(নোটঃ কিছুটা বড় পোষ্ট। তবে কানেক্টেড রাখার চেষ্টা করেছি। আশা করি ওর্থ রিডিং হিসেবে পাবেন।)
জলবায়ু পরিবর্তন, ঋতু বৈচিত্রের ক্রমবর্ধমান ভারসাম্যহীনতা, অনিয়মিত বৃষ্টি (অতিবৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টি), শক্তিমান দেশ সমূহের তৈরী ফারাক্কা রূপী মরণফাঁদ, আন্তর্জাতিক নদ নদীর পানি প্রত্যাহার ও প্রবাহ পথের পরিবর্তন , উৎস থেকে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ হ্রাস, পলি পতন আর কূলের ভাঙ্গন জনিত নাব্যতা হ্রাস, অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক পানির উৎসের গভীরতা বৃদ্ধি, সর্বোপরি সমতলের সাধু পানি অঞ্চলে সাগরের লবণাক্ত পানির আগ্রাসন ইত্যাদি ইত্যাদি বহুবিধ কারণে বাংলাদেশের কৃষক দিন দিন পানি হারা হয়ে পড়ছেন। ফসলের মৌসুমে চারদিকে পানির হাহাকার সুতীব্র হচ্ছে।
এমতাবস্থায় ধান গবেষণা প্রঠিস্থান "ইরি" ও "বিরি" পানি সাশ্রয়ী ও লবনাক্ততা সহনশীল ধানের জাত উৎপাদন করে দেশের অর্থনীতিতে এবং খাদ্য নিরাপত্তায় অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। এই গবেষণা কর্মটিকে রাষ্ট্রীয় ভাবে অসীম সম্মানে সিক্ত করা খুবই প্রয়োজন।
পরিবর্তিত জলবায়ুর অনিরাপদ বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ গুলো মোকাবেলায় আমাদের এখন থেকেই বহুবিদ পরিকল্পনা হাতে নেয়া জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য বিষয়ের শুধু একটি মাত্র হতে পারে এমন যে "আমরা আমাদের খাদ্যাভ্যাস কে ধীরে ধীরে কিন্তু কার্যকর ভাবে পরিবর্তন করব যেখানে পানি নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমে আসে "
আলোচনার গভীরে আসলেই ধান প্রসঙ্গ আসবে। ধান চাষ অতিমাত্রায় পানি নির্ভর। সুতরাং ভাত প্রধান জাতি সমূহ খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম শিকার হবে। এটা এমন এক ফসল যেখানে স্থির কিংবা বদ্ধ পানি আবাশ্যক। এটাই প্রধান সমস্যা। আজ থেকে ৫০ বৎসর পর এত বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদনের পানি আসবে কোথা থেকে? সেই সময়ের চাহিদার একটা ট্রেন্ড বের করা সম্ভভ হলেও জমির ক্রমবর্ধমান অনুর্বরতা, নদীর এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস এবং কেমিক্যাল নির্ভরতার কারনে উৎপাদন কেমন হবে সেই ট্রেন্ড বের করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে!
