বিনীত সতর্কতা : অনেক বড়ো পোস্ট। কমপক্ষে ৩০ মিনিট লাগবে পড়তে।
সেদিন জুম্মাবার ছিল। কুটিমিয়ার বাবা আগেই মসজিদে চলে গেছেন; মাঠে গিয়েছিল বলে সে একটু দেরিতে ঘর থেকে বের হলো।
ঘর থেকে বাইরে কদম ফেলতেই এক জটাধারী পাগল এসে হাঁক দিল, ‘একটা ট্যাকা দে, নইলে ধ্বংস হইয়া যাবি।’
কুটিমিয়া ভয় পেয়ে গেলো। তার জমানো কয়েকটা টাকা ঘরে আছে। সেখান থেকে একটা টাকা নিয়ে এসে পাগলের হাতে দিতে উদ্যত হয়েছে, এমন সময় তার মা এসে ধমকে উঠলো, ‘ট্যাকা কি গাছে দরছে নি? কোতাকর কুন্ পাগলে আইয়া কী না কী কইলো আর অমনি ট্যাকা বাইর কইরা দিওন লাগবো? ট্যাকা থু।’
কুটিমিয়া বিব্রত হয়। সে পাগলকে টাকাটা না দিয়ে লুঙ্গির কোঁচড়ে গুঁজে রাখে। তবে তার মন সারাক্ষণ খুঁতখুঁত করতে লাগলো। সে মসজিদে গেলো, কিন্তু স্থিরভাবে নামাজে মনোনিবেশ করতে পারলো না। তার মনে হলো, এই একটি টাকা দান না করার জন্যই হয়তো এই পাগলের অভিশাপে গোয়ালের হালের গরু দুটি মরে যেতে পারে, তার ছোটো বোনটি অন্ধ হয়ে যেতে পারে, তার মা-বাবা, ভাইবোন, এমনকি সে নিজেও হয়তোবা ভয়ংকর কোনো বিপদে পড়তে পারে। লোকটা তো পাগল না-ও হতে পারে, ভিক্ষুকরূপী ঈশ্বর, মন পরীক্ষা করে দেখার জন্য এক টাকা ভিক্ষা চেয়েছে।
এরূপ নানাবিধ ভাবনা ভাবতে ভাবতে সে যখন নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছিল, হঠাৎ দেখে সেই পাগলটি থালা হাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। সে ছুটে কাছে গিয়ে তার থালায় একটি টাকা রাখে, যেটি সে এই পাগলকে দেবার জন্য ঘর থেকে বের করে এনেছিল।
সেদিন রাতে তার ছোটো বোন নুতুর পাতলা পায়খানা ও বমি হয়, ভোর হবার আগের মুহূর্তে নুতু মারা যায়। দুপুরের দিকে কুটিমিয়ার বাবা বিছানায় পড়েন, তাঁর গুঁটিবসন্ত হয়, সন্ধ্যারাতের দিকে তার মাও টের পায় যে, তার শরীর ভরে গুঁটি উঠছে; পরের দিন সকালে গোয়ালের সবচেয়ে বড় বলদটা একেবারে অকারণে হাম্বা হাম্বা রবে চিৎকার করতে থাকলো, তারপর নেতিয়ে পড়ে মারা গেলো। প্রায় বিশদিন পর্যন্ত কুটিমিয়ার মা-বাবা বিছানায় পড়ে থাকলেন।
কুটিমিয়ার মনে আর কোনো সন্দেহই থাকলো না যে, সেই পাগলের অভিশাপেই তাদের পরিবারে এতো বড় তাণ্ডব বয়ে গেলো। ওর মা পাগলের খোঁজে হন্যে হয়ে উঠলো। কুটিমিয়া নিজেও সেই পাগলকে খুঁজলো, কিন্তু তাকে আর কোথাও পাওয়া গেলো না। তবে অন্য আরেকজন পাগলের সাক্ষাৎ পাওয়া গেলো।
একদিন টিফিন পিরিয়ডে স্কুল ছুটি হয়েছিল। কুটিমিয়া বাড়ি না ফিরে দু শ গজ দক্ষিণে মেঘুলা বাজারে গেলো চুল কাটাতে। সেলুনের পাশে উঠোনের মতো খোলা একটা জায়গা। সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। কুটিমিয়া সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখে, তার দ্রুতপঠনের কাবুলিওয়ালার মতো বিশাল-দেহ এক পাগল—কালো রঙের ঢিলেঢালা কাবুলি তার পরনে, মাথায় কালো হ্যাট, চারধারে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলে, শ্মশ্রূমণ্ডিত মুখমণ্ডল, তার হাতে বাঁশির মতো এক লাঠি, লাঠি নেড়ে নেড়ে সে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝেই চিৎকার দিয়ে ধুয়া তুলছে:
‘এই দুনিয়া ফানা হবে
কিছুই রবে না রে, কিছুই রবে না...’
ভিড় ঠেলে কুটিমিয়া পাগলের একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পাগলের গলায় লম্বা পুঁতির মালা কিংবা তসবি ঝোলে। সবচেয়ে আশ্চর্য তার ডানহাতের আঙ্গুলভর্তি আংটি— তিনটি আংটি তার তিন আঙ্গুলে শক্তভাবে এঁটে আছে, মাংস ফুলে এতোই স্ফীত হয়েছে যে আংটির পেঁচানো ধার দেখা যায় না। সবচাইতে বীভৎস ও ভয়ংকর দৃশ্য যা দেখে কুটিমিয়ার গা কাঁটা দিয়ে উঠেছিল তা হলো, পাগলের বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ায় মাংস ছিদ্র করে একটি বড় সাদা আংটি গেঁথে রাখা হয়েছে। পাগল হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলে, আংটিটা সেই সঙ্গে ঝুলতে থাকে। কী অদ্ভুত হাস্যলীলায় সেই পাগল সবাইকে মাতিয়ে তুলেছে।
এ কোন্ পাগল? কুটিমিয়ার মনে প্রশ্ন জেগেছিল— নতুন বেশে সেই পাগল নয় তো যে একদিন তার কাছে একটা টাকা ভিক্ষা চেয়েছিল, যার অভিশাপে তার ছোটো বোন নুতু মারা গিয়েছিল, গোয়ালের সবচাইতে বড় বলদটা মরে গিয়েছিল, তার মা ও বাবা গুঁটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন? কিন্তু এই পাগল কোনো টাকা ভিক্ষা চাইছে না। এর কি টাকার দরকার নেই? পেটের খিদে নেই? সে অনর্গল অট্টহাসি হাসছে, গলা ছেড়ে ধুয়া তুলছে—‘এই দুনিয়া ফানা হবে—’, আরো কত মজার মজার কথা বলছে, মানুষ প্রাণভরে তা উপভোগ করছে।
কুটিমিয়ার বুক আনচান করতে লাগলো। তার বুকপকেটে দুটি টাকা আছে, চুল কাটানোর টাকা। আজ যদি এই পাগল টাকা চায় সবার আগে সে-ই তার হাতে টাকা দুটি তুলে দিবে।
বেলা পড়ে যায়, আশ্চর্য পাগলের মেলা তবু ভাঙ্গে না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কুটিমিয়া সেই তখন থেকেই অনড় দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে একবার একটু ইচ্ছেও জাগলো— পাগল যখন আসর ছেড়ে বের হয়ে যাবে, সে তার কাছে গিয়ে বলবে, সে যেন তার সাথে তাদের বাড়িতে যায়, তার মা-বাবা এমন একজন পাগলের জন্য অস্থির হয়ে আছেন।
অনেক পরে জটলা ভেদ করে পাগল বের হয়ে গেলো, তার পিছে পিছে ছুটলো কিশোরের দল, অনেক যুবক, এমনকি বয়স্করাও। কুটিমিয়াও পিছু নিল। সে ভাবে, পাগলের একদম কাছাকাছি হবে সে, তার হাত ধরে গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে সে পাগলকে অনুনয় করে বলবে, তাদের বাড়িতে তাকে যেতেই হবে, যেতেই হবে— তার মা-বাবা একজন পাগল খুঁজছেন।
বাজারের ভিতরের গলি দিয়ে পাগল তার ধুয়া তুলতে তুলতে পশ্চিম দিকে ছুটছে। দেখতে দেখতে তার পেছনে প্রচুর মানুষ জড়ো হলো, কেউ জানে না তারা কেন কী উদ্দেশ্যে এই পাগলের পিছে ছুটে চলেছে। মানুষ ছুটছে তো ছুটছেই। যেন এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, সব মানুষ এক বংশীবাদকের পিছে ছুটে চলেছে। এখন মানুষের মুখেও সেই ধুয়া। পাগল সুর তুলে গেয়ে ওঠে—এই দুনিয়া ফানা হবে কিছুই রবে না, সঙ্গে সঙ্গে ছুটন্ত মানুষের মুখেও প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো— এই দুনিয়া ফানা হবে কিছুই রবে না।
