প্রথম পর্বের লিংক : বিষদাহ - পর্ব-১
‘লাভা’ সিনেমাটা সারাদেশে আলোড়ন তুললো। দেশের সবগুলো বিলাসবহুল প্রেক্ষাগৃহসহ বিগত ২০ বছরের মধ্যে রেকর্ডসংখ্যক হলে এটা মুক্তি পেল। ফেইসবুক, ব্লগ, পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনসহ সর্বত্র ভূয়সী প্রশংসা ও পজিটিভ কভারেজেও ছবিটি ইতিহাস সৃষ্টি করলো। সহেলি ও আমাকে নিয়ে প্রশংসার বান এতই প্রবল হলো যে, আমার ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু আমার কানের কাছে বার বার বলতে থাকলো, এই প্রশংসার ঢেউ নিশ্চয়ই বাংলার বর্ডার পেরিয়ে ইন্ডিয়ার মুম্বাইয়ে গিয়ে পৌঁছে থাকবে, এবং আমি খুব শিগগিরই বলিউডের হিরো হিসাবে কাস্টিং-এর অফার পেতে যাচ্ছি। আমাদের দেশের বেশ কয়েকজন নায়ক কলকাতার ছবিতে অভিনয় করেছেন; আমিই হয়ত বলিউড ব্লকব্লাস্টার ছবির প্রথম হিরোইক রোল পেতে যাচ্ছি।
কিন্তু ‘লাভা’ শুধু বাংলাদেশের হলেই দেখানো হচ্ছে, অন্য কোনো দেশে নয়। বন্ধুদের কটু কথা বলে দমিয়ে দেয়া অন্যায় হবে মনে করে ওদের মতের সাথে সায় দিই।
তবে, পত্রপত্রিকার একটা বিষয় আমাকে খুব আপ্লুত ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। আমাদের দেশের ছবিগুলো নায়িকাদের গুণে উৎরে যায়; ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে আমি শুধু মৌসুমীকে দেখেছি, যেমন জুহি চাওলাকে দেখেছি ‘কেয়ামত ছে কেয়ামত তক’ ছবিতে। এরপর মৌসুমীর ছবি যখনই মুক্তি পেয়েছে, আমি যেখানেই থাকি না কেন, ছুটে গিয়েছি মৌসুমীকে দেখার জন্য। মৌসুমীর সাথে ছবি করে দেশখ্যাত হয়েছেন সালমান শাহ, মান্না, ওমর সানি। কিন্তু ‘লাভা’তে এর উলটোটা ঘটেছে। একমাত্র আমার কারণেই সহেলির অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তার পারফরমেন্স আলোচনায়ই উঠতো না বলে সোশ্যাল মিডিয়ার অভিমত।
বিখ্যাত পরিচালক মারুফ স্মিথ হন্যে হয়ে ছুটে এলেন দমুহমা ললিখ-এর ‘গল্পটা সত্যি হতে পারতো’ উপন্যাসিকা অবলম্বনে নির্মিতব্য ‘ফলাফল’ ছবিতে আমাকে আর সহেলিকে কাস্ট করার জন্য। চুক্তি স্বাক্ষরের আগে আমাদের দুজনকে গল্পের স্ক্রিপ্ট দেয়া হলো পড়তে। কয়েক সেন্টেন্সে ডিরেক্টর আমাদের সারাংশ বুঝিয়ে দিলেন। এ ছবিতে আমি একজন বিবাহিত পুরুষ। আমার স্ত্রী ও সন্তানাদি আছে, কিন্তু তাদের দেখানো হবে ছবির একেবারে শেষ সিকোয়েন্সে। সহেলির সাথে আরেকজন কো-হিরোইন থাকবে - জেলিনা। সহেলি এ ছবিতে ‘তিশা’ নাম্নী খুবই একটা ইন্টারেস্টিং রোলে অভিনয় করবে, আর জেলিনার যে