আগের পর্বের লিংক :
১। আকাশযাত্রা - প্রথম পর্ব - অবতারণা
২। দ্বিতীয় পর্ব - রামালার প্রেম
আমি এগিয়ে রামালার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
‘আরেকটু ঘেঁষে দাঁড়া। আমার বুক ঘেঁষে দাঁড়া।‘
আমি রামালার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ওর চোখে তীব্র আগুনের ফলা।
‘আমার চোখের দিকে তাকা, একদম মণি বরাবর চোখ রাখ।’ তারপর রামালা নিজেই একটু সামনে এগিয়ে আসে, একটু ঝুঁকে আমার নাকের সাথে নাক লাগিয়ে, ঠোঁটের সাথে ঠোঁট ছুঁইয়ে, বুকে বুক ঠেসে একদম আমার চোখের মণি বরাবর ওর চোখের মণি ছুঁড়ে মারলো।
হঠাৎ কী যেন ঘটতে থাকলো।
আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মগজতন্তুগুলো অতিশয় মিহিসুরে রিনরিন করে বাজছে। ঝিম ধরে আসছে পৃথিবী। সূক্ষ্ম একটা কাঁপুনি, তিরতির করে মগজ থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। খুব জোরে সোনারুকে সাপটে ধরে আছি। ওর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। না, সোনারু নয়, কাঁপছে রামালা। না, তাও না, সোনারু এবং রামালা – আমরা দুজনেই কাঁপছি। এভাবে কতক্ষণ কেটে যায়, টের পাই না। যখন টের পাই, তখন বুঝতে পারি, আমার খুলির ভেতর একটা মিশ্রিত মগজ কাজ করছে। অর্থাৎ, আমার মগজটা আর আমার একার মগজ নয়, এখানে রামালার মগজটাও ঢুকে পড়েছে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, আমি নিজেই রামালা।
আমিই রামালা?
‘রামালা…’। আমি ‘রামালা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠি। না, আমি রামালা নই, আমার শরীরের উপর থেকে রামালা আস্তে ওকে সরিয়ে নেয়। আমার সামনে রামালা দুলছে। ওকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দুলতে দুলতে ঘাসের উপর বসে পড়ে সে; আমিও ওর সামনে যেয়ে বসে পড়ি। এখন কি রাত? আকাশে জোসনা? চারদিকে আলো খল খল করছে। অপরূপ নিস্তব্ধতায় আমরা ডুবে যেতে থাকি।
‘সোনা!’ নিস্তব্ধতা ভেঙে রামালা বলে, ‘আজ তোকে নিয়ে একটু খেললাম। আমি তোর মগজটা নেড়েচেড়ে উলটপালট করে দিলাম! ভালো লাগছে না তোর?’
‘সর্বনাশ! কী বলছিস এসব?’ আমি রামালার কথায় বিস্মিত হই।
‘তোর উপর একটা পরীক্ষা চালাচ্ছি।' আমার চোখ থেকে লেজার রশ্মির মতো খুব ধারালো একটা রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। এটাই সেই ধারালো ম্যাজিক সিজার, যা সবকিছু কাটবে, আবার জোড়াও লাগাবে। সেই রশ্মি দিয়ে খুব ছোট্ট একটা কণা, নিউট্রনের মতো, তোর চোখের মণিতে ঢুকিয়ে দিব।
‘তুই একটা ডাইনি তো!’ দুম করে ওর মুখের উপর বলে দিই; রামালা যেন সত্যিই একটা ডাইনি হয়ে গেল। ওর চোয়াল খুব শক্ত হলো। আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে চোখ থেকে। আমাকে হয়ত ভয় দেখাচ্ছে রামালা। না, আমি সহজে ভয় পাই না। কিন্তু রামালা ধীরে ধীরে নরম হতে থাকলো।
রামালা বলতে থাকে, ‘শোন সোনারু, আমি তোর ব্রেইনের ভেতর ঢুকে পড়বো। অতিক্ষুদ্র একটা দানার ভেতর আমার ব্রেইনের সবখানি মেমোরি ঢুকিয়ে নেব। তোর চোখ বরাবর একটা ফুঁ দিব, তারপর রেটিনা দিয়ে সুড়সুড় করে তোর নিউরনে ঢুকে পড়বো। তোর মগজ ঘাঁটাঘাঁটি করে উচ্ছিষ্ট অংশটা রেখে আবার আমার ব্রেইনে চলে আসবো।‘ এ বলে রামালা দুষ্টুহাসি ছড়িয়ে দিল মুখে।
আমি একটু উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞাসা করি, ‘আচ্ছা রামা, কেন শুধু শুধু আমাকে নিয়ে খেলছিস? জগতে কি আর কেউ ছিল না?’