কিশোর কুটিমিয়া জানে না এই ধুয়ার অর্থ কী। সবে সে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, এই আধ্যাত্মিক ধুয়ার গূঢ়ার্থ তার বোধগম্য নয়, তবু সে সবার সাথে সুর তুললো— এই দুনিয়া ফানা হবে কিছুই রবে না রে, কিছুই রবে না। যেন এক স্বপ্নাতুর ঘুমের ঘোরে আছে সে, সবাই যেদিকে ছুটছে সে-ও সেদিকে ছুটে চলেছে পাগলের পিছে পিছে। সে দৌড়ে পাগলের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করে, কিছুদূর অগ্রসর হয়, আবার মানুষের চাপাচাপিতে পেছনে পড়ে যায়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুটিমিয়া পাগলের নাগালে চলে এলো। তার বামপাশ ঘেঁষে সে হাঁটতে লাগলো। সুর করে সমবেত ধুয়া তুলতে লাগলো। সে বেমালুম ভুলে গেলো তার মনের সেই কথাটি, যে কথা বলার জন্য সে কত উদ্গ্রীব ছিল— পাগলকে তাদের বাড়িতে যেতে বলবে।
মেঘুলা বাজার পার হয়ে খালপাড়ের সরু রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে পদ্মা নদীর পানে ছুটে চললো পাগল ও তার অনুসারীদের দল। কেউ জানে না কোথায় গিয়ে এই যাত্রা শেষ হবে।
ছুটতে ছুটতে তারা নদীর তীরে চলে এলো। পাগলের দু পাশে জড়ো হয়ে দাঁড়ালো সবাই। প্রমত্ত পদ্মার উত্তাল ঢেউ পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে, দড়াম দড়াম শব্দে ঝপাঝপ তীর ভেঙ্গে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। নদীর ওপাড় যায় না দেখা, মাঝখানে শুধু ঢেউ আর ঢেউ। কুটিমিয়া ভাবে, পাগলের মনে কতই না বিচিত্র শখ জেগেছে, তাই এই সর্বগ্রাসী পদ্মাকে দেখার জন্য এতোদূর ছুটে এসেছে।
সময় চলে যায়, পাগল একটানা তার ধুয়া গেয়ে যাচ্ছে, ফিরে যাবার কোনো মতিগতি নেই। কুটিমিয়া একবার ভাবে, তার হাত ধরে তাকে টান দিয়ে বলবে, চলো, তাড়াতাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু তার সাহসে কুলায় না।
হঠাৎ পাগলের ধুয়া বন্ধ হয়ে যায়। সে স্থির হয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়— চোখ জোড়া ঈষৎ মুদিত করে। বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে, তারপর অকস্মাৎ ‘আল্লাহু আকবর’ বলে বিকট চিৎকারে চারদিক প্রকম্পিত করে এক লম্ফে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আশ্চর্য পাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তকালের জন্য সবাই স্তম্ভিত হয়ে পড়ে, পরক্ষণেই ‘হায় হায়’ ধ্বনি ওঠে মানুষের, পাগলের মৃত্যু-আশংকায় সবার মুখ শুকিয়ে যায়— প্রবল ঘুর্ণিস্রোত আর ঢেউয়ের তোড়ে নিমিষেই পানির নীচে তলিয়ে যায় পাগল।
পানির নীচে তলিয়ে গেছে পাগল— হতবাক মানুষের উদ্বিগ্ন চোখ ঢেউয়ের ভাঁজ ভেঙ্গে কাছ থেকে বহুদূর চলে যায়— যদিই বা পানির ভিতর থেকে ‘ভুউশ’ করে মাথা তুলে ভেসে ওঠে আশ্চর্য পাগলটি।
সময় পেরিয়ে যায়, সূর্য নামতে থাকে নীচে— একদল মানুষ গভীর উৎকণ্ঠায় অপলক তাকিয়ে থাকে, পাগলের ভাসমান মৃতদেহটি যদি ভেসে ওঠে— যদিই বা ভেসে ওঠে।
পাগলের ভাসমান মৃতদেহটি ভেসে ওঠে না। ধীরে ধীরে মানুষ স্থান ছাড়তে শুরু করে— যেতে যেতে আফসোসে ফেটে পড়ে— হায়, আলাভোলা পাগলটা চোখের সামনে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারা গেলো!
হঠাৎ কে একজন চিৎকার করে ওঠে, ‘ঐ যে, ঐ যে দেখা যায়...’
চকিতে সবাই ফিরে তাকায়। অবাক হয়ে দেখে— দূরে— বহুদূরে— পানির ওপর সটান চিৎ হয়ে ভেসে ঢেউয়ের সাথে দোল খাচ্ছে আশ্চর্য পাগল— তার সম্পূর্ণ শরীরখানি পানির ওপরে ভাসমান, পা আর হাতগুলো এলোমেলো ছড়ানো— মাঝে মাঝেই ডান হাতের লাঠিটি উঁচিয়ে আকাশের দিকে তুলে ধরে। তীরের মানুষ আশ্চর্য হয়ে ভাসমান পাগলের আজব কীর্তি দেখে। ভাসতে ভাসতে পাগলের দেহখানি আরো দূরে চলে যায়। যতোক্ষণ দেখা গেলো তীরের মানুষ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। দূরে যেতে যেতে এক সময় অন্ধকারের ছাযায় সে অদৃশ্য হয়ে গেলো— তখন পশ্চিমাকাশে লাল সূর্য পাটে বসেছে।
বাড়ি ফিরে সে রাতে কুটিমিয়ার বহু রাত অব্দি ঘুম হলো না। সে কেবলই ভাবতে লাগলো, এ কি পাগল, নাকি অন্য কিছু? সে এরূপ আরেক পাগলের কথা শুনেছে, সেই পাগলের দেশ বহুদূরে নয়, তার দাদির বাপের গাঁয়ে সেই পাগলের বাড়ি ছিল, তাদের গ্রাম থেকে মাত্র সাতটি গ্রাম উত্তরে। ছোটোবেলায় তার দাদি তাকে সেই পাগলের কথা বলতেন। সে আসলে পাগল ছিল না, ছিল ফকির। লোকে বলতো পাষাণ ফকির। এক রাতে পাষাণ ফকির ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। তার স্ত্রী কাঁদলো, মা কাঁদলো, কিন্তু তাকে ফেরানো গেলো না। সে গৃহত্যাগী হয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াবে পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভের জন্য। পাষাণ ফকির সবাইকে উপেক্ষা করে ছুটে চললো, পিছে পিছে ছুটছে তার ক্রন্দনরতা স্ত্রী ও জননী।
পদ্মার পাড়ে এসে সে পানির ওপর কদম ফেললো। তার মা ও স্ত্রী অবাক হয়ে লক্ষ করলো, ডাঙ্গায় হেঁটে চলার মতো পাষাণ ফকির পানির ওপর দিয়ে অতি স্বাভাবিক পদক্ষেপে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। বধূ ও জননী করুণ কান্নায় বুক ভাসালো, কিন্তু পাষাণ ফকির পিছুটানের কোনো ভ্রূক্ষেপই করলো না। সেই যে সে ঘর ছাড়লো, ইহজনমে আর ফিরলো না। তারপর কেউ তার আর কোনো খবর জানতে পারে নি।
২
