আমার জীবনটা রোমান্টিকতায় পরিপূর্ণ না। প্রেম যে জীবনে আসে নি, তা না, কিন্তু আমার কবিতা লেখালেখি থেকেই আপনারা আন্দাজ করে সত্যটা বুঝতে পেরেছেন যে, এ বাংলার ব্যর্থ প্রেমিকদের মতো আমিও প্রেমে ব্যর্থ হতে পেরেই কবি হতে পেরেছি অন্যভাবে বলা যায় যে, তামাম কবির মতো প্রেমে ব্যর্থ হয়েই আমি কবি হওয়ার যোগ্যতা অর্জনে অব্যর্থ হয়েছি
কেন প্রেমে ব্যর্থ হয়েছি তা পর্যালোচনা করতে গেলে পদে পদে প্রেমক্ষেত্রে আমার অযোগ্যতা, অদক্ষতা ধরা পড়ে। এ ব্যাপারে আমার কোনো কোচিং করাও হয়ে ওঠে নি
যাজ্ঞে সে কথা, মূল কথায় আসি। শুরুটা পড়ে মনে হতে পারে, এটা একটা রম্য পোস্ট। না, সিরিয়াস কথাগুলো লিখতে গিয়ে কিছু রম্যকথা চলে আসায় লিখে ফেলতে হলো। আমার জীবনের সবচাইতে রোমান্টিক ঘটনার কথাই লিখতে যাচ্ছি। এটার চাইতে অন্য কোনো রোমান্টিক ঘটনার কথা এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না, থাকা সম্ভবও না, যদি থাকতোই, তাহলে সেটার কথাই আমার বেশি মনে পড়তো। অতএব, বলা যায়, আমার স্মরণীয় রোমান্টিক ঘটনা এটাই।
এইচএসসি পাশের পর প্রায় বছর খানেক চলে গেছে। আমি গ্রামে গেছি। একদিন আমাদের গ্রাম থেকে দেড়-দুই মাইল দূরে শিমুলিয়া গ্রামে যাচ্ছি আমার স্কুল-ক্লাসমেট করিমদের বাসায়। আমাদের গ্রাম থেকে সুতারপাড়া গ্রাম, এরপর মালিকান্দা গ্রাম - এখানে আমার হাইস্কুল - মেঘুলা বাজার - কাজী নজরুল গার্লস হাইস্কুল। মেইন রোড থেকে নীচে নেমে গেছে একটা পায়ে-চলা পথ। আধমাইল দূরে করিমদের বাড়ি। সকালে বৃষ্টি হয়েছে। তখন ১০-১১টা হবে। আকাশে উজ্জ্বল রোদ, ছোটো ছোটো সাদা মেঘ দ্রুত উড়ছে। গাছের পাতা নড়ছে। ছায়ারা মাটিতে দাপাদাপি করছে। আমি একমনে হাঁটছি। একটু পরই 'টুন' শব্দ করে একটা রিকশা থামলো সামনে। আমি সম্বিত পেয়ে চমকে থামি। রিকশায় তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই। একটা মেয়ে রিকশায় বসে। তার অবয়বে অস্ফুট হাসির আভা।
'কেমন আছেন?' বলেই আমার দিকে তাকালো।
এ মেয়েটা আমার পরিচিত। এসএসসি পরীক্ষার সময় তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। করিমদের বাড়ির পাশে ওদের বাড়ি। সেই সময় আমাদের দোহার থানায় এসএসসি পরীক্ষার জন্য সেন্টার ছিল জয়পাড়া - জয়পাড়া পাইলট হাইস্কুল ও জয়পাড়া গার্লস পাইলট হাইস্কুলে যথাক্রমে ছাত্র ও ছাত্রীদের সিট পড়তো। অবসর সময়ে, বিশেষত বিকালবেলায় জয়পাড়া স্কুলের/বাজারের আশেপাশে, উপজেলা সদরের ভেতরে পুকুরপাড়ে সবাই ঘোরাঘুরি করতো। ঐ ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে আড্ডাও হতো, সেই আড্ডায় আমি উপস্থিত হতে পারি নি, কিন্তু কীভাবে যেন আমার নামটা উঠে গিয়েছিল এই বলে যে, আমি কবিতাও লিখি। মেয়েটা আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। করিম একদিন সন্ধ্যায় উপজেলা সদরের