পূর্বের লেখা: রাসূল সা. এলেন মদীনায়
রহস্যে ঘেরা মদীনা:
(এই লেখায় প্রদত্ত তথ্য-উপাত্তের ব্যাপারে মদীনায় অবস্থানকারী ব্যক্তিগণ আরো ভালো বলতে পারবেন। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চাইলে শেয়ার করতে পারেন। পোষ্ট রিলেটেড হলে সংযুক্ত করার চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ)
মদীনা নগরী। স্বপ্নের নগরী। রুক্ষমরুর নির্দয়তাঁর মাঝে যেন সবুজের হাতছানি। এই মদীনাকে ঘিরে রয়েছে কত স্বপ্ন, কত বেদনা। একেই মহান আল্লাহ তা’আলা নির্বাচন ও নির্ধারণ করেছেন সরওয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরত পরবর্তী দশ বছর অতিবাহিত করার জন্য, ইসলামের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার জন্য।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁর এত বড় বিশ্বে, এত বড় আরব ভুখন্ডে কেবলমাত্র মদীনাকেই দারুল হিজরত ও ইসলামের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে কেন নির্বাচন করলেন? মদীনার এমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যই বা কি ছিলো যার দরুণ সে এতো সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে সক্ষম হলো ?
এ এক প্রচ্ছন্ন রহস্য ও হিকমতে ইলাহী। মদীনা মুনাওয়ারাকে রাসূলের হিজরত ভুমি ও ইসলামের প্রাণকেন্দ্র বানানোর কুদরতী সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা ছিলো বহুপূর্বের। মদীনার ভৌগোলিক অবস্থান এবং তাতে অবস্থানকারী জাতি-গোত্রসমূহের ইতিহাস অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মহান আল্লাহ তা’আলা মদীনাকে সৃষ্টিই করেছিলেন ইসলামের কেন্দ্রভূমি ও রাসূলের হিজরতের লক্ষ্যস্থল বানানোর জন্য।
কেননা, ইসলাম আসার পর তাঁর প্রসার এবং দিক-দিগন্তে তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজন ছিলো এক স্থানে মুসলমানদের মজবুত ও সুদৃঢ়ভাবে অবস্থান গ্রহণ। আর এজন্য প্রয়োজন ছিলো এমন একটি পবিত্র ভূমির, যেখানে মুসলমানরা নিশ্চিন্তে ও নিরাপদভাবে আশ্রয় নেবে। যা হবে কুফর শিরকের প্রভাবমুক্ত, এমন সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত যার মাঝে অবস্থান নিয়ে যে কোন বহিঃশত্র“র আক্রমণ প্রতিহত করা এবং তাদেরকে পরাজিত করা সম্ভব হবে।
কেননা, এটা স্পষ্ট ছিলো যে, ইসলাম আসার পর এবং তাঁর স্বরূপ জনসম্মুখে উদ্ভাসিত হওয়ার পর দলে দলে নিরীহ জনসাধারণ তা গ্রহণ করার জন্য যেমন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে, তেমনি সমাজের এক শ্রেণীর স্বার্থবাজ, দুর্নীতিপরায়ন মোড়ল; যারা সমাজের নিরীহ লোকদের চুষে চুষে সর্বস্বান্ত করছিল এবং নিজেদেরকে প্রভুত্বের আসনে বসিয়ে অসহায় লোকদেরকে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থের গোলামে পরিণত করে রেখেছিলো- তারা যখন ইসলামের বর্ণবাদ বিরোধী উদার মনোভাবের কারণে নিজেদের কায়েমী কায়েমী স্বার্থ ও শোষনের মসনদ টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের অস্তিত্বকে প্রতিবন্ধক জ্ঞান করবে, তখন তারা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য, তাদের অস্তিত্বকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে হামলে পড়বে।
