গান সুর করা ও লিরিক লেখা নিয়া আজকের পোস্টটি।
প্রফেশনাল ও বিখ্যাত সুরকারগণ কীভাবে গানের সুর সৃষ্টি করেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত কোনো জ্ঞান নেই। তবে, তাদের সুর সৃষ্টির পদ্ধতি খুব মেথোডিক্যালই যে হয়ে থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। আমার 'প্রফেশনাল সিঙ্গার কাম কম্পোজার' দুই ছেলের দিন-রাত গানের যন্ত্রপাতি নিয়া এসব কাজে ব্যস্ত থাকার মধ্য থেকে আমার এ বিশ্বাস দৃঢ় হয়। ওরা খুব নিখুঁতভাবে এ বি সি বা সারেগামা তোলে গিটার বা কি-বোর্ডে।
কিন্তু লালন ফকির, শাহ আব্দুল করিম, বিজয় সরকার, প্রমুখ বাউল ও স্বভাব শিল্পীগণের কি এরকম সুবিধাদি ছিল? আমি গ্রামে বয়াতীদের আসরে দেখেছি, বয়াতীরা মুখে মুখে, খুবই তাৎক্ষণিকভাবে যেমন গানের কথা তৈরি করে ফেলেন, তাদের সুরগুলোও অনেকসময় ঐরকম তাৎক্ষণিকভাবেই সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে মনে হতো।
আমি কীভাবে গান লিখি বা সুর তৈরি করি? আমার কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই। সুর বা লিরিকের কোনো গ্রামারও শেখা বা অনুসরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমাকে 'স্বভাব সুরকার' বলতে পারেন কাজকর্ম, বা টিভিতে খেলা দেখার সময় আমি সাধারণত গুনগুন করে, কখনো-বা উচ্চস্বরেই গলা ফাডাইয়া গান গাইতে থাকি। আবার, রাস্তায় চলতে চলতে, হাটে-বাজারে, বা গাড়িতেও গুন গুন করতে থাকি, কিংবা শিস বাজাইতে থাকি। ইউটিউবে বা টিভিতে গান শোনার সময় ঐ গানের সাথেও গলা ছেড়ে গান গাইতে থাকি। বাড়িতে মানুষ-জন বা মেহমান থাকলে তারা কিছুটা বিব্রত হন বা লজ্জা পান বৈকি তো, প্রচলিত একটা গানের সাথে তাল মিলাইতে মিলাইতে হঠাৎ আমি নিজেই দেখতে পাই যে, গানের সুর আর আদি-সুরে নাই, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা সুরে পরিণত হয়েছে, আর সেই সুরকে টেনে নেয়ার জন্য (বা সুর যার উপর ভর করবে) প্রায় অর্থহীন কিছু লিরিকের জন্ম হইয়া গেছে। এই সুরটা যদি একটা নির্দিষ্ট ফর্মে পৌঁছে গেছে বলে মনে হয়, তখনই মোবাইল রেকর্ডার অন করে সুরটাকে ধরে ফেলি। ব্যস, আদি সুর আমার কব্জাগত, বা মোবাইলগত হইয়া গেল বলে ধরে নিতে পারেন। এটাকে ল্যাপটপের একটা নির্দিষ্ট ফোল্ডারে জমা করে রাখি। এই সুরটা যদি মনের মধ্যে গেঁথে যায়, তাহলে মাঝে মাঝেই এটা অজান্তেই কণ্ঠে গুন গুন আকারে বাজতে থাকে। অনেক সুর পরবর্তীতে শুনতে গিয়ে মনে হয়েছে, নাহ, এটা কিছুই হয় নাই। সেই সুর ল্যাপটপের কোনায় দিনে পর দিন অঘোরে কাঁদতে থাকে।
যে সুর দাঁড়িয়ে যায়, সময় পেলে ওটাকে রিফাইন করতে বসি। এখানে আমি একটা সমস্যায় পড়ি। যদিও কবিতা লিখি, কিন্তু সুর অনুযায়ী লিরিক লিখতে গেলে কোনো কবিতা বা লিরিক খুঁজে পাই না। এরকম অনেক সুরই রেডি হইয়া বসে আছে, কিন্তু কোনো লিরিক নাই
আবার, অনেক সুর শুধু শিসের মাধ্যমেই তৈরি হয়ে যায়। সুরটাকে একটা ফর্মে ফেলতে পারা মাত্রই মোবাইলে রেকর্ড করে ফেলি।