পুকুরপাড়ে ওকে নিয়ে এসেছিল আমার সাথে দেখা করানোর জন্য। মাত্র ২/৩ মিনিট ছিল সেই সাক্ষাৎপর্ব। এরপরও করিম এবং আরো কয়েকজনের কাছে শুনেছিলাম যে, মেয়েটা আমার ব্যাপারে মাঝেমাঝেই খোঁজখবর নিয়েছে, পরীক্ষা কেমন হচ্ছে, কবিতা লেখা কেমন চলছে, ইত্যাদি। পরীক্ষা শেষের দিন আরেকবার দেখা হয়েছিল, আমরা যখন জয়পাড়া থেকে নিজ নিজ বাড়িতে ফেরত যাচ্ছি। কিন্তু সেদিনও কথা হয় নি।
এরপর আরো একবার ওদের গ্রামে একটা কী অনুষ্ঠানে যেন দূর থেকে দেখেছিলাম, যদ্দূর মনে পড়ে আমি আর আমার আরেক ক্লাসমেট সুতারপাড়ার সোহরাব ছিলাম একসাথে। সেই দেখাটাও অদ্ভুত ছিল - ওর দিকে চোখ পড়তেই দেখি, ও হাত দিয়ে নির্দেশ করে ওর পাশের এক বান্ধবীকে আমাকে দেখাচ্ছে - হয়ত বলছিল - দেখ দেখ, ঐ যে সেই কবি ওটাও ছিল ১০-১৫ সেকেন্ডের মতো। তারপর মুহূর্তের মধ্যে সে উধাও হয়ে গেল, আমিও লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে সোহরাবের সাথে আপন কর্মে মন দিলাম
'কেমন আছেন?' প্রশ্নে আমি যথাস্বভাবে লাজুক স্বরে বলি, ভালো আছি। আপনি ভালো তো?
হ্যাঁ ভালোই।
কই যান? জিজ্ঞাসা করি।
কলেজে।
যদ্দূর মনে পড়ে, সে বলেছিল সে জয়পাড়া কলেজে অনার্সে বা ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে।
আচ্ছা, এখানেও ৩/৪ মিনিটের মধ্যেই আমাদের দেখার পালা শেষ।
হয়ত এখানে আপনারা কোনো রোমান্স খুঁজে পান নি। কিন্তু মরুভূমিতে দীর্ঘদিন পর এক পশলা বাতাস আর কিছু গুঁড়োবৃষ্টিই কত মূল্যবান, তাই না? আমার প্রেমহীন জীবনে এটার স্থিতি ও মূল্য এতখানিই।
গল্প এখানেই শেষ না, আরেকটু আছে।
আমি করিমদের বাড়ি যাই। ওর সাথে দেখা করে চলে আসি।
গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার মাসখানেক পর করিমের একটা চিঠি পাই। চিঠি পড়ে আমার সমস্ত আবেগ যেন জলোচ্ছ্বের মতো আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। করিম লিখেছে, তুই আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই জুঁই এসেছিল তোর সাথে দেখা করার জন্য। ওর এ কথায় আমি বার বার, শতবার, হাজারবার মরমে মরে যেতে লাগলাম। একটা মেয়ে কলেজে যাওয়ার পথ থেকে ফিরে এসে আমার সাথে দেখা করার জন্য ছুটে আসবে, তা আমি কোনোদিনই ভাবি নি। ওর জন্য আমার এমন কোনো ভাবনাও কখনো গড়ে ওঠে নি যে, সে আমার কথা ভাবে। সে যে আমার কথা ভাববে, ভাবতে পারে, এমনটা কোনোদিনই আমার মনে হয় নি, সত্যিকারেও সে কোনোদিন আমার কথা ভেবেছে কিনা, তাও জানার কোনো সুযোগ নেই, আজও নেই। অন্যদিকে, আমিও এসএসসির পর তাকে নিয়ে কখনো ভেবেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু করিমের এ চিঠি সত্যিই আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
মেয়েটির সাথে সেদিন দেখা হলে কী কথা হতো, ওর মনে কী ছিল, কেনই বা সে কলেজে না গিয়ে ফিরে এলো, বা আমাদের পুনর্বার দেখা হওয়ার পরিণতিই বা কী হতে পারতো, তা একটা অসমাপ্ত উপন্যাসের মতোই রয়ে গেছে।
