ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার খবর পাই সকালে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে। আমার বাড়িতে কোন টিউশনি মাস্টার ছিলো না। ক্লাস এইটে ওঠার পরে ব্যাচে স্যারের কাছে পড়তে যেতাম বিকেলে স্কুল ছুটির পর। ঘন্টা দেড়েক পড়াতেন তিনি। ম্যাথ আর ইংরেজী। নাইনে উঠে সাইন্স নিলাম। হায়ার ম্যাথের জন্য আরেকজন স্যারের কাছে পড়া শুরু করলাম। আমাদের স্কুলেরই স্যার। অতিশয় রাশভারী এবং গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। ছাত্ররা তাকে জমের মত ভয় পেতো। আমিও পেতাম। তার সাথে কথা বলতে আমার হাটু কাঁপতো, কলিজা কাঁপতো। এখনকার দিনের মত মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ছিলো না। স্যারের কাছে প্রথম খবরটি পেলাম। অর্থাৎ স্যার খবর পেয়েছেন আগের দিন সন্ধ্যায়। স্যারের কাছে খবর না পেলে স্কুলে যাওয়ার পরে জানতে পারতাম। এটাই স্বাভাবিক ছিলো। স্যারও অবাক হয়েছিলেন। আমার মত গর্দভ টাইপের ছেলে কিভাবে বৃত্তি পায়। উনি যাদের নিয়ে আশাবাদী ছিলেন তাদের কয়েকজন সাধারণ বৃত্তি পেয়েছে। তাদের জন্য একটু দুঃখ করলেন।
এক অন্যরকম ভালো লাগা আচ্ছন্ন করে ফেলে আমাকে। স্যার কি পড়াচ্ছেন কিছুই মাথায় ঢুকছে না। একসময় স্যারকে বললাম, স্যার আমি চলে যাবো। স্যার বললেন, এতক্ষণ যে যাস নাই তাই অবাক হচ্ছি। যা।
পুরোটা পথ কিভাবে এলাম বলতে পারি না। পাখির মত উড়ে এসেছিলাম মনে হয়। আম্মাকে খবরটা দিতে হবে। আব্বার বদলির চাকরি। বদলি করে দিয়েছে উত্তরের জেলা সৈয়দপুরে। একটা প্রমোশান পেয়েছেন বলে আছেন ওখান। ফিরে আসার খুব চেষ্টা তদবির করছেন। বাড়িতে এসে দেখি আম্মা কলপাড়ে সকালের বাসি একগাদা থালা বাসন মাজতে বসেছেন। সিনেমায় নায়কের বাচ্চা কালের অভিনয় করা কিশোরেরা এরকম সুময়ে পেছন থেকে মায়ের চোখ চেপে ধরে। কিন্তু আমি সিনেমার নায়ক নই। চোখ চেপে ধরা তাই হলো না। একটু অভিনয় করতে ইচ্ছে হলো। কলপাড়টাকে আড়াল করার জন্য বাঁশের বেড়া দিয়ে তার উপরে সুপারি পাতা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি খুঁটি ধরে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আম্মাকে ডাকলাম। আম্মা ভাবলেন স্কুলে যাবো বলে ভাত চাইছি। তিনি বললেন, থালা গ্লাস ধুয়েই তিনি ভাত দিচ্ছেন।
আমি বললাম, বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে।
আম্মা গ্লাস মাজতে মাজতে জানতে চাইলেন, কার কি খবর?
আমি একে একে অন্য সবার কথা বললাম। নিজেরটা বললাম না। দেখি আম্মা কি বলেন।
আম্মা কিছুই বললেন না। তিনি নির্লিপ্ত মুখে থালা গ্লাস মেজেই চলেছেন। আমার দিকে পেছন ফিরে বসা বলে আমি মুখ দেখতে পেলাম না। নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। বললাম, আমি বৃত্তি পেয়েছি। তাও ট্যালেন্টপুলে।
আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে সুখের খবর কম আসে। অল্প যা আসে তাই আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আম্মা কেঁদে ফেললেন। তিনি কি করবেন বুঝে উঠে পারলেন না বলে মনে হলো। কাঁদতে কাঁদতে তিনি পুকুরের অপর পাড়ের প্রতিবেশীনীকে ডেকে বললেন, আপা শুনেছেন আমার বড় ছেলে ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। প্রতিবেশীনীকে আমি খালাম্মা বলে ডাকি। তিনি অনেকটা মাইক টাইপের। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকাকে তিনি আমার বৃত্তি পাওয়ার খবরে সচকিত করলেন।
আমি গামছা খানা কাঁধে ফেলে পুকুরে গোছল করতে গেলাম। বাঁশের মাঁচার ঘাট ছিলো। আশপাশের বাড়ির অনেকেই এগিয়ে এলেন। তখন বাড়ি বাড়ি এত ঘেরা বেড়া ছিলো না। ইচ্ছে করলেই একবাড়ির ওপর দিয়ে এ বাড়ি ওবাড়ি চলে যাওয়া যেতো। পুকুর ঘাটে এসে সবাই আমাকে কনগ্রাচুলেশান, অভিনন্দন বললো তা কিন্তু নয়। এ রীতি বড় মেকি। সবাই আমাকে আরো ভালো করে পড়াশুনা করার উপদেশ দিয়ে গেলেন।
গোছল সেরে এসে খেতে বসলাম। কি দিয়ে খেয়েছিলাম ঠিক মনে পড়ছে না। বাঙালীজীবনে বিশেষ ব্যতিক্রম বাদে প্রতিদিনকার সকালের খাবারের মেন্যু একই ধরণের হয়। আজ চৌদ্দ পনের বছর বাদে সেদিনের খাবারের আইটেমের কথা মনে করতে যাওয়া মানে শুধুই চিন্তা সার। আম্মা অধিকাংশ সকালে আলু ভর্তা দিয়ে ভাত রাঁধতেন। যাতে স্কুলে যাওয়ার আগে আমরা গরম ভাত খেয়ে যেতে পারি।বাড়িতে পালা কয়েকটা মুরগী আছে। মাঝে মাঝে ডিম ভাজতেন। ভাত খেয়ে আমরা দুই ভাই স্কুলে যেতাম। আমি হাই স্কুলে, ছোট তখন প্রাইমারীতে পড়ে। ক্লাস টু কি থ্রিতে। খাওয়া সেরে স্কুলের ড্রেস পরে স্কুলের পথ ধরলাম। খবরটা তো বন্ধুদেরকে জানাতে হবে!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৫ ভোর ৪:১৭