কার্তিকপুর-নুরুল্লাপুর গ্রামগুলো পীরফকিরদের আখড়া। নুরুল্লাপুরের শানাল ফকির, কার্তিকপুরের মাদাইর ফকির, শ্যামফকির এবং শারফিন ফকিরের ভক্তদের সংখ্যা গুনে শেষ করা যায় না। এঁরা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে বংশ-পরম্পরায় ফকিরি লাভ করেছেন। ফকিরি প্রাপ্তি অসামান্য সাধনার ব্যাপার। মুরিদ রূপে বছরের পর বছর বাবা-ফকিরের পদসেবা করতে হয়। মৃত্যুর সময় বাবা যাঁকে ফকিরি দান করে যান তিনিই পরলোকগত ফকিরের স্বত্বপ্রাপ্ত উত্তরসূরি। অনেক সময় অনেক মুরিদ ভাগ্যদোষে ফকিরি প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। জনশ্রুতি আছে, ডাইয়ারকুম গ্রামের জাবেদ হাওলাদার জনৈক করিম শাহ্ ফকিরের মুরিদ হয়েছিলেন। কৈশোর-শৈশব থেকেই তিনি ফকিরি প্রাপ্তির বাসনায় বাবা করিম শাহ্’র চরণতলে ভক্তিরত ছিলেন। বাবার শুভ দৃষ্টিও তাঁর ওপরই ছিল এবং মানুষের ধারণা অমূলক ছিল না যে জাবেদ হাওলাদারই বাবার ফকিরি লাভে ধন্য হবেন। বাবা করিম শাহ্ যেদিন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবেন, জান কবজ হবার আগের মুহূর্তে তিনি আঁখি মুদিত করে জড়ানো স্বরে টেনে টেনে ডাকলেন, ‘জাবেদ কইরে?’ জাবেদ হাওলাদার তখন বাবার পথ্য তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। পাশে বসে পাখায় বাতাস করছিলেন জাবেদ হাওলাদারের জ্যেষ্ঠ সহোদর আবেদ হাওলাদার। ফকিরি তাঁরও আরাধ্য ছিল আকৈশোর, কিন্তু তিনি কখনো উপযুক্ত রূপে বাবার সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারেন নি, অধৈর্য হয়ে পড়তেন। আবেদ হাওলাদারের মাথায় কূটবুদ্ধি খেলে যায়; তিনি মাথা নীচু করে বাবার কাছে এগিয়ে এসে অস্থির কণ্ঠে বলেন, ‘বাবা, আমি তো আপনার পায়ের তলায়ই আছি।’ বাবা শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে ডান হাত উঁচিয়ে আবেদ হাওলাদারকে স্পর্শ করেন, তারপর ঈষৎ কাত হয়ে তাঁকে লক্ষ করে মৃদু ফুঁ ছুঁড়ে দিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
এরপর আবেদ হাওলাদার ফকির হলেন বটে কিন্তু তাঁর কনিষ্ঠ জাবেদ হাওলাদার জ্ঞানহারা পাগল হয়ে গেলেন। তিনি দু হাতে বুক চাপড়ান আর চিৎকার করে করিম শাহকে অশ্লীল ভাষায় গালি ঝাড়তে থাকেন। বাবা করিম শাহ্ তাঁর সাথে বেইমানি করেছেন, তাঁকে ঠকিয়ে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে ফকিরি দান করে গেছেন।
কত দূর-দূরান্ত থেকে যে ভক্তরা ছুটে আসেন তার ইয়ত্তা নেই। কোনো কোনো ফকিরের বিশেষ শ্রেণীর ভক্ত রয়েছে, যেমন রয়েছে মাদাইর ফকিরেরও। এদের মুরিদ হওয়ারও একটা আশ্চর্য জনশ্রুতি আছে। মাদাইর ফকির একবার তাঁর এক শিষ্যের নিমন্ত্রণে ঢাকা গিয়েছিলেন। লঞ্চ থেকে সদরঘাটে নেমে চিকন অলিগলি খুঁজে তিনি শিষ্যের বাড়ি যাচ্ছিলেন; হঠাৎ একদল মেয়ের কলকল হাসিতে ফিরে তাকান, তখনো তিনি বুঝতে পারেন নি এই ললনারা তাঁকেই উদ্দেশ্য করে রঙ্গহাস্যে গলে পড়ছিল। তাদের বিশ্রী আর অশালীন দেহভঙ্গি উপেক্ষা করে তিনি আপন মনে সামনে এগোতে থাকেন— অমন সময় এক মেয়ে দৌড়ে এসে তাঁর হাত টেনে ধরে। বলে, ‘আমার ঘরে আসো গো নাগর।’ হাত ছুটিয়ে নেবার আগেই লক্ষ করে দেখেন আরো অসংখ্য মেয়ে তাঁকে ঘিরে ফেলেছে, তাদের ইঙ্গিতপূর্ণ কুৎসিত হাসিতে মুখরিত চারদিক। তাঁর বুঝতে আর বিলম্ব হয় না যে তিনি বেজায় ভুল জায়গায় চলে এসেছেন।
‘তোরা কী চাস?’ মাদাইর ফকির এ কথা জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গে বেশ্যাগণ আবারো কলকল হাসিতে ফেটে পড়ে। অশ্লীল ইঙ্গিতে বলে, ‘তোমারে চাইগো...ঘরে চলো, ঘরে চলো...।’
অতঃপর কেউ তাঁর হাত ধরে টানে, কেউ টানে ধূতি, কেউ তাঁর চুলের বেণি ধরে টানে, কেউবা টানে শ্মশ্রূ। মাদাইর ফকির অস্থির হয়ে বলেন, ‘আমারে ছাইড়া দে তোরা, জ্বালাইস না, ছাইড়া দে।’
বেশ্যাদের কেউ বলে, ‘আসো না নাগর, রস খাইয়া যাও।’
ফকির বলেন, ‘তোরা কি চিনলি না আমারে? আমি তো তোদেরই জাত।’
‘আমাদের জাত?’ ওরা খিলখিল করে হেসে ওঠে, ‘আমাদের জাত হইলে তোমার দাঁড়িগোঁফ গজাইলো ক্যান গো রসের নাগর?’
এমন সময় একজন সামনে এসে হঠাৎ ধূতির কোনা ধরে এক টানে তাঁকে উলঙ্গ করে ফেলে, তখনই সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। মাদাইর ফকিরের নিম্নদেশে কোনো পুরুষাঙ্গ নেই, সেখানে একটা পুষ্পের মতো ফুটে আছে শাশ্বত নারীর একখানি যোনি।
‘বাবা’ বলে বেশ্যারা তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে। বাবা তাদেরকে ক্ষমা করেন।
পৌষ মাসে যে চাঁদ ওঠে, সেই চাঁদের পূর্ণিমারাতে ফকির বাড়িতে ধামাইল বসে। দূর-দূরান্তের ভক্তরা পায়ে হেঁটে ধামাইলে এসে শরিক হয়।
মাদাইর ফকিরের বাড়িতে যতো ভক্ত আসে, তাদের এক চতুর্থাংশ হলো দেহপসারিণী। কীভাবে মাদাইর ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতার কথা সারাদেশে এ নিষিদ্ধ নারীদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল তা এক বিস্ময় বটে।
৩
পৌষ-চাঁদের ধামাইল একটা দারুণ বিস্ময়। ফকির-বাবাদের অলৌকিক শক্তি-গুরু— অদৃশ্যে থেকে যিনি তাঁদের যাবতীয় ফকিরি সঞ্চালিত করেন, ভরা পূর্ণিমার টলমল লগ্নে তিনি বাবার সামনে আবির্ভূত হোন, সেটাই ধামাইলের লগ্ন। সন্ধ্যায় তেঁতুল গাছের কাঁচা ডাল ভেঙ্গে লাকড়ি করা হয়। বা’র-বাড়ির প্রশস্ত উঠোনের মাঝখানে সেই লাকড়ি সাজানো হয়, তারপর পূর্ণিমা-লগ্নের জন্য অপেক্ষা। ফকির বাবা তাঁর বাবার মাজারের একধারে দরগা করেন; ভক্ত-মুরিদ পরিবেষ্টিত হয়ে আসনে জোড়াসিন দিয়ে বসেন, মাজারের চারপাশ জুড়ে ধূপদানি ও মোমবাতি জ্বলে, কুণ্ডলী পাকানো ধূপের ধোঁয়া ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে, গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে বাবার আসন এবং সারা ঘর। বাবার সামনে পায়ের কাছে বড় কাষার থালায় সোনারুপার মোহর-অলঙ্কার, টাকাপয়সা; একটু দূরে চালডাল ভর্তি বৃহৎ কয়েকটা ঝাঁকা; দূরাগত ভক্তবৃন্দ সাধ্যমতো থালায় টাকাপয়সা বা গয়নাগাটি ফেলছে, গামছায় বাঁধা চালডাল ফেলছে ঝাঁকার ভিতর। দরগার বাইরে ভক্তদের মানত করা হাঁস-মুরগিতে বোঝাই কয়েকটা খুপরি, বাইরে খুঁটিতে বাঁধা ছাগল-ভেড়া, বা ষাঁড়। ভক্তগণ এসে সর্বাগ্রে বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, তারপর মোলায়েমভাবে উপুড় হয়ে বাবার পায়ের কাছে মাথা রাখে, মাথা উঠিয়ে দু হাতে বাবার পদধূলি নিয়ে মুখমণ্ডলে মাখে। তুষ্টমুখ বাবার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
বাবার আসন ঘিরে চারপাশে ভক্তবৃন্দ সমবেত কণ্ঠে অনর্গল জিকির তুলতে থাকে। রাত্রি গভীর হয়, আর ধীরে ধীরে ধামাইলের লগ্ন ঘনিয়ে আসে, অর্ধ-নিমীলিত-আঁখি ফকির-বাবা উর্ধ্বপানে চেয়ে জোড়াসিনে স্থির ও গভীর ধ্যানে মগ্ন— জিকিরের তালে তালে ধূপগন্ধময় বাবার আসনটি যেন দুলতে থাকে।
ধামাইল উপলক্ষে সাতদিন আগে থেকে বাঁশ নাচানো শুরু হয়। বাঁশ নাচানোর জন্য একই মাপের সাতটি লম্বা বাঁশ লাগে। সাত বাঁশের মাথায় সাত রঙের পাটের জুটি বাঁধা হয়। তারপর বাঁশগুলোকে জুটির রঙের কাপড় দিয়ে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত মুড়িয়ে দেয়া হয়। যারা বাঁশ নাচায় তাদেরকে বলা হয় বাঁইশা। ফকির-বাবার জন্য নিবেদিত-প্রাণ না হলে কেউ বাঁইশা হতে পারে না।