রামালা হাত বাড়িয়ে আমার গাল টেনে ধরলো। বললো, ‘আগের জন্মে তুই আমাকে খুন করেছিলি। এই জন্মে আমি তোকে খুন করবো।’ বলেই রামালা খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো, এবং একসময় অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। ওর অট্টহাসি প্রকৃতির দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে হতে বহুদূর ছড়িয়ে পড়লো।
আমি ভয় পাচ্ছি না। ভয়ের ব্যাপার ছিল কিনা, বা এখনো ভয় পাওয়া উচিত কিনা বুঝে উঠতে পারছি না। আমি যে রামালাকে ভয় পাচ্ছি না, মূল বিষয় হলো এটা। পূর্ব জন্মটন্ম নিয়ে আমার কোনো বিশ্বাস নেই। রামালা এখন অত্যধিক ঘোরের ভেতর প্রলাপ বকছে। ও আমাকে কত গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছে তা এই আজগুবি প্রলাপ থেকেই বুঝতে পারছি।
তবে, ওর একটা বিষয় আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগতে শুরু করলো।
এটা একটা অভিনব আইডিয়া বটে। মানুষের ব্রেইন কোনোদিন ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা সম্ভব হবে কিনা, ভবিষ্যতের বিজ্ঞান সেটা জানবে। তবে, ব্রেইন ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের চাইতে এক-চিলতে মেমোরি কার্ডের ভেতর একটা মানুষের সমগ্র স্মৃতিসম্ভার, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা জড়ো করা সহজতর কাজ। ‘ডাইনি’ রামালা কি সে-ধরনের কিছু করতে যাচ্ছে? এতে মানবজাতির কী উপকার সাধিত হবে, ওকেই তার একটা ব্যাখ্যা দিতে হবে।
‘হ্যাঁ, সেটাই বলছি।’ ওরে সর্বনাশ! আমার মনের কথা রামালা ধরে ফেলছে দেখি!
‘হ্যাঁ, এখন তুই আলাদা করে কিছু ভাবতে পারবি না।‘ ঠান্ডা গলায় রামালা বলে উঠলো।
‘প্রথম দিকে কৃত্রিম উপায়ে বুদ্ধিমত্তা তৈরি করে একটা সূক্ষ্ম মেমোরিকার্ডে ঢোকানো হবে। এই মেমোরিকার্ডটি মাথার একপাশে চামড়ার নীচে গেঁথে দিতে হবে। সেকেন্ড জেনারেশন স্টেজে আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিন্সসহ প্রতিভাধর জীবিত ব্যক্তিদের ডিএনএ থেকে তাদের বুদ্ধিমত্তা সংগ্রহ করে একত্র করা হবে। একত্রিত বুদ্ধিমত্তাকে কনসেন্ট্রেট করে মূল বুদ্ধিমত্তার চাইতে বহুগুণ শক্তিশালী বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা হবে। এগুলো অনুরূপ এক-চিলতে চিপসে ঢোকানো হবে। এগুলো কপি করা যাবে। মেধাবীদেরকে আরো মেধাবী এবং অমেধাবীদেরকে মেধাবী করার কাজে এ চিপস ব্যবহৃত হবে। থার্ড জেনারেশন স্টেজে চিপসকে লিকুইড ফর্মে রূপান্তর করা হবে। ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বুদ্ধিমত্তা পুশ করা হবে। ফলে হবে কী, পৃথিবীতে স্টিফেন হকিন্সের প্রতিভার পুনরাবির্ভাব ঘটবে। আইনস্টাইন, নিউটনের পুনরাগমন ঘটবে। মানব সভ্যতা সক্রেটিস, এরিস্টটলের মতো দার্শনিকদের মেধা আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতিভার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক মহামানবীয় প্রতিভা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। উন্নত বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে মানবসভ্যতার দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকবে। ফোর্থ জেনারেশন স্টেজে সংগৃহীত সমন্বিত প্রতিভার চিপসটি বায়বীয় কিংবা ‘লাইট’ ফর্মে রূপান্তর করা হবে। চোখের দৃষ্টি দিয়েই একজনের বুদ্ধিমত্তা অন্যজনের শরীরে ট্রান্সফার করা যাবে। আমরা যত্রতত্র রামালার মতো অসংখ্য সুকণ্ঠী গায়িকাকে দেখতে পাবো…’। আমার মাথা প্রচণ্ড গরম হয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতর এই যে ভাবনাগুলো কিলবিল করছে, এটা আমি না, রামালার ভাবনা। রামালার মগজ এখন আমার মগজে ঢুকে পড়েছে। আমার কথাটা রামালার, এবং রামালার কথাটা আমার, এবং আমাদের দুজনের কথাটাও… নাহ, আর ভাবতে পারছি না।