আজ যে গানটি শেয়ার করছি, সেটি খুব বেশিদিন আগের না। ১৭ নভেম্বর ২০২১-এর সকালে, কিংবা সন্ধায়, সঠিক মনে নেই, হঠাৎ এ সুরটা ধরা দেয়। প্রথম গুন গুন করে যে কথা দিয়ে সুরটা শুরু করি, সেটা ছিল - 'আমি তো তোমার কাছে হার মেনেছি। হার মেনেছি আমি হার মেনেছি'। এটাই রেকর্ড করে ফেলি। এরপর মাঝে মাঝেই এটা গুন গুন করে গেয়েছি (এর মধ্যে আরো কিছু নতুন সুর তৈরি হয়ে গেছে)। কিন্তু সুর আর এগোচ্ছিল না, লিরিকও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। গতরাতে এটা রিফাইন বা চূড়ান্ত করার ইচ্ছা নিয়া বসলাম। এবার লিরিকের প্রথম অংশটা (চূড়ান্ত গানে যেটা প্রথম অন্তরা হয়েছে) আগে লিখে নিলাম। তারপর মুখে মুখে কয়েকবার আওড়ালাম। মোবাইলের ভয়েস রেকর্ডার অন করার আগে লিরিকটা ছিল এরকম, মাত্র দুই লাইন :
‘আমি তো তোমার কথা সবই রেখেছি
তুমি তো তোমার মতো ভুলে গিয়েছ’
এই দুই লাইনের সুরটুকুই তখন হয়েছে। মোবাইল অন করে গাইতে থাকলাম। গাইতে গাইতেই নীচের লিরিকটা হয়ে গেল তাৎক্ষণিকভাবে, আর সুরটাও তাৎক্ষণিকভাবেই :
লিখে রেখেছি
লিখে রেখেছি আমি লিখে রেখেছি
হৃদয়ের গভীরে লিখে রেখেছি
পুরোটাই তিনবার গাইলাম। কেউ খেয়াল করে শুনলে বুঝবেন, প্রথম বার যে-সুরে গাওয়া হয়েছে, পরের দু’বারে সুরে একটা চেঞ্জ এসেছে।
ব্যস, সুরটা হয়ে গেল। কিন্তু তখনো আমি নিশ্চিত না, গানের শুরুটা কীভাবে হবে? অর্থাৎ, যা রেকর্ড করা হলো, তা কি প্রথম অন্তরা হবে, নাকি গানের শুরু হবে (যাকে গানের ভাষায় ‘মুখ’ বলা হয়)।
প্রথম অন্তরা হিসাবেই স্থির করলাম। এবার লিরিক লেখা শুরু করলাম সুরের সাথে। অনেক কাঁটাছেঁড়া, ঘষামাজার পর দুই অন্তরার লিরিক লেখা শেষ হলো। এভাবেই রেকর্ড করবো? কিন্তু গানের 'মুখ' বা শুরুটার জন্য তো আরেকটা সুর লাগবে। এ নিয়ে বেশি গবেষণা না করে অন্তরার শেষের অংশের যে সুর – লিখে রেখেছি – এ সুর দিয়েই ‘মুখ’-এর সুর বানিয়ে ফেললাম। এবং ‘মুখ’-এর লিরিকটাও করে ফেললাম।
সবশেষে যা দাঁড়াইল, এটাই গানের আদি ভার্সন, বা প্রথম ভার্সন। ভবিষ্যতে লিরিকে চেঞ্জ আসতে পারে, সুরেও সামান্য ভেরিয়েশন আসতে পারে।
তো এই হলো আমার গান লেখা ও সুর করার বিরাট ইতিহাস অল্প কয়েকটা সুর বানাইছি ও লিরিক লিখছি, যা কেবল নিজের আনন্দের জন্য। এ নিয়ে ব্যাপক কোনো পরিকল্পনা নাই, তবে, ছোট্ট একটা আশা বা ইচ্ছে আচ্ছে, হয়ত একদিন একটা স্টুডিয়ো ভার্সন ফুল অ্যালবাম বের করে ফেললেও ফেলতে পারি, যদি সেরকম কোনো শিল্পী জোটে ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি অনুকূল থাকে। সেটা অবশ্য অনেক পরের ব্যাপার।
পুরো লিরিক এবার দেখুন নীচে।
হার মানো নি
হারো মানো নি তুমি হার মানো নি
দোষ ছিল তোমার তবু হার মানো নি
আমি তো তোমার কথা সবই রেখেছি
তুমি তো তোমার পথে চলে গিয়েছ
লিখে রেখেছি
লিখে রেখেছি আমি লিখেছি
হৃদয়ের গভীরে সব লিখে রেখেছি
তুমি তো উজান বেয়ে চলে গিয়েছ
আজো কি নদীর কোনো কূল পেয়েছ?
আমি পেয়েছি
আমি পেয়েছি শুধু আমি পেয়েছি
তোমাকে হারিয়ে তোমাকেই পেয়েছি
হার মেনেছি
হারো মানো নি তুমি হার মানো নি
দোষ ছিল তোমার তবু হার মানো নি
২৬ নভেম্বর ২০২১ (লিরিক লেখার তারিখ)
লিরিক্যাল ভিডিও'র লিংক : হার মানো নি - কথা ও সুর - সোনাবীজ এই লিংকে ক্লিক করলেই ইউটিউবে চলে যাবেন
উৎসর্গ :
খায়রুল আহসান স্যার ও হাসান কালবৈশাখী ভাই। আয় রে সকলে হাত রাখি হাতে গানের উপর তাদের কমেন্ট আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছে। একজন শৌখিন ও অতি আনাড়ি, নগণ্য সুরকারের জন্য তা বিরাট প্রাপ্তি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০২১ সকাল ১১:৩৫