সময় আমান্ডাকে অনেক বেশী কঠোর করে ফেলেছে। তার বয়স মাত্র তেরো অথচ আজকাল ক্ষুধা-তৃষ্ণার অনুভূতি ছাড়া তার ভিতরে কেন যেন কিছুই কাজ করেনা। কিন্তু তার শরীরে ক্ষুধা থাকা দরকার। তার পেশাই যে মানুষের শরীরের ক্ষুধা মিটিয়ে নিজের পেটের ক্ষুধা নেভানো। এই শরীরি ক্ষুধাটুকু না থাকলে সে পেটের ক্ষুধাই বা মেটাবে কি করে?
নিজেকে যৌনকর্মী ভাবতে কখনই আমান্ডার বাধে না। বরং সে ধরেই নিয়েছে এটাই তার নিয়তি। আমান্ডার বড় বোন আনিতাও একই কাজ করে। তবে আমান্ডার তুলনার তার চাহিদা কয়েকগুন ভালো। পরিবারের লোকদের কাছে আনিতার কদর বেশ। অথচ সে আমান্ডা শত চেষ্টার পরেও তার বোনের মত আয় করতে পারেনা। তার আনিতার মত শরীরী সৌন্দর্য নেই। আটোশাটো পোশাকে আনিতাকে যতটাই আকর্ষণীয় মনে হয়, আমান্ডাকে ঠিক ততখানিই হাস্যকর লাগে।
প্রথম কবে এই কাজ শুরু করেছিলো তা আমান্ডার ঠিক মনে আছে। তারা তখন ব্রাজিলের বোলো হরাইজেন্টোতে থাকতো। তার বয়স তখন সাত কি আট। একদিন তার নানী হুট করে তাকে একটা লোকের সাথে ধরে ঢুকিয়ে দেয়। সেদিন বাঁচার জন্য আমান্ডা প্রাণপনে চিৎকার করেছিলো। নিজেকে রক্ষা করার জন্য গলা কাকিয়ে ঐ তল্লাটের সবাইকে জানান দিতে চেষ্টা করেছিলো। আজকাল আমান্ডার মনে হয়- তার বেচে থাকার চেষ্টা সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছে। হয়তো ঐদিনই সে মারা গিয়েছে। আজ যা আসলে আমান্ডার দেহ বেচে আছে, আত্মার মৃত্যু সেদিনই হয়েছে।
আমান্ডা এখন রিও ডি জেনেরিওর একটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ফুটবল বিশ্বকাপ উপলক্ষে শহরটা কি অসাধারণ সাজে সেজেছে। আলো ঝলমল করছে চারিদিকে। পর্যটকদের ভীড়ে মুখরিত প্রতিটি খাবারের দোকান,হোটেল, নাইট ক্লাব। তার মত যৌনকর্মীদের চাহিদাও বেড়ে গিয়েছে। সেদিন তার বান্ধবী রোজ তো খুশিতে ঝলমলে চেহারা নিয়ে ফিরে এল। এক খদ্দের নাকি তাকে নিয়ে খেলাও দেখতে গিয়েছিল। শুধু রোজ না, তার সমসাময়িক অনেকেই বেশ ভালো পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। সবাই যে ভালো রোজগার করতে পারছে এ কথা অবশ্য ঠিক না। আমান্ডার মত কেউ কেউ আছে যারা দেখতে ভালো না, যাদের কোনো সৌন্দর্য নেই, যাদের চোখে কোনো কামুক ভাব নেই, অতএব তাদের কোনো তেমন দামও নেই।
আমান্ডা ভেবেছিলো বিশ্বকাপ শুরু হলে তার খদ্দের কিছুটা বাড়বে। অন্তত এই কয়েকদিন পেটে দানাপানি নিয়মিতই পড়বে। কিন্তু ঘটনা আসলে সেভাবে ঘটেনি। খদ্দের কিছু জুটেছিল কিন্তু দাম ওভাবে পায়নি। বরং কয়েকবার এক প্যাকেট সিগারেট, এক প্যাকেট গাঁজার বিনিময়ে কাজ সারতে হয়েছে। গাজা আমান্ডা তেমন নেয় না। কিন্তু ওটার একটা সুবিধা আছে। গাঁজা নেয়ার সাথে সাথে ক্ষুধাতৃষ্ণার ব্যাপারটা সে বেমালুম ভুলে যায়। এটাই বা কম কিসে। এই যে সে রোজ সন্ধ্যায় চুল সাজায়, মুখে কড়া মেকাপ দেয়, আটসাট সংক্ষিপ্ত পোশাক পরে এই সবটুকু আয়োজনই তো পেটের ক্ষুধা দমনকে কেন্দ্র করে। গাঁজা খেয়ে ক্ষুধা ভুলে থাকা গেলে মন্দ কি?