উন্নত বিশ্ব বহু আগে থেকেই ধান চাষকে নিরুৎসাহিত করে গম, আলু, জব, ভুট্রা বা অন্যান্য কর্ণ ইত্যাদিকে প্রধান খাদ্য তালিকায় ঠাই দিয়েছে, এটা যেমন হয়েছে প্রাকৃতিক ভাবে তেমনি হয়েছে বহু বছরের সুনিয়ন্ত্রিত কর্মসূচীর মাধ্যমে।
ঠিক যেভাবে ইরি বিরি এবং বারি ধানের উপর উচ্চমান গবেষণা চালিয়ে উফশী এবং লবনক্ততা সহায়ক জাত বের করেছে, কিংবা গাছের দৈর্ঘ্য ছোট করে পানি নির্ভরতা কিছুটা কমিয়েছে, একইভাবে গম সহ অন্যান্য সামান্য পানিনির্ভর শস্যের উপর মৌলিক গবেষণা করা দরকার হয়েছে যাতে তুলনামূলক কম শীতেও (বা নাতিদীর্ঘ শীতকালীন সময়ে) বাংলাদেশের মাটির অণুজীব এবং উর্বরতার নিরিখে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ এর বিবিধ কৃষি প্রসঙ্গঃ
এই তিন দশক আগেও আমাদের দেশে শীতকালীন ফসল হিসেবে ব্যাপক ভাবে গম, কাঊন, ভুট্রা, বিভিন্ন ডাল বীজ (হেলেন, মটর, খেসারি, মুগ) ইত্যাদি আবাদ হতো যার প্রত্যেকটিই প্রধান খাদ্য তালিকায় আসার উপযুক্ত দাবিদার। আর এই সবগুলো ফসল অতি সামান্য পানি নির্ভর, গবেষণার মাধ্যমে যাকে আরো উন্নত করা সম্ভভ ছিল এবং আছে।
কিন্তু সার্বিক অবহেলায় আর দূরদৃষ্টির অভাবে প্রত্যেকটি ফসল ই আমরা হারিয়েছি, অতি আশার কথা যে আমরা বিনিময়ে আলু ফসল পেয়েছি যা আরেকটি পানি সাশ্রয়ী ফলন।
সরকারীভাবে কিছু প্রণোদনা এই প্রাপ্তির পেছনে অনস্বীকার্য অবদান রেখেছে, তেমনি আমাদের কৃষকরা আলুকে অর্থকরী ফসল আর খাদ্য দুটি পর্যায়েই আদৃত করেছেন। তাই সামাজিক আন্দোলন এর এই শ্লোগান "বেশি করে আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান" একটি নীরব সবুজ বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়েছে। আবারো বলছি, সরকার গুলোর ভুমিকাকে আমি অত্যন্ত সম্মানের চোখে বিবেচনা করি।
তবে কথা থেকে যায়, আলু কেন্দ্রিক সবুজ কৃষি বিপ্লবের সুদীর্ঘ তিন দশক পর আজ আবার আমাদের প্রাপ্তির হালখাতা খুলে বসার খুব খুব প্রয়োজন,
ক। আমরাকি চাহিদার সাথে সামাঞ্জস্য রেখে উৎপাদন করছি? খ। কৃষকের ঘাম ঝরানো উৎপাদনের আর্থিক মুল্য নিশ্চিত করছি? গ। উন্নততর প্রজাতির আলু উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজার খুজেছি? ঘ। আলু সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করেছি? ঙ। উৎপাদন মৌসুমে (হারভেস্ট) কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের নিরাপত্তা মজুদ কিংবা বাজার মুল্যে দিয়েছি?
এই মৌলিক প্রশ্ন গুলো সম্পূরক ভাবে প্রধান প্রধান সব ফসলের দৃষ্টিকোণ থেকে আসতে পারে। শুধু আলু নয় ফলন মৌসুমে ধানের জন্যও উপরের প্রশ্ন গুলার উত্তর খোঁজা জরুরী। একটি পণ্যের বাজার সূচনা করে বসে থাকলে হবে না তার বিকাশ নিশ্চিত করা সূচনা অপেক্ষা জরুরী। এটা বাজার অর্থনীতিরও একটি উপাদান।
