আজকাল বন্ধু মহলে এই শব্দ দুটা খুব প্রচলিত। প্রথম প্রথম আমি শব্দ দুটার মানে ভালোভাবে বুঝতে পারতাম না কারণ বাংলাদেশী ফরেইনার হল তারা যারা বাংলাদেশী বংশদ্ভুত ব্রিটিশ অর্থাৎ যাদের জন্ম ব্রিটেনে। কিন্তু এদেরকে বাংলাদেশী ফরেইনার কেন বলতে হবে এটা বুঝতে পারছিলাম না।
যাই হোক আমি যখন শব্দ দুটার মর্ম উদ্ধারে ব্যস্ত তখন একদিন আমার ভাইয়ের নতুন অফিসে গেলাম। ওখানে আরও একজন বাংলাদেশী কাজ করে। তার ইংরেজি উচ্চারণ দেখেই আমি বুঝতে পারলাম এ হল সেই বাংলাদেশী ফরেইনার। আমার ভাই আমাকে তার ম্যানেজারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। কথায় কথায় সে আমাকে বলল যে আমার ভাইকে দেখে নাকি তার মনে হয়েছে বাংলাদেশীরা বেশ পরিশ্রমী। আমিও তাকে হেসে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ আর তোমার এখানে তো দুজন বাংলাদেশী আছে। সে একটু অবাক হয়ে বলল, দুজন না শুধু তোমার ভাই একাই এখানে বাংলাদেশী। আমি বললাম, কিন্তু ...... ছেলেটাও তো বাংলাদেশী। সে বলল, কিন্তু ও তো বলেছে ওর অরিজিন সিলেট। আমি মোটামুটি লজ্জিত বোধ করলাম এবং তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে সিলেট হচ্ছে বাংলাদেশের একটা অঞ্চল।
এই ঘটনার কিছুদিন পর বাবার একজন দূরসম্পর্কের চাচা বাসায় আসলেন, সাথে তার স্কুল পড়ুয়া নাতি। এই ছোট বাচ্চাটা একটা বাংলা কথাও বলতে পারে না এবং কিছুক্ষণের মধ্যই জানা গেল যে সে তার জীবনে কখনো বাংলাদেশে যায়নি এমনকি সে বলেই ফেলল সে নাকি শুনেছে যে বাংলাদেশ খুব নোংরা একটা জায়গা আর সেখানে নাকি শুধু মারামারি হয়।
পহেলা বৈশাখে আমাদের বাসায় সবসময় একটু খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়। এ বছরও হয়েছিল এবং তরুণ প্রজন্মের কেউ আসেনি। আমার মা বরাবরের মত এবারও জিজ্ঞেস করেছিলেন ওদের কথা এবং এক প্রতিবেশী বললেন যে, আসলে ওরা তো এদেশে জন্ম তাই বাংলাদেশের কালচার সম্পর্কে ওদের তেমন একটা আগ্রহ নেই আর তাছাড়া দরকারও নাই, ওরা তো আর কখনো বাংলাদেশে যাবে না।
উপরের এই ঘটনাগুলোতে আমি কাউকে ছোট করতে চাইনি বরং বার বার নিজের কাছে প্রশ্ন করেছি আর আমার বাবার একটা কথা মনে করেছি। বাবা বলেছিলেন ১০ বছর আগে তিনি যখন এদেশে এসেছিলেন তখন নাকি কেউ এটা বলতে চাইত না যে সে বাংলাদেশী, সবাই বলত তারা ইন্ডিয়ান। ১০ বছর পরেও কেউ বলতে বা ভাবতে চায় না যে সে বাংলাদেশী। ১০ বছরে আরও নতুন প্রজন্ম এসেছে কিন্তু আমাদের মন মানসিকতায় কোন পরিবর্তন আসেনি।
বাংলাদেশী ফরেইনার শব্দটা যখন আমার কাছে মোটামুটি স্পষ্ট তখন এক বন্ধু বিয়ে করল এক ব্রিটিশকে। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে আমি অবাক হয়ে গেলাম, কিছুটা পুলকিতও কারণ উনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় আমাদের সবার সাথে কথা বলছিলেন এবং ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ঘুরেও এসেছেন। আমার নিজের দেশের যা কিছু আমার দেখা হয়নি তাও দেখে এসেছেন বলে কিছুটা হিংসাও হচ্ছিল কিন্তু সবচেয়ে বেশী হচ্ছিল গর্ব ওনার কথা শুনে। আমার দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানুষের আতিথেয়তা এবং সারল্যের কথা একজন বিদেশীর মুখে শুনতে খুব ভালো লাগছিল। ভদ্রলোক সবার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন এই বলে যে এরা সবাই বাংলাদেশী, সেই একটি জাতি যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছিল।
ফুরফুরে একটা মন আর মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
আমরা যারা বিদেশে থাকি আমরা কি বাংলাদেশী না? এই যে নতুন প্রজন্ম যাদের আমরা মনে করি আগামী দিনের বাহক তাদের মাঝে কি কোন বাংলাদেশী থাকবে না? একদিন কি তাহলে আমার সন্তানও বাংলাদেশী ফরেইনার হয়ে যাবে?
আড্ডায় বন্ধুদের সাথে বসে যখন প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করছিলাম তখন দেখা গেল অধিকাংশের মনেই এই একই প্রশ্ন। দু একজন বলার চেষ্টা করল যে কিন্তু ইংল্যান্ডে তো প্রচুর বাংলাদেশী ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন আছে আর তারা বেশ ভালভাবে নানা উৎসব পালন করে সংস্কৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে যদিও সেসব অনুষ্ঠানে অধিকাংশ বাচ্চাই বাংলা কবিতা পড়ে ইংরেজি হরফে লিখে। তাই অযথা আর ঘাঁটাঘাঁটি না করে সবাই বুঝে গেলাম যে বাহ্যিক আবরণে যতোই ঘষাঘষি করা হোক না কেন যদি ভেতরের কাঠামো শক্ত না হয় তাহলে ভবিষ্যৎ কি হবে তা শুধু সময়ই বলতে পারবে।