somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাকে যদি একটা বর দেয়া হয়

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাকে যদি একটা বর দেয়া হয়-
আমি ফিরে যাব আমার ৪ বছর বয়সে

ছোটোবেলায় আমি খুব লাজুক ছিলাম, এবার বর পেলে
খুব বেয়াড়া হবো- দিন নাই রাত নাই, নানা বাড়ি যাব
নানা বাড়ির বাঁশতলায় জোলাপাতি রাঁধবো আমি আর সুরুজ মামা
তারপর কলাপাতায় নানা আর নানিকে খাওয়াব।

নানান উৎসবে, পার্বণে- বিশেষত শীত ও গ্রীস্মে
দাওয়াতের ধূম পড়ে যেত। দাওয়াত ছাড়াই মা আর বাবা প্রায়
প্রতিসন্ধ্যাতে নানা বাড়ি যেত আড্ডা দিতে
প্রতিটা সন্ধ্যাই হয়ে উঠতো অনন্য উৎসব
নানা আর নানির সাথে কত কথা, কত গল্প ছিল মা আর বাবার
তারপর খেয়েদেয়ে বাড়ি চলো, মাঝখানে ফারাক মাত্র তিন শ গজ।
চৌকাঠ পেরিয়েই ঝাঁপ দিতাম বাবার কোলে –
বাবা আমাকে কাঁধে তুলে নিত।
আমার একটা অভ্যাস ছিল, বা শখও বলতে পারেন - কাঁধে চড়েই
জড়িয়ে ধরতাম বাবার গলা, আলগোছে আমার মাথা
নুইয়ে দিতাম বাবার মাথায়।
তারপর দোল খেতে খেতে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম জানি না,
ঘুম ভাঙলে দেখতাম- বাবার পিঠ জুড়ে শুয়ে আছি
খেজুর পাতার পাটিতে আমাদের সুখে ভরা জীর্ণ কুটিরে।

ধাপারি খালের পাড়ে মধ্যেরটেকে
ফুপুবাড়ির আমড়া গাছটা ছিল চৌদ্দ গ্রামের ঝাড়া,
বিলেতি গাবগাছটায় গাব ধরতো বেতুলের মতো, কী যে মিষ্টি
আর রসালো ছিল! তড়তড় করে গাবগাছে উঠতো সুজাহার ভাই
লম্বা কুটা দিয়ে আমড়ার ছোবায় ঘন ঘন বাড়ি ঝাড়তো ফুপু।
অমনি হুড়মুড় করে আমড়া কুড়ানোর লড়াই। একেকটা কামড়ে
ছিল অমৃতের চেয়েও মধুর।

ঢাকা থেকে কোহিনুর মামা আসতো প্রতিবছর। কর্পুরা খালা
আসতো। নানা আর নানি আসতো। তারা আমাকে কত্ত আদর
করতো, আমি তা কখনো ভুলতে পারি না।

সাতভিটা থেকে আসতো রাহিমা আর ওর ছোটো ভাই জুলহাস।
জোসনারাতে বাড়ির উঠোন, বাইরের পথ ও মাঠ,
গাছগাছালির মাথা খাঁ-খাঁ করতো। আমাদের অন্তরে আনন্দ তুফান।
খ্যাড়ের পালায়, নাড়ার গাঁদায়, কোনাকাঞ্চিতে গুদরাগুদরি করে
'পলানতি' খেলতাম। সে খেলায় এতই মজে যেতাম,
ঘুম বা খাওয়ার কথা মনে পড়তো না কিছুতেই।
তারপর রাহিমারা সাতভিটা ফিরে গেলে আমরা, মানে, আমি,
চাচাত ভাই জলিল ও বাবুল মনে মনে অনেক কাঁদতাম।
এরপর ৪০ বছর পার হয়ে যায়, রাহিমাকে দেখি নি।
ওকে দেখার জন্য আমার মন আকুল হয়ে উঠলে একবার দেশের
বাড়িতে গিয়ে চাচিকে বললাম- রাহিমাকে আসতে বলো তো!
চাচির জবাব শুনে সত্যিই আমরা কলজের তন্ত্রী ছিঁড়ে গেল-
রাহিমা বেঁচে নেই, অনেক বছর আগেই মারা গেছে রাহিমা।
রাহিমা আমাদের চেয়ে এক কী দু বছরের বড়ো ছিল,
রাহিমা আমাদের বাড়ি এলে ঘরদোর জোসনার মতো খলখল করতো
রাহিমা খুব মায়াবতী ছিল।
রাহিমা বাড়ি ফিরে গেলে আমাদের কান্না পেত।
রাহিমা ছিল আমার চাচির মেঝ বোনের মেয়ে।
রাহিমার হাস্যোজ্জ্বল রঙিন মুখটা মনে হলে এখন
চোখদুটো ভীষণ ঝাঁপসা হয়ে আসে।

