(এই সিরিজের প্রথম পর্বটা বছরখানেক আগে লেখা। আমার ব্লগজীবনে একেবারে প্রথমদিকের ব্লগ ছিলো সেটা। আমি বেশ অলস মানুষ হওয়ায় এর পরের পর্ব এত দিন লিখেছি।)
ধর্মীয় অন্ধতা এবং আমাদের বানরায়ন -১(নবীজির মেরাজ)
ধর্মীয় দার্শনিকরা যারা ধর্মকে নিরন্তরভাবে বিজ্ঞানময় করে তোলার ম্যামথ টাস্ক কাধে নিয়েছেন তাদের অধ্যাবস্যায়ের প্রতি পূর্নশ্রদ্ধা রেখেই আজকের আলোচনা শুরু করছি।
প্রায়ই বিভিন্ন যায়গায় বলতে শুনি সূচের মধ্য দিয়ে উট চলে যাবার ব্যাপারটি। এটি আমি প্রথম পড়েছিলাম আল কোরান দ্যা চ্যালেন্জ নামের একটি বইতে। বিভিন্ন সময় এই ব্লগেও অনেককে কথাটা বলতে শুনেছি। কথাটা সম্ভবত হাদীসের, কুরআনেরও হতে পারে। আমি সেই হাদীস বা কুরআনের রেফারেন্স দিচ্ছি না, আমি অলস মানুষ ঘেটে বের করতে ইচ্ছা করছে না। যাই হোক সেখানকার সার কথা গুলো হচ্ছে:
আল্লাহ তাআলা চাইলে সূচের ফুটো দিয়ে উট প্রবেশ করাতে পারেন
ধর্মীয় দার্শনিকদের কনক্লুশান:
সুচের ফুটোয় অনেক কম স্থান বিদ্যমান।তার মধ্য দিয়ে উট যাবার কথা বলার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণবিবর কে, কারন কৃষ্ণবিবরও ছোট জিনিস যার মাঝে বড় বড় বস্তু পতিত হয়।
বিজ্ঞানের বক্তব্য:
এখানে একটা বিষয় বলা প্রয়োজন আলোচনা শুরুর আগে সেটা হচ্ছে, যেহেতু এখানে ধর্মীয় স্ক্রীপচারকে বিজ্ঞানের সাথে মেলানো হচ্ছে সুতরাং বিজ্ঞানের দাবী থাকবে বিজ্ঞানের সংজ্ঞাগত বিশুদ্ধীর। এর অর্থ হচ্ছে যখন বিজ্ঞানের সাথে মেলানোর চেষ্ঠা হচ্ছে সুতরাং বিভিন্ন বিষয়কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে হবে। সমস্যা হচ্ছে অনেক সময়ই ধর্মীয় বিজ্ঞান দার্শনিকরা এই জায়গায় পিছলানো শুরু করেন। তারা বিজ্ঞানের তত্ব ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানের পরিভাষা ব্যবহারে বেশী একটা উতসাহী হন না। এর প্রধান কারন হচ্ছে বিজ্ঞানের পরিভাষা গুলো সাধারনত ওয়েল ডিফাইন্ড থাকে। সেখানে এদিক সেদিক ধোয়াশামূলক ব্যাখ্যা করা যায় না।
আরেকটি ব্যাপার ,বিজ্ঞান কিন্তু তত্ব নিরপেক্ষ বাস্তবতা স্বীকার করে না। তাই সাধারন জীবনে সত্য আর বৈজ্ঞানিক সত্য নামে সাধারনত যে বিভাজনটা হয়ে থাকে তা পুরোপুরি ইনভ্যালিড। হ্যা অনেক বৈজ্ঞানিক সত্য দৈনন্দিন জীবনে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপন্থী। এখানে অভিজ্ঞতা শব্দটি খুবই গুরুত্বপূর্ন কারন অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের পর্যবেক্ষনের প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার কারনে অনেক ঘটনা আমাদের কাছে যেভাবে আ্যাপিয়ার করে সত্যিকার অর্থে সেভাবে ঘটে না।সুতরাং অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা ইলিউশন ছাড়া আর কিছুই না।যেমন আমরা কখোনই দৈনন্দিন জীবনে গতিশীল জড় কাঠামোতে শ্লথ ঘড়ির সম্মুখীন হই না।