সাতটি বাঁশের জন্য সাত জন বা তার বেশি সংখ্যক বাঁইশা লাগে। ক্লান্ত বাঁইশাকে বদল করার জন্য অতিরিক্ত বাঁইশার প্রয়োজন। বাঁইশাদলের সাথে থাকে একদল ঢোলক ও বাদক। বাদ্যের তালে তালে বাঁশ নাচানো হয়। বাঁশ নাচানোর সময় বাঁইশাগণ খাড়া করে বাঁশ ধরে বাদকদল সমেত উঠোনের একটা নির্দিষ্ট গোলাকার স্থানে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। প্রথমে দৌড়ে ঘুরতে শুরু করে, তারপর বাদ্যের তালে একসঙ্গে সবার পা থামে, এরপর ধীর তালে একবার ডান পা উঠিয়ে ভিতরের দিকে ফেলে, পরক্ষণেই উঠিয়ে বাইরে নেয়, আস্তে আস্তে সামনে এগোয়— ধীর তালে বাঁশ নাচানো শুরু করে বাঁইশাগণ ক্রমশ দ্রুত কদম ফেলতে শুরু করে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এভাবেই বাঁইশারা বাঁশ নাচায়। বাঁশ নাচানোর সময় প্রত্যেক বাঁইশা তাদের ঘুর্ণনের ক্রম বজায় রাখে, সেই ক্রমের ব্যত্যয় ঘটানো হয় না। একনাগাড়ে আট-দশ মিনিট পর্যন্ত বাঁশ নাচানো চলে। তারপর উঠোনের মাঝখানে একটা বেতের ঝাঁপি রেখে তার ভিতরে বাঁশের গোড়া ফেলে ঘরের চালের সাথে কাত করে বাঁশ নামিয়ে রাখা হয়। বাঁশ নামানো এবং উঠানোর সময় একই ক্রম বজায় রাখা হয়। সর্বাপেক্ষা গুণী ও একনিষ্ঠ বাঁইশাকে দেয়া হয় প্রথম বাঁশটি।
বেতের ঝাঁপিতে বাঁশ নামিয়ে রাখার পর জনৈক মুরিদ অন্দর বাড়ি থেকে সাজিভর্তি চালডাল এনে সেই ঝাঁপির ভিতরে ফেলে। ঝাঁপি টানার জন্যও একজন নিবেদিত ভক্ত থাকে।
ধামাইলের সাত দিন আগেই বাঁইশাগণ দূর-দূরান্তের মুরিদগণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বহু পথ পাড়ি দিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তারা বাঁশ নাচায়। বাঁশ নাচানো শেষে বেতের ঝাঁপিতে চালডাল সংগ্রহ করে। সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ চালডাল বহন করার জন্যও দলের সাথে সাগরেদ থাকে। বাঁশ নাচানো শেষে বাঁইশাগণ ক্লান্ত হয়ে পড়লে তারা কোনো এক সাগরেদের বাড়িতে রাত্রিযাপন করে—উঠোনে গোল সারিতে বসে কলাপাতায় পাতলা খিচুরি খায়, তারপর গভীর রাত পর্যন্ত মারফতি আর মুর্শিদি গান গায়। সকালে উঠে অন্য গাঁয়ের সাগরেদগণের উদ্দেশ্যে পুনরায় বেরিয়ে পড়ে। দূরের মুরিদগণের বাড়িতে বাঁশ নাচানো শেষ করে ধামাইলের দু একদিন আগে বাঁইশাগণ ফকির বাড়িতে ফিরে আসে। ধামাইলের দিন সকালে বাড়ি হতে বেরিয়ে কাছের গাঁয়ের ভক্তদের বাড়িতে বাঁশ নাচাতে যায়। ভক্তদের বাড়িতে বাঁশ নাচানো শেষে সৌজন্য স্বরূপ সতীর্থ ফকিরগণের বাড়িতেও বাঁশ নাচানো হয়।
এভাবে বাড়ি বাড়ি বাঁশ নাচানোর মধ্য দিয়ে ধামাইলের লগ্ন ঘনিয়ে আসতে থাকে। সেই সাথে বাবা-ফকিরের বাঁশের নাচ দেখার জন্য ভক্তগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। লগ্নের ঘণ্টা দুয়েক আগে ফকিরের বাঁশ নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। ততক্ষণে দরগায় বাবার আসন ঘিরে ভক্তগণের একটানা জিকিরে চারদিক আন্দোলিত হয়ে ওঠে।
বাঁশ নিজ বাড়িতে ফেরত আসার পর অন্য ফকিরের বাঁশ আসার নিয়ম নেই। অন্য ফকিরের বাঁশ খুব অল্প সময়ের জন্য নাচানো হয়। কিন্তু বাড়ির বাঁশ নাচানো হয় দীর্ঘ সময় ধরে— দুই ধাপে, ফেরত আসার পর থেকেই ভিতর বাড়ির উঠোনে প্রায় ঘণ্টাখানেক, মাঝখানে আধঘণ্টার মতো বিশ্রাম, তারপর বার বাড়ির উঠোনে তেঁতুল গাছের কাঁচা লাকড়ি দিয়ে সাজানো ধামাইল-স্থানের চারধারে বাঁশ নাচানো হয়, ধামাইল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকে।
বাঁশ বাড়িতে ফেরত আসার সঙ্গে সঙ্গে ভক্তদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তারা ছুটে এসে উঠোনের মাঝখানে ভিড় করে গোল হয়ে দাঁড়ায়। বাঁইশাদের হাতে বাঁশ নাচে, দরগার ভিতরে একটানা জিকির ধ্বনিত হয়, পুরো আকাশ বাতাস যেন সেই সময় টলমল করতে থাকে
পূর্ণিমালগ্ন রাত্রির শেষ প্রহরে সংঘটিত হলে ধামাইলপর্ব গভীরতর হয়। ক্লান্ত বাঁইশাগণ প্রথম পর্ব বাঁশ নাচানো শেষে বিশ্রামভোগ করতে থাকে, তখন একদিকে বা’র বাড়ির উঠোনে ধামাইলের জন্য তেঁতুল গাছের কাঁচা লাকড়ি সাজানো হতে থাকে, অন্যদিকে ভাবগম্ভীর ভক্তিগীতিতে দরগার ভিতরে সমগ্র পরিবেশ ভারী হয়ে উঠতে থাকে। ক্রমে বাবার শরীরে মৃদু কম্পন শুরু হয়, কিছুক্ষণ পরপর সেই শরীর আপনা থেকেই প্রবলভাবে ঝাঁকি দিয়ে ওঠে, ঝাঁকির সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় বাবা’ বলে বিকট শব্দে ফকির-বাবা চিৎকার দিয়ে ওঠেন, সেই চিৎকারের ধ্বনি সমবেত জিকিরের ধ্বনিকে ছাপিয়ে অনেক উচ্চে ওঠে চারপাশ কাঁপিয়ে তোলে। ফকির বাবা তখন আর তাঁর নিজের মধ্যে নেই, ততক্ষণে তাঁর অলৌকিক গুরু তাঁর ওপর এসে ভর করেছেন। সেই গুরু যতক্ষণ তাঁর ওপরে ভর করে থাকবেন ততক্ষণ কী কী তিনি বলবেন, বা কী কী ঘটতে থাকবে তার কিছুই ফকির-বাবার স্মরণে থাকবে না, কেবল ভক্তবৃন্দই সেগুলো মনে রাখবে ও মেনে চলবে।
ফকির-বাবার ওপরে গুরুর ভর করার অবস্থাটাকে ‘ভার’ বলা হয়। ভার অনেক কঠিন অবস্থা। ভারের চাপ সহ্য করতে অনেক শক্তি ও ধৈর্যের প্রয়োজন। ফকির বাবা ইচ্ছে করলে অন্য কোনো ভক্তের ওপর ভার চাপাতে পারেন; ছোটোখাটো ভারের আসরে মাঝে মাঝে এরূপ করা হলেও ধামাইলের লগ্নে কখনোই ভার ফেরানো হয় না, কারণ ধামাইলের ভারই হলো ফকির বাবার প্রকৃত পরীক্ষা।
ভারের সময় ফকির বাবা ভক্তদের সাথে সওয়াল-জবাব করেন। আসলে এই সওয়াল-জবাব ফকির বাবার মুখ দিয়ে বেরোলেও এগুলো কিন্তু তাঁর কথা নয়, তাঁর ভিতরস্থিত শক্তি-গুরুই তাঁর মাধ্যমে এসব করে থাকেন।