রোল, সেটা হলো ‘নিশি’। ডিরেক্টর বললেন, মনে হতে পারে ত্রিভুজ প্রেমের গল্প; আসলে ওসব সস্তা ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি নিয়ে আমি ছবি বানাই না; দিস ইজ টোটালি অ্যান আনকমন স্ট্রোরি বেইস্ড মুভি। পরিচালক একটা বিষয়ে জোর দিলেন- আপনারা গল্পটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। ক্যারেক্টারের ভিতরে ডুবে যেতে হবে। তবেই আপনাদের সেরা পারফরমেন্সটা দিতে পারবেন।
আমি বাসায় এসে সময় করে গল্পটা পড়তে থাকি।
২
সন্ধ্যায় একটা জরুরি মিটিং ছিল। মিটিঙের মাঝখানে কয়েক মিনিটের বিরতি। এমন সময়ে মোবাইলে ৫০ টাকার ফ্লেক্সি আসে। আমার মোবাইল আমি নিজেই রিচার্জ করি। কোথা থেকে, কেন এ ফ্লেক্সি এলো? ভাবতে ভাবতেই টিএন্ডটি থেকে একটা মেয়ের কল। সে বলে, ‘ভাইয়া, ভুল করে আপনার নাম্বারে ৫০ টাকা ফ্লেক্সি করে ফেলেছি। টাকাটা কি ফেরত দেয়া যায়?’ ফ্লেক্সির কারণটা বুঝতে পারি। বলি, ‘অবশ্যই। আপনার নাম্বার বলুন।’ ও নাম্বার পাঠায় এসএমএস করে। আমি ভাবি, মেয়েটা গরীব ঘরের হবে হয়তো। তা না হলে এভাবে একজন অপরিচিত লোকের কাছে রং ফ্লেক্সির টাকা ফেরত চাইতো না। মেয়েটা বোকা, হাবাগোবা বা উদাসীন টাইপেরও হতে পারে। নিজের সেল-নাম্বার এভাবে কেউ ভুল করে? আমি কিছুটা দয়াপরবশ হয়ে, কিছুটা ফান করার উদ্দেশ্যে ৫০-এর সাথে আরো ১৫ টাকা যোগ করে ওর নাম্বারে ৬৫ টাকা ব্যালেন্স ট্রান্সফার করি। ও খুশি হয়ে তৎক্ষণাৎ এসএমএস করে আমাকে 'থ্যাঙ্কস' জানায়।
রাত বারটার দিকে ও আমাকে কল করে। আমার ‘মহানুভবতার’ জন্য পুনর্বার ধন্যবাদ জানায়। দু মিনিটের কথাবার্তায় সে জানতে চায় আমি কী করি, আমার পেশা কী। এতো রাতে তার কল পেয়ে আমি ডিস্টার্ব্ড ফিল করছি কিনা সে জানতে চায়। বাচ্চারা ঘুমিয়ে, আমি আর স্ত্রী দুজনে টেলিভিশন দেখছিলাম, তাকে এ-কথা বলার পর সে বিব্রত ও লজ্জিত হয় এবং আমি বিরক্ত হয়েছি মনে করে 'স্যরি' বলে রেখে দেয়।
এর দুদিন পর বিকেলে সে হঠাৎ কল করে বলে, ‘ভাইয়া, আপনি কি আমার নাম্বারে ৫০ টাকা ফ্লেক্সি করেছেন?’
‘না তো!’ আমি আশ্চর্য হয়ে বলি।
সে কিছুটা ইনডিয়ান অ্যাকসেন্টে বলে, ‘আই ডু নট নোও হু হ্যাজ সেন্ট মি দ্য ফ্লেক্সি। হুয়াট শুড আই ডু নাউ? আই অ্যাম রিয়েলি ইন এ গ্রেট টেনশন।’
ঠিক ৫ মিনিট পর সে আবার ফোন করে হাসি ভরা কণ্ঠে বলে, ‘স্যরি ভাইয়া, আপনাকে বার বার বিরক্ত করছি। আমার বড়োবোন আমাকে ফ্লেক্সি করেছিল। এইমাত্র সে আমাকে ফোন করে জানালো। কিছু মনে করেন নি তো ভাইয়া?’