এবার দেখা যাক সুচের ফুটা আর ব্ল্যাকহোলের পার্থক্য কোথায়।
সূচের ফুটা দিয়ে উট যেতে পারে না কারন উট ,সুচের ফুটার তুলনায় অনেক বড় স্থান দখল করে।
ব্ল্যাকহোলের আলোচনা শুরু করার আগে আমরা এই স্থান ব্যাপারটিকে আরেকটু rigorously সংজ্ঞায়িত করতে চাই।ইউক্লিডিয় জ্যামিতি অনুসারে স্থান শুন্যমাত্রিক বিন্দুসমূহের ত্রিমাত্রিক বিস্তৃতি। এবং ইউক্লিডিয় স্থান সমতল। এই বক্তব্যের অনেকগুলো কনসিকোয়েন্স আছে,
১.পিথাগোরাসের উপপাদ্যের সত্যতা(তিনমাত্রায় পিথাগোরিয়ান উপপাদ্য)
২.দুটি বিন্দুর মাঝে সর্বনিম্ন দুরত্ব হচ্ছে ঐ বিন্দু দুটোকে সংযোগকারী সরলরেখা
৩.চিরায়ত ,অর্থাত এই ইউক্লিডিয়ান স্থান অনেকটাই চিরায়ত এই অর্থে এই স্থান পরিপার্শ্ব দ্বারা প্রভাবিত হয় না।এই অনুসিদ্ধান্ত ইউক্লিডিয়ান স্থানকে একটি আ্যাবস্ট্রাক্ট অথবা সংজ্ঞাভেদে অবস্তুগত ধারনায় পর্যবাসিত করে।
এখন ব্ল্যাকহোলের আলোচনা শুরু করবার আগে আমাদের আরেকটু স্থানের সংজ্ঞার গভীরে যেতে হবে। কারন ব্ল্যাকহোল জেনারেল রিলেটিভিটির একটি প্রতিফল। আর জেনারেল রিলেটিভিটির ভিত্তি হচ্ছে অইউক্লিডিয় জ্যামিতি।
অইউক্লিডিয় জ্যামিতি টা কি?
যারা জ্যামিতি পড়েছেন সবাই ইউক্লিডের জ্যামিতির সাথে পরিচিত। ইউক্লিডের জ্যামিতিতে পাচটি স্বীকার্য বিদ্যমান। স্বীকার্য হচ্ছে প্রমান ব্যাতিরেকে যে ধারনা গুলোকে স্বীকার করে নেয়া হয়। ইউক্লিডের পঞ্চম এবং বহুল বিতর্কিত স্বীকার্যটি হচ্ছে
"যদি একটি সরলরেখা অপর দুইটি সরলরেখার উপর পতিত হয় তাহলে যে পার্শ্বে উত্পন্ন অন্ত:স্থ কোন গুলোর সমষ্টি দুই সমকোনের কম হবে সেই পার্শ্বে রেখাদুটোকে অনির্ধারিতভাবে বর্ধিত করলে রেখাদুটো পরস্পরকে ছেদ করবে"
স্বীকার্যটি যদি বুঝতে সমস্যা হয় তাহলে এই স্বীকার্যের ভিন্নরুপ গুলোর একটি উল্লেখ করছি(এটি প্লেফেয়ারের স্বীকার্য হিসেবে পরিচিত)
"যদি একটি সরলরেখা দুইটি সমান্তরাল সরলরেখার একটিকে ছেদ করে তাহলে অপরটিকেও ছেদ করবে"
আসলে এই স্বীকার্যের মুল নির্যাস হচ্ছে সমান্তরাল সরলরেখা পরস্পরকে কখোনোই ছেদ করবে না।
এখন অইক্লিডিয় জ্যামিতিতে এই স্বীকার্যটি সত্য নয়।অর্থাত অইউক্লিডিয় জ্যামিতিতে সমান্তরাল সরলরেখাসমূহ পরষ্পরকে ছেদ করে। এই কথা দেখে আত্কে উঠবার কোনো কারন নেই,পৃথিবীর পৃষ্ঠ একটি অইউক্লিডিয় তল,দ্রাঘিমা রেখাগুলো সমান্তরাল কিন্তু তারা মেরুবিন্দুতে পরষ্পরকে ছেদ করে।
