somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফুটবল উন্মাদনা ও আমাদের ‘উন্মাদ’ শিশুরা

১৪ ই জুন, ২০১৮ সকাল ৯:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পৃথিবীতে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকম্পের নাম মনেহয় ফুটবল বিশ্বকাপ। বিগ শো অন দ্যা আর্থ নামের এই মহাযজ্ঞে মাত্র ৩২টি দেশ অংশ নিলেও কাঁপছে পুরো বিশ্ব। ক্রিকেট বিশ্বকাপে সাধারণত অংশগ্রহণকারী দেশগুলোতেই উন্মাদনা দেখা যায়। কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে র্যাং কিয়ের ১৯৪ তম স্থানে থাকা বাংলাদেশে যেই উন্মাদনা দেখা যায়, তা অংশগ্রহণকারী শীর্ষ ৩২ র্যাং কিংয়ের অনেক দেশেও দেখা মেলে না।

জমি বিক্রি করে পছন্দের দেশের পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ পতাকা তৈরি, পুরো বিল্ডিংকে প্রিয় দেশের পতাকার রংয়ে রঙীন করাসহ অদ্ভুত সব কাণ্ড করে থাকে বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমীরা। এই উন্মাদনায় মাঝে মাঝে কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনাও ঘটে থাকে। যেমন- দুই দেশের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কিংবা উঁচু স্থানে পতাকা টানাতে গিয়ে নিহত হওয়ার ঘটনা। তবে এই অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলোর পরিমাণ খুব সামান্য হওয়ায় সবমিলে ফুটবল উন্মাদনা উপভোগ্যই ছিলো। উপভোগ্য ছিলো বলতে এখন নেই তা নয়। এখনো উপভোগ্যই আছে, তবে বয়সভেদে উন্মাদনার প্রকাশভঙ্গি ও ব্যাপ্তি নিয়ে কিছু আশঙ্কার যায়গা তৈরি হয়েছে।

উন্মাদনা শব্দটা এসেছে উন্মাদ থেকে। উন্মাদ শব্দের অর্থ- ক্ষিপ্ত, পাগল, হিতাহিত জ্ঞানহারা, খেপাটে, হিংস্র, উগ্র, উদ্দাম, মাতাল ইত্যাদি। যখন বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে কোনো একটি উপলক্ষকে কেন্দ্র করে এই বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায় তখন তাকে বলে উন্মাদনা। অর্থগুলো নেতিবাচক হলেও সব উন্মাদনা নেতিবাচক নয়। তবে লিমিটলেস সব উন্মাদনাই খারাপ।

অতীতে শুধু বাসা-বাড়িতে পতাকা টানানো, মিছিল-র্যা লী করা, প্রিয় খেলোয়াড়ের চুলের কাট দেয়ার মধ্যেই ফুটবল উন্মাদনা সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমের যুগে এই উন্মাদনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এমনটা স্বাভাবিকই ছিলো। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতের বাধাহীন মাত্রাতিরিক্ত উন্মাদনা আশঙ্কারও তৈরি করেছে। বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ ফুটবলপ্রেমি ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। যত তর্ক-বিতর্ক আর উত্তেজনা এই দুই দলকে ঘিরেই। ফেসবুকে দুই দলের সমর্থকরা একে অপরকে নানাভাবে আক্রমণ করে পোষ্ট দিচ্ছেন, খেলোয়াড়দের নিয়ে ট্রল করছেন। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে দুই পক্ষের এই আক্রমণ একপর্যায়ে গালাগালি আর কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যে গিয়ে ঠেকছে।

সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, তরুণ যুবক বৃদ্ধদের পাশাপাশি ইদানিং এই লিমিটলেস উন্মাদনায় অংশ নিচ্ছে শিশুরাও। অংশ নিচ্ছে বললে কিছুটা ভুল হবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুদেরকে অংশগ্রহণ করানো হচ্ছে। ফেসবুকে এমন বেশ কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেগুলোতে শিশুদেরকে প্রতিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে খুবই আক্রমণাত্মক কথা বলতে দেখা গেছে।

সর্বপ্রথম ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আর্জেন্টিনা সমর্থক এক শিশু ফেসবুক লাইভে এসে ব্রাজিল ও সেই দেশের তারকা প্লেয়ার নেইমারের বিরোধীতা করে বলছে- ‘....নেইমারকে জন্ম দিছে মেসি, কিভাবে মানুষ মেসি আর আর্জেন্টিনার বদনাম করে, তাদের কি বিবেক নাই, সেন্স নাই, তারা কি বুঝে না?...মেসির বিরুদ্ধে কেউ বললে আমার কলিজায় লাগে, আমি মইরা যামু....’ বলেই সে কান্না করতে থাকে। একপর্যায়ে সে প্রতিপক্ষকে হুমকী দিয়ে বলে, ‘...মাইরা ঝুলায়া দিমু, ব্রাজিলের পতাকা দেখলেই আগুনে পুড়াইয়া দিমু, সেটার উপর প্রস্রাব করমু’! একটি ১০-১২ বছরের শিশুর মুখের কথা এগুলো। নিশ্চই স্বাভাবিক কোনো কথা নয় এগুলো।

