আমার এক বন্ধু বলেছিল বিদেশ নাকি অল্প দিয়ে অনেক কিছু নিয়ে নিয়েছে। তখন আমি ওর কথাটা বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন মনে হয় ও ঠিকই বলেছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি টাকা উপার্জন করে দামি গাড়িতে করে বাড়ী ফেরার পথে খুব একা মনে হচ্ছিল নিজেকে। বৃষ্টি হচ্ছে এখানে। এখন কি বাংলাদেশে বৃষ্টি হচ্ছে, কে জানে? কাউকে ফোন করে জানারও উপায় নাই, সবাই এখন ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা ইংল্যান্ডের বৃষ্টিতে কি কখনো ভিজতে ইচ্ছে হয়েছে? কি জানি মনে পড়ছে না। অথচ বাংলাদেশে বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে আম্মুর কাছে কত যে বকা খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
এখানে আমরা সপ্তাহে একদিন বাঙ্গালী বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেই। আড্ডার প্রধান বিষয় হল দেশে থাকতে কে কি করতাম, কোথায় কোথায় যেতাম, কত মজা করতাম ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ ভুলেও বলে না যে এখানে কত মজা করছি, কত বেশী উপার্জন করছি, কত আরামে আছি অথচ এরাই দেশে থাকতে হাজারটা সমস্যা তুলে ধরত আর সবশেষে যে লাইনটা উচ্চারণ করত তা হল এই দেশে মানুষ থাকতে পারে? এমনই এক আড্ডায় এক বন্ধু বলে ফেলল যে দেশকে ভালবাসতে হলে বিদেশে আসতে হবে। আমরা সবাই খানিকক্ষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। সবার মনেই একই প্রশ্ন তাহলে কি দেশে থাকতে আমরা দেশকে ভালবাসতাম না? কি জানি তখন সবাই মাসে কতবার হরতাল হল, রাস্তায় কত ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকতে হয়, প্রতিদিন কয় ঘণ্টা করে লোডশেডিং হয় ইত্যাদি ভাবতে ভাবতেই দিন কাটাত তাই হয়ত কত ভালোবাসি তা ভাবার সময় হত না।
আবারও রমজান মাস এল। গত বছর রমজান মাসে বন্ধুরা সবাই দুএকবার ইফতার পার্টি দিয়েছি আর হাহুতাশ করেছি আহা দেশে থাকলে কত মজাই না হত! পরিবারের সবার সাথে একসাথে ইফতার করার মজাই আলাদা। এ দেশে তো বোঝাই যায় না যে এটা রমজান মাস। আর বাংলাদেশের রমজান মাসে সেহেরীর সময় এলাকায় এলাকায় থালা বাসন পিটিয়ে সবাইকে ঘুম থেকে তোলা, ইফতারের সময় চারিদিকে এক অন্যরকম ব্যস্ত সময়, কেনাকাটার ধুম, শবেবরাত-শবেকদরের রাতে রাত জেগে নামাজ পড়া সে এক অন্যরকম পরিবেশ।
হয়ত সেই বন্ধু ঠিকই বলেছিল। এদেশ টাকা দিয়েছে, সম্মান দিয়েছে, দিয়েছে পায়ের তলায় শক্ত মাটির অস্তিত্ব কিন্তু এর জন্য মূল্য দিয়েছি অনেক। অনেক কাটিয়েছি বিরহের সময় আরও অনেক কাটাতে হবে। মাঝে মাঝে হয়ত প্রবাসের চিঠির মত স্বদেশ তোমার দুএকটা খবর নিয়ে আলোচনায় বসব। তবু অধিকাংশ সময়ই তুমি আমার কাছে এক না পাওয়ার ব্যাথা, যেন সে আছে তবু বহু দূরে, যেন তাকে ইচ্ছে হলেই ছোঁয়া যায় না। মাঝে মাঝে রাত জেগে তোমার কথা ভাবি আমি। ভাবি একদিন ফিরে যাব। একদিন আবার সেই শহরে সেই রাস্তায় তোমার সাথে মিলব আমি। একদিন আবারও ঝুম বৃষ্টিতে ভিজব আমি মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে। একদিন আবার কাল বৈশাখী ঝরে দাদু বাড়ীতে গিয়ে আম কুড়াব। একদিন আবার পদ্মার পাড়ে ইলিশ খেতে যাব। পালা পার্বণে শাড়ি পরে, হাতে চুরি, কপালে টিপ দিয়ে উৎসব করব। একদিন আবার বাঙ্গালী হব। কিন্তু তাহলে কি এখন আমি বাঙ্গালী নই? অবশ্যই আমি বাঙ্গালী। হয়ত এত নানা রঙের মানুষের ভিড়ে নিজেকে খুঁজে পেতে সময় লাগে তবু আমার অস্তিত্বের ভেতর থেকে এখনও আমি বাঙ্গালী আর আজীবন বাঙ্গালীই থাকব।
ফাহিমা দিলশাদ