শিক্ষিত বাঙালী জীবনে একটি সরকারী চাকুরীর জন্য আকূলতা নতুন কিছু নয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে শুরু। মাস্টার্স শেষ করার আগ থেকেই চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি। আজো পর্যন্ত সরকারী চাকরি নামের সোনার হরিণের দেখা পেলাম না। আজকাল তো পরীক্ষা তিন স্টেপে হয়। প্রথমে প্রিলি, দেন রিটেন, শেষে ভাইভা ভোক। ভোক আমার ভোগে চলে যায়। প্রথম দুই ধাপ পেরোনো পর্যন্ত আমার যোগ্যতা। তৃতীয় ধাপ পেরোতেই পারলাম না। আর সরাসরি টাকা পয়সাও কেউ চায় না দালালদের হাতে টাকা দিতে সাহসে কুলায় না। এদিকে আক্ষরিক অর্থে কপালটা দিন দিন চওড়া হয়ে যাচ্ছে।
২৮ আগস্ট ২০১৫। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে পরীক্ষা। দশটায় পরীক্ষা শুরু। আমাকে সকাল সাতটায় রওনা দিলাম। রাস্তায় জ্যামের কথা তো বলা যায় না। দূর্ভাগ্য বলতে হবে। আজ রাস্তায় কোন জ্যামই নেই। সাড়ে আটটায় পৌঁছে গেলাম মিরপুর ১ এ। সিট পড়েছে হযরত শাহ আলী ডিগ্রি কলেজে। গেট তো সাড়ে নটার আগে খুলবে না। এই এক ঘন্টা আমি কোথায় গড়াগড়ি খাই! অনেককেই দেখা যায় এই সময়ে কারেন্ট এফেয়ার্স টাইপের চটি সাইজের বইগুলোর উপর উপুড় হয়ে পড়তে। চাকরীর পরীক্ষার না থাকে সিলেবাস না থাকে পরিধী। এরা করতে পারে না এহেন প্রশ্ন নেই। যে প্রশ্ন করে তাকে যদি ঐ একই প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা দিতে বসিয়ে দেওয়া হয় আমি শিওর সে ৫০% আন্সার দিতে পারবে না। যতসব বইয়ের কোনা কুঞ্চি ঘেঁটে আখাস্তা প্রশ্ন করে। কলেজের সামনের নাম ফলকে লেখা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ আর আমার প্রবেশ পত্রে লেখা ডিগ্রি কলেজ। জনৈক পথচারীকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম এটাই আমার কাঙ্খিত শিক্ষ্যালয়। গেটে টাঙানো সিট প্লান থেকে রোল নাম্বার মিলিয়ে দেখে রূম জেনে নিলাম। ৩০৮ নম্বর রুম। অনেককেই দেখা যায় রোল নাম্বার দেখার পরে সিট প্লানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। মনে হয় পরীক্ষা শুরুর আগে কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে থাকা যেন নেকীর কাজ। রোদের উত্তাপ থেকে বাঁচতে পাশের গলিতে ঢুকলাম। ডান হাতে মার্কেটের সিড়িতে সারি বেঁধে বসে পরীক্ষার্থীরা সব পড়ায় ব্যস্ত। আমি পকেটে হাত গুঁজে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। শাহ আলীর মাজারের চূড়ো দেখা যাচ্ছে। সামনে মনে হচ্ছে একটা গেট আছে। গেট দিয়ে আমি মাজারে ঢুকে গেলাম। শুরুতেই বলে রাখি আমি মাজার ভক্ত টাইপের কেউ নই। জাস্ট উৎসুক একজন দর্শক হিসেবে প্রবেশ করলাম। নেকী লোভী ভক্ত হিসেবে নই। মাজার মানেই তো এক গাদা দান বাক্স, ভিক্ষারী আর পাগলের ভিড়। কেউ ভবের পাগল আর কেউ বা ভাবের পাগল। ঢুকতেই পাগলা কিছিমের এক লোকের দেখা পেলাম। পরণে শুধু পায়জামা। খালি গা, খালি পা। শীর্ণদেহ। বাম হাতের কব্জিতে লাল রঙের কাপড়ের ফুল বাঁধা। ডান হাতে একটা প্লেট। একটা দশ বারো বছরের ছেলেকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দিতে জুতো রাখার বক্সের দিকে এগিয়ে গেলো। হাতের থালা থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট উড়ে ইট বাঁধানো ফ্লোরের উপর পড়লো। একটা মেয়ে টাকাটা কুড়িয়ে