হাতে ওয়াকম্যান, কানে হেডফোন লাগিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গান শোনা গানপাগলাদের দেখে আমারও একটা ওয়াকম্যান কেনার শখ হয়েছিল। এটা অনেকদিন আগের কাহিনি। সেই শখ পূরণ করলাম ১৯৮৯ সালের মার্চ বা এপ্রিল মাসের কোনো একদিন। আমি তখন সিলেটে। আমার দুই রুমমেটকে নিয়ে সিলেট শহরে গেলাম ওয়াকম্যান কেনার জন্য। এ দুজনের একজনের অলরেডি ওয়াকম্যান আছে, অনেক আগে থেকেই। এক্সপার্ট লিসনার সে। ওরাই মার্কেট ঘুরে ঘুরে আমার জন্য ওয়াকম্যান কিনলো। এটা আবার ওয়াকম্যানের ইম্প্রুভড ভার্সন। ক্যাসেট প্লেয়ার হিসাবেও বাজানো যায়, অর্থাৎ, ওয়াকম্যান শুনতে হয় হেডফোন দিয়ে, এটাতে হেডফোন ছাড়াও শোনা যায়।
তারপর ওদের সাথে করে ক্যাসেটের দোকানে গেলাম। ৩/৪টা ক্যাসেট কিনেছিলাম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার ২টা, শাকিলা জাফরের একটা (তার নাম তখন শাকিলা জামান ছিল), আরেকটা কার ছিল বা ছিল কিনা মনে নেই, তবে সেটা হতে পারে সোলসের 'মনে করো' কিংবা শেখ ইশতিয়াকের কোনো একটা।
যাই হোক, আমার রেডিও শোনার একটা বিশেষ অভ্যাস ছিল। রাতে ঘুমানোর সময় খুব মৃদু ভলিয়্যুমে ছেড়ে দিয়ে কানের কাছে রেখে দিতাম রেডিও। গান বাজতো, ঘুমের ঘোরে গান শুনতে খুব ভালো লাগতো, একটা মূর্ছনার মতো সৃষ্টি হতো ঘুমের মধ্যে। রেডিও চ্যানেল বন্ধ হওয়ার পর শো শো আওয়াজে একসময় ঘুম ভাঙতো, তখন রেডিও অফ করতাম।
তো, ওয়াকম্যান কেনার পর আমি রেডিওর সেই অভ্যাসটি আমাকে নতুন করে পেয়ে বসলো। ঘুমানোর সময় বন্যার ক্যাসেটগুলোই বেশিরভাগ সময় অন করে অল্প সাউন্ডে কানের কাছে রেখে দিতাম। ঘুমের ঘোরে শুনতাম - আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন, কিংবা জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ, ইত্যাদি। এই গানগুলো শুনতে শুনতে শুনতে শুনতে একসময় দেখি, সবগুলো গানের সুর আমার মুখস্থ হয়ে গেছে, যদিও গানের লিরিক আমি কদাচিৎ মুখস্থ করি বা মনে রাখি। এই গানগুলোর মধ্যেই একটা গান ছিল খুবই অদ্ভুত, সেই গানটিই হলো এ পোস্টের মূল প্রতিপাদ্য। শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা। যেহেতু লেখালেখি করি, শব্দজগতের সাথে মোটামুটি পরিচয় আছে এবং নতুন শব্দ আমাকে টানে। কিন্তু এই গানের কথাগুলো খুবই অদ্ভুত, শুধু তাই না, প্রায় প্রতিটা শব্দই আমার কাছে নতুন, আবার শিল্পীর উচ্চারণরীতি থেকে আরও কনফিউজ্ড আমি - ঠিক বাংলার মতো লাগছে না, আবার সংস্কৃত শব্দও হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এ গানটাও আমার ভালো লাগছে এবং এ গানটার সুরও আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।
আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, আমরা যখন ক্লাস নাইন-টেনে পড়ি, ৮০'র দশকে, তখন থেকেই বন্যার যশখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু, রেডিওতে আমি কোনোদিন তার গান শুনেছি বলে মনে পড়ে না, রেডিওতে যার গান বেশি শুনেছি, তিনি হলেন পাপিয়া সারোয়ার। মিতা হকের গানও আমি রেডিওতে শুনি নি। তবে, ১৯৮৪ বা ৮৫ বা ৮৬'র কোনো এক ১লা বৈশাখে বাংলা একাডেমীর বৈকালিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেয়ে দেখি (তখন কলেজে পড়ি। ঢাকা কলেজ), অনুষ্ঠাসূচিতে বন্যার গানের কথা বলা আছে। এবং সেই প্রথম বন্যার গান সরাসরি শুনি। ক'টা গান গেয়েছিলেন, বা কী গান গেয়েছিলেন, তা অবশ্য মনে নেই। বন্যার গান আগে না শুনলেও তার গানের প্রতি ঝোঁক ছিল আগে থেকেই, তাই তার ক্যাসেটই কেনা হয় সবার আগে, যার কথা উপরে লিখেছি।
আমার ইউটিউব চ্যানেলটা ১১ এপ্রিল ২০০৯-এ ওপেন করি। প্রথম দিকে ছেলেমেয়েদের গান, ভিডিও, বিভিন্ন মুভি ক্লিপ আপলোড করতাম। পরে অবশ্য ওগুলো মুছে দিয়ে শুধু গান আপলোড করা শুরু করি। বাংলা ভাষার জনপ্রিয়, কালোত্তীর্ণ, সুরেলা ও ক্লাসিক গানগুলোর অধিকাংশই আমার চ্যানেলে পাওয়া যাবে। ক্যাসেটের যুগে ক্যাসেট, সিডিও যুগে সিডি কেনা ছিল আমার অন্যতম হবি। ল্যাপটপের যুগে এসে সব অডিও মেটারিয়াল নিয়ে আসি ল্যাপটপে, তারপর ইঊটিউব যুগে আসার পর ওগুলো ইউটিউবে আপলোড করা শুরু করি। নিজের সংগ্রহ, প্লাস, ইউটিউব থেকে বাছাই করা ভালো কোয়ালিটির গান, রেখে দিই আমার নিজের চ্যানেলে - আমার জন্য এবং গানপাগল মানুষদের জন্য। আমার চ্যানেল পুরোপুরি অ্যামেচার; কোনো মানিটাইজেশন নেই।
গান আপলোডিঙের এক পর্যায়ে এসে বন্যার গান আপলোড করা শুরু করি। বন্যার গান আপলোড করতে যেয়ে আবার সেই অদ্ভুত ও ঐতিহাসিক গানটার মুখোমুখি হই। বন্যার গান যে এর মধ্যে নিয়ম করে শুনেছি, তা না, হুটহাট সামনে চলে এলে সময় ও মুড ভালো থাকলে শুনেছি। কিন্তু আপলোড করার জন্য ভিডিও বানানোর সময় এ গানটি আবার বেশ কয়েকবার শুনলাম। সত্যিই অদ্ভুত। প্রায় ৩৫/৩৭ বছর আগে শোনা গান আজও দুর্বোধ্য, প্রথম লাইন ও মাঝে মাঝে কিছু শব্দ ছাড়া কিছুই বুঝি না। কোন ভাষা এটা?