এরপর এই শিশুটিরই আরেকটি ভিডিও দেখেছি। যেটাতে সে বলছে, আগের ভিডিও করার কারণে নাকি অনেকেই তাকে হুমকী দিয়েছে, এমনকি ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার কথাও বলেছে অনেকে। এই লাইভ ভিডিওতেও সে আর্জেন্টিনা আর মেসির কথা বলে অনেক কান্নাকাটি করেছে।

এরপর আরো দুইটি ভিডিও দেখেছি। যেগুলোতে ব্রাজিল সমর্থক আলাদা দুটি শিশু প্রথম শিশুর ভিডিওর কথার জবাব দিয়েছে খুবই আক্রমণাত্মকভাবে। ভিডিওগুলোতে আর্জেন্টিনা সমর্থক শিশুটিকে মারধরের হুমকীও দেয়া হয়েছে। ৮-১০ বছরের এক শিশুতো তার লাইভ ভিডিওতে বড়দেরকে উপদেশও দিয়ে গেছে এই বলে যে, ‘বেশি আবেগি হওয়া ভালো নয়’!

ব্যাপারগুলো শুনতে আসলে হাস্যকরই শোনায়। সবাই ভিডিওগুলো দেখে আনন্দই পেয়েছে। বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে ভিডিওগুলো। বিনোদন নিতে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থকগণ ভিডিওগুলো শেয়ারও করেছেন ব্যাপকভাবে। কিন্তু আপনি যদি সচেতন মানুষ হোন, তাহলে বিনোদনের পাশাপাশি এই ভিডিওগুলো আপনার চিন্তার খোরাকও জোগাবে। আপনাকে চিন্তা করতে বাধ্য করবে কোনো শিশু নিশ্চই বিনোদনের খোরাক হতে পারে না। এটা তো কোনো নাটক বা সিনেমার অভিনয় নয়।

এই শিশুগুলো নিজে নিজেই ফেসবুক লাইভে এসেছে বলে আমার কাছে মনে হয়নি। তাদেরকে লাইভে আনা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তাদেরকে পাশ থেকে কেউ শিখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তারা একটুও ভাবেনি শিশুগুলোকে তারা আসলে কি শিখাচ্ছে। একটি শিশুকে আমি শিখাচ্ছি কোনো যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই একটি পক্ষে কিভাবে অবস্থান নিতে হয় । আমি তাদের শিখাচ্ছি সত্য হোক আর মিথ্যা, আমি যেটার পক্ষে আছি সেটাই ঠিক। আমি তাদের ফ্যাসিজম শিখাচ্ছি। জোর যার মুল্লুক তার শিখাচ্ছি। তাদের শিখাচ্ছি কিভাবে জোর করে নিজের মতবাদ অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে হয়। কিভাবে ভিন্নমতের লোকদের হুমকী দিতে হয়। কিভাবে ভিন্নমত দমন করতে হয়। পতাকা পুড়িয়ে দিয়ে সেটার উপর প্রস্রাব করার কথা বলে আমি তাদের শিখাচ্ছি কত কুরুচিপূর্ণ আর কঠোরভাবে ভিন্নমত দমন করতে হয়!

অথচ আমরা তাদের শিখাতে পারতাম অন্যের মতকে কিভাবে সম্মান জানাতে হয়। তাদের শিখাতে পারতাম একেকজনের একেক ধরণের মত, পথ ও পছন্দ থাকবে এটাই স্বাভাবিক, এটাকে মেনে নিতে হয়। আমরা শিখাতে পারতাম এই শিশু বয়সে ফেসবুকে আশক্ত হওয়া উচিত নয়। তোমাদের বয়স এখন ফেসবুকে সময় পার করার নয়। তোমার বয়স এখন পড়ালেখার, মানুষের মত মানুষ হওয়ার।

আমরা আমাদের চোখের সামনে এমন একটি ফ্যাসিস্ট প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে দিতে পারি না। সাবালক হওয়ার আগে যেখানে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে দেয়াই ঠিক নয়, সেখানে ১০-১২ বছরের একটি শিশুকে কি করে আমরা ফেসবুক লাইভে আসতে দেই? সে লাইভে আসা শিখলোই বা কি করে? ফুটবল উন্মাদনা আপনাকে এতটাই উন্মাদ আর হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য করে যাতে না দেয় যে আপানি একটি প্রজন্মকেই ধ্বংস করে দিবেন। এ ব্যাপারে এখনই সচেতন না হলে পরে আর সচেতন হওয়ার মওকাও মিলবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৮ সকাল ৯:৪৫
৮টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×