বৃহস্পতিবার আজ , সুষমা বের হয় নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে । কত সপিং মল হয়েছে এখন , চোখ ধাঁধানো রূপ তাদের ; ক্রেতা বিক্রেতারাও অপরূপ ! সেখানে গেলে তেমন আপন মনে হয় না যেমন মনে হয় নিউমার্কেটে গেলে । নানাবাড়ীর পুরোন এক পা ভাঙ্গা নড়বড়ে জলচৌকীটার মত ; নতুন নতুন চেয়ার এসেছে , কিন্তু গেলে সেই জলচৌকীর খোঁজ । বসবার আসন নয় শুধু , স্মৃতিরও আসন ; পুরোন দিন , অভ্যাস -- এ সব যে ফেলনা নয় সেটা জলচৌকীটার কাছে গেলে বোঝা যায় । নিউমার্কেটে ভীড় বেড়েছে আগের চেয়ে । সাদা- কাল শাড়ী পরা সুষমা লম্বা মালাটা জড়িয়ে নিতে ভুলেনি কাল পাথরের ; মন ভাল রাখতে সাজগোজ করে সে ।
দুপুর গড়িয়ে গেছে , গেট দিয়ে ঢুকতে হালকাই মনে হয় ভিতরটা । বইয়ের দোকানে গিয়ে পেয়ে যায় বই দুটো যার খোঁজে আসা। বেরিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে চলতেই পা পিছলে যায় , পড়ে গিয়েছিল প্রায় ; কে যেন ডান কাঁধের কাছে শক্ত করে ধরে ফেলে , ভু-পাতিত হতে দেয় না । সোজা হয়ে দাড়াতে দাড়াতে বলে ,ধন্যবাদ আপনাকে ,পড়ে যাচ্ছিলাম । তাকিয়ে দেখে বাদল , দেখে দু'চোখে স্পষ্ট দেখে তবু বিশ্বাস করতে পারে না । সুষমার কন্ঠনালী কে যেন চেপে ধরেছে , বোধশূন্য , ভরশূন্য মনে হয় নিজেকে । বাদল একপাশে সরে দাড়ায় , ওকেও বলে সরে দাড়াতে । সুষমার মনে হয় ওর হৃদপিন্ড বারে বারে পাঁজরে সজোরে আঘাত করছে ! বাদল হাত বাড়িয়ে বইয়ের প্যাকেটটা নেয় ; ফ্যাকাশে সুষমাকে দেখে বুঝতে পারে হয়তো ওর শক্তিহীন এই দাড়িয়ে থাকা । বলে , চল সুষমা কোথাও বসি । বাইরে বেরিয়ে এসে কাছের এক চাইনীজে গিয়ে বসে ওরা । খাবার অর্ডার দিতে চাইলে সুষমা বলে , ড্রিঙ্কস ওনলি । প্রথম সুষমার কথা শুনতে পায় বাদল । বাদল নুডলসএর অর্ডার দেয় সাথে ।
বাদল পরিবেশ হালকা করতে বলে , আজ তো পড়ে যেতে , পা ভাঙ্গতো ; আমি না ধরলে ।
সুষমা বলে ,তুমি তো আমার ছায়াসঙ্গী , এতদিন জানি এই তুমি পতনোন্মুখ আমাকে বার বার রক্ষা কর , পড়তে দাও না । তবে পড়ে যাবার কারন কি তুমি নও ? আমাকে অন্যমনস্ক করে রাখবার দায় তোমার , আর কারো নয় । তুমি এখন এখানে ? কিভাবে ?
বাদল জানায় একটা জরুরী কাজে আসতে হয়েছে দেশে , আগামী পরশু চলে যাবে । বলে , বলাকার ওদিকের গেট দিয়ে ঢুকেছি আমি , পেছন থেকে একজনের চলার ভঙ্গী দেখে তোমার কথা মনে হয়েছিল , ভেবেছিলাম ভুল দেখেছি । এখন বুঝতে পারছি ঠিক তোমাকেই দেখেছিলাম । বিপরীত দিকে গেলে দেখতে পেলাম ।
সুষমা বলে , নিউমার্কেট গোলাকৃতির দেখনা , একসাথে নাই বা চললে , বিপরীতমুখী চললেও সাক্ষাৎ ঘটে যায় , ধাক্কাও লেগে যেতে পারে । পৃথিবীটাও গোল , গন্ডগোল সেখানেই ; চলতে চলতে ধাক্কা লেগে যায় , মর্মে সে আঘাত স্থায়ী হয়ে গেলে মরন ! আগুন জ্বলতেই থাকে আজীবন !