মনের মধ্যে এ প্রশ্ন সেই কতদিনের! গুগলে একটু সার্চ দিলেই কিন্তু মুহূর্তে সব সামনে চলে আসে। কিন্তু সেই ফুরসত আর হয় নি। আসলে, ইচ্ছে করেই ইচ্ছে পূরণ করি নি
এ গানটার কথা মনে পড়লো কয়েকদিন আগে। গানটা গেয়ে ইউটিউবে আপলোড করারও একটা ইচ্ছে জাগলো মনে। সেই ইচ্ছে থেকেই গানটার লিরিক বের করলাম। বন্যার গানটার সাথে লিরিক ধরে ধরে গাইলাম। আমরা যখন কোনো গান দিনের পর দিন শুনতে থাকি, গানগুলোর সুর আমাদের মগজে ঢুকে যায়, সুর মুখস্থ হয়ে যায়, যদিও লিরিক মুখস্থ নাও হতে পারে (আমার অভিজ্ঞতা থেকে বললাম)। কিন্তু এ গানটা গাইতে গিয়ে দেখি, যা ভেবেছিলাম, তা না। অর্থাৎ, আমি যে ভেবেছিলাম এ গানের সুর আমার মুখস্থ হয়ে আছে সেই ওয়াকম্যানে গানটা শুনেই, তা ঠিক না। এটা একটা কঠিন সুরের গান। এক অন্তরার সুরের সাথে আরেক অন্তরার সুরের মিল খুব কম। প্রায় প্রতিটা লাইনেই ভিন্ন ভিন্ন সুর। সুরের এই আপ অ্যান্ড ডাউন মনে রাখা খুবই কষ্টকর। তবে, গানটা অনেকবার শোনা ছিল বলে সুরটা ধরতে আমার কষ্ট হলেও আয়ত্তে চলে আসলো। অন্য যে-কোনো গানের চাইতে এ গানের সুরটা আয়ত্তে আনতে আমাকে বেশি বেগ পেতে হলো। যারা শুধু গানই শোনেন না, গানের সুর বৈচিত্র নিয়েও চিন্তাভাবনা করেন, তারা এ গানটার সুর শুনে এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূতি লাভ করবেন।
এই কঠিন গানটা অবশেষে গেয়ে ফেললাম। শব্দের উচ্চারণগুলো বোঝার জন্য ইউটিউবে বিখ্যাত কয়েকজন শিল্পীর কণ্ঠেও গানটা শুনলাম। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে মেলোডি খুব চমৎকার উঠে এসেছে। তবে, বন্যার উচ্চারণ আমার কাছে সবচাইতে বেশি ভালো লেগেছে, বন্যার গলার কারুকাজ, বিশেষ করে রাগাশ্রিত অংশটুকু (লোল চিকুর মম, এবং রিমঝিম রিমঝিম) খুব উপভোগ্য। আমার গাওয়া গানটা এ লিংকে পাওয়া যাবে - শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা
রাগ: পিলু-মল্লার
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): আশ্বিন, ১২৮৪
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1878
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩১
শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে।
কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।
উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত, ঘন ঘন গর্জিত মেহ।
দমকত বিদ্যুত, পথতরু লুন্ঠিত, থরহর কম্পিত দেহ
ঘন ঘন রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ বরখত নীরদপুঞ্জ।
শাল-পিয়ালে তাল-তমালে নিবিড়তিমিরময় কুঞ্জ।
কহ রে সজনী, এ দুরুযোগে কুঞ্জে নিরদয় কান
দারুণ বাঁশী কাহ বজায়ত সকরুণ রাধা নাম।
মোতিম হারে বেশ বনা দে, সীঁথি লগা দে ভালে।
উরহি বিলুন্ঠিত লোল চিকুর মম বাঁধহ চম্পকমালে।
গহন রয়নমে ন যাও, বালা, নওলকিশোরক পাশ।
গরজে ঘন ঘন, বহু ডর পাওব, কহে ভানু তব দাস।
যারা গায়ক, গানের গলা ভালো, তারা চেষ্টা করে দেখতে পারেন, কতখানি সূক্ষ্ম ও শুদ্ধভাবে গাইতে পারেন।
বন্যা ও লতার গানটি শুনতে চাইলে ইউটিউবে সার্চ দিন, চলে আসবে।
আসল জিনিস তো বলাই হলো না। গতকাল গুগলে সার্চ দিলাম 'শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা' গানটার অর্থ কী। অনেকগুলো থ্রেড উঠে এলো। জনৈকা শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য Quora-তে লিখেছেন :
'শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা' এই গানটি লেখা হয়েছে ব্রজবুলি ভাষাতে। এই গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী গ্রন্থের অন্তর্গত, যা প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালের ১ জুলাই। এই গ্রন্থে রয়েছে ওই গানটি সহ ব্রজবুলি ভাষায় ২০টি পদ।
বর্তমান ভারতের উত্তর বিহারের তিরহূত জেলা ও দক্ষিন নেপালের জনকপুর মিলে ছিলো প্রাচীন রাজ্য “বিদেহ”, রাজ্যের রাজধানী “মিথিলা”। বিদেহ রাজ্যের রাজা শিবসিংহের রাজসভার মহাকবি ছিলেন “বিদ্যাপতি”। এই বিদ্যাপতি-ই ব্রজবুলির সূচনা করেন। মিথিলা’র ভাষা বাঙলা ছিলো না, তাদের ভাষা ছিল “মৈথেলি”, বিদ্যাপতি যে ভাষাতে কাব্য রচনা করতেন তাতে মৈথেলি ছিলো, সংস্কৃত ছিলো। আর তার কাব্যে ছিলো মনিপুরি সুর। সেইসময় বাঙলা থেকে ছাত্ররা মিথিলায় জ্ঞানার্জনের জন্য যেত। ছাত্ররা মিথিলার কবিদের, বিশেষ করে বিদ্যাপতির সুমধুর পদাবলি গুলো মুখস্থ করে এসে বাঙলায় প্রচার করতো। পরবর্তীতে বাঙলার কবিগণ বিদ্যাপতির পদাবলিতে আকৃষ্ট হয়ে বাঙলা, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা মিশিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। এটাই ব্রজবুলির উৎপত্তির ইতিহাস। রাধা-কৃষ্ণ, সনাথ-ব্রজমন্ডলের লীলা বিবরণের ভাষা বলে একে বলা হয় ব্রজবুলি।
এই কাব্যগ্রন্থে থাকা গানগুলি হল:
বসন্ত আওল রে
শুনলো শুনলো বালিকা
হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে
শ্যাম রে, নিপট কঠিন মন তোর
সজনি সজনি রাধিকালো
বঁধুয়া, হিয়াপর আওরে
শুন সখি বাজত বাঁশি
গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে
সতিমির রজনী
বাজাও রে মোহন বাঁশি
আজু সখি মুহু মুহু
গহির নীদমে
সজনি গো, শাঙন গগনে
বাদর বরখন
সখিরে পিরীত বুঝবে কে
হম সখি দারিদ নারী
মাধব, না কহ আদর বাণী
সখিলো, সখিলো, নিকরুণ মাধব
বার বার, সখি, বারণ করনু
দেখলো সজনী চাঁদনি রজনী
মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান
এই গ্রন্থ কবি উৎসর্গ করেন তাঁর নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীকে, যিনি ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। এই গ্রন্থ প্রকাশের পূর্ববর্তী বছরেই আত্মহত্যা করেছিলেন প্রিয় নতুন বউঠান।
সুত্র- ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী - উইকিপিডিয়া
সবচাইতে ইনফরমেটিভ থ্রেডটা হলো এটা - জনৈকা সোমা লাই Quora-তে এই গানটা সম্পর্কে কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। আপনারা জানতে চাইলে প্লিজ লিংকে ক্লিক করুন। সংক্ষেপে আমি ওখান থেকে তুলে দিচ্ছি।
প্রথমেই গানটির মর্মার্থ বুঝে নিই।
রবি ঠাকুর, এই গানটিতে শ্রীমতি রাধারানী ও শ্রীকৃষ্ণের দিব্য প্রেমলীলার একটি দৃশ্যের বর্ণনা করেছেন।
'শাওন' মানে শ্রাবণ মাস। আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষা কাল - এটা আমরা সবাই জানি। বর্ষাকালের মেঘ কেমন হয় সেটাও জানা। আকাশ কালো করে মেঘ আসে। থেকে থেকে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখতে পাওয়া যায়। প্রকৃতির এক রুদ্র রূপ আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে! সে এক হুলুস্থুূল ব্যাপার!