এক মিনিটে কথা শেষ। আমি মনে মনে হাসি আর বলি, শুধু একদণ্ড কথা বলার জন্যই সে এই গেইমটা করলো। অবশ্য আমার ধারণা ভুল হওয়াও অসম্ভব ছিল না।
আরো দু-তিন দিন পর বিকেলবেলা ওর একটা এসএমএস পাই। ‘ভাইয়া, আমার মনে খুব কষ্ট। আমি এখন চা খাচ্ছি। আপনি কি আমার সাথে বসে এককাপ চা খাবেন? আমি চা পাঠিয়ে দিই?’ খুব মজা পেলাম এ ধরনের এসএমএস পড়ে। তবে ওর প্রতি আমার মনে একটু সহানুভূতি জন্মালো। আমি ছড়াকার হয়ে উঠি এবং ছড়ার আকারেই একটা রিপ্লাই দিই:
এমন যদি হতো,
আমার দুটি পাখা আছে বিহঙ্গদের মতো,
আকাশ-পাহাড় পাড়ি দিয়ে এক নিমিষের প্রায়
ইচ্ছে হলেই পৌঁছে যেতাম তোমার আঙিনায়।
রাত দশটার দিকে ওর আরেকটা এসএমএস আসে, ‘আমার ভাবতে খুব ভালো লাগছে যে, আমার একজন এসএমএস-বন্ধু আছে।’ এর সাথে আরো কী সব যেন লিখেছিল। আমি অল্প কথায় এসএমএস-এর উত্তর দিয়েছিলাম।
তার পরের দিন আরেকটা এসএমএস, ‘হাই ইনভিজিবল ফ্রেন্ড, হাউ আর ইউ?... ...’
তিন-চার দিন পর সকালের দিকে ও ফোন করে। তার মন খুব উৎফুল্ল। কথায় কথায় সে ফান করতে থাকলো। আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে। আমার পেশা সম্পর্কে জানতে চায়। আমি নাকি খুব বুদ্ধিমান। তবে ওর কথাবার্তায় ওকে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত, সমাজসচেতন, শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিবোধ সম্পন্ন মনে হয়। ওর ব্যক্তিত্ব আমার ভালো লাগে। সত্যি কথা, আমার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা প্রচুর হলেও 'মেয়ে-বন্ধু' বলতে যা বোঝায় সে-রকম ঘনিষ্ঠ কেউ নেই। তবে সহপাঠিনী, বাল্যবান্ধবী, এ-ধরনের কিছু মেয়ের সাথে এখনো জানাশোনা আছে, এবং তাদের অর্থাৎ মেয়েদের ‘পুরুষ-বশীকরণ’ মোহনীয় গুণাবলি সম্পর্কে আমি সচেতনভাবে জ্ঞাত আছি। এ মেয়ের সাথে কথা হচ্ছে, কিন্তু তাকে কোনোক্রমেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মনে হয় না; আমার স্ত্রী কিংবা সহপাঠিনীদের চেয়ে ওর কণ্ঠস্বর অধিক মাধুর্যমণ্ডিত নয়; কথা বলার স্টাইল অন্যদের চেয়ে অধিক মাদকতাময় ও আকর্ষণীয় নয়। তবু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, ফ্লেক্সিশপ থেকেও আমার নাম্বার পাবলিক হবার সুযোগ দেখি না, কারণ, আমি স্ক্র্যাচকার্ড ব্যবহার করি। তাহলে কোথা থেকে আমার নাম্বার সে পেলো?
‘আপনি কি আমার অফিস থেকে নিয়েছেন আমার মোবাইল নাম্বার?’ জিজ্ঞাসা করতেই জবাব না দিয়ে সে পালটা প্রশ্ন করে, ‘আপনি চাকরি করেন? ও আল্লাহ্, আপনার অফিসটা কোথায় ভাইয়া? বেড়াতে আসি?’ বলেই সে হাসতে থাকে।
‘আপনি কি আমার বসের মেয়ে? বসের বোন? শ্যালিকা? বসের মোবাইল থেকে আমার নাম্বারটা নিয়েছেন নিশ্চয়ই! সত্যি বলছি না?’