আজকে ব্রাজিলের খেলা আছে। কাদের বিপক্ষে ব্রাজিল খেলবে তা অবশ্য আমান্ডা জানে না। তবে যেদিন ব্রাজিলের খেলা থাকে সেদিন রাতে শহরের রাস্তা একদম ফাঁকা হয়ে যায়। লোকজন চুপচাপ টেলিভিশনের সামনে বসে যায়। ফুটবলের দেশের মানুষেরা ফুটবলকে নিজের আত্মার সাথে মিশিয়ে নিয়েছে। তাদের কাছে ফুটবল হল দেশপ্রেমের অংশ। কিন্তু আমান্ডার তাতে তেমন কিছু আসে যায়না। একদম যে আসেনি কখনও তা বললে অবশ্য ভুল হবে। বছর খানেক আগে সে গর্ভধারণ করেছিলো। বাচ্চাটাকে এবরোশন করে বাড়ি ফেরার পথে তার একবার মনে হয়েছিল- এই শিশুটা বেচে থাকলে হয়তো বড় কিছু হতে পারতো। হয়তো বড় কোনো ফুটবলার হয়ে সারা দুনিয়াকে চমকে দিতে পারতো। ফুটবল নিয়ে আমান্ডার ভাবনা এমনই। এর বেশী কিছুনা।
আমান্ডা আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। রাস্তায় ছুটে যাওয়া গাড়িগুলোর দিকে ইশারা করলো, কাজ হল না। লাল বাতি জ্বলে উঠতেই থেমে যাওয়া গাড়ির জানালায় উকি দিলো। কেউ আমান্ডার আমন্ত্রণে আজ সারা দিচ্ছে না। অথচ ক্ষুধা নামক জন্তুটা ভিতর থেকে ক্রমশ ডাক ছাড়া শুরু করেছে। আমান্ডার আর ভালো লাগে না।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। অথচ শহরের কোনো বাতিই নিভছে না আজ। প্রতিটা ঘরে আজ কেউ উৎসব। বিশ্বকাপের উন্মাদনায় শহরে আলোর উৎসব। অথচ আমান্ডা নিজেকে এই উৎসবে সামিল করতে পারেনি। দূর থেকে মানুষের উল্লাসিত চিৎকার শোনা যায়। নিশ্চয়ই ব্রাজিল গোল করেছে! আমান্ডা এবার খদ্দের খোজায় হাল ছেড়ে দেয়। আজ সেও সবার সাথে উৎসব করবে। ক্ষুধার জ্বালা কিছুটা ভুলবে ফুটবল খেলা দেখে। ফুটবলের এই দেশে আমান্ডা আলাদা কেউ না।
( সেদিন একটা নিউজ পড়ে গল্পটা মাথায় ঘুরছিলো। সেই সাথে মাহমুদ মামুর ফুটবলের গল্প লেখার অনুরোধ তো ছিলোই। এই গল্পটা তাই মাহমুদ মামুকেই উৎসর্গ করলাম।)