সওয়াল-জবাবের সময় ভক্তগণ গুরুর সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পায়। ভক্তরা বালামুসিবত হতে মুক্তি পাবার জন্য গুরুর কাছে পানা প্রার্থনা করে। গুরু তাদেরকে আশ্বস্ত করেন; অনেক সময় এর বিনিময়ে বড় একটা বর চেয়ে বসেন, অসমর্থ ও হতদরিদ্র ভক্তরা তখন বাবার পায়ের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে বাবার এহেন বড় দাবি থেকে মাফ পাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতে থাকে; যতক্ষণ না বাবা একটা ষাঁড়ের বদলে একটা মোরগ নিতে রাজি হন ততক্ষণ পর্যন্ত সেই ভক্ত বাবার পা জড়িয়ে পড়ে থাকে। তবে কোনো কোনো সময় বাবা তাঁর দাবিতে একেবারে অটল থাকেন; ভক্তের সম্ভাব্য বিপদটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, এ থেকেই তা আঁচ করা যায়। অনেক সময় বাবা কোনো কোনো ভক্তের ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে যান। বাবার সাথে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে দীর্ঘদিন ধামাইলে অনুপস্থিত থাকলে, কিংবা বর্তমান বাবার অগোচরে কেউ যদি অন্য বাবার শরণাপন্ন হয়, যা এ-বাবার ওপর অনাস্থার শামিল, পুনর্বার সামনে আবির্ভূত হওয়ামাত্র বাবা তাকে কঠিন অভিশাপ বর্ষণ করেন। সেই অভিসম্পাতে কেউ কেউ ধ্বংস হয়ে যায়, বাবা দয়া না করলে সেই ধাক্কা আর কেউ কাটিয়ে উঠতে পারে না।
পূর্ণিমার লগ্ন সমাসন্ন, বাবার ভার ও ভক্তদের সাথে সওয়াল-জবাব চলমান— জিকিরের ধ্বনি, বাদ্যের বাজনা ও বাঁশির সুরের ঐকতান মূর্ছনা— হঠাৎ একসময় জোড়াসিন ভেঙ্গে সচিৎকারে বাবা উঠে দাঁড়ান, তারপর ভক্তদেরকে ডিঙ্গিয়ে দ্রুত ছুটে চলেন বা’র বাড়ির উঠোনে ধামাইল-স্থানের দিকে— স্বল্প বিশ্রাম শেষে বাদকদল ও বাঁইশাগণ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল, বাবাকে ছুটতে দেখামাত্র তারা বাঁশ লয়ে বাবার পেছনে ধাবিত হয়ে ধামাইলের জন্য নির্ধারিত স্থানে গিয়ে হাজির হয়।
শিষ্যসাগরেদ সমভিব্যাহারে সাজানো তেঁতুল লাকড়ির চারপাশে বাবা হাঁটু গেড়ে বসেন। জোড়াবদ্ধ দুই হাত বার বার কপালে ঠেকান আর সমস্বরে ঘন ঘন গুরু-ধ্বনি করে ওঠেন। বাঁইশাগণ এখন নাচে না, বাঁশ হাতে দ্রুত ছুটে চলেছে তারা, যতো দ্রুত দৌড়ে চলা সম্ভব। ঢোল ও বাঁশির ঐকবাদনে পূর্ণিমার চাঁদ তখন আকাশে টলমল করে। এরই মাঝে সাগরেদগণ মোমের আগুনে কাঁচা লাকড়ি জ্বালিয়ে দেয়। লাকড়ির ধোঁয়ায় তাদের চোখ নাক মুখ গলে জল ঝরতে থাকে। তবু তারা থেমে থাকে না।
ঠিক লগ্নের সময়টাতে অকস্মাৎ লাকড়ির স্তূপে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে, সেই আগুনের শিখা মানুষের মাথা ছাড়িয়ে বাঁশের মাথায় জুটি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বাদ্যের তাল ও বাঁশির সুরও তখন দ্রুততর লয়ে বাজতে থাকে। বাঁইশাদের গতি তখন পৌঁছে যায় শীর্ষে। লাকড়ি জ্বলতে জ্বলতে আগুনের শিখা নীচে নেমে আসে, যখন একেবারে নিভে যায়, দু হাতে এক খাবলা জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে বাবা ছুটে যান কোনো এক পুকুরের পানে। এক ঝাঁপে পানিতে নেমে দীর্ঘ এক ডুব দেন, তারপর শূন্য হাতে উঠে এসে অন্দর বাড়িতে উধাও হয়ে যান। তাঁর সাথে তখন অন্য কারো সঙ্গী হবার নিয়ম নেই।
ভক্তরা ধামাইল শেষে পোড়া লাকড়ির কয়লা কিংবা ছাইয়ের জন্য এক কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। মুহূর্তে ধূলাবালি আর মাটিসুদ্ধ সেই কয়লা নিঃশেষ হয়ে যায়। এই কয়লার অনেক ফজিলত। যারা এই কয়লা লাভে ব্যর্থ হয় তাদের পরবর্তী ধামাইলের জন্য পুরো একটা বছর অপেক্ষা করতে হয়।
ধামাইললগ্ন পরবর্তী চাঞ্চল্যের মধ্যেই একসময় ভোর হয়, তারপরই মানুষজন উঠোনের একপাশে জড়ো করে রাখা কলাপাতার জন্য ছোটে, অল্পক্ষণের মধ্যেই সিন্নি পরিবেশিত হবে। এই সিন্নি কখনো চালডালের খিচুরি, কখনো বা ভাত ও পাতলা ডাল। পুরো রাতের ধকল শেষে সিন্নি খেয়ে ভক্তগণ ক্ষুধা নিবারণ করে।
এভাবে বাড়ি ফেরার সময় হয়ে যায়। ফকির বাবা অন্দর মহল থেকে ফিরে এসে ভক্তদেরকে বিদায় জানানোর জন্য আসন গ্রহণ করেন। তাঁর জোড়াসিন নেই, চেহারায় সৌম্যভাব, তবু ধামাইলের ধকলে বিধ্বস্ত মনে হয়। ভক্তরা একে একে সভক্তি বিদায় গ্রহণ করে, তিনি মৃদু হেসে নিরুত্তর বিদায় জানান।
৪
সারা বছরে ধামাইল ছিল কুটিমিয়ার জন্য সবচাইতে বড় ও উপভোগ্য উৎসব। ছোটোবেলায় মা-বাবা, চাচা-চাচিদের সঙ্গে সে ধামাইলে যেতো। তাঁরা যে-ফকিরের মুরিদ ছিলেন তাঁর নাম শারফিন ফকির। শারফিন ফকির কার্তিকপুরের সবচাইতে বড় ফকির। তাঁর বাড়িতে বিশাল কয়েকটা টিনের ঘর ছিল, তাঁদের উঠোন দুটির মতো এতো বড় উঠোন অন্য কোনো ফকিরের ছিল না। শারফিন ফকিরের ভারের আসনটা দরগার ঘরে না হয়ে অন্য আরেকটা ঘরে ছিল, যে-ঘরে কোনো বেড়া ছিল না, মাঝখানে ছিল ফকির বাবার আসনখানি, তার ওপরে মখমল কাপড়ের ঝলমলে চাদোয়া, চাদোয়ার ঘেরে অতি চমৎকার করে লেখা ছিল— ‘ভক্তি বিনে মুক্তি নাই।’ শারফিন ফকিরের দরগাটাও ছিল অতি মনোরম ও সুদৃশ্য। এটি একটি চৌচালা টিনের ঘর ছিল, সামনে একটি বড় বারান্দা; ঘরের চাল ও বেড়ার নতুন টিনগুলোই সবচাইতে চমৎকার। দরগার ভিতরে দুটি মাজার ছিল, একটি শারফিন ফকিরের বাবার, আরেকটি তাঁর দাদার। বাবার পাশে আরেকটা স্থান নির্দিষ্ট ছিল, সেটা শারফিন ফকিরের।
এই ঘরটির অবস্থা আগে খুব জীর্ণ ছিল, কোনো এক মুরিদ সবকিছু পালটে নতুন করে গড়ে দিয়েছেন। সেই মুরিদ বড় কয়েকটা কার্গো লঞ্চের মালিক ছিলেন। একবার তিনি পদ্মা নদীর মাঝখানে বোঝাই কার্গো সমেত প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়লেন। পাহাড় সমান ঢেউয়ের ওপর তাঁর কার্গো লঞ্চটি খড়ের মতো দলে-মুচড়ে দুলতে লাগলো— বাঁচবার আর কোনো ভরসা নেই। সেই মুহূর্তে মুরিদ চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, ‘দোহাই আলাহ্ রাসূলের, দোহাই বাবা শারফিন ফকিরের।’ মুহূর্তে ঝড় থেমে গিয়ে পুরো আকাশ ঝরঝরে ফরসা হয়ে যায়, যেন এতোক্ষণ কিছুই হয় নি।
শারফিন ফকিরের নামের ওপর এই আশ্চর্য ফজিলত দেখতে পেয়ে তিনি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বাড়ি ফিরে সপরিবারে বাবার দরবারে হাজির হয়ে বাবাকে সহস্র বার ভক্তি করেন এবং তাঁর সামান্য অর্থ দ্বারা বাবার পুরো দরগা ঘরটার সংস্কার করার অনুমতি গ্রহণ করেন। দরগা ঘরের সামনে বারান্দার বাইরে একটা দেয়ালঘড়ি ঝোলানো আছে, সেই মুরিদের দেয়া। এক ঘণ্টা পরপর সেটা ‘ঢং...’ করে বেজে উঠতো। এ শব্দটা কুটিমিয়ার কাছে দারুণ লাগতো। প্রথমবার যখন কুটিমিয়া এটা দেখেছিল তখন সে জানতো না এটা কী জিনিস। জীবনে এমন আশ্চর্য জিনিস দেখতে পেয়ে তার গর্বের অন্ত ছিল না। সঙ্গীদের সে এর কথা বলেছিল, তখন তারা ওর প্রতি খুব শ্রদ্ধাবনত হয়েছিল।
