বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্প পরিচালনার চিত্র:
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে গবেষণা খাতে সর্বাধিক ব্যয় করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা প্রকল্প পরিচালনায় মোট ২ কোটি ৭২ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করে এ বিদ্যাপীঠ, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেটের ১ শতাংশেরও কম। দ্বিতীয় সর্বাধিক ১ কোটি ৭২ লাখ ৪২ হাজার টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। গবেষণা প্রকল্পের দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে বাকৃবি। এর গবেষণা প্রকল্পের সংখ্যা ১৩৬টি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) গবেষণার জন্য ব্যয় করেছে মাত্র ৫৫ লাখ টাকা। আর বছরজুড়ে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বাস্তবায়িত গবেষণা প্রকল্পের সংখ্যা মাত্র ৭। গবেষণা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯ হাজার টাকা ব্যয় করা হলেও কোনো গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি এ বিশ্ববিদ্যালয়।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা বিষয়ে গবেষণার জন্য ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে কোনো অর্থই ব্যয় করেনি। ইউজিসির সর্বশেষ প্রকাশিত ৪০তম বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গবেষণা খাতে কোনো অর্থই ব্যয় হয়নি, এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় রয়েছে—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়।, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি), বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় এর নিজস্ব আয়ের পরিসর
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের ব্যয় নির্বাহের মোটামুটি চিত্র হল-প্রায় ৮৮-৯০ শতাংশ সরকারি বরাদ্দ আবাসন এবং বেতন খাতে খরচ হয়। তারপর খরচ হয় পরিবহন এবং জ্বালানি খাতে। ন্যূন্যতম খরচ হয় একাডেমিক্স এ। একাডেমিক্স এর ব্যয় পরিসর আনুমানিক ৫-১০% বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে, গবেষণা খাতে সর্বাধিক ব্যয় ১-১.৫%। (ইউ জি সি র প্রতিবেদন রয়েছে এই নিয়ে, আগে একবার লিখেছিলাম)। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এর নিজস্ব আয় রয়েছে, তবে নগন্য।বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের উৎস কি হতে পারে এটা নিয়ে ইন্টেলেকচুয়াল পর্জায়ে বিস্তর আলোচনা হওয়া দরকার।
বুয়েট দিয়েই আলোচনায় প্রবেশ করা যায়। আমরা দেখছি বুয়েটের বিভিন্ন ডিপার্ট্মেন্ট ব্যাপক ভাবে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রকল্পের সাথে জড়িত, এটা অনেকটা বাণিজ্যিক ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের কাঠামো বিবেচনায় এই উপার্জনের প্রেক্ষিত ঠিক আছে বলা যায়। কিন্তু এই প্রকল্প সংশ্লিষ্টতা কে আমরা গবেষণা বলতে পারি না কিছুতেই।
এর একটি নির্দেশক হল, বুয়েট থেকে জার্নাল বের হচ্ছে না তেমন, আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং জার্নালে তো নয়ই।
দ্বিতীয় নির্দেশক হোল, বুয়েট এর পোষ্ট গ্রাড, ডক্টরাল এবং পোষ্ট ডক্টরাল কোর্স সমূহ খুবই সীমিত। যারা বুয়েটে মাস্টার্স করেছেন তাঁরা ব্যাপারটা ভাল মূল্যায়ন করতে পারবেন। ফলশ্রুতিতে বুয়েট পি এইচ ডি ডিগ্রী দিতে পারছে না। পোষ্ট ডক তো সাধ্যেরই অতীত।