আবার তার প্লেটে দিলো। লোকটা গালি দিয়েই যাচ্ছে। আর ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হাসছে। বোঝা যাচ্ছে এরা এগুলোর সাথে অভ্যস্থ। মাজারের বারান্দায় খাদেম টাইপের একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমি মাজার বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মাজারের কোল ঘেষে ডান পাশে বিশাল তিন তলা মসজিদ। দুজন মুসল্লী চুপচাপ বসে আছে। মাজার ঘরের সামনে বড় একটা গাছ। কি গাছ জানিনা। চিনতে পারলাম না। গোল করে বাঁধানো। একটা টিনের প্লেটে লেখা শিন্নি গাছের নিচে দুধ ঢালবেন না, আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালবেন না। সাধারনত মাজারে এই ধরণের নির্দেশিকা দেখা যায় না। পাশের শিন্নি ডেকচি রাখা। বিশাল পেতলের হাঁড়ি। আমি হাঁড়িটার কাছে এগিয়ে গেলাম যে এতে শিন্নি রান্না হয় কিনা। আসলে এটা একটা দান বাক্স। হাঁড়ির মুখে ঢাকনার বদলে বিশাল এক লোহার গ্রিল লাগানো। মধ্যে অজস্র টাকার নোট। পাশে খাঁচার মধ্যে অনেকগুলো মোরগ রাখা। খুব সম্ভবত মানতের মোরগ এগুলো। ঘুরে ঘুরে দেখছি। মাজার প্রাঙ্গনের পুরোটা ইট বিছানো এবং কয়েক ধাপে করা হয়েছে। স্থ্যাপত্যবিদের ডিজাইন আমার ভালো লেগেছে। অদূরে একটা বটগাছ। বটতলায় নানান ধরণের মানুষ বসে আছে। মাজারে যে ধরণের মানুষ সচরাচর দেখা যায়। একটা লোক হুস হুস করে বটগাছের কাক তাঁড়াচ্ছে। কাক তাড়িয়ে সে ওখানে পুরোনোর খবরের কাগজ পেতে বসলো। এমন সময়ে দ্বিতীয় গেটের সামনে বাদ্যের আওয়াজ পাওয়া গেলো। আমি ওদিকে এগিয়ে গেলাম। সেই পাগল লোকটা বাদ্যের তালে তালে নাচছে। পেছনে কয়েকজন সাধারণ পোষাকের মহিলা। পেছনের তিনজন বাদ্যকর। একজনের হাতে ঢোল, অন্যজনের হাতে ঝুনঝুনি। তৃতীয়জন কাঁশি বাজাচ্ছে। পাগল লোকটা ছুটে এসে শিন্নি গাছকে নমস্কার করলো। বাদকরদের সামনে দুজন মহিলা। একজন মধ্যবয়সী অন্যজন প্রায় পৌঢ়া। আর একজন কিশোর। কিশোরের গলায় কাগজের মালা। কুরবানীর সময়ে এখনকার দিনে যে মালা পরানো হয়। তারা সবাই বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগলো। বাঁশি, ঢোলের আওয়াজ ঘন হয়ে উচ্চগ্রামে বাজছে। হঠাৎ মহিলা দুজন নাচতে শুরু করলো। পাগল লোকটাও নাঁচছে। নাচের তালে তালে তার থুঁতনীর নিচে ছাগুলে দাঁড়িও লাফাচ্ছে। নাচের চোটে মহিলাদের শাড়ি আলুথালু হয়ে গেছে। সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। কে যেন খই বাতাসা ছুড়ে মারছে। উপস্থিত হাতে গোনা গোটা দশেক মানুষের জটলা। হাতে হাতে দিলেই পারতো। আজকাল তো আর কেউ মাটি থেকে কুড়িয়ে খায় না। ইটের মেঝে কিছু আগে পানি ছিটিয়ে ধুয়ে গেছে পরিচ্ছন্নতা কর্মীগণ। ওখান থেকে কুড়িয়ে খাওয়ার অবস্থাও নেই। মসজিদের সামনে ঢোল বাজিয়ে নাচ, হোক সে মাজারের মসজিদ, আমার কাছে বিষয়টা অভূতপূর্ব। পৌঁঢ়া মহিলা নাচ সাঙ্গ করে সিন্নি গাছের নিচে গিয়ে গাছকে ঘিরে রাখা রেলিংয়ের গায়ে চুমু খেলো। বাজারের এরকম হাজার রেলিং আছে। কেউ চুমু খাবে না। কিন্তু মাজারে এনে রাখলে দেখা যাবে চুমুতে চুমুতে রেলিং মসৃণ হয়ে গেছে। সবই বিশ্বাসের লীলাখেলা। এবার অপেক্ষাকৃত কম বয়সী মহিলাটি মাজারের সামনের সিড়িতে গিয়ে মাজারকে সিজদা করলো। আমি তখনও কৌতূহলী হয়ে সব লক্ষ্য করছি। না মেয়েটার শাঁখা সিঁদুর নেই। মুসলিমই হবে। কিন্তু ইসলামে