ধামাইলে আসার খুব ছোটোবেলার দিনগুলোর কথা কুটিমিয়ার মনে নেই। যে-দিনটার কথা তার স্পষ্ট মনে পড়ে সে-সময় কুটিমিয়ার বয়স বড় জোর পাঁচ বছর ছিল। সূর্য মাথার ওপর থেকে সামান্য পশ্চিমে হেলে পড়লে তারা বাড়ি থেকে রওনা করে। তার মায়ের কোলে দেড় বছরের বোন করিমন, কুটিমিয়া তার বাবার কাঁধে, কখনোবা কোলে। কিছুক্ষণ পরপরই বাবা তাকে নামিয়ে দিয়ে হাত ধরে হাঁটেন, তার আগের বছরও সে পুরোটাই বাবার কাঁধে ও কোলে চড়ে গিয়েছিল, সেবার হাঁটতে গিয়ে তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল।
ফকির বাড়িতে পৌঁছতে ভরসন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। পথে তার প্রচুর খিদেও পেয়েছিল। বাবার হাতে গামছায় বাঁধা ভাতের থালা ছিল, সে খেতে চেয়েছিল। কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে তাকে পথে খেতে দেয়া হয় নি। রাস্তার পাশে দোকান দেখে সে নেবুনচুষ খেতে চেয়েছিল, বাবা একটা লম্বা কাঠিওয়ালা নেবুনচুষ কিনে দিয়েছিলেন। তা দেখে করিমনও খেতে চেয়েছিল, মা জোর করে তার নেবুনচুষের এক কোনা ভেঙ্গে করিমনকে খেতে দিয়েছিল। করিমন খুব খুশি হয়েছিল, কিন্তু কুটিমিয়া সারাপথ গুনগুন করে কেঁদেছিল।
ফকির বাড়িতে পৌঁছে বাবা তাকে নিয়ে ফকিরের সামনে গেলেন। বাবা অনেকক্ষণ উপুড় হয়ে থেকে ভক্তি করলেন, মাথা উঠিয়ে দু হাতে ফকিরের পদস্পর্শ করলেন, সেই পদধূলি নিজ বক্ষ ও মুখমণ্ডলে মাখলেন, ডান হাত বাড়িয়ে কুটিমিয়ার সমস্ত শরীরে বুলিয়ে দিলেন। বাবা বলেছিলেন, ‘বাজান, বক্তি করো।’ কুটিমিয়ার চোখে খুব লজ্জা। মাটিতে হাঁটু গেড়ে উপুড় হয়ে বাবার মতো ভক্তি করতে তার ভীষণ লজ্জাবোধ হচ্ছিল। বাবা আবার বলেন, ‘বাজান, বক্তি করো তো দেহি। বক্তি না করলে গুইন্যা অইবো। জলদি করো।’
কুটিমিয়া গুনাহ্র ভয় কিংবা ভক্তির মাহাত্ম্য জানতো না, শুধু ভক্তির লজ্জাটুকুই তার সমস্ত চোখ জুড়ে ছিল।
সেদিন কুটিমিয়াকে কোনোভাবেই ভক্তি করানো যায় নি, সে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেকে ভক্তি করাতে না পেরে কুটিমিয়ার বাবা ফকিরের সামনে খুব লজ্জিত হয়েছিলেন।
এরপর যতোবার সে ধামাইলে গেছে, বাবার সাথে একবারও ফকিরের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয় নি— উপুড় হয়ে ফকিরের পায়ে ভক্তি করতে হয়, এই ভয়ে। ভক্তি করতে কুটিমিয়ার লজ্জার অন্ত ছিল না। কখনো কখনো তার মা তাকে হাত ধরে টেনে ফকিরের সামনে নিতে চেষ্ট করতো, কিন্তু সে ছুটে পালাতো, অথবা শক্ত হয়ে পেছনে ঝুলে পড়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, যেতো না। অথচ দূরে দাঁড়িয়ে সে দেখতো তার মা ও বাবা অতিশয় শ্রদ্ধাবিগলিত হয়ে ফকির-বাবার পায়ের উপর দীর্ঘক্ষণ উপুড় হয়ে পড়ে থেকে ভক্তি প্রদান করছেন। ভক্তি শেষে ফিরে এলে কুটিমিয়া একা একা ফকিরের খুব কাছাকাছি গিয়ে মানুষের ভিড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো, দেখতো কত মানুষ তার মা-বাবার মতো দীর্ঘ সময় ধরে ভক্তি করে ফকির বাবার পদধূলি গ্রহণ করছে।
ধামাইল শেষে পরদিন নুরুল্লাপুরের মেলায় যেতো তারা। নুরুল্লাপুরের শানাল ফকিরের বাড়িতে বিরাট মেলা বসে। ধামাইলের দু দিন আগে মেলা শুরু হয়, ধামাইলের পর আরো সাত দিন পর্যন্ত সেই মেলা থাকে। অত্র অঞ্চলে শানাল ফকির হলেন সবচাইতে বড় ফকির। সারা দেশ জুড়ে তাঁর লাখো লাখো মুরিদ। শানাল ফকির এখন আর জীবিত নেই, কিন্তু তাঁর ছেলেরা আছেন, প্রত্যেক ছেলেই উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার কাছ থেকে ফকিরি প্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁরা আলাদা আলাদা ধামাইল করেন, সারা দেশের মুরিদগণ নিজেদের পছন্দমতো যে কোনো পুত্রের কাছে ভক্তি প্রদান করে। ছেলেরা আলাদা ধামাইল করলেও মেলার আয়োজন হয়ে থাকে যৌথভাবে। সারা দেশে এরূপ বৃহৎ মেলা অন্য কোথাও দেখা যায় না। পুরো গ্রামের বিশাল এক চক জুড়ে মেলার স্থান নির্ধারণ করা হয়, গাঁয়ের মানুষ নিজ উদ্যোগে মেলার যাবতীয় নিরাপত্তা, দোকানঘরের জন্য স্থান বণ্টন ও অন্যান্য বিষয়াদির দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
সার্কাস আর যাত্রাপালা হলো মেলার সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয়। যেনতেন সার্কাস আর যাত্রাপালাকে এখানে আসার অনুমতি দেয়া হয় না। দেশের সর্ববৃহৎ ও শ্রেষ্ঠ সার্কাস দল— বর্ধ্বনপাড়ার ‘অপেরা সার্কাস’ই প্রায় প্রতি বছর নিমন্ত্রণ ও অনুমতি পেয়ে থাকে। এর বাইরে অনেকগুলো পুতুল নাচ ও চড়ক গাছ থাকে। মেলার পুরো জায়গাটাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগে শুধু মিষ্টির দোকান—রসগোল্লা, আমৃতি, চমচম, খেজুর, জিলাপি, সন্দেশ—দোকানের পর দোকান থরে থরে পাত্র ভর্তি সাজানো থাকে। অন্যদিকে ভাজাপুরি, যেমন, চানাচুর, মুরলি, নিমকি, পাপরভাজা, গজা; একদিকে খেলনা—হরেকরকম বাঁশি, রং-বেরঙের বেলুন, মাটির তৈরি পুতুল, হাতি, ঘোড়া, গরু, লঞ্চ, স্টিমার, ঠাকুর-দেব-দেবী; একদিকে মেয়েলি কসমেটিকস, চুড়ির বাহার হলো তাতে সবচাইতে বেশি, তাছাড়া আলতা, স্নো, পাউডার, খোঁপার বেণি; একদিকে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রও থাকে, যেমন বলন, ডাল ঘুটনি, তাওয়া, কড়াই, হাঁড়িপাতিল। মেলার একধারে খাবারের হোটেল, পাশেই মাছতরকারির দোকানপাট। থৈথৈ করে মানুষ, এতো ভিড় এবং হট্টগোল— বহুদূর থেকে তার শোরগোল শোনা যায়।
৫
সিন্নি খাওয়ার পরপরই কুটিমিয়া নুরুল্লাপুরের মেলায় যাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে দিত। কিন্তু একটু বেলা না হলে এবং ফকির বাবার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে বাড়ি ত্যাগ করা যায় না, তাই দেরি হতে থাকতো। এই দেরি হওয়া কুটিমিয়ার একদম সহ্য হতো না।
