ব্যাংকে টাকা রাখলে গড়ে সুদ দেয় ৪ শতাংশ বা সামান্য বেশি। কিন্তু মূল্যস্ফীতি ৯.১%। আগস্টে ছিল ৯.৮৬%। এটা সরকারি হিসেব। বাস্তবে মূল্যস্ফীতি ১৫% এর কাছাকাছি হতে পারে, আমার কাছে প্রমাণ চাইলে আমি বলব বাজারে যান, বছর টু বছর, ৫ বছর টু ৫ বছর, ডিকেড টু ডিকেড গড় হিসাব করেন। আমরা সরকারি হিসাব নিলেও দেখি, বছর শেষে প্রকৃত বিচারে আমানতকারীর কোনো লাভ তো নেই বরং ৫% এর বেশি লস। অর্থাৎ আপনার টাকা নিয়ে ব্যাংক ব্যাবসা করবে, এইজন্য আপনি ব্যাংককে উল্টা আমানতের বছরে ৫% করে দিবেন। এই লোকসানের উপর আরও লোকসান আছে। যেটুকু সুদ দেওয়া হয়, তার ওপর আবার কর কেটে রাখা হয়। এদিকে ব্যাংক নিন্ম সুদে সাধারণ মানুষের আমানত নিয়ে খোদ আমানতকারিকে গরিব করে নিজের প্রভাববলয়ের ঋণপ্রাপ্তদের ধনী করছে। ওয়েলথ কন্সেন্ট্রেশন এবং ধন বৈষম্য তৈরির কি মাইরি সিস্টেম রে ভাই!
আবাল অর্থনীতির বড় ও প্রভাবশালী কারিগররা বলছে সুদ বাড়ালে নাকি বিনিয়োগে ভাটা পড়বে। ৯.১% মূল্যস্ফীতির সময়ে এরা ব্যাংক থেকে ৭-৯% সুদে বেশুমার ঋণ নিচ্ছে। এতে বেসরকারি বিনিয়োগের সংখ্যা ঠিক দেখাচ্ছে। কিন্তু তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের ব্যবসা কি সম্প্রসারণ হচ্ছে? কর্মসংস্থান কি বাড়ছে?
আসলে তারা কিছুই করছে না, বরং ''সস্তা'' নতুন ঋণ নিয়ে আগের ঋণ ক্লিয়ার করছে।
এটা বনেদি ব্যবসায়ীরা করছেন। অন্যরা নতুন নিচ্ছেন, পুরানোটাও ফেরত দিচ্ছে না। সুবিধা দেওয়ার পরেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই মাসে ঋণখেলাপিদের জন্য বড় ধরনের ছাড় দেয়৷ ঋণের শতকরা আড়াই থেকে চার শতাংশ (আগে দশ ছিল) অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়৷ এদিকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের বিপুল ‘সঞ্চয়’ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এখানে নতুন ২টা ঘটনা ঘটছে। সেটা হচ্ছে ব্যবসার মধ্যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। বড় রা ঋণ পাচ্ছে, ছোট রা পাচ্ছে না। কারণ ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত তারল্য নাই। এটা কয়েক বছর ধরেই হয়ে আসছে। করোনার সময়েও বড় ব্যবসায়ীরা সরকারি প্রণোদনার স্বল্প সুদের ঋণ পেয়েছেন, বিপরীতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ দেয়নি। ফলে এসএমই, অপরিচিত, প্রভাবহীন ব্যবসায়ীরা ঋণ পায়নি।
আবার দেখেন, সরকার ডলার বাঁচাতে এলসি বন্ধ করছে, এখানে প্রভাবশালীদের এলসি বন্ধ হচ্ছে কম, সাধারণ ব্যবসায়ীর এলসি বন্ধ হচ্ছে বেশি, আরেক পর্যায়ের বৈষম্য।
বড় ব্যবসায়ীদের সস্তা ঋণদানের 'হেলিকপ্টার মানি প্রদান' প্রকল্প অব্যহত থাকায় বেসরকারি বিনিয়োগের রেট গত কয়েক বছরের হারে খুব খারাপ দেখাচ্ছে না।
বড় ব্যবসায়ীদের সস্তা ঋণদানের রাজনৈতিক প্রকল্প খুব দরকার, কারণ তারা বিগড়ে গেলে সরকারের বিপদ। গত ১২ বছরে গার্মেন্টেসে শ্রমিক ইউনিয়ন সরকারের সহায়তা নিয়ে গুড়িয়ে দেয়া গেছে। কোন আন্দোলন হয়নি, যেটা বিএনপির সময়ে নিত্য ঘটনা ছিল। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, বরং ব্যবসায়ীরাই দেশের মুদ্রানীতি ঠিক করে দিচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয়য়ের মধ্যমে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির তেমন কোনো কার্যকারিতা নেই। ব্যাংক তার পছন্দের লোকেদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে ঋণ দিচ্ছে। প্রশ্ন করবেন না যে! ব্যাংকের মালিক-পরিচালক কারা!
