পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলের আলোচনা কার্যত ভেঙে গেছে। দুদক সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে বাদ দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। এতে সম্মত হয়নি বিশ্বব্যাংক।
এ নিয়ে বিশ্বব্যাংক বা দুদক কেউ-ই পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। তবে দুই পক্ষের কথাবার্তায় মনে করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে মতৈক্য হয়নি। দুদক এবং সরকারের বিভিন্ন সূত্র থেকেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর ফলে পদ্মা সেতুর ভাগ্য আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। কেননা, বিশ্বব্যাংক আগেই বলেছিল, দুদকের তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর নির্ভর করছে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন।
তবে সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, আলোচনা ভেঙে যায়নি। দুদক শিগগিরই বিশ্বব্যাংকের কাছে একটি নামের তালিকা পাঠাবে। তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে এবং কাদের বিরুদ্ধে যাবে না, সেই নামগুলোই থাকবে। তার পরই বিশ্বব্যাংকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
গতকাল বুধবার দুদকের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের দুই দফা বৈঠক হয়েছে। অবশ্য দ্বিতীয় বৈঠকটি ছিল অনেকটাই সৌজন্যমূলক। এ সৌজন্য বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় দুদকের কার্যালয় ত্যাগ করার সময় বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুদকের সঙ্গে বেশ খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। তাদের ধন্যবাদ। আমরা চলে যাচ্ছি।’ তদন্ত ও মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ওকাম্পো বলেন, ‘আমরা এখন এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।’
আরও আধা ঘণ্টা পরে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের উভয় পক্ষের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো গোপনীয়। পুরো বিষয়টি আমাদের দেশের আইনের আলোকে এবং প্রয়োজনে আমাদের অনুসন্ধান দলকে দিয়ে পুনরায় অনুসন্ধান করা হবে।’
মামলার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে কোনো মতবিরোধ হয়েছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে দুদকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে দুদক। আর সেটা অবশ্যই দেশের আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী। বিশ্বব্যাংক কী বলল, প্যানেল কী বলল, তা আমরা শুনব, বিবেচনা করব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বা আইনানুগ পদক্ষেপ হবে দেশীয় আইন অনুযায়ী।’ কিছু বিষয় নতুন করে পর্যালোচনা করা হবে বলে তিনি আবার জানান।
গতকাল বলেছিলেন দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে, আজ বলছেন আবার অনুসন্ধানের কথা। এ রকম কেন—জানতে চাইলে দুদকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইনি ব্যবস্থার বিষয়টি দু-এক দিনের মধ্যেই বিবেচনা করব। তবে এ কাজে কিছুটা সময় লাগলে বা আরও কয়েক দিন দেরি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।’
এর আগে বিকেল তিনটা ৪০ মিনিটে বিশ্বব্যাংকের এ বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে দুদকের তৃতীয় দিনের প্রথম বৈঠক শুরু হয়। এ দলে মোরেনো ওকাম্পো ছাড়াও ছিলেন হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং এবং যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশপ্রধান অ্যালেন গোল্ডস্টেইনও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
বৈঠকটি ছিল মাত্র আধা ঘণ্টার। বৈঠক শেষে সবাই চলে যান অর্থমন্ত্রীর হেয়ার রোডের বাসায়। অ্যালেন গোল্ডস্টেইন এ সময় দুদকে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখনো অনেক বিষয় অমীমাংসিত। কিছুটা আলোচনার জন্য বাইরে যাচ্ছি। আবার কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে হয়তো দুদকের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারি।’
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের তিন সদস্য সন্ধ্যা সাতটার দিকে দুদকে ফিরলেও অ্যালেন গোল্ডস্টেইন আর ফেরেননি। দ্বিতীয় দফায় বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা মাত্র ১০ মিনিট দুদকে ছিলেন। সবার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেই তাঁরা ফিরে যান। ওদিকে অর্থমন্ত্রীর বাসার সামনে সাংবাদিকেরা ভিড় করলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়ে দেন।
দুদক ও সরকারের বিভিন্ন সূত্র জানায়, গতকালের বৈঠকের একমাত্র আলোচনা ছিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মামলার আসামি করা হবে কি না, তা নিয়ে। এ সময় দুদকের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। ফলে তাঁকে এ মামলায় জড়ানো হলে তা আদালতে টিকবে না। তবে দুদকের এ বক্তব্য মানেননি বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা। এ বৈঠকে দুদকের চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার, তদন্ত দলের কর্মকর্তারা ছাড়াও দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, দুদক বৈঠকে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা জানিয়েছিল। তাঁরা হলেন: সংসদের হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর ভাই নিক্সন চৌধুরী, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত কমিটির সদস্যসচিব কাজী ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের এবং এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় এজেন্ট মো. মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের তিন কর্মকর্তা সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল।
তবে তদন্তকারী কর্মকর্তারা দুদককে তদন্ত করে যে খসড়া প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাতে আরও দুজনের নাম রয়েছে। তাঁরা হলেন: সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী।
সরকারি একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মূলত সরকারের চাপেই সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এ বাদ দেওয়ার কথা গত মঙ্গলবারের বৈঠকেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। সেদিনও তারা এতে সম্মতি দেয়নি। শেষ চেষ্টা হিসেবে বিশ্বব্যাংক গতকাল আবারও বৈঠক করে। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান না হওয়ায় তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা কার্যত ব্যর্থই হয়ে গেল। জানা গেছে, এ নিয়ে শিগগিরই বিশ্বব্যাংক একটি বিবৃতি দেবে। আর এর পরেই চূড়ান্ত হয়ে যাবে পদ্মা সেতু নির্মাণে দাতাদের ফিরে আসার সিদ্ধান্তটি।
গত ২৯ জুন পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের পর গত সেপ্টেম্বরে পুনরায় প্রকল্পে শর্ত সাপেক্ষে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয়। অন্যতম শর্ত ছিল দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সেই তদন্ত পর্যবেক্ষণ করবে একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল। গত অক্টোবরে প্রথম দফায় বিশেষজ্ঞ দলটি ঢাকায় এসে দুদকের সঙ্গে বৈঠক করে।
সরকারি একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এর আগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিবরণসহ দুই দফা চিঠি দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। সেসব চিঠি দেওয়া হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলকে। তারা সেসব চিঠি দেখার পর মতামত দিয়েছিলেন যে, এর ভিত্তিতে অভিযোগ করা যাবে না। বিশ্বব্যাংককে অবশ্যই অভিযোগের পক্ষে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে। এর ভিত্তিতে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রমাণ দেওয়ার কথা বলেছিল বিশ্বব্যাংক। শেষ পর্যন্ত গত ১৩ নভেম্বর বিশ্বব্যাংকের অ্যালেন গোল্ডস্টেইন দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে নতুন কিছু প্রমাণ দেন।
জানা গেছে, পদ্মা সেতুর কাজ পেতে ঘুষ লেনদেনের পরিকল্পনার বেশ কিছু বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ বিশ্বব্যাংক দুদককে দিয়েছে। এর বাইরে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তারাও নতুন কিছু প্রমাণ অনুসন্ধান করে পেয়েছেন। ফলে দুদক স্পষ্ট করেই বলছে, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং এ জন্য দেশি ও বিদেশি বেশ কয়েকজন নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়ার পর এখন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া সরকারের কাছে বিকল্প পথ নেই। তবে কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে, তা নিয়েই এখন সংকট দেখা দিয়েছে
সূএ -প্রথম আলো