'গগন' মানে আকাশকে বুঝিয়েছেন। 'আকাশ' এর সমার্থক 'গগন'।
'ঘন' শব্দের অর্থ 'মেঘ'।
'নিশীত' শব্দের অর্থ 'গভীর রাত্রি'।
'যামিনী' শব্দের অর্থ 'রাত্রি'।
'কুঞ্জ' শব্দের অর্থ 'উপবন'। এইখানে শ্রীমতি ও শ্রীকৃষ্ণ দেখা করতেন। শ্রীকৃষ্ণকে 'কুঞ্জবিহারী' বলা হয়। 'বিহারী' শব্দের অর্থ 'যিনি সদাই আনন্দে থাকেন ' / 'প্রমোদরত'।
'কৈসে' শব্দের অর্থ 'কী করে?'
'যাওব' শব্দের অর্থ 'যাও'।
'অবলা' শব্দের অর্থ 'বলহীনা' ( পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অবলা বলা হত। এখন অবশ্য এটা আর কেউ বলে না। কবি রাধারানীর সম্পর্কে এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। )
'কামিনী' শব্দের অর্থ 'নারী'।
' উন্মদ' শব্দের অর্থ 'পাগল', [উৎ+মদ্+অ ]।
'পবন' শব্দের অর্থ 'বায়ু'।
'যমুনা' - একটি নদী।
'তর্জিত' - 'তর্জন' থেকে 'তর্জিত' হয়েছে। এখানে অর্থ বলে, 'তুমুল শব্দে প্রবাহিত হওয়া'।
'ঘন ঘন' শব্দের অর্থ 'বার বার' হবে।
'গর্জিত' শব্দের অর্থ 'প্রচন্ড শব্দে ডাক দেওয়া'।
'মেহ' শব্দের অর্থ 'মেঘ'।
'দমকত' অর্থ ' কী পরিমাণ আওয়াজ করে' ( ☆ 'দম' শব্দের অর্থ ক্রমাগত আওয়াজ, ☆ 'কত' শব্দের অর্থ কী পরিমাণ। )
'তরু' = গাছ ( 'পথতরু' 'পথের গাছ'। )
'লুন্ঠিত' শব্দের অর্থ 'মাটিতে লুটিয়ে পড়া'।
'কম্পিত' শব্দের অর্থ 'কাঁপা'।
'ঘন ঘন ' শব্দের অর্থ 'বার বার'।
'বরখত' শব্দের অর্থ 'বজ্র / বর্ষণ করে'।
'নীরদপুঞ্জ' - শব্দের অর্থ 'মেঘরাশি '। { ☆ নীর শব্দের অর্থ জল, ☆ নীরদ শব্দের অর্থ মেঘ ( মেঘ থেকে জল পড়ে। তাই সে নীরদ। ), ☆ পুঞ্জ অর্থ সমগ্র, রাশি, স্তুপ। অর্থাৎ, কোনোকিছু যখন একসাথে থাকে, অনেকগুলি। }
'নিবিড়তিমিরময় ' শব্দের অর্থ 'গাঢ় অন্ধকারময়'। ( ☆ নিবিড় অর্থ গাঢ় / ঘন, ☆ তিমির অর্থ অন্ধকার। )
'কহ রে' অর্থ 'বল রে'।
'সজনী' শব্দের অর্থ 'সখী'।
'দুরুযোগে' শব্দের অর্থ 'দুর্যোগে'।
'নিরদয়' শব্দের অর্থ 'নির্দয়'।
'কান' শব্দের অর্থ 'কানু' ( শ্রীকৃষ্ণের একটি নাম )।
'কাহ' শব্দের অর্থ 'কীসের জন্য'?
