুব স্মার্ট আর জিনিয়াস। এক্সট্রা অর্ডিনারি জিনিয়াস।
- তা হলে তো আরো ভাল।
- কিভাবে?
- আমি উনাকে নিজে যেয়ে বুঝিয়ে বলব।
- দেখতে পারেন। লাভ হবে মনে হয় না।
সবাই আশার আলো দেখলেন ৫ম দিনের মিটিংয়ে। রুবায়েত স্যার গেলেন বিনি চাচার কাছে। লোকটাকে দেখতে বেশ স্মার্ট মনে হলো। ফটো তুলতে ভালবাসেন।
হতাশার ব্যাপার হলো বিনি চাচা রাজি হলেন না কারন এতে উনার ফেসবুক ফলোয়ার কমে যেতে পারে। উনি নিজেই যে ভিডিও আপলোড করে অর্ধলাখ নতুন ফলোয়ার পেয়েছেন এখন ঐটা ভুল বলে কিছু লিখলেই তো লাখ লাখ ফলোয়ার আনফলো করবে। অতএব তিনি একটি মেয়ের জীবন নষ্ট হোক ভ্রুক্ষেপ করলেন না।
তাই ৬ষ্ট দিন গেলো বিষন্নতায়। কোন উপায়ই বের হয়না।
৭ম দিনও গেলো কিছুই হয়না আর ৮ম দিনে আরেকটা ঝামেলা হলো। রুজিকে ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছিলেন। সে ফোন করেছে। তাঁর আরো ড্রাগ চাই।
এদিন মা বাবাকে ফাঁকি দিতে লেট হইছিল একটু বেশি রুজেলের। সে একটা ভাল আইডিয়া নিয়ে এসেছে। তাঁর বিনি চাচাকে ব্ল্যাকমেইল করতে হবে।
রুবায়েত স্যার কালা মতিনের নাম ধরে হুমকি দিতে গিয়ে ধরা খেলেন।
অথচ রুবায়েত স্যারের অনেক হাই লেভেলের জিনিয়াসদের মাথার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। আর আজ সিরিয়াস একটা কাজে ফেল হলেন। বোধহয় লোকটা আসলেই জিনিয়াস। ২ মিনিটের মাথায় সে অট্টহাসি দিতে থাকল। আর সাবধানও করল নেক্সট এইরকম ট্রাই করলে পুলিশের কাছে কেস দিয়ে দেবেন।
রেহা আপা, রুবায়েত স্যাররা তাই পারলেন না এই উপায়ে কার্যসিদ্ধি করতে।
যথারীতি ব্যর্থ মনোরথে মাথা নিচু করে এইদিনেও সবাই ফিরে গেলেন। তবে একটু লেট হল। রাত ১০টা বেজে গেল। জাবি ও রুজেলের বাসা পাশাপাশিই। দুজনেই তাই একসাথে গেল। সিমির বাসা রুবায়েত স্যারের বাসার পাশেই। বাপ্পিকে রুবায়েত স্যার এগিয়ে দিলেন।
জাবি বাসায় পৌঁছেই ফোন দিল রুজেলকে। সে ফিসফিসিয়ে জানাল বাসায় কেউ নেই।
রুজেল আশ্চর্যবোধ করলো কি এমন ঘটল যে তাকে কানেকানে তাও সেলফোনে বলতে হবে। একটু পরে অবশ্য গোমর কাটল। জাবি তাকে জানাল বুয়া দরজা খুলে দিয়ে নিজের ঘরে গেছে। তাঁর ফুফু ও বিনি চাচা এক বিছানায়। এইটাই চান্স।
রুজেল এবার আর স্বার্থপরতা করেনি। নিজের চাচা হলে কি হবে। বন্ধুকে বাঁচাতেই হবে এ বিপদ থেকে। সে তড়িৎ গতিতে চাচার রুম থেকে ডিএসএলআরটা নিয়েই দিল দৌড়। রাত সাড়ে দশটা হলে কি হবে।
জিনিয়াস এইবার ঠিকই ধরা খেলেন। বিনি চাচাকে রুবায়েত স্যার ফোন করে বেশি কিছু বলেন নাই। কেবল বললেন আপনার মেইলটা চেক করে আমাকে ফোন করবেন। জিনিয়াস বিনি চাচা নিতান্ত পরিহাস করে বলেছিলেন "আইচছা"।
কিন্তু যখন মেইল চেক করে দেখলেন মিনামা ও উনার কেলেংকারি হাই রেজুলেশন ভিডিওটা। ৩০ সেকেন্ডের বেশি দেখার সাহস হলো না। মাথায় যেন আচমকা দুনিয়া কাঁপানো বাজ পড়লো। অস্বীকার করবার কোনই উপায় নেই।
বিপদে পড়লে যে বাঘেও ঘাস খায় তাও চাটুকারের মত হেসে হেসে সেটা বুঝা গেল যখন বিনি চাচার ফোনের কথা শুনে। অবস্থাটা এমন যেন পাইলে ফোনেই পা ধরে ফেলেন ঠিক এমন আরকি। রুবায়েত স্যার বেশিক্ষন নাচালেন না অবশ্য। কেবল সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন উনার কাঁধে একটা হুমকি দিয়ে।
