১। আমদানি একেবারেই কমে গেছে। মেগা প্রকল্প গুলোর গতি একেবারেই বন্ধ বা ধীর হয়ে গেছে।শিল্পের ক্যাপিটাল মেশিনারি ইম্পোর্ট কমতে শুরু করেছে করোনার আগেই। সুতরাং ফরেন কারেন্সি কম খরচ হয়ে রিজার্ভ স্থিতি বেড়েছে। ইউরোপ ও এমেরিকায় লকডাউন ধীরে ধীরে উঠে যাওয়ায় রপ্তানিও পিক করছে আস্তে আস্তে।
২। সরকার অনেক বেশি বৈদেশিক ঋণ নেয়া শুরু করেছে। নতুন বাজেটে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৮০ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ নেয়ার রেকর্ড টার্গেট সেট করা হয়েছে। এর বিপরীতে নতুন টাকা ছাপানোর একটা যজ্ঞ (টাকশাল পেপার, কালি ইত্যাদি কেনাতেও) শুরু হয়েছে। ফলে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ, আইডিবি, জাইকা, চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার তোড়ঝোড় শুরু হয়েছে। ওয়ার্ড ব্যাংক ও এডিবি ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ঋণ ছাড় করেছে। এতে রিজার্ভে প্রভাব পজিটিভ পড়েছে। কথা হচ্ছে আপনি বৈদেশিক ঋণ রেকর্ড বাড়ালে আপনাকে তো রিজার্ভের স্থিতিও রেকর্ড বাড়াতে হবে, নাইলে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কিভাবে করবেন!
৩। এখানে আরো একটা ট্রিক আছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং হাইজের পাওনা ডলার রিলিজ করার ঠিক আগেই রিজার্ভ স্থিতির সংবাদ সম্মেলন করা হয় বলে এতে কয়েক বিলিয়ন ডলার বেশি দেখায়, এটা একটা চর্চা, এতে সমস্যা দেখি না।
৪। কয়েক মাস পরে ধীরে ধীরে আমদানি,এশিয়ান ক্লিয়ারিং হাউজের ফরেন কারেন্সি, বৈদেশিক ঋণের কিস্তি নিয়মিত দেয়া শুরু করলে রিজার্ভ কিছুটা কমে আবার ৩০-৩২ এর সেটেল হবে। অভ্যন্তরীণ বাজার কতটা পিক করে, তার উপর আমদানি পিকের অবস্থা নির্ভর করবে। আমদানী পিক না করলে, মেগা প্রকল্প গুলোর কাজ আবার পুরোদমে শুরু হতে দেরি হলে রিজার্ভ বেশ কয়েক মাস ভালই থাকবে। এই ভালো থাকার সাথে দেশের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে পড়া দারিদ্র্য এবং প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া বেকারত্বে উন্নতির কোন সম্পর্ক কি টানা হবে?
৫। অনেকেই বলছেন সরকার ঘোষিত রেমিটেন্স প্রণোদনা হাতিয়ে নিতে, ব্যবসায়ীরা অলস টাকা বাইরে হুন্ডিতে পাচার করে তারপর রেমিটেন্ট হিসেবে দেশে ঢুকানোর একটা চল শুরু করেছে। বাংলাদেশে চুরিতে ইনোভেশনের যে মাত্রা, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ীক দুর্বিত্তপণার যে গভিরতা তাতে অতি উর্বর মস্তিকের পাচারকারী দল এবং কালো টাকার মালিকরা এটা করে থাকলে আমি খুব অবাক হব না। এটার গভীর তদন্ত দরকার।
তবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, টাকা দেশ থেকে হুন্ডি করে বাইরে নিয়ে আবার রেমিটেন্স হিসেবে ব্যাংকে আসার পরে যে ২% প্রনোদনা পাওয়া যাবে তা দুটি কনভার্শন লসের রেইটের প্রায় সমান হবার কথা। একটি কনভার্শনে ১% লস হবার কথা। তবে একই ব্যবসায়ী গ্রুপের নিজস্ব পাচারকারী ও হুন্ডি ব্যবসা থাকলে কনভার্শন লসের হিসাব ভিন্ন হতে পারে। বাংলাদেশে বহু নামী দামি ব্যবসায়ী গ্রুপ হুন্ডি, মানব পাচার সহ অভ্যন্তরীণ শিল্পে একযোগে জড়িত। তাই এটা অমূলক নয়।
তদন্তে যদি দেখা যায় প্রণোদনার ২%, ২টি কনভার্শন রেটের যোগফল থেকে বেশি বা সমান হয় তাইলে আমি বলবো রেমিটেন্স প্রণোদনা কিছুটা কমানো হোক, যাতে এই চক্রাকার টাকা পাচার+ ডলার রেমিটেন্স আনার কাজে সিগ্নিফিক্যান্ট এমাউন্ট লস হয়। যদিও এতে প্রবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
তবে ফরেন ব্যাংকিং ট্রাঞ্জেকশান, রেমিটেন্স এবং এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট ডেটার সমন্বয় ঘটানো এনালাইসিস, অটোমেটেড সিস্টেম করে, কার্ব মার্কেট মনিটরিং করে, হুন্ডি চক্রের বিরুদ্ধে কার্যকর একশন নিয়ে এই দুর্বিত্তপনা বন্ধ করাই স্থায়ী সমাধান, সাময়িক রেমিটেন্স প্রনোদনাও কালো টাকার মালিকদের থামাতে পারবে না।
মোটকথা রেমিটেন্স প্রণোদনার কারণে ব্যক্তি পর্যায়ে হুন্ডি কমে গেছে বটে, তবে কালো টাকার মালিক রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের চক্রাকার হুন্ডি বেড়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
