১৯৭১ এর দর্শক ছিলাম না আমি ।ঐ আলো আর আধার মেশানো সময় টা তে আমার বাবা ছিলেন ১০ বছরের একজন ছোট,অন্ধকার অনুধাবনে অক্ষম, মানুষ ।আর আমার ময়ের জন্ম হয়েছে ৭১ এর সেপ্টেম্বরে(এজন্যেই হয়ত আমার মা এত উজ্বল,৭১ এর সব আগুন মেশানো শক্তি তার জন্মে মিশে আছে) ।
আমার বড় চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন(ভুল বললাম,মুক্তিযোদ্ধারা কোনো অতীত ইতিহাস নন,তারা আমাদের অতীত,বর্তমান,ভবিষ্যত )।চান্দিনা অপারেশনে একটা সুচালো রাইফেল এর বুলেট,তার ডান বুকের পাশ ঘেষে গিয়েছিল ।আমি কখোনো এত সুন্দর ক্ষত দেখিনি ।সেই আলোঘেরা সময়টা নিয়ে চাচা যখন কথা বলেন, তার চোখ যেন নীলাভ স্বপ্নীল হয়ে উঠে ।মুরাদনগরে আর্মি ক্যাম্পে আক্রমনের সময় একরাত তাকে পাশের একটা ডোবায় কচুরীপানা মাথায় দিয়ে থাকতে হয়েছিলো ।সেই ডোবায় নাকি ছিলো বিশাল বিশাল জোঁক ।চাচা বলে জোঁক তো আর স্বাধীনতা বোঝে না,তাই মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত শুষে খেতে তাদের বিশেষ কোনো আপত্তি ছিলো না ।
৭১ সম্পর্কিত আমার আবেগ অনেকটাই ধার করা ।তবে সেই আবেগই আমি অনেক বেশি কেপে উঠি,কেপে কেপে উঠি ।ভালোবাসা জমতে থাকে স্তরে স্তরে ।
সৈয়দ শামছুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় পড়ে আমি ভীষন আপ্লুত হয়েছিলাম ।
নুরল দীনের সারা জীবন পড়ে মনে হয়েছিলো,৭১ সালে যে হাজার হাজার,লক্ষ লক্ষ নুরলদীনের জন্ম হয়েছিলো,তারা
আমার দেশটাকে সোনায় সোনায় আবৃত করে দিয়েছিলো ।
কিন্তু নষ্টদের আগ্রাসন দিনে দিনে বাড়ছেই ।
মাঝে মাঝে মনে হয়,সারা দেশ ভরে গেছে ঐসব রক্তচোষা জোঁকে!যারা দংশন করেছিলো ৭১,এখনও তারা দংশন করেই যাচ্ছে ।
আমি কখোনো ৭১ নিয়ে বিশেষ কিছু লিখি নাই ।কারন নিজেকে কখোনো ৭১ কে ধারন করার যোগ্য মনে হয় নাই ।
তবে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের কিছু অংশ পড়ে তীব্র আবেগ নিয়ে একবার একটা কবিতা লিখেছিলাম,৭১ নিয়ে আমি ,সেটা ছাড়া অসম্পূর্ন(কবিতাটা কলেজে থাকার সময় লেখা,প্রায় ৪ বছর আগে,ঐসময়ে লেখা সবলেখাই এখন আমার ভালো লাগে না,ফেলে দিয়েছি অধিকাংশ ,অপরিনত মনে হত ।তবে এইটা এখনও ভালো লাগে আমার ।)
১৯৭১
বাতাসে আগুন জ্বলছে,
অনাগরিক স্রোতে আকাশে,অবশ কম্পন ।
আগুন,ঘৃণা,অথবা নীল আকাশের বিরতিহীন সহবাস ।
সবুজ ঘাস,নদী,
নির্লজ্ব লালায়িত লাল লাভাস্রোতে ঢেকে যায় ।
চারদিকে আধপোড়া বিবেক,মৃতদেহ এবং সদ্যজাতের চিত্কার,
হিংসার নামে কদাকার মৃত্যু ।
অথবা কল্পনিক ন্যাচারাল ইকুলিব্রিয়াম ।
অন্ধকারটা যেন অন্ত:স্বত্তা !
আলোর অপেক্ষায় ছিলো সবাই,
আলোর অপেক্ষায় ছিলো অনেকেই ।
সেই ছেলেটি;
চোখে আকাশ হৃদপিন্ডে স্রোত নিয়ে,
অনন্তের মত আকস্মিকতা নিয়ে,
সোনালী সবুজ ঢেউ ওঠা ঘাসের মত,নদীর মত,কাব্যকে
ধারন করেছিলো বিশুষ্ক হৃদপিন্ডে ।
যার লাশ আজকাল,
শেয়াল শকুন অথবা কুত্তার নেশাতে ব্যস্ত ।
অন্ধস্রোতে লাশের অন্ধকার গন্ধ!
অথবা অতলান্তের মত সেই মেয়েটি!
যার শরীরে সোনালী ধানের শীষের মত গন্ধ ছিল,
যার সোনার রং এ,
শাদা শাপলার অকৃত্রিম স্পর্শ ছিলো ।
এখন সে,
ছিন্ন স্তন,ছেড়া তলপেট,বেয়নেট চর্জের ঘৃনা
আর কৃষ্ণশূন্যতার মত চোখ নিয়ে ভাগাড়ে বাসী ।
লাভাস্রোতে আকাশে ওড়ে,
সবুজ আগুনে পোকামাকড়ের আনন্দময় মৃত্যু ।
আমরা সোনায় জন্মাই ।
আকাশে আবার পুরাতন সূর্য,
কী যে লাল!!
এখনো,অসত্য,ঘৃণা,ভুলের মাঝেও,
জোছনায় ওড়ে মাতৃফুল ।