তাই এদেরকে রুখার জন্য, অসহায় মুসলমানদেরকে এদের নিগ্রহ থেকে মুক্ত করার জন্যই প্রয়োজন ছিলো একটি সুরক্ষিত আবাস ভূমির। আর সমগ্র আরব ভূখন্ডের মাঝে একমাত্র মদীনাই ছিলো এ ব্যাপারে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। মদীনার ভৌগোলিক অবস্থান তাকে সুদৃঢ়, সুরক্ষিত আর মজবুত একটি দূর্গে পরিণত করে রেখেছিলো। সমগ্র আরব উপদ্বীপের অন্য কোন শহর এ ব্যাপারে মদীনার সমকক্ষ ছিলো না।
মদীনার ভৌগোলিক অবস্থান :
মহান আল্লাহর কুদরতের নির্দশন হয়ে মদীনা শহর তার সকল দিক থেকেই সুরক্ষিত ছিলো। পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই দিক দিয়ে মদীনাকে হিফাজত করত যথাক্রমে ‘হাররাতুল ওয়াকীম’ ও ‘হাররাতুল ওয়াবরা’ নামক রোদের পোড়া, আড় ও তেরছা, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত পাথুরে প্রান্তর। যার মধ্যে দিয়ে উট ও অশ্বের চলাচল অথবা কোন সেনাবাহিনীর অতিক্রম তো দূরের কথা, কারো পক্ষে পায়ে হেঁটে চলাও ছিলো কষ্টকর। সেনাবাহিনী চলাচলের পথে বিরাট বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এই দু’টি হাররা বিভিন্ন বহিরাক্রমণ থেকে মদীনাকে রক্ষা করতে সক্ষম ছিলো।
মদীনার দক্ষিণ দিক খেজুরের ঘন বাগান এবং ক্ষেত-খামার দ্বারা বেষ্টিত ছিলো। এদিক দিয়ে মদীনায় আক্রমণ করতে হলে আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর রাস্তায় এমন সংকীর্ণ পথ ও অলিগলি পড়তো, যা পূর্ণ কাঁতারবন্দী ও ফৌজী শৃংখলার সাথে পার হওয়া সহজসাধ্য ছিলো না এবং ছোট খাট মামুলী ফৌজি চৌকিও এই অগ্রাভিযান ভন্ডুল করার জন্য যথেষ্ঠ ছিলো।
মদীনার উত্তরাংশ ছিলো একমাত্র পথ, যা আক্রমণকারী কোন বাহিনীর জন্য উন্মুক্ত ছিলো। শুধুমাত্র এই একটি পথ দ্বারাই মদীনায় আক্রমণ করা সম্ভব ছিলো। কিন্তু এতদসত্বেও এ পথ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে আক্রমণকারী বাহিনীর জন্য বাড়তি কোন সুযোগ-সুবিধা দিতে সক্ষম ছিলো না। বরং এ পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আক্রমণকারী বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা ছিলো সহজসাধ্য। যেমনটি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দকের যুদ্ধের সময় এ পথে খন্দক খনন করে করেছিলেন। তাই প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক (রহঃ) বলেন,
“মদীনার এক দিকের অংশ বা রাস্তাই ছিলো উন্মুক্ত। বাকি সকল দিক বসতি, খেজুর বাগার এবং পাথুরে প্রান্তরের কারণে পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। কোন দুশমন এর ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে পারত না।”