এই মুদ্রানীতির মূলনীতি, হচ্ছে বড় মাফিয়া ব্যবসায়ীদের সহজে ঋণদান প্রক্রিয়া চলতে দিতে হবে। এটা নাকি উচ্চ প্রবৃদ্ধি সহায়ক।
তর্ক সাপেক্ষে একটা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ দুটা, ১। হার্ড ফরেন কারেন্সির বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা স্ট্যাবল রাখা, ২। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল কাজ হচ্ছে, যে কোন মূল্যে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণদান প্রক্রিয়া সহজ রাখার জন্য একটা অকার্যকর মুদ্রানীতি চালিয়ে যাওয়া।
৬-৯ সুদ হার যখন চালু করা হয় তখন মূল্যস্ফীতির সরকারি সংখ্যাটা ছিল ৫%। কোন আক্কেলে মূল্যস্ফীতির সরকারি সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও সুদ হার একই থাকে? উজবুকদের ব্যাখ্যা দিয়ে কিছু বুঝানো সম্ভব নয়।
একটা দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়লে সুদ হার বাড়িয়ে অর্থনীতিকে কিছুটা ব্রেক করতে হয়। কিন্তু সরকার উল্টা এক্সেলারেট করছে। আজীব কাজ কারবার। ব্যবসায়ীদের ঋণের খরচ বাড়ালে তারা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে যায়, মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসে। বিষয়টা এমনভাবে করতে হয়, যাতে ছোট ব্যবসায়ীদের সমস্যা না হয়, তারা কিছু পরোক্ষ ছাড় পায় ।
ইউক্রেন আগ্রাসনের ঠিক পরে পশ্চিমা নিষেধজ্ঞায় রাশিয়ায় যখন মুদ্রা ক্রাশ করে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছিল, রাশিয়া তার ব্যাংক সুদের হার দ্বিগুণ করেছিল। এটাই স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ আমানতের সুদের হার বাড়িয়েছে। কিন্তু আমরা দুর্বিত্তদের জন্য জাতীয় মুদ্রানীতি চালাচ্ছি।
আবার দেখেন, ইউরোপে বেকারত্ব এই মহুর্তে রেকর্ড কম, ফলে সেখানে ডিমান্ড পুল ব্যাখ্যা খাটে, আবার জ্বালানির দাম বেড়েছে বলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, কষ্ট পুশও খাটে।
কেমন উজবুক সিদ্ধান্ত দেখেন, গ্রাহক পর্যায়ে আমানতের সুদ বাড়িয়ে যেখানে ব্যাংকে আমানত প্রবাহ তৈরি করে, তারল্য সংকট সমাধানের দরকার, সেখানে চলমান তারল্য সংকটে তারা আন্তঃব্যাংক রেট এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার রেপো হার বাড়িয়েছে। (করোনার সময় রেপো কমানো হয়েছিল) নিশ্চিতভাবে এটা তারল্য সংকট সমাধান করবে না।
যেখানে টাকা বছরে সাড়ে ৯% মান হারাচ্ছে, আমানত সুদের সাথে টাকার ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যবধানই অন্তত ৫%, সেখানে আধা বা এক শতাংশ রেপো হার বাড়িয়ে আপনি কি গোল অর্জন করবেন?