আজ আমাদের কৃষকের সামনে ভায়াবহ বিভীষিকা। ৮-৯ টাকা উৎপাদন খরচের আলুর বাজার মুল্য কৃষকের হাতে ভরা মৌসুমে (সোর্স এন্ড) ৩-৪ টাকা, এটা সামান্য একটা ভয়াবহতা নয়, এরও নীচে যদি কিছু থাকে, তারও নিচের বিষয়। এই অবস্থা উন্নত বিশ্বে হলে বহু কৃষক আত্মহত্যা করতেন। হাঁ ব্যাপারটি সেই রকমের ভয়াবহ। এভাবে আমরা ফলন মৌসুমে ধান চাষিদেরও নিরাপত্তা হীন করেছি। এর কুফল সামনে আসছে। সহজ কথায় এভাবে খামখেয়ালীপনা আর অবহেলায় আমাদের কৃষির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাচ্ছে। জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ।
বাজার চাহিদা এবং রপ্তানীর সম্ভাবনার সাথে সামাঞ্জাস্য রেখে ফসল উৎপাদনের টার্গেট নির্ধারণ, কৃষককে বীজ নিরাপত্তা, সেচ ও সারের নিশ্চয়তা দান এবং উৎপাদিত ফসলের নুন্যতম দাম নির্ধারিত ন্যায্য লভাংশ্য সহ নিশ্চিত করা, মধ্য সত্ত্ব ভোগীদের দৌরাত্ত্ব কমানো, মজুদকরন আর পণ্য পরিবহন সহজীকরন আজকের জরুরী কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বাইরে আছে বীজ নিরাপত্তা, অতিমাত্রয় কীটনাশক ব্যবহারের চাকচিক্যময় আগ্রাসন রোধ, জৈব সারের সুলভতা নিশ্চিত করন, জিএমও জাতের ফলন বিনা নিরীক্ষায় অথবা স্বল্প মেয়াদী নিরীক্ষায় অনুপ্রবেশ ঠেকানো (এতে কৃষক বীজের জন্য এনজিও নির্ভরতা বাড়ছে, উৎপাদন খরচ বাড়ছে এবং দেশীয় ফলনে ডিস্কন্টিনিউটির জন্য দেশীয় প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে)।
বাজার চাহিদা নির্ণয়ের ব্যাপারটি আসলেই সরকার ও সরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের অনেক অনেক দায়িত্ব ও করণীয় চলে আসে। এটা একটা ব্যাপকতর কাজ। কৃষক, তার সামর্থ্য, বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনের মাত্রা ও প্রয়োজনীয়তা, সংরক্ষণের সক্ষমতা ইত্যাদি বহু সম্পূরক বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে। এতে করে একটি ফসলের সারপ্লাস হয়ে যাওয়া কমবে, বর্ষা ও বন্যা মৌসুমে অন্য ফলনের আমদানি নির্ভরতা কমবে। একটি উদাহরন হতে পারে আলু ও পিঁয়াজ। শীত মৌসুমে উৎপাদিত পন্য হলেও একদিকে একটির বাম্পার ফলন হচ্ছে যাকে অবকাঠামোর (কোল্ড স্টোরেজ, সংখ্যায় এবং লোকেশন ভিত্তিক ) অভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভভ হচ্ছে না। অন্যদিকে আমাদের পিঁয়াজ উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, বিশেষ কারনে অনুৎসাহিত বটে এবং পিঁয়াজ আমদানিতে আমাদের একটি ভালো পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।
অর্থাৎ আমরা বলছি একটি সমন্বিত ফলন সহায়ক কৃষি পরিকল্পনা এবং পরিবেশ তৈরি করতে হবে, জাতে বাজার চাহিদা ফোরকাস্ট করে শস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে। কৃষক নিজ নিজ স্তানীয় কৃষি অফিসে নিজের ফলনের রকমভেদ, আবাদক্রিত জমি এবং আনুমানিক উতপাদনের আভাস রেজিস্ট্রার করবেন। বাজার চাহিদা ফোরকাস্ট অনুযায়ী আঞ্চলিক কৃষি অফিস সেটা উৎসাহিত বা অনুৎসাহিত করবে। এতে করে ফলনের উতপাদনে বৈচিত্র্য আসবে, বিশেষ ফলনের সারপ্লাস হবে না। এর অন্য একটি গুরুত্ব পূর্ণ দিক হোল, এটা কৃষি খাতে অবকাঠামো উন্নয়নে