ঠান্ডা পানীয়তে চুমুক দিতে গিয়ে দেখে সুষমা তার হাত কাঁপছে । বেমানান লাগল কিনা বোঝার ধৈর্য্য থাকে না তার , সে টেবিলে কপাল ঠেকিয়ে বসে থাকে । কেন , কেন দেখা হল বাদলের সাথে ? এই সেই জন -- বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ লুকিয়ে ফেলল নিজেকে , শত অনুরোধেও সাড়া দিল না বাদল ।
কিছুদিন আগে বার বার উদ্যোগ নিয়ে শেষে বন্ধু ফাহিমাকে কিছু কথা না বলে পারে নি সুষমা বাদলের এবারের ব্যাপারে , দূর দেশে বসেও বাদলের প্রভাবে তার স্বাভাবিক জীবনে ঝড় , তোলপাড় সকাল দুপুর ভোর ।
বিপর্যস্থ সুষমাকে দেখে ফাহিমা মন খারাপ করল , তাকে খুলে বলাতে ফাহিমা আপসেট হয়ে গেল , সে সুষমার ডায়েরীতে যত্নে রেখে দেয়া বাদলের নিজ হাতে লেখা ফোন নম্বর কলম দিয়ে কেটে দিল , সুষমার অনুরোধে তার নামটা থাকল শুধু অক্ষত । এই সে বাদল , কোমল আশ্রয় সুষমার , কত কতবার আশ্রয় নিয়েছে মনে মনে সুদূরে থাকা বাদলের কাছে জানতেও পারেনি বাদল , পারেনি অন্য কেউ । অনেক পরে অস্বচ্ছভাবে যা জেনেছে সুষমা তা হল , বাদলের পারিবারিক জীবনে সুষমা একটা কাঁটা হয়ে আছে বিনা আয়োজনে , বিনা ছিদ্র অন্বেষনে ।
ফাহিমা সব শোনবার পরে কদিন ধরে চিন্তিত ।
বলল , আমার টেনশন হচ্ছে , তুমি যেমন চাপা স্বভাবের তোমাকে আমি চিনি ; ভাবছি বাদলের রহস্যময় আচরনে তুমি যেমন স্ট্রেসফুল কন্ডিশনে আছো ভয় পাচ্ছি তোমার কোন শারিরীক সমস্যা হয় কিনা ! কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি না ; বলেছি তোমাকে বিষয়টা ভুলে যেতে ; পরস্পর তোমরা আজ এতদূরের অধিবাসী যে মীমাংসা সহজ নয় । বুঝতে পারছি বলা সহজ তবে তোমার পক্ষে ওর এহেন জটিল আচরন মেনে নেয়া দু:সাধ্য । আমার ভাল লাগছে না , তোমাকে সাইকিয়াটিস্টের নিয়েও লাভ হবে না , তুমি তো ঘুমের ওষুধ খেতে শুরু করেছো , ঘুমুতে পারছো না ।
আরো বলল , আমি বাদলের সাথে ফোনে কথা বলি , আমার মনে হয় এটাই একমাত্র পথ সমাধানের । অন্য কিছুতে কাজ হবে না মনে হয় । আমি তো বাদলের ফোন নম্বর রেখে দিয়েছি লিখে আমার কাছে , তোমার ডায়রীতে কাটবার সময় । তোমার অবস্থা দেখে আমার মনে হয়েছিল নম্বরটা রাখা দরকার ।
সুষমা বলে , বাদলের বন্ধুর সাথে কথা বলা যায় কিনা ;
ফাহিমা জানে বাদলকে , বলে কোন মাধ্যম নয় , সরাসরি ওর সাথে কথা বলা ভাল ।
সুষমা বুঝে উঠতে পারে না কি বলবে । বলে , আমি কদিন ভেবে নেই কি করা যায় ।
এরপরে সুষমা অনেক ভেবেছে । বাদল তার বিশেষ এক বন্ধু ছিল , ছিল ছায়াসঙ্গী । তার নিশ্চিন্তপুর স্টেশন হল বাদল ; বাদল তার ঘরের বাইরের বড় উঠোন ! সুষমা তার সব কাজের কৈফয়ত লিখে রাখে মনের দলিলে বাদলের জন্য , সব ব্যথাভার সঞ্চিত রাখে নির্বিঘ্নে বাদলকে সপে দিয়ে মুক্ত হবে বলে !