শারফিন ফকিরের বাড়ি থেকে বেরোনোর পথে হাওয়ার বেগে উড়ে নুরুল্লাপুরে গিয়ে পৌঁছতে ইচ্ছে হতো। যখন সে কাঁধে চড়ে যেতো, বাবার ঘাড়ে ঝাঁকি দিয়ে এবং মাথায় চুল শক্ত করে ধরে সামনে ঝুঁকে কুটিমিয়া বলতো, ‘তারতারি কইরা আডো বাজান, তারতারি...।’ যখন তার হেঁটে চলার বয়স হলো, সে দৌড়ে বাবার আগে আগে ছুটতো। শানাল ফকিরের মেলা অনেক দূর। ছোটো পায়ে কুটিমিয়া কেবলই দৌড়ে ছুটতো। পথ চলতে চলতে সে দেখতো, মেলা থেকে কিশোর-কিশোরীদের হাতে লাল নীল বাঁশি, বাঁশির মাথায় রঙিন বেলুন, ফুঁ দিয়ে বেলুন ফোলায়, ফুঁ ছেড়ে দেয়, বেলুনের বাতাস বাঁশির মুখ দিয়ে বের হয় আর সুরেলা সুরে বাঁশি বেজে ওঠে। হরেকরকম বাঁশি, দোতারা, ডুগডুগি, পুতুল। যার হাতেই সুন্দর একটা খেলনা সে দেখতো, সাথে সাথে ওটা দেখিয়ে বলতো, ‘বাজান, আমারে এই বাশিডার মতন একটা সুন্দর বাশি কিইন্যা দিবা—দিবা কিন্তু...।’ মেলার আরো কাছাকাছি হতেই দূর থেকে অসংখ্য চড়ক গাছের ক্যা-ক্-কুক আওয়াজ, বাঁশি আর ডুগডুগির বাজনা, মানুষের চিৎকার আর হৈ-হল্লা কানে এসে লাগতো—তা শুনে কিশোর কুটিমিয়ার মনে ঝিলিক দিয়ে আনন্দ জেগে উঠতো। লম্বা এক দৌড়ে চোখের পলকে মেলায় পৌঁছে যেতে ইচ্ছে হতো তার।
মেলায় এসে সর্বাগ্রে তার বাঁশি কেনা চাই—বাঁশির প্যাঁ-পু শব্দ তার মধ্যে একটা উন্মাদনার সৃষ্টি করতো। আরেকটা জিনিসের প্রতি তার দারুণ ঝোঁক ছিল—তা হলো কাগজের বেজি। বেজির মাথায় বাঁধা সুতা ধরে টান দিয়ে সুতাটি ছেড়ে দিলে কড়্ড়ৎ করে ওটা দৌড় মারে। বাঁশি আর বেজি কেনার পর কুটিমিয়া শান্ত হতো। কিন্তু যখনই নতুন কোনো একটা খেলনার প্রতি তার চোখ পড়তো, সঙ্গে সঙ্গে সে বাবার হাত টেনে ধরে বলতো, ‘বাজান, এইডা কিন্যা দিবা?’ বাবা বলতেন, ‘দূর ব্যাডা, ঐড্যা কোনো খেলনা অইলো?’ তারপরও সে নাকি সুরে গুনগুন করে কাঁদতো, ঐ সময় তার মা তাকে একটা ঝাড়ি দিয়ে ভর্ৎসনা করতো। তাতে কুটিমিয়ার কান্না কিছুটা কমতো।
প্রতি বছরই যে নুরুল্লাপুরের মেলায় যাওয়া হতো তা কিন্তু নয়। যে বছর হাত টান থাকতো, সে বছর শারফিন ফকিরের বাড়ি থেকে সোজা বাড়ি ফিরে আসতো তারা। মেলায় না যাওয়ার দুঃখে সারা রাস্তা গুনগুন করে কাঁদতে থাকতো কুটিমিয়া। জয়পাড়া বাজারে এসে তাকে রসগোল্লা সাধা হতো, কিন্তু সে একটা ঝামটা দিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াতো।
কিশোর কুটিমিয়ার মনের ভিতরে এক আশ্চর্য শারফিন ফকির বসবাস করতেন। তার খুব ইচ্ছে হতো শারফিন ফকিরের মতো হতে।
ধামাইল শেষ হওয়ার পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত বাড়িতে কুটিমিয়া খুব আমোদে থাকতো। তাদের রসুই ঘরের পেছনে দক্ষিণ দিকে একটা পোড়ো ভিটা ছিল, সেখানে আগাছা ও ময়লা পরিষ্কার করে খেজুরের ডাওগা আর কলাপাতা দিয়ে একটা দরগা ঘর বানাতো সে। দরগা ঘরের মাঝখানটায় সে জোড়াসিন দিয়ে শারফিন ফকিরের মতো বসতো। তার ছোটো বোন, চাচাতো ভাইবোন, প্রতিবেশী ছেলেমেয়েরা ছিল তার মুরিদ। কিশোর কুটি ফকিরের মুরিদরা অনেক লম্বা সময় পর্যন্ত তার পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে ভক্তিরত থাকতো। মুরিদগণের অবশ্য ভক্তি ব্যতীত অন্য কোনো কর্ম ছিল না, তাই তারা একের পর এক কেবল ভক্তিই দিয়ে যেতো। সে সময় তার মুরিদরা কিন্তু তাকে কুটি ফকির ডাকতো না— কেউ ভুল করে ডেকে বসলে কুটিমিয়া বেজার-কুজার হয়ে বলতো, ‘আমারে কুডি কইবা না। আমার নাম কি কুডি ফকির? আমার নাম অইলো শারফেন ফকির।’
ধামাইলের দিন শারফিন ফকির গায়ে লাল গেরুয়া ও মাথায় লাল পাগড়ি পরতেন। কিশোর শারফিনের কোনো লাল পোশাক ছিল না, তবে লাল-নীল-সবুজে মেশানো বাবার যে গামছাটা সে পেতো, তা পরেই সে তার আসনে গিয়ে বসতো। সে ধামাইলও করতো। বাঁশের কঞ্চি, কিংবা পাটখড়ির মাথায় পাটের জটা, কিংবা পুরনো কাপড়ের টুকরো বেঁধে বাঁশ বানাতো। বাঁইশাদের সংখ্যা ছিল অনির্দিষ্ট, তিনজন উপস্থিত থাকলে তিন, দশজন হাজির থাকলে দশ; ছেলে আর মেয়েতে কোনো বাছবিচার নেই।কুটিমিয়া ফকির যদিও, কিন্তু সে নিজেও বাঁশ নাচাতো; বাঁশ নাচানো খেলতে খেলতে মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যেতো। তার জের ধরে কুটিমিয়া দাপাদাপি করে দরগা ঘরটা ভেঙ্গে ফেলতো, ভেঙ্গে ফেলতো নাচের বাঁশগুলোও।
একবার পরপর দু বছর তারা ধামাইলে গেলো না। সে সময় কুটিমিয়াদের সংসারে আয়উন্নতি একটু ভালো হচ্ছিল। পৌষ-চাঁদে ধামাইল হয়। পূর্ণিমার পরের দিন করিমন অসুখে পড়লো। ঘন ঘন পাতলা পায়খানা আর বমি। কুটিমিয়ার চাচা মেঘুলা বাজার থেকে কল্পনাথ ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। তার পথ্যে পায়খানা আর বমি থামলো বটে, কিন্তু করিমনের সমস্ত খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। সে ঘন ঘন চোখমুখ খিঁচতে লাগলো। কেউ কেউ বললো ধনুষ্টংকার। আবার ডাক্তার ডাকা হলো, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। মাঝে মাঝে করিমন চোখ উলটে পড়ে থাকে, নাড়ি নড়ে কী নড়ে না, সারা বাড়ি ভরে কান্নার রোল ওঠে। কিছু পরে হয়তো করিমন সামান্য নড়েচড়ে ওঠে—এভাবে চার-পাঁচ দিন চলে যায়। এমন সময় একজন বললো, ‘খামাখা ডাক্তার দেখাইতেছাও। এই রোগ তো ডাক্তারের রোগ না। ডাক্তার বাইড্যা খাওয়াইলেও কিছু অইবো না। এইড্যা অইলো ফকিরের রোগ।’ কুটিমিয়ার চাচিজান দৌড়ে তার বাপের গ্রাম শিমুলিয়ায় গিয়ে তার চাচা কালু ফকিরকে ধরলো। কালু ফকির এলেন, করিমনের মাথার কাছে বসে একের পর এক বিড়ি টানতে লাগলেন। বিড়ির ধোঁয়ায় পুরো ঘর ভরে গেলো। ওপরে ছাদের দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে কালু ফকির বললেন, ‘খুব গাড়াইয়া গেছে রে...।’ কুটিমিয়ার মা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে কালু ফকিরের পায়ের ওপর ভক্তি দিয়ে পড়ে গেলো। বললো, ‘বাবা, আমার মেয়ারে বাছাও তুমি বাবা, তুমি ছাড়া গতি নাই বাবা...।’
‘ভার লাগবো’, কালু ফকির গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘তরে অনেক বড়ডায় ধরছে। ভার ছাড়া ছোডান যাইবো না।’
ঐদিন রাত্রেই ভারের আয়োজন করা হলো। কুটিমিয়াদের ঘরে ভার বসবে। শিমুলিয়া থেকে কালু ফকিরের আরো কয়েকজন শিষ্য সঙ্গে আসবে। ভারের জন্য এক প্যাকেট মোমবাতি, এক প্যাকেট বিড়ি, এক প্যাকেট দিয়াশলাই লাগবে।
এশা’র পর ভারের গান শুরু হলো। ঘরের মাঝমাঝি জায়গায় নিথর হয়ে করিমন শুয়ে আছে, তার সিথানের কাছে লম্বা ঘোমটা টেনে বসেছে তার মা। এক ধারে মাটির গাছায় সর্ষের তেলে ঝিনুকবাতির সলতে জ্বলছে। ঘর ভর্তি মানুষ গান ধরলো :
আমায় আর কান্দাবি কতকাল
দয়াল আর কান্দাবি কতকাল
আজ আমার দুঃখেরই কপাল...