ইনভেস্ট করা শিল্পপতি দের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। উদাহরন হলো, কোল্ড স্টোরেজ ম্যানেজমেন্ট ইফিশিয়েন্ট হবে। পূর্বের বৎসরের অতিরিক্ত পন্যের খালাশ না হবার কারনে নতুন বৎসরে স্টোরেজ মালিকের ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে না। অন্য একটি দিক হলো ট্রান্সপোর্ট (পরিবহন) চাহিদা নির্ধারন এবং অপ্রয়োজনীয় ট্রান্সপোর্টেশন রোধ। মানে হোল একদিকে অপ্রয়োজনীয় অধিক ফলন নিরুৎসাহিত হবে, অন্যদিকে গুরুত্ব পূর্ণ বিশেষ ফলনের উপর কৃষক মনোযোগ হাবে না, সেই সাথে কৃষি অবকাঠমো উন্নয়েনে বিনিয়োগ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়বে।
খাদ্য নিরাপত্তার অতি আবশ্যকীয় অন্য একটি দিক হলো কৃষি জমির মান সংরক্ষণ। মানসম্পন্ন ও মানহীন উভয় প্রকারের কীটনাশক আর গুনাগুন সম্পন্ন কিংবা গুনাগুণ শূন্য রাসায়নিক সারের ব্যাপক হারে ব্যবহারের ফলে আবাদী জমি তার উৎপাদন সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। সুতরাং আমাদেরকে রাসায়নিক ও জৈব সারের মধ্যকার সামঞ্জস্য নির্ণয় করতে হবে। অত্যন্ত কঠোর ভাবে গুনাগুণ হীন অথবা ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিপনন নিয়ন্ত্রন করতে হবে। এই কাজটি সরকারকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে পালন করতে হবে। এখানে একদিকে যেমন গবেষণা মুলক কর্ম (সঠিক স্থানে অর্থ বরাদ্দ প্রদান, উৎসাহ দান, রোডম্যাপ তৈরি) করতে হবে তেমনি নিয়ন্ত্রন মূলক পদক্ষেপও নিতে হবে। সেই সাথে কৃষকের আঞ্চলিক বা মৌসুমি সমস্যা গুলি (বিশেষ রোগের বা কীট পতঙ্গের প্রাদুর্ভাব) যত্ন সহকারে আমলে আনতে হবে। সময়মত ও প্রয়োজনমত রাসায়নিক ও জৈব সার উৎপাদন আর এর বিতরন নিশ্চিত করতে হবে।
কীটনাশক ব্যবস্থপনার উচ্চতর ধাপে গিয়ে এটিকে সঙ্কুচিত করে আনতে হবে। উচ্চ মাত্রার কীটনাশক একদিকে যেমন ক্ষতিকর পতঙ্গ দমন করে তেমনি কিছু পতঙ্গ প্রজাতিকে প্রতিরোধী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে কৃষক একটি অনন্ত চক্রে পড়ে যান, যাতে তাঁকে বছর বছর উন্নততর কীটনাশক ব্যবহারের উপর নিরভরশীল হয়ে পড়তে হয়। এটি কৃষি বিপনন কোম্পানি গুলোর ক্রমবর্ধমান প্রসারতার হেতু। খাদ্য নিরাপত্তার অতি উচ্চতর ধাপে আমাদের এই সূক্ষ্ম ব্যাপার গুলো নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা নিয়ে আসতে হবে যেটা কিনা জৈব ব্যাবস্থপনাকে কৃষক আর কৃষি জমির মান সংরক্ষণের অনুকূলে নিয়ে আসবে।
খাদ্য নিরাপত্তার পরবর্তী ধাপে গিয়ে জেনেটিকালি মডিফাইড ফলনের জাতকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে কিংবা এইসব জাতের অনুপ্রবেশকে সার্বিক ভাবে বাঁধাগ্রস্ত করতে হবে , যাতে এর প্রভাব কীট পতঙ্গের জীবন চক্র, প্রাসঙ্গিক জৈব অনুষঙ্গ, এবং প্রাকৃতিক খাদ্য চক্রের ব্যাল্যান্সকে ধ্বংস করে না দেয়। এই ভাবে অতিরিক্ত ফলন সহায়ক সার ও কীটনাশক ও অতি দীর্ঘ মেয়াদী গবেষণা করে উপযোগীতা নির্ণয় সাপেক্ষেই শুধুমাত্র বাজারজাতের অনমুতি দিতে হবে। এই ধরনের গবেষণা সুবিধা এবং কাঠামো উভয়ই আমাদের অপ্রতুল।