‘হায় আল্লাহ্, আপনার বসের মোবাইল থেকে আপনার নাম্বার নেব? আপনি কি খুব নামকরা কেউ যে আপনার নাম আপনার বসের মোবাইলে দেখেই তুলে নিয়ে তড়িঘড়ি কল দেব? এটা একটা কাকতাল জনাব! কাকতালীয় ঘটনা।’
কাকতালীয় বটে! ওর আর আমার মোবাইল নাম্বারের ডিজিটগুলো হুবহু এক। ওর কথাবার্তায় আমার মনে হতো ও খুব একা এবং দুঃখিনী, ওর কিছু বন্ধুর দরকার। সুতরাং একটা পরিকল্পিত খেলার মাধ্যমে ও হয়তো বন্ধু সংগ্রহ করছে। আমি ভাবতাম, মোবাইল নাম্বারের ডিজিটগুলো উলটা-পালটা করে সাজিয়ে যে নাম্বার পাওয়া যায়, তাতেই সে ফ্লেক্সি পাঠায়, পরে ঐ নাম্বারে ফোন করে রং ফ্লেক্সিলোডের টাকা ফেরত চায়; দৈবাৎ কাউকে ভালো লাগলে তার সাথেই বন্ধুত্ব করে। আমার ভাবনা অমূলক ছিল না। ও বলেছিল, ওর নাকি প্রায়ই এমনটা হতো। আগেও এক-আধবার এমন হয়েছে, তবে অব্যবহৃত নাম্বারে ফ্লেক্সি চলে যাওয়ায় টাকা ফেরত পায় নি। আমি অনেকভাবে জেরা করে বের করার চেষ্টা করেছি, আমার সাথে এই খেলাটাই খেলেছে কিনা।
পেশাগত কারণে অনেক অপরিচিত নাম্বার থেকে আমার কাছে কল আসে। ওর বাসায় আমার বস না হয়ে জুনিয়র কোনো কলিগও থাকতে পারেন- ওর বড়ো ভাই, বাবা, চাচা, যে কেউ। ওদের ফোন ডাইরেক্টরি থেকে হয়ত আমার নামসহ নাম্বার পেয়ে আমাকে সে খুঁজে বের করেছে। ও এসব স্বীকার করে না। বলে, ও নাকি খুব ভুলোমনা। ওর নিজের নাম্বার মনে থাকে না বলেই মাঝে মাঝে এমন হয়ে যায়। আমি অর্ধেক বিশ্বাস করতাম।
আমার আরেকটা ভয় ছিল। ভাসমান পসারিনিদের ব্যাপারে আমার ধারণা একেবারে অস্বচ্ছ; হোটেলে, পার্কে, সিনেমায়, ঘাঁটিতে কীভাবে ওদের বেচাকিনি হয়, আমার সে-ধারণা বোকা বালকদের চেয়ে কিছু বেশি ছিল না। এক পর্যায়ে আমার মনে হলো, মেয়েটা এভাবে কোনো খদ্দের খুঁজছে না তো! আমি কি ওর খদ্দেরে পরিণত হচ্ছি?
মেয়েটার নাম জিজ্ঞাসা করি। আশ্চর্য, সে তার নাম বলে না। শেষমেষ একদিন জানালো তার নাম ‘তিশা’, এবং কয়েকদিন পরই জানালো ‘তিশা’ তার আসল নাম নয়।
একদিন একটা সকাল ছিল অন্য সকল সকালের চেয়ে অনেক আলাদা ও সুন্দর। সেই সকালে তিশা ফোন দিল। দু-চার কথার পর খুব আবেগঘন স্বরে তিশা বললো, ‘ভাইয়া, আপনার কণ্ঠস্বর আমার কী যে ভালো লাগে!’