মালেক মামা আর যন্ত্রাইল মামাদের বাড়ি উত্তর শিমুলিয়া।
চাচির বাপের বাড়ি ওটা।
আমাদের ছোটোবেলায় মায়ের বাপের বাড়ি
আর চাচির বাপের বাড়িতে কোনো তফাত বুঝি নি।
মায়ের ভাই আর চাচির ভাইয়েতেও কোনো তফাত দেখি নি।
মালেক মামা শুধু জলিল আর বাবুলের মামাই নয়, আমারও মামা
সুরুজ মামা শুধু আমার মামাই নয়, জলিল বাবুলেরও মামা
আমরা দল বেঁদে বেড়াতাম নানার বাড়িতে, মামির ঘরেতে
মালেক মামা আর সুরুজ মামা কিংবা কোহিনুর মামাতে
কখনো কোনো আলাদা টান দেখি নি।

যত দূরেই যাই, আকাশের সপ্ততলা ডিঙ্গিয়ে গেলেও
শৈশবের ছোট্ট ‘আমি’টা ছায়ার মতো জীবন জড়িয়ে থাকে
তখন কোনো দুঃখ ছিল না, চিন্তা ছিল না, ভাবনা ছিল না
মায়ের আদরে, বাবার ছায়ায় পৃথিবী নিশ্চিন্ত ছিল

আমাকে যদি একটা বর দেয়া হয়-
আমি ফিরে যাব আমার ৪ বছর বয়সে
বাবার হাত ধরে গুঁটি গুঁটি পায়ে হেঁটে যাব মেঘুলা বাজার
মায়ের আঁচলে সারাটা শরীর মুড়িয়ে তার পায়ে পায়ে হাঁটবো
আর শরীরের ঘ্রাণ খাব
আমাকে যদি একটা বর দেয়া হয়-
আমি ফিরে যাব আমার ৪ বছর বয়সে- সুরুজ মামা, সুজাহার ভাই,
রাহিমা, জলিল আর বাবুলের সাথে জুট্টি করে বলবো-
‘এই যে বসলাম, এই ৪ বছর বয়স থেকে
আর একটা চুলও বাড়বো না। বল, রাজি?’

৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১


কিছু আঞ্চলিক/অপ্রচলিত শব্দের অর্থ :

কুটা - লম্বা লাঠি জাতীয় বস্তু, যা দিয়ে গাছ থেকে ফল-ফলাদি পাড়া হয়
পলানতি - লুকোচুরি খেলা
গুদরাগুদরি - এটা বলে বোঝানো কিছুটা মুশকিল। জড়াজড়ি করা, ঘেঁষাঘেঁষি, দাপাদাপি করে খেলাধুলা করা
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৫৮
৩৭টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বৈপ্লবিক ছন্দ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৫ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১:১২




বছর তিনেক আগে রাজু ভাস্কর্যের সামনে উড়ন্ত ভঙ্গিতে ছবি তুলেছিলো একটা মেয়ে। তার নাম ইরা।

ইরার ওই ছবিটাই হওয়া উচিত বাংলাদেশের মেয়েদের প্রতীক। আমাদের মেয়েদের মেধা আছে, অদম্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম ও তার আসল বাস্তবতা

লিখেছেন নীল আকাশ, ০৫ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭







বাংলাদেশের ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার নামে যে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো দেশের মানুষের সাথে ভন্ডামি করে বেড়াচ্ছে তাদের জন্য উপরের ছবিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‌এই সমস্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

কওমি সমস্যার সমাধান কি?

লিখেছেন প্রফেসর সাহেব, ০৫ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৪

দেশে বিশ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিপরীতে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা কত জানেন? অসংখ্য। এর নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা কেউ দিতে পারেনাই, নামে বেনামে নিবন্ধিত অনিবন্ধিত মাদ্রাসার সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি, মার্কিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

শূন্যতার বিরম্বনা

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ০৫ ই মে, ২০২৫ রাত ৯:৫৯

"শূন্যতার বিরম্বনা "

তুমি আমার ভিতরে থাকা গভীর কষ্ট,
অনেক টা আলমারীতে তুলে রাখা পরতে না পারা
কাপড়ের মতো।
তুমি আমার বুকের ভিতর লুকিয়ে থাকা গভীর
এক ভালোবাসা,
যেখানে নেই কোনো প্রাকৃতিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাষ্ট্রীয় মনোবিকৃতি ও জাতিসত্তার লোপ: নিৎসে, ফুকো, ফ্রয়েড ও মার্ক্সের দর্শনে বাংলাদেশের অন্তর্গত বিপর্যয় !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই মে, ২০২৫ রাত ১১:২৩


আমরা কোথায় যাচ্ছি ? না, এই প্রশ্নটিই ভুল। আমরা আদৌ কোথাও যাচ্ছি কিনা, সেই নিশ্চয়তাই আজ খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা যে সমাজে বাস করি, সেটিকে আর সমাজবিজ্ঞান দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×