যেখানেই গিয়েছি, সেখানে একটা ছাপ ফেলে এসেছি। এই যেমন প্রায় তিন বছর পর এক বন্ধুর মেসে গেলাম। বন্ধুর রুমমেট দেখেই বলল, ‘ভাই, আপনি সেই লোক না, ওই যে তিন বছর আগে একবার রাতে ছিলেন এখানে? কারেন্ট চলে গেল, সারা রাত গান গাইলেন?’
‘হ্যাঁ।’ বলে একটা হাসি দিলাম। মনে রেখেছে আমাকে! বন্ধুর রুমমেট আবার বলল, ‘ভাই, এসেছেন খুব ভালো হয়েছে। আপনাকে আমার মনে আছে। তো ভাই, এবার কত দিন থাকবেন?’
: হ্যাঁ, থাকব দিন তিনেক।
কথোপকথনের কিছুক্ষণ পর বন্ধুর রুমমেট ‘টিউশনিতে যাচ্ছি’ বলে বেরিয়ে গেল। পরের তিন দিন আর ফেরেনি!
আমার প্রথম প্রেমিকার নাম ইশরাত। কথায় কথায় তাকে অনেকবারই বলেছিলাম যে আমি গান গাইতে ভালোবাসি, গান আমার অন্তরে। অনেকবার গান শোনানোর আবদার করেছিল; কিন্তু মুড ছিল না বলে শোনাইনি। বলেছিলাম, ‘শুনবা শুনবা। আমার গান যে একবার শুনেছে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে ভোলেনি।’
অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আমাদের প্রেমের পর তার প্রথম জন্মদিন। কেক কাটার পর বন্ধুরা যখন চলে গেল, সে আবদার করল, ‘আমার জন্মদিনে একটা গান গেয়ে শোনাও।’
‘না’ করতে পারলাম না। দুবার কাশি দিয়ে শুরু করলাম গাওয়া, ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো...।’ পুরো গানটা শেষ করে দেখলাম, ইশরাত কাঁদছে। মেয়েদের এই এক সমস্যা। একটু আবেগময় কিছু হলেই কান্না শুরু করে দেয়। তারা সিনেমা দেখে কাঁদে, বই পড়ে কাঁদে, এমনকি প্রেমিকের গান শুনেও কাঁদে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী, কাঁদছ কেন?’
কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুমি এমন গান গাও ভেবেই আমার কান্না পাচ্ছে। আমার কী হবে গো...।’
সেবার ইশরাতের কান্না থামিয়েছিলাম ঠিকই, তবে ধরে রাখতে পারিনি। ইশরাত চলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল, ‘ভালো আছি, ভালো থেকো। শুধু বাথরুমেই গান কোরো...।’
ব্রেকআপের পর অনেক দিন বিমর্ষ ছিলাম। তার মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। তত দিনে আমার গানের ব্যাপারটা পুরো এলাকা জেনে গেছে। জানতাম, প্রতিভার কদর একদিন না একদিন হবেই। এক সকালে এলাকার ছোট ভাইয়েরা এল। তাদের নেতা জামাল। সে বলল, ‘ভাই, উত্তরপাড়ার ছেলেরা আমাদের সেই মারছে! আমাদের এখন লোকবল খুব কম। তাই মারের বদলে মার দিতে পারছি না। কিন্তু ওদের আমরা ছাড়ব না। প্রতিশোধ নেবই!’
আমি খুব কৌতূহলী হলাম, ‘কীভাবে?’
জামাল বলল, ‘ভাই, ওদেরকে ডেকে নিয়ে আসব একদিন। তারপর আপনি গিয়ে গান শুনিয়ে দেবেন। উঠে চলে যেতে চাইলে প্রয়োজনে বেঁধে রাখব। টানা চারটা গান না শুনিয়ে থামবেনই না। ওরা আমাদের চেনে নাই!’
রাজি হলেও নানা কারণে সেবার গান শুনিয়ে প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে ব্যাপারটা আমি খুব ইতিবাচকভাবেই নিয়েছি। দেশের নানা জায়গা থেকে আমার কাছে প্রস্তাব আসতে শুরু করল। আমিও প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে গান গেয়ে আসতাম। একবার ভয়ংকর এক অপরাধী ধরা পড়ল পুলিশের হাতে। রিমান্ডের পর রিমান্ড যাচ্ছে, কিন্তু কিচ্ছু স্বীকার করছে না। ডাক পড়ল আমার। আসামির সামনে গিয়ে গান ধরলাম, ‘মনে বড় আশা ছিল শোনাব তোমায় এই গান...’ এটুকু গাওয়ার পর আসামি আর্তনাদ করে উঠল, ‘থাক ভাই, থাক! আশা পুরাপুরি পূরণ করতে হবে না! আমি সব বলব, সব...।’
সেবারের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম। ভাবতে ভালো লাগে, রাষ্ট্র প্রতিভার সঠিক কদর করে। তো এভাবেই দেশের নানা প্রান্তে নানান অনুষ্ঠানে গান গেয়ে গেয়ে বেড়াতে লাগলাম। বিয়ে, জন্মদিন, আকিকা ইত্যাদি। খাবার কম পড়লে আমার ডাক পড়ত। আমি গান গেয়ে দিতাম, অতিথিরা সবাই বিদায় নিত। খাবার কম পড়ত না। এ ছাড়া বাসায় গিয়েও মাঝেমধ্যে গান গাই। দেখা যায় অতিথি এসেছে কিন্তু যাওয়ার নাম নেই। আমার ডাক পড়ে। গিয়ে গান গেয়ে দিই। বাপ বাপ করে চলে যায়। জীবন বাঁচাতে গিয়ে তাড়াহুড়ায় তাদের কাপড়চোপড়সহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছু ফেলেও যায়।
যেটা বলছিলাম, আমি যেখানে যাই, সেখানে একটা ছাপ ফেলে আসি। শেষ ছাপটা ফেলেছি অফিসে। আমি অফিসে জয়েন করার পর চারজন কলিগ চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। একজনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। যারা আমার গান শুনে শেষ পর্যন্ত টিকে গিয়েছে, তাদের মাথায় এসেছে অসাধারণ একটা বিজনেস আইডিয়া। ‘নোমানের সংগীতসন্ধ্যা’ নামের একটা কনসার্ট আয়োজন করা হবে। কনসার্টটির টিকিট একদম ফ্রি। সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকার এক স্টেডিয়ামে কনসার্ট শুরু হবে। তার আগে পুরো দেশে করা হবে প্রচারণার কাজ। সন্ধ্যা হতে হতে যখন হাজার হাজার মানুষ স্টেডিয়ামে ঢুকবে, তখনই বন্ধ করে দেওয়া হবে স্টেডিয়ামের সব গেট। তারপর আমি মঞ্চে উঠব এবং গান ধরব, ‘গান আমি গেয়ে যাব এই আসরে...।’
আমার গান শুনে হাজার হাজার মানুষ স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইবে। কিন্তু গেট তো বন্ধ! অতএব বের হতে চাইলেই টিকিট কেটে বের হতে হবে। বাঁচতে হলে টিকিট কাটতেই হবে!