৬। এখানে আরো কথা আছে, কালো টাকাকে একেবারে ফকফকে সাদা এবং ভবিষ্যতে বৈধভাবে আবারো বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ তৈরির জন্য, পদ্ধতিগত সুবিধা নিবে। এক্ষেত্রে অবৈধ আয়কারী রাজনীতিবিদরা, কালো টাকার মালিকরা কনভার্শন লসেও রেমিটন্স প্রণোদনার সুযোগ নিয়ে থাকবে। যেহেতু নতুন বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সব বাঁধা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে, আবারো বলছি এই দিকটা, তদন্ত সাপেক্ষ। তবে অলস কালো টাকা যদি -১-১+২=০% এ, কিংবা কিছু লসেও বিনিয়োগ উপযোগী ফরেন কারেন্সি কিংবা ফকফকে সাদা বাংলা টাকা হয়ে যায় তাতেও ব্যবসায়ীরা কখনই আপত্তি করবে না।
৭। ফেব্রুয়ারি থেকে টানা রেমিটেন্স কমে হঠাত গত মাসে বাড়ার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, তা হচ্ছে লকডাউন আফটার ইফেক্ট। লকডাউন অনিশ্চয়তায় প্রবাসিরা না পাঠিয়ে কিছু সঞ্চয় রেখে দিয়েছেন চলার জন্য, অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। যেহেতু বিদেশে লকডাউন খুলতে শুরু করেছে, কাজ শুরু হয়েছে, তাই উনারা টাকা পাঠানো শুরু করেছেন। এতে হঠাত রেমিটেন্স বেড়েছে।
৮। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এখন অসুখ বিশুখ লেগে আছে। পরিবারের অনেকেই অসুস্থ, চিকিৎসার বেশি টাকা দরকার খুব। তাই প্রবাসীরা ধার দেনা করেও কিছু টাকা বেশি পাঠাতে শুরু করেছেন। পরিচিত অনেকের ক্ষেত্রেই এই ঘটনা ঘটেছে।
৯। জুনে রেমিতেন্স বাড়ায় রমজান ও রোজার ঈদের প্রভাব ছিল।গতমাসে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির মূল কারণ হলো রমজান মাসে প্রায় প্রতিজন প্রবাসী চেষ্টা করে দেশে টাকা পাঠানো জন্য, এটা বছরের পিক মাস। রেমিট্যান্স ফ্লো স্বাভাবিক থেকে কমবে ব্যাপকভাবে কারণ লকডাউন উঠে গেলেও চাকরীর পরিস্থিতি ঠিক হয় নাই,সৌদি আরবে হজ্জ্ব কেন্দ্রিক কর্মসংস্থানও প্রায় বন্ধ,তাই প্রবাহে ব্যাপক পরিবর্তন হবে নিশ্চিত।।
কয়েক মাসের মধ্যেই ধীরে ধীরে আমদানি আর এশিয়ান ক্লিয়ারিং হাউজের ডলার, বিদেশ নির্ভর মেগা প্রকল্প শুরু, আমদানি বৃদ্ধি, বৈদেশিক ঋণের কিস্তি নিয়মিত দেয়া শুরু করলে রিজার্ভ কিছুটা কমে আবার ৩০-৩২ এর সেটেল হবে। প্রায় ৫০ থেকে ৫৭ বিলিয়ন ফরেন কারেন্সি ডেবট এর বিপরীতে ৩২-৩৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ স্থিতির রিস্ক ম্যানেজমেন্ট স্থিতি থাকা খুবই দরকার। যেহেতু বৈদেশিক ঋণের আউট স্ট্যান্ডিং বেড়েছে তাই আপানকে আনুপাতিক হারে ফরেন কারেন্সি রিজার্ভের স্থিতিকে বাড়াতে হবে।
ঠিক একবছর আগে, জুন ২০১৯ এ বাংলাদেশের মাথাপিছু ঋণ ৬৭ হাজার টাকা ছিল। কিন্তু গত একবছরে রেকর্ড প্রায় ৭১ হাজার টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণ করেছে সরকার, যা বিগত ৪৭ বছরের মোট ঋণের সমান। পাশাপাশি ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ করেছে সরকার। ফলে বর্তমানে মাথাপিছু ঋণ ৮০-৯০ হাজারের মধ্যে বলেই মনে করি। আওয়ামীলীগ সরকারের বিগত ১২ বছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণ অন্তত ১১ গুণ বেড়েছে। এইসময়ে ঋণের সুদ প্রদান কথিত মেগা বাজেটের ৩য় সর্বোচ্চ একক (১১%+) খাত হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে।
তাই বলছি, করোনা লকডাউন উন্মুক্ত হওয়া, আমদানি প্রায় বন্ধ থাকা, পারিবারিক অসুস্থতা জনিত বাস্তবতার মধ্যে রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে, রিজার্ভের রেকর্ড স্থিতিতে লাফালাফির কিছু নেই। বরং সেন্সিবল ঋণ ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছ খরচের পরিকল্পনা চাই। এই পরিকল্পনার সাথে করোনার কারণে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে পড়া দারিদ্র্য এবং প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া বেকারত্বে উন্নতির সম্পর্ক টানা হোক।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০২০ ভোর ৪:০৩