কোনো রোমান্স পান নি, তাই না? হ্যাঁ, সব রোমান্টিক ঘটনাই সবার কাছে রোমান্টিক নাও মনে হতে পারে, আবার একেবারে মামুলি গল্পও মনে হতে পারে। কিন্তু একবার ভাবুন, আমাদের সেই হাইস্কুল জীবনে, যেখানে ক্লাসমেট মেয়েদের সাথে কথা বলারও সুযোগ ছিল না প্রয়োজন ছাড়া, কোনোদিন কোনো এক ক্লাসমেট আমাদের কারো দিকে একমুহূর্ত তাকালেই আমরা তা নিয়ে একেকজন গল্প করতে করতে পাগল হয়ে যেতাম, সেই মরুময় জীবনে দৈবাৎ কোনো মেয়ে যদি আমার সাথে দেখা করার জন্য ছুটে আসে, তা আমার জন্য কতবড়ো ঘটনা হতে পারে, আর আমি যদি সেই মুহূর্তটা কোনোভাবে মিস করে ফেলি, তা কত বেদনাময় ট্র্যাজেডি হতে পারে!
মেয়েটির নাম 'জুঁই' না, আসল নাম ভুলে গেছি অনেক আগেই। করিমকে অবশ্য একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিল।
প্রায় ৪০ বছর আগের কথা। ঘটনার মধ্যে আরো কিছু খুটিনাটি, টুকরো গল্প ছিল, যেমন, আমাকে দেখে আমার হাতে জুঁইয়ের ৫টাকা তুলে দেয়া, করিম সেই ৫টাকার সাথে আরো ৫টাকা যোগ করে ১বস্তা চানাচুর কিনে জুঁইকে দিয়ে আসা, এরপর এ নিয়ে কারো কারো সাথে মজার মজার আলোচনা করা - বেশ কিছুদিন চলেছিল।
করিম ছাড়া আর কে কে এ ঘটনার কথা জানতো, বা আর কার কার সাথে এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তাও মনে নেই। তবে, সেই সময়ের ইউএনও'র ছেলে আজাদ (আমাদের সাথে এসএসসি দিয়েছিল) এটা জানতো। শেরখান আর আমি এক রুমে থেকে এসএসএসি দিয়েছিলাম (হেলথ কমপ্লেক্সের যে-রুমটি শেরখানের মামাই আমাদের জন্য যোগাড় করেছিলেন)। শেরখানের সাথে নিশ্চয়ই এটা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছিলাম, যদিও ঠিক মনে নেই
জুঁই বেঁচে আছে, কী বেঁচে নেই, সেই খবরও জানি না। কিছু কিছু খবর না জানার মধ্যে যেমন একটা সুগভীর বেদনা আছে, সেই বেদনায় একটা অমোঘ মাধুর্যও আছে; আমি এ বেদনাময় মাধুর্য নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।
ইন্টারেস্টিং ঘটনা হলো, এ ঘটনাকে নিয়ে আমার একটা উপন্যাস ও একটা ছোটোগল্প, সর্বশেষ একটা ছোট্ট গানও লেখা হয়ে গেছে। ঘটনাটি আমার জীবনে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলে নি, কিন্তু স্কুলজীবনের উপর ভিত্তি করে একটা গল্প লিখতে গিয়ে সেটা হয়ে যায় উপন্যাসের গোড়াপত্তন, সেই উপন্যাসকে সমাপ্তি পর্যন্ত টেনে নেয়ার জন্য একটা কাহিনির প্রয়োজন ছিল- সেই কাহিনিকে গড়তে যেয়েই জুঁই চলে আসে 'প্রেমিকা' হিসাবে, যদিও পুরো গল্প জুড়ে 'প্রমীলা'কেই প্রধান নায়িকা হিসাবে দেখা যায়। রেফারেন্স হিসাবে সেগুলোর লিংক দিলাম নীচে।
লিংক
===
অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, একুশে বইমেলা ২০০৪ : Click This Link