তৃতীয় নির্দেশক হোল, আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিদ্যালয় র্যাংকিং এর জন্য বুয়েট বিবেচনায় আসেই না।
এই বাইরে কিছু ইনফরমাল কথা বলা যায়, বুয়েটের ভাল শিক্ষক গন (আসলে প্রায় সকল বিশ্ব বিদ্যালয়েরই) প্রাইভেট বিশ্ব বিদ্যালয়ে আন্ডার গ্র্যাড কোর্স নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, প্রকল্প কন্সাল্টান্সি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আমি আপনাকে জামিলুর রেজা স্যার এর উদাহরন দিচ্ছি, এত এত বাণিজ্যিক প্রকল্পে উনি সারা জীবন ব্যস্ত থেকেছেন যে কখন গবেষণা কাজে সময় দিয়েছেন এটা চিন্তার বিষয়। কারন স্যার উনার সেক্টরে লিজেন্ড। এই সময় ইনভেস্ট গবেষণা, পি এইচ ডি স্টুডেন্ট দের দিলে সেটা কতটা প্রডাক্টিভ হোত! (এটা স্যার এর দোষ নয়, আমি বলছি আমাদের স্ট্রাকচার উনাকে অন্য খানে কানেক্টেড রেখেছে)।
এই সব এক একটি নির্দেশনা- আসলে আমাদের বিশ্ব বিদ্যালয় মানেই হোল গ্র্যাড প্রোগ্রাম! এখানে বিশ্ব বিদ্যালয় নিজেরা মৌলিক গবেষণা করে না, তাই গবেষণা কর্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সেল করতে পারে না। ইন্ডাস্ট্রিও বাণিজ্যিক প্রয়োজন (সনদ দেয়া) ব্যতিত এদের কাছে আসে না। বাণিজ্যিক পন্যের সার্টিফিকেশন গবেষণা হতে পারে না, এটা স্রেফ টেস্টিং।ডিজাইন এবং ইনপ্লেমেন্টেশন কন্সাল্টেশন, কিছু ক্ষেত্রে পুর্ন ডিজাইন।
অন্যদিকে সরকার যত কম পারে বরাদ্দ দেয়।মনে পড়ে, ২০০৪-০৫ এ দেশের শীর্ষস্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাপিঠ বুয়েটকে মাত্র ৩৭-৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, বাকিদের সংখ্যা অনূমেয়! যেখানে একটি মাঝারি রকমের সরকারি বিল্ডিং বা ব্রিজ কন্সট্রাকশন এ এই পরিমান টাকা শুধু দুর্নিতিতেই গচ্ছা যায়, কিংবা মূল্য বেড়েছে বলে এডিশনাল কস্ট কোট করা হয়, যা এপ্রুভও করা হয়। এই নগণ্য পরিমান টাকা ইউরোপ আমেরিকার ৪-৫ জন প্রফেসরের কাছেই থাকে! কথা হচ্ছে উনারা এই ফান্ড কিভাবে পান? কেন পান?
কিছু ভালো কাজ অবশ্যি আছে-বুয়েটের আইসিটি ভালো কাজ করছে, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটুট ভালো কাজ করছে। কিন্তু দেশের প্রয়োজন এর তুলনায় এগুলা নগণ্য, এগুলা দিয়ে ভালো বলা লজ্জার ব্যাপারও বটে।
ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বাজেট বড়, সাব্জেট বেশি সেই সাথে বেশি স্টুডেন্টসও। কিন্তু প্রাচীনতম এই বিদ্যাপীঠ এর গবেষণা কর্মে ১% ফান্ড ব্যয় একটা লজ্জার ব্যাপার। উপরন্তু ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় এর রয়েছে কিছু ইউনিক ডিপার্টমেন্ট। কাজেই গবেষণার পরিসর অনেক বড় হওয়া কাম্য।
এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি গবেষণা কর্মে আমাদের দেশে আগ্রদূত, সংখ্যায় এবং মানে। কিন্তু অনালোকিত, অনালোচিত! জলবায়ু পরিবর্তন কে সামনে রেখে আগামীর দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণায় রিচ করতে হবে ব্যাপক ভাবে। গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে বহু গুনে।
সময় এসেছে গবেষণার পরিসর বাড়ানোর। তাহলে মৌলিক কাজের ভিতর থেকেই প্রতিষ্ঠান আয়ের পথ পাবে, আজকে সান্ধ্য কোর্স চালূ করে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো আয় বাড়াচ্ছে, এটা অনৈতিক, চরম অন্যায়। বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার মূল উদ্দেশ্যের সাথে সরাসরি কনফ্লিক্টেড!
শিক্ষা মান সম্পন্ন হোক!
বাংলাদেশ এগিয়ে যাক!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:১৫