আদালতের কার্যক্রমের প্রকৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই সাম্প্রতিক একটি বিষয় নিয়ে শুরু করি, "হাইকোর্ট বলেছেন, বর্তমান আইনি কাঠামোতে দশম সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ১৫৪ সংসদ সদস্যের বৈধতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। ‘না’ ভোটের বিধান সংযুক্ত করা নিয়ে জারি করা রুলও খারিজ করে দিয়েছে আদালত।"
"সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এ রায়ে আমি খুবই হতাশ। এবার ১৫৪ জন বৈধতা পেলো। পরের বার তো ৩০০ জনও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারেন। তাহলে আমাদের গণতন্ত্রের কি হবে?"
একটার পর একটা সামাজিক ইস্যুকে রাজনৈতিক ইস্যু বানানো হয়েছে এবং রাজনৈতিক ইস্যুকে বিচারালয়ের ইস্যু বানানো হয়েছে। এর কারন সুস্পষ্ট। দুর্নীতিবাজ আদালত দলীয় অফিসের ভূমিকা পালন করায় সরকার জটিল ব্যাপার গুলো আইনের ফাঁকে এনে সাময়িক স্বস্তি পাচ্ছে। এই তথাকথিত আদালত নাগরিকের স্বার্থ সুরক্ষা এবং নাগরিক নিরাপত্তা (দেওয়ানি আর ফৌজদারি) বিষয়াদি বাদ দিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে অতি দ্রুত সেই সব রাজনৈতিক ইস্যূ (তাদের ভাষায় নাকি সাংবিধানিক!!!!) নিয়ে একের পর এক হকচকিত করে দেয়া রায়/রুল দিয়ে যাচ্ছে। অথচ এই ধরনের দ্রুততা এবং সময় নিয়ন্ত্রণ যদি নাগরিক স্বার্থ রক্ষায় দেওয়ানি আর ফৌজদারি মামলার বেলায় মানা হোত তাহলে,আমাদের সমাজের অপরাধ প্রবনতা সত্যিকার ভাবেই কমে যেত।
৫ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে নাকি প্রশ্নের অবকাশই নেই? আদালক কি ভাবে "না" ভোট বাদ দিতে রায় দিতে পারে?
আমি ওবায়দুল কদের এবং মুহিত সাহেব কে কয়েকবার নির্বাচন এর বৈধতা নিয়ে সংশয় দেখাতে দেখেছি। উনারা বলেছেন, সাংবিধানিক শূনতার কথা। যেখানে আওয়ামীলীগ এর দায়িত্বশীল অংশ একটু অবকাশ রেখে কথা বলছেন, সেখানে আদালত পেটায়া ছাত্র লীগ, তাতী লীগ, গুন্ডা লীগ এর মত কথা বলছে (রায় দিচ্ছে) কেন? তারা ভূলে গেসে যে তারা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এবং নাগরিক আধিকার এবং সংবিধান এর চূড়ান্ত অভিভাক!
আপনি আমাকে বলুন, বাংলাদেশে আদালত না থাকলে আদৌ কি কোন সমস্যা হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারন নাগরিকের? আমার ৩৪ বছর বয়সে এদেশের কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, রিক্সা অয়ালা, কাজের বুয়া, কাজের ছেলে, দোকানের বয়, হোটেল বয়, বাসের হেল্পার, মাটি কাটার মজূর, মিলের বস্তা টানার লোক, বাসা বাড়ীর পাহারাদার, নাইট ডিউটির গার্ড, গার্মেন্টস শ্রমিক, পাস করা এস এস সি পাশ, এইচ এস সি পাশ, স্নাতক, স্নাতকত্তোর, (অথবা কোন কর্মহীন) এই কোন পেশার স্বার্থের অনুকূলেই (সাধারন নাগরিক স্বার্থের) কোন রায় দিতে দেখিনি আদালতকে। হাঁ আমি আমরা সব রায় সম্পর্কে খবর রাখি না। কিন্তু এমন কোন রায় বয়স হবার পর শুনিনি যা অমানবিক পরিশ্রম করা এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আয় বা জীবন মান বা জীবনের নিরাপত্তার অনূকুলে গেসে! বেকারের কর্মসংস্থানের সহায়ক হয়েছে! অথবা গরিবের জীবনের মান উন্নয়নের বিশেষ কর্মসূচী নিশ্চিতকরণে সরকারকে বাধ্য করা হয়েছে! নাগরিকের কোন কোন অধিকার রাষ্ট্র অর্থনৈতিক দিক থেকে মেনে নিবে, তাদের প্রাধান্য কোন পর্যায়ের হবে তা সংবিধানে সুস্পষ্ট থাকলেও, সেইসব সরকার পালন করছে কিনা নাগরিকের কাছে তার নিশ্চয়তা আদালতের পক্ষ থেকে নেই!
