গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখের ব্লগাড্ডা থেকে ফেরার সময় মনে হলো: চলতি সংখ্যা কিনতে হবে। কিনলাম, পড়লাম এবং ভাবলাম; একটা পর্যালোচনা লেখা প্রয়োজন।
অপরবাস্তব ৬-এর একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা ছাপা হয়েছে। তবে এটি প্রচলিত রীতির নয়; ৭টি বাক্যে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য ছাপা হয়েছে প্রচ্ছদ পাতার ভিতরের দিকে। এখানে বইটির শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অপরবাস্তব-৬; কিন্তু সংকলনটির প্রচ্ছদ এবং অন্যান্য স্থানে আছে, অপরবাস্তব ৬। এ অংশের চতুর্থ এবং পঞ্চম বাক্যে আহ্বান শব্দটি ছাপা হয়েছে, আহবান!
বইটির সর্বস্বত্বের দাবিদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, সম্পাদনা পরিষদ। কিন্তু এর সম্পাদনার সঙ্গে যুক্তদের একজনের পরিচয় সম্পাদক এবং এরপর আছে সম্পাদনা পর্ষদ। সম্পাদনা পর্ষদভুক্ত আছেন ছয় জন। পর্ষদ এবং পরিষদ একই অর্থে প্রয়োগ হলেও বিষয়টি এক্ষেত্রে বেমানান, অগ্রহণযোগ্যও বটে। তাছাড়া এখানে সম্পাদক এবং সম্পাদনা পর্ষদকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে ঠিক কি বোঝানো হয়েছে তা-ও স্পষ্ট নয়। প্রশ্ন আসতে পারে, সম্পাদক কি সম্পাদনা পর্ষদের বাইরের কেউ?
এবারের সংকলনটিতে সামহোয়্যারইন-এর নির্বাচিত ২৫টি রম্য পোস্ট স্থান পেয়েছে। অন্তর্জালের আধিপত্যের এ যুগে অন্যতম আকর্ষণ ব্লগ এবং ব্লগিং। তাছাড়া দ্রুতলয়ে ভাব-আবেগ-অনুভূতি-মতামত প্রকাশের মাধ্যম বলেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে এর অবস্থান। এখানে ভাষা, বানান কিংবা বাক্য গঠনের শুদ্ধতা নিয়ে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। লেখক এবং পাঠকের মধ্যে ভাব বিনিময় হলেই হলো। সেই অর্থে অপরবাস্তব ৬-এর সংকলিত লেখাগুলো যতক্ষণ অন্তর্জালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলো, ততক্ষণ সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু সম্পাদকের হাত ধরে অন্তর্জালের গন্ডি পেরিয়ে লেখাগুলো যখন মলাটবন্ধী হলো, তখন আর মানের প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
মান বিবেচনার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতে হয়, অপরবাস্তব ৬-এ প্রকাশিত লেখাগুলো যথেষ্ট অযত্ন আর অপুষ্টির শিকার। প্রকাশিত লেখাগুলোর মধ্যে এমন একটি লেখাও খুঁজে পাইনি যেটি সম্পাদনার প্রাথমিক বিবেচনায় মানোত্তীর্ণ। প্রতিটি লেখার দুর্বলতা নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করা সম্ভব। কিন্তু করছি না; বরং কিছু সাধারণ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
একটি লেখার শিরোনাম ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নোবেল প্রাইজ’। কিন্তু লেখার মধ্যে কয়েকটি নোবেল প্রাইজের বিষয়টি পরিষ্কার নয়। অপর একটি লেখার শিরোনাম ‘ব্যাচেলরস ডাইরি: বিবর্ন একদিন’। এখানে বিবর্ন না হয়ে বিবর্ণ হওয়া প্রয়োজন ছিল। অন্য একটি লেখার শিরোনাম ‘বর্ণবিচ্যূতি এবং প্রবল দ্বিধান্বিত কিছু সময়’। এখানে বর্ণবিত্যূতি না হয়ে বর্ণবিচ্যুতি হলে শুদ্ধ হতো।
শিরোনামের পর মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে লেখাগুলোর অভ্যন্তরভাগে। লেখাগুলোতে যতি চিহ্ন, বিশেষ করে হাইফেন(-) এবং কমা(,)-র ব্যবহারে যত্ন নেওয়া হয়নি। তাছাড়া একই লেখায় একই শব্দ ছাপা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বানানে। যেমন- ‘মুরগির’, ‘মুরগীর’; ‘মাল খানা’, ‘মালখানা’; ‘যেনো’, ‘যেন’; ‘ইতালিয়ান’, ‘ইতালিআয়ন’; ‘তাবলিগের’, ‘তাবলীগের’ ইত্যাদি। হ্রস্ব ই-কার (ি), এবং দীর্ঘ ঈ-কার (ী) ব্যবহারে বিভিন্ন স্থানে প্যাঁচ লেগে গেছে। একই অবস্থা হ্রস্ব উ-কার (ু) এবং দীর্ঘ ঊ-কার (ূ) ব্যবাহরের ক্ষেত্রেও। অপ্রয়োজনীয় কিংবা ভুল শব্দ প্রয়োগের কারণে কোনো-কোনো বাক্য অস্পষ্ট। ত্রুটি আরো আছে, কিন্তু সব উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি না, আর সেটা হয়ত করা সম্ভবও নয়। কেননা সীমাবদ্ধতা আমারো আছে।
উপর্যুক্ত ত্রুটিগুলোর কোনো-কোনোটি হয়ত শুধুই মুদ্রণ প্রমাদ কিংবা সামান্য অসতর্কতার জন্যই ঘটেছে। তার উপর আছে, ছাপাখানার ভূত। তারপরেও আলোচনা করার কারণ হলো: গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখের আড্ডা থেকে জেনেছি, শুদ্ধ বাংলা চর্চা এবং প্রচারে সামহোয়্যারইন কর্তৃপক্ষ আন্তরিক। আর আজ (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২) প্রথমআলোতে প্রকাশিত আনিসুল হকের লেখা পড়ে জেনেছি, ‘শুদ্ধস্বর’ (অপরবাস্তব ৬-এর প্রকাশনা সংস্থা) প্রকাশনা খাতে দায়িত্বশীলতার প্রতিজ্ঞা নিয়ে কাজ করতে আন্তরিক। তাই আশা করছি, উপরের পর্যালোচনা সংশ্লিষ্টরা আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করবেন এবং পরবর্তী প্রকাশনার ক্ষেত্রে এগুলো তাদের জন্য সহায়কও হবে। তবে অন্যকারো কাজে লাগুক বা না লাগুক আমার নিজের চর্চায় সহায়তা করেছে, এটা নিশ্চিত। অরুণাভ সরকার রচিত সম্পাদনার প্রথম পাঠ শীর্ষক পুস্তিকার শিক্ষা সেরকমই।
তবে যতই সমালোচনা করি না কেন, একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, অনেকদিন পর যে বইটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম তার নাম অপরবাস্তব ৬। চমৎকার একটি রম্য সংকলন, সমালোচনার দৃষ্টি নিয়ে না পড়লে হয়ত মজাটা আরো বেশিই পেতাম।