‘সোনা!’ রামালার কথায় আমি সম্বিৎ পাই। একটা জলবতী স্নিগ্ধ কবিতা এক অপরূপ ভঙিমায় আমার সামনে বসে আছে। ওর মুখের হাসিটিতে পৃথিবী মধুর হয়ে উঠছে।
এখন দিন, নাকি রাত, আমরা জানি না। কোথায় আছি আমরা জানি না। আমরা হাত ধরে মুখোমুখী বসে আছি। চারদিকে অন্ধকার, নাকি জোসনা, আমরা ভুলে গেছি। ভুলতে ভুলতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন ঘুম ভাঙলো, তখন আমি এবং রামালা দুজনেই ক্লাসে। একজন সাহিত্যের শিক্ষক বোর্ডে বেশকিছু অদ্ভুত আকৃতির ছবি এঁকে বলছেন, ‘এরা হলো অন্যগ্রহের মানুষ। অন্যগ্রহের মানুষ দেখতে আমাদের মতো নয়; কেউ পাথর, কেউ পাহাড়, কেউ গাছের মতো, কেউ-বা বায়বীয় বা তরল পদার্থের মতো; কেউ আবার এমন, যাদের আকৃতি আমাদের কল্পনার অতীত। এদের চলাচলও কিন্তু আমাদের মতো না; এরা কল্পনাগামী, অর্থাৎ, এরা যেখানে যাবার কথা কল্পনা করে, মুহূর্তে সেখানেই চলে যায়। এরা একই সাথে অনেক জায়গায় অবস্থান করতে পারে; যার কল্পনাশক্তি যত বেশি, সে তত বেশি জায়গায় এবং তত বেশি দূরবর্তী স্থানে যাতায়াত ও অবস্থান করতে পারে। আমাদের পৃথিবীতেও মানুষ একদিন কল্পনাগামী হবে। প্রথমে তারা বাতাস, পরে ইথারে ভ্রমণ করতে পারবে। এরপর তারা…’
রামালা হঠাৎ দাঁড়িয়ে স্যারকে থামিয়ে দিয়ে বলতে থাকলো, ‘স্যার, এ গল্পগুলো প্লিজ না করুন। ইউনিভার্সের অন্য কোথাও কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। ইউনিভার্সে পৃথিবীর মতো ৪০ বিলিয়ন গ্রহ এবং অগুনতি উপগ্রহ আছে। পৃথিবীর বয়সই ৫০০ কোটি বছর। ইউনিভার্সের বয়স প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর। ৫০০ কোটি বছরে যদি পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ ঘটতে পারে, ১৪ বিলিয়ন বছরে অনেক আগেই ইউনিভার্সের অন্য কোথাও প্রাণীর সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল। বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে আজও কোথাও প্রাণের সন্ধান পৃথিবীর মানুষ পায় নি; অন্য কোথাও প্রাণী থাকলে তাদের আমাদের চাইতেও বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার কথা, যেহেতু ইউনিভার্সের বয়স পৃথিবীর বয়সের চাইতে অনেক বেশি। এবং আমরা তাদের খুঁজে না পেলেও অন্তত তারা এতদিন আমাদের খুঁজে বের করে ফেলতো।’ আশ্চর্য, পুরো ক্লাস হাততালি দিয়ে উঠলো, এবং স্যার অবাক হয়ে রামালার দিকে তাকিয়ে আছেন।
এবং রামালা, না, রামালা না, হ্যাঁ, রামালা আমার মগজে ঢুকে পড়ে আরেকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘স্যার, আপনি সাহিত্যের শিক্ষক হয়ে বিজ্ঞানের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করছেন, এটা হাস্যকর বটে।'
শিক্ষক আহত হলেন না, কিংবা তার কোনো ভাবান্তর হলো না। খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘ডিয়ার সান, আমি সাহিত্যের শিক্ষক বলেই এতখানি কল্পনা করতে পেরেছি। এখন বিজ্ঞানের যদি ক্ষমতা থাকে, তাহলে আমার কল্পনাকে ছুঁয়ে দেখুক।’ রামালা চুপসে গেল, না, আমিই আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। ক্লাসে কোনো শব্দ নেই। কেউ নেই ক্লাসে। বোর্ডের সামনে একটা ব্ল্যাক মার্কার হাতে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে রামালা।
২৩ জুন ২০২০
চলতে থাকবে---------
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:৩১