ছোটোগল্প : আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম - এ গল্পটা বেশ কয়েকবার ব্লগে শেয়ার করা হয়েছে। নীচের লিংকেও একই গল্প, তবে, প্রতিবারই কিছু না কিছু পরিমার্জন করা হয়েছে। এটা হলো সর্বশেষ পরিমার্জিত রূপ।
https://www.somewhereinblog.net/blog/farihanmahmud/30337744
গান : ও সুজানা, তুমি এখন কোথায় আছো - Click This Link
২২ এপ্রিল ২০২৪ যোগ করা হলো নীচের অংশটি
আমার স্কুলজীবনের আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবুল কালাম শের খান, এসএসসি পরীক্ষার সময় যার সাথে আমি এক রুমে থাকতাম, যে জুঁই-সম্পর্কিত ঘটনাবলি পূর্বাপর জানতো, আজ ২২ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে আমার বাসায় এসেছিল। সম্ভবত ২০০৭ সালের পর এই প্রথম ওর সাথে দেখা। অন্তর থেকে অনেক কথা অগ্নিলাভার মতো টগবগিয়ে উঠে এলো, এতদিনের জমানো কথাগুলো খইয়ের মতো ফুটছিল দুজনের মুখে। কথায় কথায় হঠাৎ শের খান উচ্চারণ করলো ‘রানু’। আরো দু’বার – ‘রানু’। ‘রানু’। আমি জিজ্ঞাসা করি, রানু কে? শের খান অবাক হয়ে উলটো প্রশ্ন করে, ‘তুই ভুলে গেছিস?’ কয়েকটা সেকেন্ড, তারপর স্মৃতিতে তুমুল ভাস্বর হয়ে উঠলো নামটি। এ নামটি আমি কত খুঁজেছি, অর্থাৎ, এ নামটি আমি কত সহস্রভার, কতভাবে মনে করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু মনে করতে পারি নি। শেষ বার কবে এ ‘রানু’ নামটি আমার মনের কুঠরিতে স্থিত ছিল, তারপর কবে তা হারিয়ে গিয়েছিল, আমি বিলকুল টের পাই নি। ২০০৩/৪ সালে আমি ‘অন্তরবাসিনী’ লিখতে শুরু করি; ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের মূল চরিত্র বা নায়িকাটিই হলো রানু। কিন্তু ঐ সময়ে আমি এ নাম মনে করতে পারি নি। লজ্জার কারণে করিম বা আর কাউকে জিজ্ঞাসাও করি নি। অবশ্য, অন্য কারো মনে যে এ ঘটনা গেঁথে থাকতে পারে, তাও আমি ভাবি নি তখন। আর, দৈবাৎ যদি ‘রানু’ নামটি মনে পড়তোও, নিশ্চিতভাবেই উপন্যাসে এ প্রকৃত নামটি দেয়া হতো না।
রানুকে নিয়ে আমি উপন্যাস লিখেছি ঠিকই, যদিও রানুই গল্পের মূল চরিত্র, কিন্তু বাস্তবে রানুর প্রতি আমার কোনো প্রেম গড়ে ওঠে নি। ঐ ঘটনাটাকে একটা গল্পের প্লট হিসাবেই ব্যবহার করেছি মাত্র।
ওর প্রতি আমার কোনো মোহ বা টান জন্মায় নি বলেই ওর কোনো খোঁজখবরও নেয়া হয় নি কোনোদিন। পথে যেতে যেতে কত মানুষকে পাশ কাটিয়ে যাই, কতজন চলে যায় পাশ দিয়ে, দিন শেষে কারো কথাই মনে থাকে না। রানু হয়ত এমনই একজন পথচারিণী ছিল।
শের খান জানালো, রানু আর বেঁচে নেই। কয়েক বছর আগে মারা গেছে। ক্যান্সার হয়েছিল। আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারি নি, আমার এ গল্পটির মতোই রানু পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে।
ফুটনোট লেখার তারিখ : ২২ এপ্রিল ২০২৪
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