জনপ্রসাশন, এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের দুর্নীতি, টেন্ডার জালিয়তি, অবাধ ঘুষ বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্য নিয়ে আদালত উদাসীন। দুর্নীতি কমিয়ে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সামর্থ্য যে বহুগুনে বাড়ানো যায় সেই নির্দেশনা আদালত থেকে আসে না। সরকারী কাজের অতি নিম্ম মান, ভবন ব্রিজ ভেঙ্গে অনেক অনেক প্রানহানি হলেও আদালত নির্বিকার! সরকারী বরাদ্দের বেপারোয়া লুটপাটে আদালত কার্যত নিরব দর্শক! যা দুর্নীতি, ঘুষ আর লূটপাটের সহায়ক।
আমরা দেখেছি মানুষ জমি নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে, সম্পদ খুইয়ে, নিরাপত্তা হানিতে পড়ে, বা বিবাদে জড়িয়ে কিংবা অসৎ লোকের ফুস্লানীতে পড়ে মামলা করেছে। সন্ত্রাসীর কাছে জিম্মি থেকে মামলা করেছে, মা বাবা ভাই চাচা জেঠা বন্ধু কিংবা সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে আদালতে গয়েছে। নিতান্ত বাধ্য হয়ে আদালতে যাওয়া মানুষের কম সংখ্যা দেখিনি জীবনে। কিন্তু খুব খুব কম শুনেছি একটু জমি সংক্রান্ত বিরোধের সুনিস্পত্তি আদালত করে দিয়েছে কিংবা প্রতারনার প্রতিকার পেয়েছে কেউ, কিংবা আঘাতের বা সম্পদ হানির বিচার পেয়েছে কেউ। বরং মামলার খরচ চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হবার উপক্রম হয়ে বাদী বিবাদিকে একে অপরের হাতে পায়ে ধরে মামলা উঠানোর ব্যাপার দেখেছি অনেক!
এই আমাদের আদালত, যেখানে নাগরিক জানেন না তাঁর মামলার বিচার ন্যায় নিষ্ঠ হবে কিনা, খরচ কবে হবে। বিপরীতে শুধু সরকার আর দলীয় নেতারা জানেন কবে তারা জামিন পাবেন, কবে তাকে দুর্নীতির দায়মুক্তি দেয়া হবে, কবে ক্ষমতাসীন এর মামলা উঠিয়ে নেয়া হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে লড়ার বন্দোবস্ত হবে। কিংবা জানেন কবে এবং কিভাবে বেকসুর খালাস মিলবে অথবা রাষ্ট্রপতির ফাঁসির আদেশ মৌকুফ পাওয়া যাবে।
কথা বলছি আমাদের আদালতের কার্যক্রমের গতি প্রকৃতি নিয়ে। এটা এমন এক আদালত যেখানে গেলে নাগরিক জানেন না তাকে বিচারকি ফয়সালা কবে নাগাদ (অন্তত আনুমানিক) দেয়া হবে। মানে হলো আমাদের আদালত সময় ব্যবস্থাপনা জানেন না। মামলা ব্যবস্থাপনা, পুলিশ রিপোর্ট জমা দানের সময় নিয়ন্ত্রিত বাধ্যবাধকতা জানানো, ফাইল-নথি তৈরি, বেঞ্জ নির্ধারণ, সাক্ষ্য নেয়ার-জেরা করার সময় নির্ধারণ, শুনানির দিন ধার্য এইসব কোন কাজই মামলা করার সময় বা পরে বিচারকি সিডিউল এর আদলে বাদীকে জানানো হয় না। দেওয়ানি বা ফৌজদারি কোন ক্ষেত্রেই নয়। বরং আইনজীবীর হাতে অন্য মামালা না থাকলে উনি বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখতে পারেন। নিন্ম আদালতের সাথে অর্থ যোগ, উপঢৌকন আদান প্রদান ইত্যাদি অভিযোগ বহুপুরানো। এর বাইরে রয়েছে, নথি গায়েব, সাক্ষী জালিয়াতি, তারিখ পেছানো, অনুপুস্থিতি, বিব্রত হয়ায় ব্যাপার সমূহ। রয়েছে মামলা আর আইনজীবী ফি'র অনির্ধারিত পরিমান। অজপাড়া গাঁয়ের ২ কাঠা জমি সংক্রান্ত মামলায়, কয়েক বছর বা প্রায় দশক ধরে চলতে থাকা মামলায় বাদীর মামলা খরচ জমির প্রকৃত মূল্যকে অনেক গুনে ছাপিয়ে যায়। মামলা করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া নাগরিক বাংলাদেশে নিতান্তই কম নয়। সুতরাং আদালতের উপর মানুষের আস্থাও সেভাবেই গড়ে উঠেছে। আদালতে যাওয়াকে ক্ষমতাহীন নাগরিক সর্বস্ব উজাড় হবার প্রতীক বলেই মনে করেন।