তারপর আসবে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পরিকল্পনা সমূহ, যেমন খাদ্যাভ্যাসকে পরিকল্পিত ভাবে নিয়ন্ত্রন করে এর প্রকৃতি পরিবর্তন করার সুদূরপ্রসারী এবং বুদ্ধি ভিত্তিক ব্যাপার যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে পানি সাশ্রয়ী ফসল গুলোকে (যেমন, গম, আলু, ভুট্রা, কাউন ইত্যাদি ) প্রধান খাদ্য তালিকায় নিয়ে আসা যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষক, নিট্রিউশন এক্সপার্ট, ডাক্তার এবং কৃষি বিজ্ঞানীদের কার্জকর ইন্টেলেকচুয়াল ভূমিকা রাখতে হবে। মোদ্দাকথা হলো আমাদেরকে খাদ্য নিরাপত্তার কার্যকর পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে ধানের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে, চাষাবাদে পানি বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন আর তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তার অন্য একটি বিষয় হলো কৃষককে প্রয়োজনীয় প্রধান প্রধান শস্যের ফলন গুলোর সাথে বছর বছর সম্পৃক্ত রাখা। একটি নতুন ফলনকে রাষ্ট্রীয় উৎসাহ আর প্রথম দিককার আর্থিক প্রণোদনার বলয়ে রেখে বিকশিত করা সম্ভব (যেমনটি আলুর ক্ষেত্রে হয়েছে বাংলাদেশে গত দশক গুলতে) কিন্তু সেই ফলনটিই যদি প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ( প্যাসিভ ) সমস্যার কারণে কৃষকের মন থেকে উঠে যায় তাকে ফিরিয়ে আনা একবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে যেমনটি হয়েছে গম ফসলের বেলায়, যেটি কিনা অত্যন্ত পানি সাশ্রয়ী। বাংলাদেশে আজ কৃষকের সরাসরি সমস্যা গুলোর তালিকাই অনেক দীর্ঘ, এর সাথে যোগ হয়েছে প্যাসিভ সমস্যা যেমন-১। পণ্যের মুল্যের তুলনায় তার পরিবহন খরচ বেশি। ২। পরিবহনের সময়,পন্য পরিবহনের পিছনে কৃষকের শ্রম ঘন্টা্র অপচয়। ৩। লজ্জাকর চাঁদাবাজি (কৃষি পন্য উৎপাদনে আর তার পরিবহনে চাঁদাবাজি...কৃষিতে বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাতাদের লোকসান (গুদামজাত ফসলের বাজারমূল্য পরিবহন খরচের তুলনায় কম তাই পন্য খালাস হচ্ছে না, নতুন গুদাম বিঘ্নিত হচ্ছে)। ৫। উৎপাদনকারী চাষির তুলনায় মধ্য সত্ত্ব ভোগী দালালদের লভাংশ বেশি। ৬। সার, বীজ, শ্রমিক, সেচ, কীটনাশকের দাম এর অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি। ৭। নিম্ম মুল্যের কারণে সৃষ্ট অপরিশোধিত কৃষি ঋণের দায়ভার ইত্যাদি ইত্যাদি।
সুতরাং দীর্ঘ মেয়াদে একটি পানি বান্ধব ফলন পরিকল্পনা গুলো বাস্তবায়ন করতে চাইলে প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সমস্যা সমাধান করে কৃষককে প্রধান প্রধান শস্যের ফলন গুলোর সাথে বছর বছর সম্পৃক্ত রাখা জরুরী।