এখন তার হাজার দ্বিধা , হাজার দ্বন্ধ ! ফাহিমার অনুরোধে বাদল যদি ফোন করে , যদি সুষমাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কোন ভুমিকা রাখে ; সুষমার কি মনে হবে না এটা বাদলের স্বেচ্ছাপ্রনোদিত নয় ; অভিনয় ! কি করবে সুষমা , কি করা উচিৎ ! বাদল কেন সব পরিষ্কার করতে পারছে না তার কাছে ? কি এমন বাঁধ , বাঁধা বাদলের -- তাকে মু্ক্তি দিতে যে মুক্তি তার প্রাপ্য । আর কিছু না দিতে পারুক বাদল , সুষমার সময়গুলোকে কেন নিষ্পেষিত করা !
বাদল তো অনেক মেইল পেয়েছে সুষমার , তারপরেও কেমন কঠিন নিশ্চুপ , পাষানতম !
এক একবার মনে হয়েছে , সব আঘাত যে ভুলিয়ে রাখত সবার অজান্তে ,আড়ালে থেকেও , সে বাদল । অথচ সেই বাদলই সবচেয়ে বড় আঘাত হয়ে হানল তাকে ! কিন্তু কেন ? স্বেচ্ছায় ? নিল কি প্রতিশোধ !
হতেই পারে না । সুষমার বড় কষ্ট , যন্ত্রনারা চেপে ধরে তাকে বার বার ।
ফিরে আসে বর্তমানে সুষমা ।
বাদলের সামনে বসে ঠান্ডা পানীয় চুমুক দিতে দিতে ভাবে সুষমা আজ যে দেখা হয়ে গেল এর পরিনতি কি ? ওতো কোনভাবে দোষী করতে পারে না বাদলকে , বাদলের কাছে হার মানা হার কবে পরে নিয়েছে বাদল জেনে গেছে , তবে কেন বাদল তাকে নিয়ে খেলা করে , মনটাকে ভেঙ্গে চুরে কি আবিষ্কার করতে চায় বাদল ?
বাদল দেখে অনেকটা সময় চুপ করে আছে সুষমা , বলে , আর কিছু খাবে সুষমা ?
সুষমার বলতে ইচ্ছে করে , " বাদল তুমি আমাকে শান্তি দাও , তা না হলে মরন দাও , এত কষ্ট , এত শাস্তি দিও না যা আমার সহ্য করবার ক্ষমতা নেই " । বলতে পারে না । বাদলের নিষ্পলক চোখে সেই অতীতের মত আকুতি, যা বার বার সুষমার মনে ঝড় তোলে । বাদল কষ্ট পাবে ভেবে সামলে নেয় নিজেকে ।
বাদল তার টেবিলের ওপর রাখা হাতটা ধরে , ধরে রাখে । সুষমা এই মানুষটাকে কি ভীষন জানে ! তাই বোঝে বাদলের কতখানি সে । তবু আজ কথা বলার বেলা ; সুষমা বলে , আমার কোন ইচ্ছা তোমাকে সমর্পণ করবো না বাদল , কোন জিজ্ঞাসাও নয় আর । শুধু অনুরোধ করবো , ফাহিমা যদি আমার বিষয়ে তোমার সাথে কথা বলে , তার পরিপ্রেক্ষিতে তুমি এমন কিছু করো না যা তোমার স্বত:স্ফূর্ত নয়। আমি একদিন ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি , তুমিও সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করনি ;সময় চলে গেছে । সে সবই মেনে নিয়ে আমাদের আপাত:সুখী জীবন । তুমি আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে আছো , বন্ধনহীন পরিচয়ে যে কষ্ট তোমার কারনে এবার পেলাম সেও সইবে -- তোমার করুনা আমি সইতে পারব না ।
তুমি আমার স্বপ্ন , আমার কল্পনায় যে কষ্টের ছবি আঁকতে পারো , এঁকে দাও । বাস্তবের আর সব কিছু একপাশে পড়ে থাকে , থাক ; তুমি অন্যপাশে একা আমার বিশ্ব , আমার আশ্রয় । তেমনি থাকো যেমন তোমাকে মানায় । ক্যাকটাসে ফুল , খুব একটা সুলভ নয় ; যখন ফুটেছে সে ফুল , থাক তার অনন্য পরিচয় ।
ছবি কৃতজ্ঞতা : রানা
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:১০