কথা ছিল, নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করার যায়গা হিসেবে আদালত আবির্ভূত হবেন। কিন্তু হয়েছে ব্যতিক্রম। আমাদের আদালত আজ রাজনৈতিক ইস্যু বোঝাপড়ার জায়গা। সামাজিক ইস্যু কে অন্তর্ঘাত মূলক ভাবে রাজনৈতিক ইস্যু বানানো হয় , আদালতকে ব্যস্ত রাখা হয় তার সমাধানে, যার প্রায় প্রতিটি রক্তক্ষয়ী সঙ্কট তৈরি করে। এখানে আদালত অবমাননা , ক্ষমতাসীনের মানহানির শুনানি দ্রুত হলেও, সাধারনের বিরুদ্ধে সঙ্ঘঠিত দেওয়ানী আর ফৌজদারি অপরাধের বিচার হয় অতি দীর্ঘায়িত। প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন ভীতি জাগানিয়া রূপে নাগরিক আধিকার হরণের যে কলা কানুন আর প্রচলতি ঘুষ, দুর্নীতি আর অপরাধ সংস্কৃতি , সেজন্য আমলা, আইন রক্ষাকারী বাহিনী, দলীয় নেতা অর্থাৎ ক্ষমতাসীনকে কৈফিয়ত দিতে বলা হয় না আমাদের আদালত থেকে। সমাজে বিদ্যমান বিচারবোধ, ন্যায় বিচারের উপস্থিতি এ থেকেই অনুমেয়।
এই ধরনের দলীয় পা চাটা তোষামুদে, দুর্নীতি গ্রস্ত এবং অযোগ্য আদালত থাকলে একটি দেশে নাগরিক আধিকার, সুশাসন এবং গণতন্ত্র থাকে "রেস্টে, ইন পিস"। নিজেদের দুর্নীতি, অবৈধ নিয়েগ, ঘুষ বাণিজ্য, অব্যবস্থাপনা আড়াল করতে তারা যখন যে বৈধ বা অবৈধ সরকার আসবে তাঁর গোলামী করবে। সরকার থাকাকালীন সময়ে তার সব কাজকে বৈধ বলবে, সরকার বিদায় হলে তাকে অসাংবিধানিক বলবে। এভাবেই মূল কাজ থেকে দূরে সরে তারা চাঞ্চল্যকর কাজে জড়াবে। নাগরিক অধিকার, জনস্বার্থ সবসময় অবহেলিত থাকবে, বিচার বিলম্বিত হবে, অন্যায্য হবে, অথবা একেবারেই অবিচার হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উপর অবৈধ অর্থের ধারক ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, গোষ্ঠী আর দলীয় কুপ্রভাব প্রাধান্য পাবে, সততার পক্ষে আদালতের সুরক্ষা বলে কিছু থাকবে না।
আদালতের মাধ্যমে সাংবিধান বা আইনি সুরক্ষা না থাকায় জনপ্রশাসনের সৎ অংশ রাষ্ট্রের স্বার্থ নিয়ে আগাতে পারে না, সৎ থাকতে পারে না, সরকারের বা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের বা আন্ডারগ্রাউন্ডের গডফাদারদের স্বার্থ রক্ষার বিপরিতে রাষ্ট্র আর নাগরিক স্বার্থ কে সুরক্ষা দিতে পারে না চাকুরি চ্যূতি, বদলি হায়রানি, ওএসডি পোস্টিং এবং নিজের আর পরিবারের সবার জীবনের উপর হামলার ভয়ে। আদালত এসব দেখেও না দেখার ভান করে। অথচ আদালতের সত্যিকারের সুরক্ষা পেলে পুলিশ সহ সরকার বা ব্যক্তির আন্যায় নির্দেশ মানবে না, ডিপার্টমেন্ট গুলো অযোগ্যদের টেন্ডার বরাদ্দ দিতে রিভল্ট করবে, নিয়ম ভাঙ্গার রাজনৈতিক প্রভাব কে দিন দিন অস্বীকার করবে, অবৈধ নিয়োগ প্রতিহত করবে, যোগ্যতা ভিত্তিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এভাবে শুধু মাত্র আদালতের সুরক্ষায় একটি দেশে ন্যায়নিষ্ঠ রাষ্ট্রীয় সংঘঠন গড়ে উঠতে পারে, আর নাগরিক সঙ্ঘঠন গড়ে উঠলে নাগিরকের স্বার্থ রক্ষা পাবে, নাগরিক স্বার্থ রক্ষা পেলে নাগরিক রাষ্ট্রের প্রতি আরো বেশি দায়িত্ববান হবে, আইন মানবে, ট্যাক্স দিবে।
হায়রে বিচারালয়, তোমার গদিতে বসিয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!