অইউক্লিডিয় জ্যামিতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন কনসিকোয়েন্স:
১.পিথাগোরাসের উপপাদ্য সঠিক নয়
২.দুটো বিন্দুর মধ্যে সর্বনিম্ন দুরত্ব ঐ অইউক্লিডিয় তলের উপর নির্ভর করে। যাকে আমরা জিওডেসিক বলি। যেমন পৃথিবী পৃষ্ঠে কোন সরল রেখা আকা সম্ভব নয় পৃথিবী পৃষ্ঠের বক্রতার জন্যে। পৃথিবী পৃষ্ঠে দুটি বিন্দুর সর্বনিম্ন দুরত্ব হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্রকে কেন্দ্র করে ঐ বিন্দু দুইটি দিয়ে যাবে এমন কোন বৃত্ত আকা হলে ঐ বৃত্তের পরিধি বরাবর। আন্তর্জাতিক বিমানরুট গুলো যখন নির্নয় করা হয় তখন এই পদ্ধতিতেই করা হয়। এই বৃত্তগুলোকে বৃহত বৃত্ত বলে।
৩।ত্রিভুজের তিন কোনের সমষ্টি দুই সমকোনের সমান নয়। কতটুকু পার্থক্য এটা নির্ভর করে ত্রিভুজের আকৃতির উপর।
এখন পৃথিবীর তলকে কিন্তু ইউক্লিডিয় গোলীয় জ্যামিতি দ্বারাও ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে একটি যৌক্তিক সমস্যা আছে। এয়ার রুট নির্নয়ের সময় আমরা ইউক্লিডিয় গোলীয় জ্যামিতি ব্যবহার করছি। এবং আমাদের একটি অতিগুরুত্বপূর্ন তথ্য এখানে দরকার ,সেটি হচ্ছে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ। এখন ধরা যাক একটি দ্বিমাত্রিক প্রানী গোলকের উপরিতলে বাস করে। যেহেতু সে দ্বিমাত্রিক প্রানী সুতরাং ত্রিমাত্রা সমন্ধে তার কোন ধারনাই নেই। গোলকের ব্যাসার্ধ তার কাছে পর্যবেক্ষনযোগ্য নয়। সুতরাং সে কিভাবে যদি তার বিশ্বের এয়াররুট নির্নয় করতে চায় ,নির্নয় করবে?
গস,বোলাই,রীম্যান এরা এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েই অইউক্লিডিয় জ্যামিতি আবিস্কার করেন।
গানিতিক টার্মে প্রস্তাবনাটি হচ্ছে কোনো তলের বাইরে না গিয়েই তলের বৈশিষ্ঠসমূহ নির্নয় করা।খেয়াল করুন এয়ার রুট নির্নয় করার সময় আমাদের যে গোলকের ব্যাসার্ধ লেগেছিল সেই গোলকের ব্যাসার্ধ কিন্তু তলের বাইরের প্যারামিটার।
এখন জেনারেল রিলেটিভিটি বলে এই মহাবিশ্ব হচ্ছে স্থানকালের অইউক্লিডিয় বিস্তৃতি। অর্থাত স্থানকালের কাঠামো অইক্লিডিয় জ্যামিতি মেনে চলে। বস্তুকনাসমূহ তাদের ভরের কারনে চারপাশের স্থানকালকে বক্র করে দেয়। এবং এই বক্রতাই মহাকর্ষের প্রকৃত কারন।
এখন ছোট স্কেলে অইউক্লিডিয় জ্যামিতি ,ইউক্লিডিয় জ্যামিতিতে আসন্নীকৃত হয়।যে কারনে আমরা অইউক্লিডিয় জ্যামিতির প্রভাবে দৈনন্দিন জীবনে তেমন একটা পর্যবেক্ষন করি না।