৩
স্কুলজীবনে একবার আবৃত্তি ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। কলেজের ক্লাসে একবার আমার আট লাইনের আবৃত্তি শুনে ক্লাসমেটরা প্রশংসা করেছিল। ঐ সময়ে কোনো এক বিয়ে-বাড়ির মাইকে আমার খালি গলায় গাওয়া ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়’ শুনে একটা কিশোরী প্রেমে পড়েছিল। ‘বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল...’ আমি যখন পথ দিয়ে হাঁটতাম, আমার মুখে এ কবিতা খইয়ের মতো ফুটতো। আমি কবিতা লিখতাম। আমার কবিতা পড়ে রোজেলা কোনোদিন বলে নি, ‘এত্ত ভালো লিখিস!’ আমার প্রতিভা এটুকুই। আমার মধ্যে কোনো এক্সট্রা-অর্ডিনারি গুণ আছে, সেই বিশ্বাস আমার কোনোকালে ছিল না।
ও যখন বললো, ‘আপনার কণ্ঠস্বর আমার কী যে ভালো লাগে’, বাস্তবিকই আমি গলে গেলাম; ওর প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা সৃষ্টি হলো না, আমার মনে হলো আমি আমার সত্তাকে খুঁজে পেয়েছি। আমি বিমুগ্ধ হলাম। কিন্তু যুগপৎ ভেবেছি, এটা ওর তোষামোদিও হতে পারে। ও বলে, ‘আপনি তো আমার বস নন, আপনার তোষামোদি করে আমার লাভ কী?’ কথা তো ঠিকই, আমি ভাবি। ও আরো বলে, ‘আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। আপনি খুবই ব্রিলিয়ান্ট। আপনি অনেক বেশি বুদ্ধিমান।’ আমি চমৎকৃত হই। এমন করে কেউ কোনোদিন আমার প্রশংসা করে নি। ওর স্তুতিবাক্যগুলো সারাদিন, আরো কিছুদিন পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে বাঁশির সুরের মতো অনুরণিত হতে থাকলো।
একবার তিশা আমাকে মেসেজে লিখেছিল, ‘প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই যেন আপনার একটা মেসেজ পাই। আর রাতে ঘুমোবার আগে আপনার মেসেজ না পেলে আমার কিন্তু ঘুমই হবে না।’
এর আগে অন্য একটা মেয়ের সাথে টিএন্ডটি ফোনে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেই মেয়েটির সাথে অবসর সময়ে প্রচুর কথা হতো, রাজনীতি, সাহিত্য, বিবিধ বিষয়ে। তার সাথে আমার কোনো প্রেমের বা বন্ধুর সম্পর্ক ছিল না। ইন্টারনেটের কোনো এক সাইটে তার কিছু সমস্যার কথা জানতে পারি; তাকে সাহায্য করার ইচ্ছেয় ফোন করেছিলাম। সেখান থেকেই শুরু। ছেলেরা এমন মেয়েদেরই খোঁজে, যাদের খুব বিপদ! সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারলে সে-মেয়ে আপনা-আপনি কবজাগত হয়ে পড়ে; আমি তো ছেলেই; ছেলেদের সহজাত কাজটিই করেছিলাম। সে মেয়ে খুব রহস্যময়ী ছিল। একেক সময়ে তার একেক নাম বলতো। বিবাহিতা। সংসারের নানা টানাপোড়েনের কথা বলতো। স্বামীর সাথে তার ইগোয়িস্টিক মনোমালিন্যের কথা বলতো। আমার সাথে আলাপ করে সে খুব আনন্দ পেতো, তা বলতো। সে তার মোবাইল নাম্বার আমাকে কখনো দেয় নি। আমার পরিবারের সব কথা তাকে বলতাম। তার প্রতি আমার কোনোদিন যৌনাকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয় নি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার শক্তি ও ইচ্ছে দুটোই আমার ছিল। আমাদের কোনোদিন দেখাসাক্ষাৎ হবে না, চুক্তি ছিল। এ মেয়েও কোনোদিন তার নাম বলে নি। আমি তার নাম দিয়েছিলাম ‘নিশি’।