কোন মানুষকে সিজদা করা এলাউ করে হোকনা সে যতই পূজ্য। বারান্দায় একদল লোক দাঁড়িয়ে মিলাদ পড়ছে, ইয়া নবী সালা মালাইকা, ইয়া রসুল সালা মালাইকা। আমাদের এলাকায় মিলাদ খুবই কম পড়া হয়। আর মিলাদ পড়া হলেও দাঁড়ায় না। এই অঞ্চলে এসে মিলাদে দাঁড়ানো দেখেছি। এরা বিশ্বাস করে মিলাদে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম পড়ার সময়ে নবীজী এসে মিলাদে শরীক হন তাই তারা দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান করেন। আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে আরে হতচ্ছড়ার দল একটু আগে যে তোরা মহান রব্বুল আলামিনের নাম করলি। তখন দাড়ালি না কেন? তবে কি তোরা খোদার চেয়ে খোদার ম্যাসেঞ্জারকে বেশী সম্মান দেখিয়ে ফেললি না? না এই প্রশ্ন কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় না। করার দরকার নেই। কারণ মিলাদ ইসলামের কোন অংশ নয়। এটা সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে। পাগল লোকটা দৌঁড়ে এসে মহিলা দুজনকে বললো যাও যাও মিলাদে শরীক হও। খাদেম লোকটা এগিয়ে এসে দাঁত মুখ খিচিয়ে পাগল লোকটাকে সেখান থেকে তাঁড়িয়ে দিলো। লোকটা মনে হয় খাদেমকে ভয় পায়। অনেকটা লেজ গুঁটিয়ে কুই কুই করে পালিয়ে গেলো। একটা ভিখারি আমাকে থেকে থেকে জ্বালাতন করছিলো। স্যার দুডো টাকা দেন খাবো। আমি প্রথম দুই বার যাও যাও করে তাড়িয়ে দিলাম। অতটা পূণ্যলোভী আমি নই। আমি জানি ভিক্ষাবৃত্তিকেই এরা পেশা হিসেবে নিয়েছে। এদেরকে দান করার কোন মানে নেই। তৃতীয় বার আমি মানিব্যাগ ঘেঁটে ঠিকই দুই টাকা ধরিয়ে দিলাম। লোকটা টাকা হাতে নিয়ে অপ্রসন্ন মুখে বললো, দুই টাকাই দিলেন! মামা বাড়ির আবদার আর কাকে বলে। আমি প্রাঙ্গনে হাঁটতে লাগলাম। একটা লোকা বাম হাতের তালুতে শিন্নি নিয়ে ডান হাতে খেতে খেতে যাচ্ছে। লোকটার চেহাড়ায় গাঁজা খাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। একটা লোক আমাকে জিজ্ঞেস করলো ভাই কয়টা বাজে। ঘড়ি পরা কাউকে দেখলে একদা মানুষের সময় জানতে চাওয়ার বেশ প্রবল ছিলো। লোকটির সময় জানতে চাওয়া দেখে সেটা মনে পড়ে গেলো। না আর বেশী সময় নেই। ফিরতে হবে। ফেরার পথে দেখলাম কিছু ভক্ত আসছে। তিন চারজন মহিলা। একজন আবার বোরখা পরা। একটা ছেলের হাতে কয়েকটা মুরগী। মেয়েটা মুরগী নিয়ে ঝুঁড়ির মধ্যে রাখছে। আর ছেলেটা মোবাইলে সেই ছবি তুলছে। আমার ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুঁটে উঠলো। দ্বিতীয় গেটের ভেতরের বাম পাশে শাড়ির মত ধুতি পরা একজন মানুষ পসার সাজিয়ে বসেছে। কৌঁটার মধ্যে কি সব। একাই বসে আছে। আমাদের দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলো। সেও কিছু বললো না। আমিও কিছু বললাম না। মেয়েদের মত চুলওয়ালা লোকটার একটা জিনিস নজর কাড়লো। হিটলারের বিখ্যাত টুথ ব্রাশ গোঁফ ছিলো। নাকের গোঁড়ায় ব্রাশের সাইজের গোঁফ। আর এই লোকটার সব গোঁফ আছে শুধু ঐ ব্রাশের সাইজের জায়গাটুকু শেভ করা। এ বুঝি কোন উলটো হিটলার। গেট পেরোতেই একটা লোক সালাম দিলো। আমি ভ্রুক্ষেপ না করে হেঁটে যেতে শুরু করলাম। লোকটা আমার পিছে হাঁটা শুরু করেছে। আমি জোরে হেঁটে রাস্তা পেরিয়ে গেলাম। মাজারে বহুজাতের ধান্দাবাজ দেখেছি আমি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:২৭