এই এলাকায় এসেছি বছর তিনেক। সপ্তাহে চার পাঁচ দিন হাঁটতে বের হই। বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। স্থানীয়দের সাথে তেমন যোগাযোগ হয় নি। এই হাতে গোনা কিছু দোকানদারদের সাথে চেনা জানা হয়েছে। কেনাকাটা, খাওয়া দাওয়ার খাতিরে আর কি। কাঁচা বাজার আমার জীবনের এক অজানা অধ্যায়। তোমরা হয়তো কেউ খেয়াল করো নি আমি কখনো বাজার করা নিয়ে স্ট্যাটাস দেই না। বাজারে আমার সেভাবে কখনো যাওয়া লাগেনি। বাড়িতে আব্বা নিজেই বাজারে যান। বাড়িতে ফ্রিজ আসার আগেও যেমন এখনও তেমন। তিনি ফ্রিজে মাছের লাশ রেখে খেতে রাজি নন। ব্যাগ হাতে বাজারে ঘুরবেন। লাফানো ঝাঁপানো নদীর মাছ কিনবেন। মেস লাইফে মনে হয় টাকা মারার সুবর্ণ সুযোগ ছিলো। কারণ আমি দেখেছি সবাই মহা উৎসাহে বাজারে যায়। আমি যে যেতে চাই না তা নিয়ে কোন প্রতিবাদ সমাবেশ, মিছিল কিছুই হতে দেখিনি। হাতে গোনা কয়েক দিন গেছি বাজারে অন্যের সাথে। সেও ঐ ব্যাগ ধরা পর্যন্ত। এরপর তো চাকরি পেলাম মেঘনা পাড়ের এই বাজারে। এখানকার একটা সুবিধা হলো থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা সবই কোম্পানী করেছে। খাওয়ার জন্য মাস শেষে টাকা দিলেই চলে। কষ্টের মধ্যে এটুকু করতে হয় টেবিলে বসে প্লেট আর গ্লাসখানাকে পানি দিয়ে একটু ধুয়ে নিতে হয়। এখানে রুম সার্ভিসও ফ্রি। সপ্তাহে একবার রুম ঝাড়ু দিয়ে মুছে যায় এক মহিলা। টয়লেট সাফ করে যায় একজন। প্রতি পনেরো দিনে বালিশের ওয়ার, বিছানার চাদর বদলে দিয়ে যায়। জীবনটা মোটামুটি নিরিবিলি চলে যাচ্ছে আর কি।
ওহ একটা সময়ে আমাকে কিছুদিন বাজারে যেতে হতো। সপ্তাহে একদিন। প্রতি বুধবার আমাদের এলাকায় সাপ্তাহিক হাট বসতো। আব্বা সরকারী চাকরি করেন। তাকে উত্তরবঙ্গে বদলি করে দেয়া হলো। রংপুরেরও ওপাশে। সৈয়দপুরে। তখন ডেমার, ডুমলা, নীলফামারী কত্ত নতুন নতুন জায়গার নাম জানা হয়ে গেলো। বছরের মাঝামাঝি সময়। ক্লাস নাইনে পড়ি। স্কুলের রেজাল্ট ভালো। ফার্স্ট হই। আম্মা আমাদের পড়াশোনার জন্য এলাকায় রয়ে গেলেন। ভাড়া বাড়িতে আম্মা এবং আমরা দুই ভাই থাকি। তখন তো আর মোবাইলের যুগ না। আমাদের দুটি ভাইকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকতে আমার মহা ভীতু আম্মা যে কিনা সামান্য কল্পিত কারণেও টেনশানে পড়ে যায়, কি পরিমান সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তা তখন না বুঝলে এখন বুঝি। সন্তানের জন্য মায়েরা, বাবারা যে কি পরিমান ছাড় দেন তা আমাদের বুঝতে অনেক সময় লেগে যায়। সেই সময়টাতে আমাকে সপ্তাহে একদিন বাজারে যেতে হতো। আম্মার বানানো কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বাজারে যেতাম। একশো দুইশো টাকার বাজারে ব্যাগ ভরে যেত। ২০০০ সাল। বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব মাইল খানের হবে। ভারী ব্যাগ নিয়ে বাড়ীর পথ ধরতাম। হাতে দাগ বসে যেতো। হাঁটের অনেক দোকানদারের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। এক দোকানদারের চেহারা মনে পড়ে না। কিন্তু তার কথা মনে পড়ে। কত তার বয়স। ত্রিশ পঁয়ত্রিশের মত ছিলো। আমার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করতো। অন্যদের থেকে কম দামে জিনিস পেতাম। বলতো আমাকে সে খুব পছন্দ করে। আমাকে তাদের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাবে। নতুন জায়গা বেড়াতে যাওয়ার আগ্রহ আমার মধ্যে জেগে ওঠে। আম্মাকে বলি। আম্মা রাগ করেন। বলেন ছেলে ধরা হবে। খবরদার যেন কোনদিন তার সাথে না যাই। ক্লাস নাইনে পড়া ছেলেকে ছেলে ধরার ভয় দেখানো কতটা যুক্তিসংগত ছিলো বলাই বাহুল্য। কিন্তু আমি কখনো আম্মার কথা ফেলতে পারি না। আবার কখনো ফেলিনি এমনও নয়। আম্মা কাঁদতে শুরু করলেন। আমার আর সেই লোকটার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হলো না।