কলকাতা এক আজব শহর। আজব বলছি এই কারণে যে - সবাই যেখানে আধুনিকতার দিকে ধাবমান এবং পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যস্ত, সেখানে কলকাতা বেশ অনেক ক্ষেত্রেই সংরক্ষনশীলতার পরিচয় বহন করে চলছে। তাদের এমন ধ্যান ধারণার প্রাথমিক ধারণাই আমি পেয়েছি বেনাপোল বর্ডার ক্রস করেই। সর্বপ্রথম আমার নজরে আসলো তাদের বাংলা লেখার ফন্ট গুলো। সংস্কৃতি ভাবসম্পন্ন এক আদিম ছাপ রয়েছে তাদের লেখনীতে। দোকানের নেম প্লেটে কিংবা কোনো বিল বোর্ডে সবখানেই বাংলা অক্ষরগুলো দেখে মনে হচ্ছিল সেগুলো অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত !!
বর্ডারের কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন খুব পীড়াদায়ক এক বিষয় মনে হয়েছে , তাই যখন তা অতিক্রম করে ভারত সীমান্তে ঢুকলাম কিছুটা শান্তি অনুভব করলাম। এলাকার নামগুলো পড়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের দেশে গ্রামের দিকে মানুষ জন ঘর বাড়ি বানায় রাস্তা থেকে বেশ ভেতর দিকে আর রাস্তার পাশে বানালেও বাড়িগুলো থাকে রাস্তার দিকে পেছন দিয়ে। কিন্তু সেখানে দেখতে পাচ্ছিলাম সব ঘরগুলো রাস্তা থেকে একটু দূরে কিন্তু রাস্তার দিকে ফেরানো এবং বেশ খোলামেলা।ফলে দূরপাল্লার বাসে বসেই দেখলাম - কেউ সবজি কাটছে , কেউ বা আরামসে ঘুম দিচ্ছে আর কেউ বা করছে স্নান !!
বনগাঁও, গাইঘাটা, হাবড়া এইসব নাম পড়ে পড়ে একপর্যায়ে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠেই দেখি কলকাতা শহরের মধ্যেই প্রায় ঢুকে পড়েছি। যা হোক - কলকাতা নেমেই প্রথমেই যেই ধাক্কাটা খেলাম তা হলো - মানুষজনের মধ্যকার রুক্ষতা। আমি যার সঙ্গেই কথা বলতে চাই, চরম অনীহা মূলক জবাব পাচ্ছিলাম। একটি কথা দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করতেই যেন রাজ্যের বিরক্তি তাদের চেহারায়। সেক্ষেত্রে এমন কটু কথা শুনতে হচ্ছিলো যে থ হয়ে যাচ্ছিলাম। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে এবং খাপ খাওয়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।
কলকাতার খাবার খেতে গিয়ে দ্বিতীয় ধাক্কা খেয়ে ফেললুম !! সুন্দর সুন্দর পারফিউম খাবার গুলোতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে বলেই আমার ধারণা। মুরগির মাংসে গোলাপের গন্ধ পাই তো মাছের তরকারিতে পাই বেলি ফুলের। এক মহা বিড়ম্বনা ই বৈকি !! আর মুখে দেবার সাথে সাথেই অনুভব করতে পারি কেউ যেন ১০ নিউটন বল নিয়ে গালের মধ্যে চড় বসিয়ে দিলো !
বিস্বাদ , অস্বাদ নাকি কুস্বাদ আভিধানিক অর্থে কোনটা সঠিক জানিনা তবে কলকাতার খাবারগুলোর সাথে এগুলোর যেকোনো উপমা ই অনায়াসে বসিয়ে দেয়া যায়। আমাদের দেশে খাবারের সাথে সালাদ ফ্রি দেয়া হয় , কিন্তু সেখানে সালাদের দাম অন্যান্য তরকারির দামের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তবে - শুধু মাত্র বড় বাজারের এক দোকানে বিরিয়ানি খেয়ে বেশ ভালোই লেগেছিল - যাতে বাসমতি চাল এর সাথে আলু বোখারা ও কাজু বাদামের মজাদার কম্বিনেশন ছিল।
কলকাতার মানুষ যে হিসেবি তা সবাই জানে, তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ হলো - বিল যদি সাতশত একানব্বই টাকা আসে তবে তারা সাতশত একনব্বই টাকা ই রাখবে , ভুলেও এক টাকা কমিয়ে সাতশত নব্বই টাকা রাখবে না।
কলকাতার অধিবাসীরা তাদের সংরক্ষনশীলতার ছাপ রেখে দিয়েছে আরো একটি বিষয়ে আর তা হলো হাতে টানা রিক্সা। বিষয়টি আমার কাছে চরম অমানবিক মনে হয়েছে। একজন বয়স্ক মানুষ পায়ে হেটে ও হাতে টেনে রিক্সা টানছে আর আমি তার ঘাড়ের উপর বসে আছি - ভাবতেই একটা খারাপ লাগা কাজ করে।মনে মনে ভাবি - ফোর জি'র ভারতে আজ ও উলঙ্গ দাসবৃত্তি !!
একদিন বাইরে চা খাবো ভাবছি। চায়ের দোকান খুঁজতেই দেখি রাস্তার এক কোণে দুজন লোক বসে চা খাচ্ছেন কিন্তু তাদের হাতের চায়ের কাপ দেখা যাচ্ছে না। আরেকটু কাছে যেতেই দেখি - বোতলের ছিপির সমান একটি মাটির তৈরী পাত্রে তারা চা খাচ্ছে। ব্যাপার টা আরো হাস্যকর মনে হলো যখন দেখলাম তারা বেশ অনেক্ষন সময় ব্যায় করে, গল্প স্বল্প করে করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। আমার মনে তখন একটি ই প্রশ্ন "এক ঢোক চা কয় চুমুকে খাওয়া যায় !!??!!"
এতক্ষন কলকাতার এক গাদা দোষের পসরা সাজালাম, এবার পজেটিভ কিছু বলতে চাই। কলকাতার যানবাহনে চলাচল তথা যোগাযোগ ব্যবস্থা ঢাকার চেয়ে যথেষ্ট উন্নত। ট্রাফিক জ্যাম মুক্ত রাস্তা, দ্রুতগামী মেট্রো রেল, কম ভাড়ার সহজলভ্য লোকাল বাস, পর্যাপ্ত অটো ও ট্রাম এ শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যথেষ্ট শক্তিশালী করেছে। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়টি আমার নজর কেড়েছে তা হলো - নিয়মানুবর্তিতা। নিয়ম মেনে বাসে বসা হতে শুরু করে রাস্তা পার হওয়া সবকিছুতেই প্রচন্ড সিস্টেম মেনে চলে তারা। আমাদের ঢাকা ও এমন হবে সেই স্বপ্ন দেখি।
পরিশেষে এক বিশেষ অনুভূতি ব্যক্ত করবো। কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করি তখন - এক টানা ২ মিনিট নিঃশাস বন্ধ করে রেখে তারপর শ্বাস নিলে যেমন প্রশান্তি লাগবে ঠিক তেমন লাগছিলো। আমার রক্ত কণিকায় অক্সিজেন এর পরিমান যেন শত গুন্ বেড়ে গিয়েছিলো। কত শত অপরিচিত বাঙালিদেরকেও দেখে মনে হচ্ছিলো তারা আমার অনেক পরিচিত , অনেক আপন। আমি তখন উপলব্ধি করতে পারি - আমি আমার জন্মভূমিকে কতটা ভালোবাসি।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৩০