বিকেল বেলা ঘুরতে বের হওয়া আমার অনেক দিনের অভ্যাষ। এখনো বের হই। চাকরিতে শিফটিং ডিউটির জন্য সপ্তাহে পাঁচটি বিকেল বের হতে পারি। দুই দিন কাটে অফিসের বদ্ধ রুমে। এসির হাওয়া শীতলতা দিতে পারে কিন্তু নদীর পাশ ঘেঁসে বয়ে যাওয়া বাতাসের মত আন্তরিক ভালো লাগা দিতে পারে না। তখন আমি ঝিনাইদহে আমি থাকতাম পাগলা কানাই মোড়ে। ২০০৬ সালের দিকে। অনেকটা মফস্বল এলাকা। বাসার কাছেই একটা মাঠ ছিলো। একলা বিকেল গুলো সবুজ ধান খেতের পাশে বসে কাটাতাম। মোবাইলে থাকা গানগুলো বারবার শুনতাম। তখন থেকেই মূলত আমি রবীন্দ্র সংগীতের প্রেমে পড়ি। মনে হত রবীন্দ্রনাথ গান গুলো শুধু আমারই জন্য লিখে গেছেন। বিশেষ করে এই গানটা বেশী শুনতাম , আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে...
একজন সঙ্গী সাথী পেলেই ঘুরতে বের হয়ে যাই। পাগলা কানাই রোড ধরে গ্রামের ভিতর চলে যাই। গাছপালা ঘেরা নিবিড় এক গ্রাম। ঢোল সমুদ্র দীঘি এই পথেরই বাঁকে অবস্থিত। ঢোল সমুদ্র দীঘিতে প্রথম যাই রুমমেট শাহিনের সাথে। এই জীবনে অনেককে পেয়েছি রুমমেট হিসেবে। অনেকের কথা ভূলে গেছি। কিন্তু দুই তিনজন রুমমেটের কথা আমি হয়তো কখনো ভূলতে পারবো না। তাদের স্বার্থপরতার জন্য। শাহিন হলো আমার প্রথম কোন স্বার্থপর রুমমেট। নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সে এক চুল ছাড় দিতে রাজি হত না। অপ্রয়োজনীয় স্বার্থটুকু আদায় করতে সে যে কি করত তা মনে পড়লেও আজো আমার হাসি পায়।
শাহিন আর আমি দুজন মিলে হেটে চলে যাই ঢোল সমুদ্রের দীঘির পাড়ে। ঝিনাইদহ সদর থেকে ঢোল সমুদ্র দীঘি ৪/৫ কিলোমিটারের মত হবে। আমার বাসা থেকে তিন কিলোমিটারের মত পথ। গল্প করতে করতে চলে যেতাম। ৫২ বিঘা জমির উপর বিশাল দীঘি। দীঘির টলটলে জলের দিকে চেয়ে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। পাড়ে নানান প্রজাতির গাছে। গাছের ছায়ায় বসে থাকতাম। কে কবে এই বিশাল দিঘী খনন করিয়েছিলো জানিনা। শাহিনের কাছ থেকে জানতে পারলাম মুটুক রাজা নামে কোন জমিদার এই দীঘিটা খনন করেন।
আমি জানতাম না আমি একটা ঐতিহাসিক স্থানে বসে আছি। মুটুক নয়, মুকুট রায় নামে এই স্থানে দিল্লী সালতানাতের যুগে এক রাজা ছিলেন। তিনি খুব জনহিতৈষী রাজা ছিলেন। প্রজাদের জলকষ্ট নিবারণে তিনি এই বিশাল দীঘিটা খনন করেন।
জনশ্রুতি আছে রাজা পানির জন্য এই বিশাল দীঘি খনন করেন। মাটিয়ালরা দিনরাত মাটি কেটে চলেছে। দীঘির গভীরতা বাড়ে কিন্তু পানি ওঠে না। স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রানী পূজা দিতে পুকুরের মাঝে নামলেন। ইষ্টদেবতাকে স্মরন করা মাত্র পুকুরে পানি উঠতে শুরু করলো। প্রজারা উচ্চ্বসিত আনন্দে ঢোল বাদ্য বাজিয়ে উল্লাস করতে লাগলো। ঢোলের আওয়াজে রানীর চিৎকার কেউ শুনতে পেলো না। সবার অলক্ষ্যে রানী দীঘির জলে তলিয়ে গেলেন।
রানীর স্মৃতিকে স্মরন করতে দীঘির নাম রাখা হলো ঢোল সমুদ্র দীঘি। মুকুট রায় প্রতাপশালী রাজা ছিলেন। তার বিশাল গোশালা ছিলো বাড়ীবাথানে , বেড়বাড়ীতে ছিলো বাগান বাড়ী, তার কোড়াদারেরা থাকত কোড়াপাড়ায়। ঝিনাইদহে এখনো বেড় বাড়ী, কোড়াপাড়া, বাড়ীবাথান এখনো বর্তমান।
মুকুট রাজার আরো একটি ঘটনা আছে। দ্বিল্লীশ্বর মুকুট রাজার বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। মুকুট রাজার বাহিনীর কাছে দিল্লীর সেনাবাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। মুকুট রাজা আনন্দে অভিভূত হয়ে তার একজন সৈন্যকে কালীর মন্দিরে বলি দিতে আদেশ করেন। এতে তার বাহিনীর পাঠান সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে দিল্লীর বাহিনীতে যোগ দেয়। এরপরে দিল্লীর বাহিনীর হাতে মুকুট রাজা পরাজিত ও বন্দী হন। দিল্লীর শাসক রাজার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকেমুক্তি দেন। রাজা বাড়ি ফিরে দেখেন সম্ভাব্য পরিনতি চিন্তা করে রাজকন্যা, রানী, রাজ পুরোহিত আত্মহত্যা করেছে। তার কন্যার আত্মহত্যার স্থান কন্যারদহ, স্ত্রীর আত্মহত্যার স্থান দুই সতীনে এবং পুরোহিতের আত্মহত্যার স্থান দৈবজ্ঞদহ নামে আজো পরিচিত।
সূর্য্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। এবার ফেরার পালা। ঢোল সমুদ্র দীঘির পাড় থেকে নেমে আসি। সতেজ মন নিয়ে পাগলা কানাই মোড়ের দিকে হাঁটা শুরু করলাম
আমার নিজস্ব ব্লগঃ http://www.frahaman.com
বেড়াতে আসতে ভূলবেন না কিন্তু।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:৫৮