এছাড়াও মদীনা মুনাওয়ারায় প্রচুর পরিমাণে ‘আতাম’ বা দুর্গ বেষ্টিত মহল্লা ও কেল্লা ছিলো। এসব ‘আতাম’ এর সংখ্যা ছিলো ৫৯টি।
ড. ওয়েলফিন্সন এসব আতাম এর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন “হিব্র“ভাষায় ‘আতাম’ শব্দের অর্থ হচ্ছে বন্ধ ও রুদ্ধ করে দেওয়া। প্রাচীরের সঙ্গে যখন এই শব্দ ব্যবহৃত হবে, তখন এর অর্থ হবে সেই খিড়কি যা বাইরে থেকে বন্ধ, কিন্তু ভেতর থেকে খোলা যায়। এর ব্যবহার পাঁচিল কিংবা প্রবল নিরাপত্তামূলক প্রাচীরের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে এবং ছোট বড় দূর্গ বুঝানোর জন্যও ‘আতাম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়, যাতে বাইরে থেকে ভেতরের আলো প্রবেশের জন্য ছিদ্র থাকতো যা এসব দুর্গ-বাইরে থেকে বন্ধ এবং ভেতর থেকে খোলা যেতো।”
তিনি আরো বলেন- “মদীনায় ‘আতাম’ এর বিরাট গুরুত্ব ছিলো শত্র“ও আক্রমণ মুহুর্তে গোত্রের লোকের সেসবে আশ্রয় নিতো, বিশেষত: মহিলা, শিশু, পঙ্গু ও অসহায় লোকেরা সে সময় এতে মাথা গোজার ঠাঁই পেত, যখন মহল্লার পুরুষেরা লড়বার জন্য চলে যেত। এসব ‘আতাম’ গুদাম হিসাবেও ব্যবহৃত হতো এবং এতে খাদ্যশস্য ও ফলমূল জমা করে রাখা হতো। কেননা, এগুলো খোলা জায়গায় রাখলে শত্র“ কর্তৃক লুণ্ঠিত ও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার আশংকা থাকতো। এছাড়া এতে মালামাল ও অস্ত্র-শস্ত্র রাখা হতো।” (ওয়াফাউল ওয়াফা, প্রথমখন্ড ১১৬ পৃষ্ঠা)
এছাড়া সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মদীনার এ সকল ‘আতাম’ বা দুর্গের বিরাট গুরুত্ব ছিলো। কেননা, এগুলোকে অবলম্বন করে শত্র“র মোকাবেলা করা ছিলো অতি সহজসাধ্য। পক্ষান্তরে এগুলো বিজয় করা বা অতিক্রম করে এর অধিবাসীদের কোন ক্ষতিসাধন করা ছিলো দু:সাধ্য।
মদীনাকে ইসলামের কেন্দ্র বানানোর আরো কিছু কারণ ছিলো। যেমন, ইসলামের বহুল প্রচার ও প্রসারের জন্য প্রয়োজন ছিলো কুফর ও শিরকের প্রভাবমুক্ত একটি পবিত্র ভূমির। এ ব্যাপারেও মদীন ছিলো গর্বের দাবীদার। কেননা, মদীনায় মুর্তিপূজা ও কুফরীর কিছু প্রভাব থাকলেও তা ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিলো না এবং কুফর ও শিরকের প্রতি মদীনাবাসীদের অবস্থান মক্কাবাসীদের মতো এতো শক্ত ও জোড়ালো ছিলো না।
তৃতীয়ত: ইসলামের বিজয় ও বহুল প্রচারের জন্য প্রয়োজন ছিলো ইসলাম যেখানে এসে আশ্রয় ও অবস্থান নিবে, সে স্থানের অধিবাসীরা দূর্বল ও উত্তম চরিত্রের হওয়া। কেননা, এ বিষয়টা বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, সবল ও শক্তিমান লোকেরা সত্য ধর্ম খুব কমই গ্রহণ করে থাকে। শক্তির অহংকার আর অর্থের প্রাচুর্য্য তাদেরকে বাস্তবতা থেকে অনেক দুরে সরিয়ে রাখে। অথচ দুর্বল ও চরিত্রবান লোকেরা সত্য ধর্ম গ্রহণ করার ব্যাপারে অনেক অগ্রগামী থাকে। আর এই দিক দিয়েও মদীনা ছিলো একক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
চলবে...
পরবর্তী পর্ব: মদীনায় অবস্থানকারী জাতি-গোত্রসমূহ