চলার পথ ছিল বন্ধুর। বেশির ভাগ রাস্তা ই এবার থেবড়ো। সারারাতের জার্নি আর দুপুরের পেট পূর্তি খাবার এ দুয়ের অসাধারণ সংমিশ্রনে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসতে লাগলো। সি এন জি'র চরম ঝাকুনি সত্ত্বেও ঝিমুচ্ছিলাম। পথে একজায়গায় গাড়ি নষ্ট হয়ে যায় , ফলে প্রায় ২০ /২৫ মিনিট রাস্তা ধরেই হাটা হাটি করে নিলাম, চা খেলাম, কিছু ছবিও তুলেছিলাম। আঁকা বাঁকা পিচঢালা রাস্তাকে ঘিরে রেখেছে দুপাশের লম্বা গাছের সারি। পড়ন্ত দুপুরের নিস্তব্ধতা অন্যরকম প্রশান্তি ঢেলে দিচ্ছিলো।
এক বিশাল প্রান্তরের মধ্য দিয়ে আঁকা বাঁকা মেঠো পথ ধরে বেশ কিছুক্ষন চলে একটা ছোটোখাটো ছাউনি সহ সামান্য লোকসমাগমপূর্ণ একটা স্থানে এসে থামলো আমাদের সি এন জি। দুপুরের খাঁ খাঁ রোদে গাছপালাহীন কর্দমাক্ত এক পরিবেশ দেখে মনের মাঝে অপ্রত্যাশিত ভাবে একটা ধাক্কাই খেয়ে ফেললাম। কাঁদার মধ্যে সারিবদ্ধ কিছু নৌকা দাঁড় করানো দেখলাম। মনের মধ্যে রাতারগুলের শান্ত শীতল ও সবুজ এক ছবি ধারণ করে এসে এমন কর্দমাক্ত পরিবেশ দেখতে পাওয়া পুরোপুরি ই অনাকাঙ্খিত ছিল, সাথে যোগ হলো মাঝি সিন্ডিকেট সদস্যদের আকাশছোঁয়া ভাড়া। একবার ভাবলাম চলেই যাই, আবার ভাবলাম - এসেছি যখন দেখেই যাই। অনেক দর কষাকষি করে একটা ছোট নৌকা নিয়ে কাঁদার ভেতর দিয়েই রাতারগুল যাত্রা শুরু করলাম।
প্রথম কিছুক্ষন কাঁদা পানির উপরেই নৌকাটাকে ঠেলে নিয়ে গেলো মাঝি। এক ঝাঁক ব্যাঙের পোনা কাঁদা পানিতে লাফালাফি করছিলো। কিন্তু যতই ভেতরে যাচ্ছিলাম ভালো লাগা কাজ করছিলো। যদিও পানি ছিল ঘোলা তথাপি হিজল আর তমাল গাছের ফাঁক গলিয়ে যখন আমাদের নৌকাটা এগোচ্ছিল অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করছিলো। বর্ষা শেষ হয়ে যাওয়াতে পানি ঘোলা, তা না হলে বর্ষায় এখানকার পানি থাকে আয়নার মতো স্বচ্ছ। মাঝির কাছ থেকে আরো যা জানতে পারলাম - বর্ষা মৌসুম ছাড়া এখানে কৃত্রিম ভাবেই বাঁধ দিয়ে পানি সংরক্ষণ করা হয়। গুইসাপ, ব্যাঙ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, পাখি এবং বানরের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র এই বন টি।
কিছুদূর এগিয়ে দেখতে পেলাম প্রায় ছয় তলার উচ্চতা সম্পন্ন একটা ওয়াচ টাওয়ার। নৌকা ভিড়িয়ে উঠে পড়লাম একদম চূড়ায়। পুরো বন এখানথেকে দেখা যায়। এক পাশে দেখতে পেলাম চিল টাইপের পাখিদের জটলা, আবার আরেক পাশে দেখলাম কয়েকটা বানর শোরগোল করছে। ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে রাতারগুলের পুরো ভিউটা মন ভালো করে দেবার জন্য যথেষ্ট।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে - বিছানাকান্দির টুরিস্ট গ্রুপের সাথে এখানেও আবারো দেখা হয়ে গিয়েছিলো। ওয়াচ টাওয়ারের ওখানেই ওদের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ। দুটি পাশাপাশি নৌকায় ঘুরে বাকি পথটুকু ঘুরে রাতারগুল পাঠ চুকিয়ে পুনরায় শাহবাজ মিয়ার সি এন জি তে চড়ে বসলাম। এবার হোটেলে ফেরার পালা।
চলতে চলতে চোখে পড়ছিলো উঁচু নিচু টিলা, চা বাগান, গ্রাম্য হাট আর ডুবন্ত সূর্য। একটা হাটে নেমে চা আর বিস্কিট খেলাম। পথে একটা চা বাগানে নেমে ছবি তোলার ব্যর্থ চেষ্টা চালালাম যদিও তখন মাগরিবের আজান পড়ছিলো।
হোটেলে এসে ফ্রেশ হয়ে শহরের মধ্যেই কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করেই রাতের খাবার সেরে ফেললাম। তারপর গেলাম হযরত শাহজালাল (র এর দরগায়। ঘুরলাম, জিয়ারত করলাম। বাইরে থেকে কিছু কদমা, তিলের নাড়ু কিনে নিলাম। চোখে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে ঘুমোতে গেলাম। পরদিন ভোরেই যে রওয়ানা দিতে হবে জাফলং এর উদ্দেশ্যে। ........................চলবে।
[বি: দ্র: ট্যুরের এ পর্বের খরচাপাতি :
** রাতারগুলে নৌকা ভাড়া ১০০০/১৫০০ টাকা চাইলেও অনেক দরদাম করে ৬৫০ টাকায় ঠিক করা হয়েছিল।]
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৪৪