ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত কী থাকছে? নিষিদ্ধ হয়েই যাবে শেষ পর্যন্ত জামায়াত ! এমন প্রশ্ন আসছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এক এক করে দলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাগণ ফাঁসির দঁড়িতে ঝুলছেন, আগের মত ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারছেন না মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে ৯০ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম মারা গেছেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীর চূড়ান্ত রায় হয়ে গেছে, কার্যকরে বাধা নেই আর। একই অপরাধে দলের শীর্ষ তিন নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে। দলের প্রভাবশালী আরও কয়েক নেতার বিচারও শেষ পর্যায়ে। গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত সারা দেশে দলটির সকল কার্যালয় তালাবদ্ধ। শিবিরের অফিসগুলোও আর প্রকাশ্যে নেই। সরকারের মামলা-হামলায় ও জেল জুলুমে আজ বিপর্যস্ত নেতা-কর্মীরা এখনো অনেকে ঘরছাড়া। মাসের পর মাস পালিয়ে বেড়াচ্ছেন । চরম নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে দলটি। নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নামে দলটিও। তুরষ্কের বা মিসরের ভাগ্য বরণ হতে পারে এ দলটির।
জামায়াত সমর্থিত ও মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, হাউজিং প্রতিষ্ঠান, পরিবহণ সহ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। যে কোনো সময় এসব প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়তে পারে। একটি জাতীয় পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, জামায়াতের নতুন প্রজন্মের একটি অংশ ’৭১-এর ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন ভাবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক অনুসারে দেশের আইনী মোতাবেক ধারাবাহিকতায় রাজনীতি করার পক্ষে। দলটির ওপর কলঙ্কের কালিমা তথা ৭১’ এর যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে মুক্তি চান তারা। নতুন নামে আসতে চায় তারা। প্রবীন অনেক নেতাগণ এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ। তারা ক্ষমা চাইবেনা। কঠোর অবস্থানে তারা । কট্টরপন্থি আরেকটি অংশ চায়, অতীতের কৃতকর্মের জন্য দল ক্ষমা চাইবে না। এজন্য মৃত্যুকে বরণ করে নিতেও তারা প্রস্তুত।
অনেক নেতাই ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নামেই রাজনীতির পক্ষে। জামায়াত এখনো ভাবে তারা আশা করেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত সরকার নেবে না। তবুও যদি বাতিল ঘোষণা করা হয় তবে নতুন নামে আসবে এ দলটি। দলের নামও ঠিক করে ফেলেছে তারা। তার পরও রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে বিকল্প সব পথেই হাঁটছেন তারা। জামায়াত নিষিদ্ধ হলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নেই এমন নেতাদের সামনে রেখে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ, জনকল্যাণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদারনীতির নতুন দল গঠনের কথা ভাবা হচ্ছে।
মডেল হিসাবে তারা মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড ও তুরস্কের জাস্টিস একে পার্টির ইতিহাস অনুসরণ করবে। প্রাচীন এ দলটি ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠার পর তিনবার নিষিদ্ধ হয় । ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর অন্য সব ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। সাত বছর পর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে আবার প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত। এর পরই ধারাবাহিকভাবে রাজনীতি করে আসছে দলটি। জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথা চিন্তা করে জামায়াতের কেন্দ্র থেকে চারটি নতুন নাম প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে তৃণমূলের নেতাদের কাছে মতামতও চাওয়া হয়েছে। নামগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি), তুরস্কের ক্ষমতাসীন পার্টির নামে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (জেডিপি), ইসলামী জাগরণ দল ও বাংলাদেশ জাগরণ মঞ্চ। তবে জামায়াতের সিনিয়র নেতাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ নতুন নামকরণের ঘোরতর বিরোধী। সরকার নিষিদ্ধ করার আগেই নতুন নামকরণ করা হবে, না নিষিদ্ধ করার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী নতুন নামকরণ করা হবে।
কেন্দ্রীয় আমীর হতে পারেন ডা. শফিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক হতে পারেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ। এ পদের জন্য ঢাকা মহানগরীর আমির রফিকুল ইসলাম খানের নামও শোনা যাচ্ছে। অন্যান্য পদের নেতাদের দায়িত্ব বণ্টনের কাজ চলছে। জানা গেছে, দু-এক জন ব্যতিক্রম ছাড়া জামায়াতের ষাটোর্ধ্ব নেতারা নতুন দলের নেতৃত্বে থাকবেন না। তারা মূল দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতেই থেকে যাবেন। তবে তারা প্রকাশ্য রাজনীতি করবেন না। মূলত এসব নেতা গোপনে জামায়াতের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। নেপথ্যে থেকে নতুন দলকে পরিচালনায় ভূমিকা রাখবেন। এমনটাই ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
বিগত ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত জামায়াত নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান ছিল। তাদের শক্ত অবস্থানে আওয়ামী লীগ অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলো। রাজপথে থেকে আন্দোলন করে সরকারকে বিব্রত করে ফেলেছিলো। দেশ-বিদেশে এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে এ দলটি। নির্বাচনের পরই অনেকটা নিরবে চলে যায় জামায়াত-শিবির। এর মধ্যে দু-এক বার হরতাল দিয়েও মাঠে থাকেনি দলটি। প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারছে না তারা। জামায়াত-শিবির দমনে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। স্বাধীনতার পর এমন সংকটে আর পড়তে হয়নি দলটিকে। নিষিদ্ধ দলের মতোই আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে চলছে সংগঠনটির কার্যক্রম। জামায়াত সমর্থিত বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানও নজরদারির আওতায় আনায় বেকায়দায় পড়েছে দলটি। ওইসব প্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা এখনো কর্মরত। এ কারণে চাপে থাকলেও কার্যক্রম চলছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এসব প্রতিষ্ঠান হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। জামায়াত সমর্থিত ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আতঙ্ক বিরাজ করছে। জামায়াত-শিবির চালিত ও নিয়ন্ত্রিত স্কুল, কলেজ, কোচিং সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। জামায়াত নেতাদের পরিচালিত বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া জামায়াত পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের সংগঠন, এনজিও এবং জামায়াত নেতাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কাজ শুরু করেছে। এ নিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছে জামায়াত।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৬ রাত ১১:০৯