'বজায়ত' শব্দের অর্থ 'বাজাচ্ছে'।
'সকরুণ' শব্দের অর্থ 'করুণার সাথে'/ 'অতি দুঃখপূর্ণ'।
'মোতিম' শব্দের অর্থ 'মুক্তা নির্মিত' ( ☆ মোতি অর্থ মুক্তা )।
'বেশ' শব্দের অর্থ 'সজ্জা বেশবিন্যাস., পোশাক অলংকারাদি বেশভূষা'।
'বনা দে' অর্থ 'বানিয়ে দে'। ( তৈরি করে দে )
'সীঁথি' শব্দের অর্থ 'কপালে পরা হয় একধরনে গহনা'।
'লগা দে' অর্থ 'লাগিয়ে দে'।
'ভালে' শব্দের অর্থ 'কপালে'।
'উরহি' শব্দের অর্থ 'আঁচল' ( কাপড়ে যে অংশ দিয়ে নারীরা বক্ষ আবৃত করে রাখে )
'বিলুন্ঠিত' শব্দের অর্থ 'মাটিতে গড়াগড়ি'।
'লোল' শব্দের অর্থ 'শিথিল' ( আলগা )।
'চিকুর' শব্দের অর্থ 'চুল, কেশ'।
'মম' শব্দের অর্থ 'আমার'।
'বাঁধহ' শব্দের অর্থ 'বাঁধন', 'বন্ধন'।
'চম্পকমালে' শব্দের অর্থ 'চম্পার মালায়' ( চম্পক অর্থ চম্পা ফুল, মালে অর্থ মালা )।
" গহন রায়নমে " মানে ঘন সন্ধ্যায় । গহন - ঘন, রায়ন - সন্ধ্যা । মে - য় / তে। ঘন সন্ধ্যাতে
'গহন' শব্দের অর্থ 'গভীর', 'দুর্গম', 'দুরূহ স্থান'।
'ন যাও' অর্থ 'না যাও'।
'বালা' শব্দের অর্থ 'কন্যা'।
'নওলকিশোরক' শব্দের অর্থ 'নন্দকিশোরের' ( শ্রীকৃষ্ণের অন্য একটি নাম )।
'পাশ' শব্দের অর্থ নিকটে', 'কাছে'।
'গরজে ঘন ঘন' অর্থ 'মেঘের বার বার গর্জনে'।
'বহু' শব্দের অর্থ ' 'বহুত'/ 'খুব'।
'ডর' শব্দের অর্থ 'ভয়'।
'পাওব' শব্দের অর্থ 'পাই'।
'কহে' শব্দের অর্থ 'বলে'।
ভানু = কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছন্দ্ম নাম ( ভানু সিংহ )।
'তব' শব্দের অর্থ 'তোমার'।
দাস = তোমার অনুগত ব্যক্তি। ( তিনি নিজেকে সমর্পিত করেছেন, তাই দাস বলছেন। )
◆◆◆◆◆◆◆◆◆☆☆☆☆☆◆◆◆◆◆◆◆◆◆☆☆☆☆
◆ গানটির সঠিক অর্থ বুঝতে হলে, আক্ষরিক ভাবে করলে সঠিক ভাবে বোঝা যাবে না, ভাবের আশ্রয় নিতে হবে।
◆◆☆☆◆◆ এইভাবেই বলা যায়, শ্রাবণ মাসের মেঘেদের প্রচণ্ড জমক ঠমক, গভীর রাত্রিতে রে। কুঞ্জ বনের পথে, কী করে যাও অবলা নারী? বায়ু উন্মাদের মতো বইছে, যমুনা নদী প্রবল বেগে প্রবাহিত হচ্ছে, মেঘ ঘন ঘন গর্জন করছে, ক্রমাগত বিদ্যুতের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, পথের গাছ নীচে পড়ে আছে, থরথর করে দেহ কাঁপছে, ঘন ঘন ঝিম্ রিম ঝিম্ করে মেঘ বর্ষণ করে চলছে।
শাল - পিয়ালে, তাল- তমালে ঘন অন্ধকারময় বন। এইরকম দুর্যোগের দিনেও কানু সকরুণ ভাবে রাধা নাম নিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে কেন?
মুক্তা দিয়ে আমার পোশাক সাজিয়ে দাও, কপালে সিঁথি লাগিয়ে দাও, আঁচল নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আমার শিথিল কেশ চম্পা ফুল দিয়ে বেঁধে দাও।
কন্যা, তুমি এই ঘন সন্ধ্যায় নন্দকিশোরের কাছে যেও না।
মেঘের ঘনঘন গর্জন শুনে আমি খুব ভয় পাচ্ছি, তোমার দাস ভানু এই কথাটি বলছে।
ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১:০৯