তবে উনাকে ট্র্যাপে ফেলে ভালই কাজ হয়েছে। যে বিনি চাচা নিতান্ত চোখ কুঁচকে বিরক্তি দেখিয়ে রুজির ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়েছিলেন এখন ওঁর জন্য কাজ করছেন নিজের পয়সা খাটিয়ে, ঘরের খরচে। পাভেল ও রুজিকে নিয়ে শর্টফিল্ম তৈরি করলেন। যেখানে খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করা হলো রুজির বিপদে পড়ার ব্যাপারটা। রুজির সাথে পুলিশের নির্দয় ব্যবহার, রুজি ও পাভেলের ব্যাপারে এলাকার মানুষের রিপুটেশন, রুজির পরিবারের সর্বস্ব খোয়ানোসহ সবকিছু নিয়ে।
বাঙালি বলেই কথা। হুজুগে সব কাজকারবার। এবারো বারুদের মতো ফুসে ওঠল দেশ। মিডিয়ার সমালোচনা হল। রংচং মাখিয়ে পুরো ঘোলাটে করে ফেলা রুজির আসল কাহিনীও তুলে ধরল এবার মিডিয়া নিজেই। মাত্র ৩ দিনে রুজির মুক্তির জন্য দেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল।
পুলিশের লোকেরাও রাতারাতি বদলে গেল। এবার রাস্তায় প্রতিবাদ করতে নামা মানুষদের গুলি না ছোঁড়ে মনে হলো পথ দেখিয়ে দিতে লাগল। অনেকটাই ইউরোপের দেশের পুলিশের মত অবস্থা।
রুজি জেল থেকে বের হয়ে মা বাবার কথা জানতে চাইল। কেউ কিছু বলতে সাহস করছে না দেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।
যখন শুনল মা হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন, কে বা কারা বাবাকে কুপিয়ে খুন করে চলে গেছে তখন আরেকবার মাথা ঘুরে মেয়েটা পড়ে গিয়েছিল। কে তাঁর পরিবারের দায়িত্ব নেবে তার চেয়ে যে বড়ো কথা জলজ্যান্ত দুইটা মানুষ নেই। রুজির কাছে মনে হল নিজের শরীর থেকে ২টি মাংসের টুকরো কেউ ছিলে নিয়ে গেছে। ভেতরের আত্মার পাখিটার দুটো ডানা কেউ জোর করে খুবলে নিয়েছে। এখন সে উড়তে পারবে না।
পরে অবশ্য বাস্তবতা মেনে নিয়েছিল বিপদাপন্ন মেয়েটি। ওকে বিনি চাচা মানসিক সাপোর্ট দিয়েছিলেন। একটানা একমাস। অবশ্য পিছে পিছে রুবায়েত স্যার ছিলেন কারন লোকটার চরিত্র তো তিনি জানেনই।
বিনি লোকটার মুখে জাদু আছে বলতে হয়। রুজিকে তিনি যেভাবে মানসিক চাঙা করে তুলেছিলেন একজন সাইকোলজিক্যাল এক্সপার্টেরও এইভাবে কাউকে প্রেরণা দেওয়া সম্ভব ছিল মনে হয়না।
রুজিও আশা ছাড়েনি। কারন আশা ছাড়তে নেই। ইউনিসেফ এগিয়ে এসেছিল ওর জন্য। ইউএসএইড ওর পড়াশোনা থাকা খাওয়ার খরচ দিয়েছিল এসএসসি পর্যন্ত। রুজি নিজে থেকেই ভাবতে শিখল জীবন মানেই যুদ্ধ। পরাজিত ব্যাক্তির জায়গা নেই এখানে। যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। ছোটভাইকে বড়ো করতে হবে। ওর বয়স মাত্র ২ বছর। ও এখনো পৃথিবী দেখেনী।
পিছন থেকে কিউটবয় রাজের ডাকে সম্বিত ফিরে রুজি দেখেন চোখ হতে দুফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে গেছে ম্যাকবুকের শ্বেত মাউসপ্যাডের ওপর। অবচেতনভাবেই। বিনি ওরফে রবিউল ইসলাম রবিন আসলেই একটা জিনিয়াস।
আগের পর্বসমুহঃ (যদিও সিরিজ গল্প বলতে রাজি নই আমি)
রুজি একটি নষ্টা মেয়ে
রুজির বাসায় পুলিশ
রুজি ও একটা বখাটের গল্প
ছবি গুগল থেকে নেয়া।
নোটঃ এই গল্পগুলো লেখকের মষ্তিষ্কপ্রসূত। অন্য কোনও ঘটনার সাথে মিলে গেলে লেখকের মোটেও দায় থাকবে না। কাকতালীয় ব্যাপার স্যাপার হিসেবেই ক্ষ্যান্ত দেবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:১১