সবাই দুলে দুলে গান গায়, সুরের মূর্ছনায় ঘর ভারী হয়। এক গান থামে, তার রেশ ধরেই শুরু হয় আরেক গান, সবই মুর্শিদি আর মারফতি। গান গাইতে গাইতে এক সময় গভীর ভাবরসে আসর পুরোপুরি জমে উঠবে, আধো আলো আধো অন্ধকারের মাঝখানে আচমকা শরীর ঝাঁকি দিয়ে দয়াল দয়াল বলে সারা ঘর কাঁপিয়ে সুগম্ভীর চিৎকার দিয়ে উঠবেন ফকির বাবা। সহসা গান থেমে যাবে, তার বদলে একটানা আল্লাহু-আল্লাহু জিকির ধ্বনিত হতে থাকবে। ভারের ঘোরে ফকির বাবা ভক্তের প্রতি তাঁর জমাট ক্ষোভ প্রকাশ করবেন—কী কারণে করিমনের ওপর তাঁর নজর পড়েছিল।
রাত্রি গভীর হয়, গভীর হয় গানের ঐকতান, ঘর ভেদ করে নিজ্ঝুম চরাচরের অনেক দূর ভেসে যায় গানের সেই সুর।
প্রহর পেরিয়ে যেতে থাকে, গান গাইতে গাইতে সবার গলা ধরে আসে, দু চোখ তন্দ্রাক্লিষ্ট হয়, ধ্যানমগ্ন ফকির বাবা অর্ধ-মুদিত নয়নে সেই যে জোড়াসিনে উর্ধ্বপানে চেয়ে আছেন, তাঁর শরীরে ভার-গ্রহণের কোনো লক্ষণই দেখা যায় না।
ভোরের আজান পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্পষ্ট হয়ে যায়, আজ আর ভার আসবে না। ভক্তের ত্রুটির কারণে অসন্তুষ্ট হলে কোনো কোনো সময় ‘দয়াল’ মুখ ফিরিয়ে রাখেন। ফকির বাবার বিষণ্ন ও অবসন্ন অবয়বে বিরক্তি ফুটে ওঠে, ভক্তের প্রতি দয়াল বাবা মোটেও সদাশয় নন, রাতভর তাঁর অক্লান্ত সাধনা বৃথা গেছে।
পরের রাতে আবারো ভার বসলো। আগরবাতি, মোমবাতি, ঝিনুকবাতি, বাবার জন্য পানবিড়ি, সব সম্পন্ন হলো।
ভারের জন্য এতো দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দয়াল বাবা উদয় হোন, ভক্তের সাথে তাঁর দেনদরবার শেষ করে বিদায় নিয়ে চলে যান।
কিন্তু এদিনও ভারের কোনো আলামত পাওয়া যাচ্ছে না। উপস্থিত সুধীজনেরা কেউ কেউ এ বাড়ির প্রতি খুব নাখোশ হলেন, এরা দয়াল বাবার হুকুমাত মান্য করে না ঠিকঠাক। কেউ কেউ অবশ্য খুব আফসোস করে বলতে লাগলেন, দয়াল বাবা এইভাবে মুখ ফিরাইয়া নিলে ওগোর কী দশা অইবো? বাবার কি মায়ামমতা একটুও নাই?
ভাব সমুদ্রে উথালপাথাল ঢেউ খেলে যায়, কিন্তু দয়াল মুর্শিদ দেখা যে দেয় না, দেয়ই না।
আগের রাতের মতো এ-রাতের ভারও যখন বৃথা যায়—এমন সময় দয়াল বাবা কালু ফকির গর্জন করে উঠলেন—রক্ষা নাই—রক্ষা নাই—রক্ষা নাই—হাঁটু গেড়ে প্রবল শক্তিতে দু হাতে মাটির ওপর ধম-ধম-ধম করে চাপড় মারতে থাকেন—এতো প্রচণ্ড সেই চাপড় যে খেজুর পাতার বিছানা সমতে মাটির অংশটুকু নীচের দিকে দেবে যেতে থাকলো।
গান থেমে যায়, সমবেত আল্লাহু জিকির ধ্বনিত হতে থাকে—সেই সঙ্গে ফকির বাবার মুখে অনর্গল উচ্চারিত হয়—‘রক্ষা নাই...রক্ষা নাই...রক্ষা নাই...’
শংকিত রহিমন বিবি ফকির বাবার সম্মুখে অগ্রসর হয়, সে পাগলিনীপ্রায়, সক্রন্দনে বারংবার বাবার কাছে যাচনা করতে থাকে—‘দোহাই তোমার আল্লাহ রাসূলের, বাবা, বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানীর দোইাই লাগে, আমার করিমনরে ফিরাইয়া দেও বাবা...।’ অস্থির আর্তনাদে সে বাবার সামনে আছড়ে পড়তে লাগলো।
কিন্তু কালু ফকিরের মুখের ধুয়া অপরিবর্তিত—‘রক্ষা নাই...রক্ষা নাই...রক্ষা নাই...’
‘রক্ষা নাই’ ধুয়া তুলতে তুলতে হঠাৎ কালু ফকির নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ঝড়ের পর প্রকৃতি শান্ত হয়। ভারের পর দয়াল বাবার অমঙ্গল-আভাসে পুরো ঘর থমথমে হয়ে উঠলো। ক্লান্তি দূর হলে কালু ফকির ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। তিনি অতি ভগ্নহৃদয়, দুঃখ-ভারাক্রান্ত, ভক্তের বিপদ দূর করতে আজও ব্যর্থ হলেন!
মজলিশ ভাঙ্গবার কিছুক্ষণ আগে কালু ফকির গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বাবার দরগায় একটা বড় খাসি দিস্।’
কালু ফকিরের দরগায় খাসি দেয়া ভীষণ দায় হয়ে হলো। একটা মোরগ, কয়েক সের চালডাল তেমন কোনো সমস্যা নয়, কিন্তু একটা বড় খাসি কুটিমিয়ার বাবার জন্য পাহাড়সম কঠিন।
করিমন ধীরে ধীরে সুন্দর ও সুস্থ হয়ে উঠলো। সে কুটিমিয়ার সাথে আগের মতো চঞ্চল হয়ে খেলাধুলোয় মেতে উঠলো।
আশ্বিন মাসের শেষ তারিখে দিবাগত রাত্রে কালু ফকিরের বাড়িতে উরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। ভক্তরা বিগত বছরের মানত কিংবা খাজা বাবার আদিষ্ট সামগ্রী উরসের সময় বাবার দরবারে উৎসর্গ করে।
কুটিমিয়ার মা’র মনে সামান্য চালাকি আর সন্দেহের উদ্রেক হয়। ফকির বাবা ভারের সময় কোনো মানত চান নি, যখন খাসির কথা বলেন তখন ভার শেষ হয়ে গিয়েছিল, কাজেই খাসির কথা দয়াল বাবা বলেন নি। খাসি না দিয়ে ছোটোখাটো কিছু একটা দিলেই সারবে। তাছাড়া, এমনও তো হতে পারতো যে, ভার-টার কিছুই না, করিমন এমনি এমনি ভালো হয়ে উঠেছে, সেজন্য একটা বড় খাসি দেয়ার কোনো মানে নেই।
কার্তিকের মাঝামাঝি এসে করিমন শুকোতে শুরু করলো। তার খাওয়া দাওয়া বন্ধ হলো, চঞ্চলতা থেমে গেলো, কয়েক দিনের মাথায় বিছানায় পড়লো। সে মড়ার মতো পড়ে থাকে, নাড়ি নড়ে না, শ্বাস-প্রশ্বাস চলে কী চলে না।
একদিন রাতের শেষ প্রহরে রহিমন আর্তনাদ করে ওঠে। কী মড়ার ঘুমই না সে ঘুমিয়েছিল! কোন ফাঁকে করিমনের প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেছে মা তা টের পায় নি, ছোট্ট চড়ুই পাখির মতো ওর নিথর দেহটি রহিমনের বুকের কাছে ঠান্ডা হিম হয়ে পড়ে আছে।
কুটিমিয়ার মা’র মাতম উঠলো। ভোরের প্রকৃতিতে তার করুণ কান্নার সুর বহুদূর—বহুদূর ভেসে গেলো, অবিরাম।
ডাউনলোড লিংক : ই-বুক 'লৌকিক রহস্য; অথবা অলৌকিক', এপ্রিল ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০২০ রাত ১১:৪৫