এভাবে পর্যায়ক্রমে আলোকপাত করতে হবে কৃষি ভূমি সংরক্ষণের উপরও। ক্রমবর্ধমান জনবসতির চাপ আর শিল্প বিকাশের ফলে কৃষক আবাদ যোগ্য ভূমি হারাচ্ছেন, কৃষি উতপাদনে যার প্রভাব খুবই নেগেটিভ। কৃষি ভূমি সমীক্ষা করে সংরক্ষণ দরকার। কৃষি ভূমি সংরক্ষণের বিপরীতে শিল্প প্রসারণে কৃষি ভূমি অধিগ্রহন করা বা না করার কৃষি বান্ধব নীতিমিলা চূড়ান্ত করা দরকার। বসত বাড়ি নির্মানে কৃষি ভূমি ভরাটের ভয়ংকর ট্রেন্ড বন্ধ করে কার্যকর ভার্টিক্যাল কন্সট্রাকশন এর নীতিমালা এবং তার কঠোর বাস্তবায়ন চাই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে উপকূলীয় কৃষি প্রাকৃতিক ক্যালেন্ডার কিংবা আমাদের কৃষকদের দীর্ঘ সময়ের এডাপ্টেড ক্যালেন্ডার ব্যাহত হচ্ছে, তাই উনারা পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন, আস্তে আস্তে শুহুরে বস্তিতে এসে ভিড়ছেন। জলবায়ু জনিত ডিস্প্লেইস মেন্টের বাইরে আছে, ইকোনমিক ডিস্প্লেইস্মেন্ট (শিল্প প্রসারে কৃষি জমির দাম বাড়ছে, কৃষক ভূমি হীন হয়ে টারমিনিটেড হচ্ছেন। এর বাইরে ব্যাপক আকারে রাজনৈতিক ডিস্প্লেইসমেন্ট আছে, আছে সীমিত আকারে ক্ষুদ্র ঋনে জর্জরিত হয়ে গরীবের এলাকা ছাড়ার ব্যাপার। এই সবগুলো ব্যাপারই কৃষি উৎপাদনের উপর প্রভাব ফেলছে। অনেক মানসম্পন্ন বা গুণী কৃষক চাষাবাদ থেকে দূরে সরে অন্য পেশায় অন্তরীন হচ্ছেন।
পাশাপাশি আসবে কৃষিতে নিবেদিত অমানবিক পর্যায়ের কায়িক শ্রমের ব্যাপার গুলো। সুতরাং যান্ত্রিক চাষাবাদের অনুষঙ্গ (মেশিন টুলস) গুলোকে দেশীয় প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে যাতে কৃষি সারঞ্জামের দাম সাধ্যের নাগালে আসে। এখানে সাবসিডি দেয়া চাই। প্রত্যেক ইউনিয়ন পর্জায়ের কৃষি অফিসে নাম মাত্র টাকায় ব্যাপক পরিসরে কৃষি সারঞ্জাম ভাড়া দেবার বন্দবস্ত করা যেতে পারে। জমি তৈরি, বীজ ছিটানো, আগাছা পরিস্কার,পানি সেচ, হারভেস্ট প্রত্যেকটি কৃষি ইভেন্টকে দেশীয় প্রযুক্তির আওতায় আনতে পারলে কৃষক তার পেশাকে আনন্দময় ভাববেন এবং কৃষিতে তাঁর ইনভল্ভমেন্ট ও ইনভেস্টমেন্ট বাড়াবেন। কায়িক শ্রমের বিলোপ ঘটানো গেলে শিক্ষিত এবং স্বল্প শিক্ষিতদের কৃষিতে টানা সহজ হবে।
ক্রমান্বয়ে আসবে অনিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণকে চরম পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপার। অবারিত প্রাকৃতিক উৎস থেকে অনিয়ন্ত্রিত কৃষি ও মৎস্য সম্পদ আহরণ গ্রামীণ কর্মসংস্থানেরআদিম উপায় হলেও জলবায়ু পরিবর্তন এবং অনিয়ন্ত্রিত হিউম্যান ইন্টারভেনশন এর কারনে প্রাণ এবং পরিবেশ এর চরম বিপর্জয়ের ঝুকির উপর দাঁড়িয়ে আমাদের আজ কর্মসংস্থানের সেসব মধ্যমকে পুনরায় ভাবনায় আনতে হবে। চাষ না করে ওয়াইল্ড সোর্স থেকে মধু আহরণ, চাষ না করে মৎস্য আহরণ বা নিধন, পাখি শিকার, সুন্দরবন সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক বন থেকে মধু, মোম, চিংড়ী পোনা, উদ্ভিদ্য এবং প্রাণীজ সম্পদ আহরণের ন্যাচারাল এবং প্রাচীন ব্যাপারগুলো আমাদের ওয়াল্ড লাইফ, জৈব বৈচিত্র, মৎস্য প্রজনন এবং পরাগায়নের মত মৌলিক ব্যাপার গুলোকে বিষিয়ে তুলছে তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। মাছের ডিম এবং ডিমওয়ালা মাছ খাওয়ার কালচার বন্ধ করতে হবে, বন্ধ করতে হবে ন্যাচারাল মৌচাক থেকে মধু আহরণের ব্যাপার গুলো। বিচ্ছিন্ন ভাবে নদী, বন ও বাঘ রক্ষার অকার্জকর আন্দোলন এবং ইনভেস্টমেন্ট না করে বিস্তৃত গ্রামীণ জনসাধারণের (মৌয়াল, বনজীবি, মৎস্যজীবী) বিকল্প কর্মসংস্থানের উৎস বের করে পাখি, মৌমাছি, নদী এবং বন বাঁচাতে হবে। মৌমাছি এবং সাধু পানির মৎস্য প্রজাতির সংরক্ষণে অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক সার কীটনাশক চাষাবাদ নিয়ন্ত্রিত করে মৃত্তিকা, পানি এবং মৎস্য সংবেদনশীল চাষাবাদের উপর জোর দিতে হবে। প্রাণ এবং পরিবেশ রক্ষায়, মৌমাছি রক্ষায় এবং মা মাছ রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে। বন বাঁচাতে সবার আগে বনজীবিদের বাঁচাতে হবে। কৃষি পন্য উৎপাদন পুরোপুরি প্রকৃতির উপর ছেড়ে না দিয়ে, পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিক চাষাবাদ ভিত্তিক করে তুলে প্রাকৃতিক কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উৎসগুলোকে রক্ষায় মনোযোগী হতে হবে।
বাংলাদেশ সংকটে কিংবা দুর্যোগে খাদ্য শস্য আমদানি করে থাকে। এর বাইরে নিয়মিতই বাইরে থেকে বীজ আমদানি করা হয়। বায়ো সিকিউরিটি টেস্ট বা জেনেটিক টেস্ট, ফাঙ্গাল টেস্ট বিহীন বাছবিচারহীন হীন বীজ আমদানি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে চারম ঝুঁকি পুর্ণ অবস্থায় নিয়ে গেছে। অথচ আমাদের দেশে কয়েক হাজার ধান জাত ছিল, যার মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে বহু ন্যাচারাল উচ্চ ফলনশীল জাত ছিল। বারির বীজ রক্ষার হিমাগারের চিলার নষ্ট ছিল কয়েক মাস, ফলে প্রায় ৮০০ ধান বীজ প্রজাতির ভাগ্য কি হয়েছে জানা যায়নি। নিজস্ব বীজ থেকে নিজেদের কৃষকদের ডিস্কানেক্টেড করে বিদেশী বীজ (পড়ুন বায়ো ওয়েপন) ধুকিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ডাম্পিং, মেয়াদুত্তীর্ণ খাদ্য শস্য আমদানিতেও কোন টেস্ট হয় না। (একটি ধারণা এমনো আছে ব্রাজিল থেকে আনা পচা গম থেকে নেইক ব্লাস্ট পরবর্তিতে গুদামজাতকরনের প্রক্রিয়ায় কোন ভাবে ফসলী বীজে ট্রান্সফার হয়)। উল্লেখ করা যেতে পারে প্রায় ৩ দশক পরে এসে গত ২০১৬তে চালের উৎপাদনে শূন্য প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে, আগামীতে এটা নেগেটিভে যাচ্ছে।
বিদ্যমান নির্মাণকৌশল ও প্রযুক্তি কোনোভাবেই পরিবেশবান্ধব বা কৃষিবান্ধব নয়। নির্মাণ করতে গিয়ে আমরা আমাদের মাটি, পানি, উর্বরতা, পরিবেশ এবং প্রতিবেশকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলেছি। ইটের ভাটা মাটি, পানি, জলজ বাস্তুসংস্থান,মাটির অণুজীব ও উর্বরতা ব্যবস্থা অর্থাৎ বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশের জন্য মরণ ফাঁদ! ভূমির উপরিভাগের মাটি উর্বর। মাটির উপরিভাগের অণুজীব ও উর্বরতা ব্যবস্থাপনাকে ধ্বংস করে দিয়ে বর্তমানে