নিশির সাথে প্রায় বছর খানেক যাবত কোনো যোগাযোগ নেই। নতুন ‘মোবাইলভাষিণী’র সাথে কথা বলতে বলতে একদিন হঠাৎ মনে হলো, এ নিশি নয়তো! কেননা, বিশেষ বিশেষ সময়ে নিশির স্বর আহ্লাদিত হয়ে উঠতো, তিশার মধ্যেও তা লক্ষ করি। আমার বিশ্বাস হয়, নিশি হয়ত আরো রহস্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নতুন একটা গল্প তৈরি করে আবির্ভূত হয়েছে ‘তিশা’ নাম নিয়ে।
একদিন আচমকা তিশাকে প্রশ্ন করি, ‘আপনি কি নিশি?’ ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এরপর নিশিকে নিয়ে গল্প চলে তিশার সাথে। নিশির সাথে কী কী বিষয় নিয়ে কথা হতো, ঠিক ঐ কথাই তিশার সাথে চলতে থাকে। আশ্চর্য, তিশা আমার প্রতি আরো আকৃষ্ট হতে থাকে। নিশি আমাকে ‘জ্ঞানের সাগর’ ভাবতো, তিশাও কথায় কথায় আমার অসাধারণ জ্ঞান আর বুদ্ধিমত্তার তারিফ করে। মহামতি আলেকজান্ডার পারেন নি, আমি কী করে এই প্রশংসা অ-গ্রহণ করবো? আমি ফুলে-ফেঁপে উঠি।
কিন্তু ক্রমশ তিশাও রহস্যময়ী হয়ে উঠলো। প্রথম দিনের মেসেজে সে তার নাম বলেছিল ‘কলি’। বাসা বলেছিল নারায়নগঞ্জ। পরে তার নাম হলো ‘অহনা’। বাসাবোয় তার বাসা। বিয়েশাদি হয় নি। সম্ভাব্য দুই পাত্র আছে। একজন কানাডায়, আরেকজন দেশে। দুজনের কাছেই ছবি পাঠানো হয়েছে। কানাডার পাত্র সবদিক থেকেই শ্রেয়তর, কিন্তু তার পছন্দ দেশের পাত্রকে। কারণ তিশা দেশে থাকতেই ভালোবাসে।
একবার আমি বাসা ছেড়ে দিন দশেকের জন্য অন্যত্র চলে যাই। প্রচুর ব্যস্ততা। তার মধ্যেও তিশার কল আসে, মেসেজ আসে। আমার ভালো লাগে। বলে রাখি, ওর জন্যও আমার মধ্যে কোনো প্রেমভাব বা যৌনভাবের উন্মেষ হয় নি, তখনো। অথচ আমরা রাজ্যের গল্প বলি।
সন্ধ্যায় ওকে বলি, ‘আমরা কোন্ কোন্ বিষয়ে আলাপ করতে পারি তা কি বেছে নিতে পারি না?’
‘হ্যাঁ পারি।’
‘কী কী বিষয়?’
‘আপনিই বলুন।’
‘এমন কী বিষয় আছে যা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি না?’
‘এমন কিছুই নেই।’
‘আমরা কি সেক্স নিয়েও আলোচনা করতে পারি?’
‘আমি তো কোনো অসুবিধা দেখছি না।’
আমি হুট করে বলি, ‘আচ্ছা, আপনাকে যদি এখন চুমু খাই, আপনার কোনো ফিলিংস হবে?’
‘নাহ্।’ ও খুব নির্বিকারভাবে বলে।
‘কেন?’ আমি জানতে চাই।
‘জানি না কেন। আমার সেক্স খুব কম।’
আমি বলি, ‘আমরা একটা শর্ত বা চুক্তি করি আজ?’
‘কী রকম?’
‘আমাদের সকল যোগাযোগ মোবাইলেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আমাদের কোনোদিন দেখাসাক্ষাৎ হবে না। কথা বলাই আমাদের যাবতীয় বিনোদন। রাজি?’
‘রাজি।’
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০২২ রাত ১:৩১