এখন আসা যাক ব্ল্যাকহোল প্রসঙ্গে। সেখানে যা হয় তা হচ্ছে,
চন্দ্রশেখর লিমিটের বাইরে এরকম নক্ষত্রের হাইড্রোজেন জ্বালানী যখন শেষ হয়ে যায় তখন তার ভর নিজের উপরই কোলাপস করে। বিপুল পরিমানে ভর কেন্দ্রীভূত হওয়ায় চারপাশের স্থানকালের বক্রতা অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌছায়। এবং আলো সমূহ জিওডেসিক বা সর্বনিম্ন দুরত্বের পথ অতিক্রম করতে গিয়েই নিজের উপরই পতিত হয়। মহাকর্ষ ক্ষেত্রের শক্তিও অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌছায়।
ব্ল্যাখোল কিন্তু স্থানের পরিমানে কম নয়, কেবল বিপুল পরিমান স্থান নিজের উপর বক্র হয়ে আছে। ব্যখোলের যেটা কম সেটা হচ্ছে ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফল। সুতরাং ব্ল্যাক হোলে স্থান কম কথাটা অবৈজ্ঞানিক।
কিন্তু সুচের ফুটায় স্থান আসলেই কম।সুতরাং সেখানে উটের প্রবেশ অযৌক্তিক।
এই দুটোর মাঝে মিল খুজে পাওয়া কেবল বিজ্ঞান জানায় ঘাটতিকেই প্রকাশ করে,কোনো মহিমা নয়।
(যদিও আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি উটের সুচের ফুটায় প্রবেশ শুধুমাত্র একটি অসম্ভব ঘটনার মেটাফোর। সর্বশক্তিমানের ক্ষমতা উদাহরন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এভাবে অনেক লং শটে মেলানোর চেষ্টা অনেকটাই হাস্যকর। বরং হিন্দু ধর্মে ব্ল্যাকহোলের আরও কাছাকাছি বর্ননা পাওয়া যায়। যেমন কৃষ্ণকে বলা হয়েছে সব আলো শোষনকারী। যেটা ব্ল্যাকহোলের জন্যে সত্য।এভাবে ডান বাম করে অনেক কিছুর সাথেই মেলানো যায় বিজ্ঞানকে। যদি কোনোদিন ধর্ম থেকে আগেই বলা হত ভবিষ্যত তত্বের কথা তাহলে বিষয়টি ক্রেডিবিলিটি পেত।কিন্তু সেটা কখোনই হয় না )
আমরা বিবর্তনের পথে উল্টোদিকে না হাটি। অন্ধ বানরায়ন না ঘটে আমরা উন্নততর মানুষ হয়ে উঠি এই প্রত্যাশা রাখছি।
চলবে।
(আমি প্লাস মাইনাস নিয়ে কখোনোই মাথা ঘামাই না। কারন আমি মুলত কবিতা লিখি। সুতরাং প্লাস মাইনাস কেবলই ভালো লাগা না লাগার দলিল। কিন্তু একটি বিশ্লেষন মূলক লেখায় মূলত মাইনাসগুলো গুরুত্ব বহন করে।কারন যারা প্লাস দিচ্ছেন তারা আংশিক বা সম্পূর্নভাবে পোস্টের সাথে একমত। কিন্তু নঞর্থকতার মানে হচ্ছে সম্পূর্নভাবে দ্বিমত পোষন করা। সুতরাং আমি তাদের যুক্তিগুলো শুনতে আগ্রহী। তাই মাইনাস দেবার সময় কারন বলাটা অন্তত বিশ্লেষনমূলক লেখায় উচিত।কেউ যদি না বলে মাইনাস দেয় আমি ধরে নিব হয় সে যুক্তিহীন অন্ধ এবং আয়োডিনের অভাবে বুদ্ধী প্রতিবন্ধী ,না হয় নিজের মত প্রকাশে সাহসী নয়। ধর্ম মানুষকে যদি কাপুরষতা শেখায় তাহলে খুব দু:খজনক।)