কিছু অর্থনীতিবিদ বড় ব্যবসায়ীদের পক্ষে মাঠে নেমে বলা শুরু করলো সরকার প্রণোদনা দিয়েছে তাই নাকি মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, অথচ একদিকে ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ পায়নি, অন্যদিকে তহবিল সংকট ও দুর্নীতির উভয় কারণে সরকারের খাদ্য ত্রাণ ও নগদ অর্থ দান প্রক্রিয়াটা বাস্তবায়ন করাই যায়নি।
বাস্তবে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিকে ‘কস্ট পুশ’ বা ‘ডিমান্ড পুল’ দিয়ে ভাগাভাগি করা যাবে না এই মুহুর্তে। দুটাই ঘটেছে, তবে অর্থনীতির গতানুগতিক পদ্ধতিতে নয়্ বরং ভিন্নভাবে। আবার ধনী গরিব, বড় ছোট ব্যবসায়ীর জন্য দুটা ঘটনার মধ্যেও বৈপরিত্য আছে।
বাংলাদেশে প্রকৃত মোট দেশীয় পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটেনি, আবার বেকারত্বও কমেনি। (চট্রগ্রাম বন্দরে আমদানিকৃত পণ্যের ভলিউম বেড়েছে ৩%, বিপরীতে আমদানি খরচ বেড়েছে ৩০%)। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদাও সামগ্রিক সরবরাহের চেয়ে বেশি হয়নি, (দেখুন বিদ্যুৎ খাতে ১২ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা অলস, অতিরিক্তি)। বরং ধনীর ঋণ সস্তা হবার কারণে সে সস্তা বিনিয়োগ পেয়ে বেদরকারি খাতে উৎপাদন বাড়িয়েছে, কিন্তু এতে বেদরকারি পণ্যের দামও কিন্তু কমেনি, কারন তার উৎপাদন মূল্যই বেশি। কাঁচামাল, জ্বালানির কারণে উৎপাদন মূল্য বাড়াটাই মূল্যস্ফীতি ঘটিয়েছে। আমি অনেক উদাহরণ দিতে পারব, চাহিদা না থাকলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশুমার বিনিয়োগ, ৩০টার বেশি সিমেন্ট কোম্পানি, রড কোম্পানি, স্টীল কোম্পানি। বহু কোম্পানি আঁটা ময়দার ব্যবসায়, টিন ও প্লাস্টিক শিল্পে নেমেছে। এদিকে দেখেন সারে, এমোনিয়া তৈরিতে বিনিয়োগ নাই। এগুলা মিথ্যা প্রবৃদ্ধি আফটার ম্যাথ, কঞ্জাম্পশন ব্যাপক বাড়ার ভুল ফোরকাস্ট, বর্ধিত মাথাপিছু জাতীয় আয় দেখানোর ফল, যেটার উপর ভিত্তি করে বেসরকারি বড় কোম্পানি বেদরকারি খাতে বিনিয়োগ করেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে গরিব মানুষের আয় কমেছে, ৬৮% মানুষ খাদ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে, সঞ্চয় ভাংছে। শ্রমিকরা টাকার অভাবে দুপুরের খাবার ছেড়েছে। জ্বালানি সংকট ও আন্তর্জাতিক সরবারহ সমস্যায় মূল্য বেড়েছে। সস্তা ঋণে ধনীর আয় বেড়েছে, গরিবের আয় কমে বৈষম্য প্রকট হয়েছে।
এই চিত্র ইউরোপ আমেরিকা থেকে কিছুটা ভিন্ন, সেখানে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, কর্মসংস্থানও বেড়েছে।
করোনার সময় মানুষের আয় কমেছে। এটা না ঘটলে আজকের মূল্যস্ফীতি আরও বেশি হতে পারত, তবে একই কারণে আন্তর্জাতিক সরবারহ সংকটে, কাঁচামালের দাম বাড়ায়, জ্বালানির দাম বাড়ায় বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে গেছে। অর্থাৎ ডিমান্ড ও সাপ্লাই উভয় সাইডেই সমস্যা বেড়েছে।
এমতাবস্থায় শুধু বড়লোক ব্যবসায়ী, বড় শিল্প গ্রুপকে সুরক্ষা দেয়ার নীতি মূল্যস্ফীতি কমাবে না। বরং সুদের হার বাড়তে হবে, একই সাথে গরিবকে সস্তায় খাদ্য সরবারহ করতে হবে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও ঋণ প্রদানে কিছু সুবিধা দিতে, হবে। এসএমই বিকাশের ক্ষেত্রে প্রশ্নটা সুদের উচ্চ হারের নয়, রবং ঋণ প্রাপ্তির। দেখেন ক্ষুদ্র ঋণ কিন্তু আগে থেকেই উচ্চ সুদে ছিল, তাও মানুষ ঋণ নিয়েছে। অর্থাৎ বিষয়টা এক্সেস টু ফাইনান্সিয়াল সিস্টেমের। সেখানেই বাঁধাটা। এটাই সরানো হচ্ছে না। তাই আমানতের সুদ বাড়ালে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে, প্রবৃদ্ধি কমে যাবে ব্যাখ্যাটা এভাবে দাঁড়া করানো যায় না। সময়ের করনীয় কী! সেটাই বড় বিষয়।
মূল্যস্ফীতির সরকারি সংখ্যাটা নিজেই একটা সার্কাস। এটা আগস্টে ছিল ৯.৮৬%, হাউকাউ হবার পরে গতমাসে দেখাইসে ৯.১%। আপনি যদি, তাঁদের জিজ্ঞেস করেন ঠিক কোন কেরামতিতে গত মাসে মূল্যস্ফীতি ০.৭৬% কমেছে, কেউ উত্তর দিতে পারবে না। অথচ বাজার দেখেন, দাম বাড়ছেই। সরকারের মূল্যস্ফীতি পরিমাপ পদ্ধতি শুধু ভুল ও সেকেলেই নয়, এখানে দুর্নীতিও আছে। অর্থনীতিবিদরা এসব সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করেন না।
'শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি' সবাইকে প্রভাবিত করে ফেলেছে, চারদিকে নিরবতা।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০২২ রাত ১:৫১