বছরে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয় কমবেশি ২ হাজার ৫০০ কোটি পোড়ামাটির ইট। এর কাঁচামাল হিসেবে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টন কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি নষ্ট হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিবছর ১ শতাংশ কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। এর ৯৭ ভাগ নষ্ট হচ্ছে অপরিকল্পিত গ্রামীণ গৃহায়ণ ও ইটের ভাটার কারণে ওপরের মাটি তুলে ফেললে সেই জমির উর্বরতা কমপক্ষে ২০ বছরের জন্য নষ্ট হয়ে যায়। যে ৫০ লাখ টন কয়লা ইটের ভাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে তা দুনিয়ার নিকৃষ্টতম ভারতীয় কয়ালা যাতে অশোধনযোগ্য সালফারের পরিমান ৬% এর বেশি, উচ্চ মানসম্পন্ন হিসেব কয়লার মান হিসেবে এটা প্রায় ১০ থেকে ২০ ভাগ। এই কয়লার অশোধিত অপদ্রব্য বাংলাদেশের জল স্থল এবং বাতাস বিষিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের কৃষকের স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে ইটের ভাটার অশোধিত হাই পার্টিক্যাল এবং ভারত-বাংলাদেশের যাতবতীয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল, ক্যামিক্যাল হ্যাজার্ডে সয়লাব নদীর পানি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ খাবারের পানিতে দূষণ থাকে যা স্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে আনছে এবং হাস্পাতালে রোগীর মিছিল তৈরি করছে। মাটি, পানি, জলজ বাস্তুসংস্থান এবং মাটির অণুজীব ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে পড়ায় আমাদের কৃষককে অতি বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সার বীজ কিটনাশাক ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে ফলনের উৎপাদন খরচ লাগামহীন হচ্ছে, ভূমি আরো বেশি বিষাক্ত হচ্ছে। জমির উপরিভাগের মাটি দিয়ে পোড়া ইট তৈরি করায় দিন দিন খাদ্যের হুমকিতে যাচ্ছে দেশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা পুরোপুরি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এখনও সময় আছে, আমাদের কৃষকদের নিয়ে নাগরিক এবং রাষ্ট্রীয় ভাবনা গভীর এবং চূড়ান্ত করতে হবে। অর্থনীতিতে সাস্টেইনেবল বলে তেমন ধ্রুব কিছু নাই, আগামীর অর্থনীতিতে সাস্টেইনেবল হয়ে উঠবে শুধু কৃষি আর চাষাবাদে পানি ব্যবহারের উৎকর্ষ।
একটা সময় এমন আসতে পারে যখন কাঁড়ি কাঁড়ি বৈদেশিক মুদ্রা থাকলেও পৃথিবীর বহু দেশকে খাদ্য রপ্তানিতে রাজি করানো যাবে না, নিজ নিজ নাগরিকের মৌলিক অস্তিত্বের প্রশ্নে আপোষ করবেনা দেশগুলো। কৃষিপ্রধান দেশ গুলো তাদের নাগরিকদেরও খাদ্য সঞ্চয় করতে বাধ্য করবে। হাঁ একটি বিকল্প আসবে হয়ত, সুপার কেমিক্যাল ফুড বাজারে আসবে। কিন্তু তা প্রাণ ধ্বংসকারী খাদ্য বোমা হয়েই থাকবে যার সত্ত্বও আমাদের থাকবে না।
পুনঃলিখন
১৭ই জানুয়ারি ২০১৬
১ মে ২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৭ ভোর ৪:১৬