বড়শির গল্পটা লিখতে বসেছিলাম। লিখতে গিয়ে দেখি লেখা বের হয় না। যারা নৃত্যশিল্পী, বা কণ্ঠশিল্পী, তাঁরা বহুদিন বিরতির পর নাচতে বা গাইতে গিয়ে এমন বিড়ম্বনায় পড়েন কিনা জানি না, তবে, লেখকরা লেখার বিরতি দিলে নতুন করে লিখতে গেলে এমন সংকটে যে পড়তে পারেন তার উদাহরণ আমি নিজেই তো!
ছোটোবেলায় গাঁওগেঁরামের পোলাপান মাছ ধরে নি, এমন উদাহরণ বিরল। চকে আর খালেবিলেই তো ছোটোবেলাটা কেটেছে। একটা পাখির ছানা ধরার জন্য মান্দার গাছের কাঁটায় পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত করেছি। ঘুড়ি উড়িয়েছি চাঁন্দিফাটা রোদে লাঙ্গলচষা ক্ষেতের উপরে পাথরের মতো শক্ত ইটায় পা আর হাঁটু রক্তাক্ত করে। দোহারের খাল, ধাপারির খাল, আড়িয়াল বিল, এবং আমাদের বাড়ির সামনে ছোটো নালাটিতে মাছ ধরতে ধরতে শরীরে চর পড়ে যেত।
মাছ ধরার ছোটোখাটো অনেক গল্প আগে লিখেছি। সেগুলো ছিল উছা, ঝাঁকিজাল, টানাজাল, পোলো বা দোহাইর দিয়ে মাছ ধরার কাহিনি। আজ বড়শিতে মাছ ধরার গল্প বলছি।
দোহারের খালটি দোহার গ্রাম থেকে বের হয়ে চকের মাঝখান দিয়ে আমাদের গ্রামে প্রবেশ করেছে এবং গ্রামের উত্তর মাথায় ফকির বাড়ির পাশ দিয়ে আড়িয়াল বিলে গিয়ে পড়েছে। ফকির বাড়ির ঘাটে বিশাল একটা ‘মোড়’ আছে, যেটি খুব গভীর; বর্ষাকালে এখানে কাটালের শক্তিশালী ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়, যার ভেতরে পড়লে ছুটে আসা অসম্ভব ব্যাপার।
আশ্বিন মাসের শেষদিকে বর্ষা ফুরিয়ে গেলেও দোহারের খালে পানি থাকে। খালের নানা জায়গায় ঝাঁকিজাল, টানাজালে মাঝ ধরার ধুম পড়ে যায়। অনেকে উবু হয়ে, কিংবা পানির নীচে ডুব দিয়ে কাঁদা হাতড়ে মাছ ধরে; ঘন ঝোপঝাঁড়ের নীচে বিরাট গর্তের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ধরে আনে বাইন, শিং বা মাগুর মাছ। মাছ ধরতে গর্তে হাত ঢুকিয়ে কতজনে যে সাপের কামড় খেয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
ছোটোবেলা থেকেই মাছ ধরার প্রতি আমার ঝোঁক ছিল খুব বেশি। খালে কিংবা মধ্যপাড়ার ফয়জল খা’র আড়ায় যেদিন মাছ গাবাতো, আমি ছুট দিতাম ওড়া, কিংবা বাবার গামছা নিয়ে। ঐ বয়সে একটা-দুটো ট্যাংরা কিংবা পুঁটি ধরতে পারলেই উল্লাসে চিৎকার দিয়ে উঠতাম এবং মাথার উপরে হাত উঁচু করে মাছ তুলে লাফাতে লাফাতে বাড়িতে ছুটে এসে মাকে বলতাম- ‘মা দ্যাক, কত্ত বড়ো পুডি দরছি।’ এরপর উছা, টানাজাল, ঠেলাজাল, ঝাঁকিজাল ও পোলো দিয়ে মাছ ধরেছি। একই সাথে বড়শিতেও মাছ ধরেছি।
প্রথম প্রথম বড়শিতে মাছ ধরতাম বাড়ির ঘাটে; এরপর পাশের বাড়ির পুকুরে। একটু বড়ো হলে একদিন বিকেলে মাছ ধরতে গেলাম ফকির বাড়ির ঘাটে। তখন বর্ষা নেমে গেছে।
ফকির বাড়ির ঘাটের উলটো দিকে একটা বাঁশঝাড়। তার নীচে বসার জায়গাটা বেশ মনোরম এবং ওখানে পানির গভীরতাও একটু বেশি হওয়ায় মাছের আনাগোনাও বেশি। আমি রোজ বিকেলে ওখানে গিয়ে বড়শি ফেলি। আমার মাছের রাশ ভালো। ছিপ ফেলা মাত্র মাছ বড়শি ঠোকরানো শুরু করে। তবে, ছোটো ছোটো চ্যালামাছগুলোই এ জ্বালাতন করে বেশি। আমরা এগুলো খুব একটা খাই না, যদি না আকারে কিছুটা বড়ো হয়। কিন্তু বড়শিতে ধরা বেশিরভাগ চ্যালাই খুব ছোটো, বড়শি থেকে খোলার সময়ই ওগুলোর মাথা থেতলে যায় এবং পানিতে ফেলে দিই।
মাছ ধরার দ্বিতীয় দিনে একটা সরপুঁটি ধরা পড়লো। সরপুঁটি ধরার পর খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়িতে চলে যাই। সরপুঁটি দেখে মা খুব খুশি হলো।
এভাবে প্রায় প্রতিদিনই একটা, কোনো-কোনোদিন দুটো বা তিনটাও সরপুঁটি পেতে থাকলাম। এর সাথে থাকে ছোটো পুঁটি, চিংড়ি, ট্যাংরা, ফলি, শিং। মাঝে মাঝে বাইন, কই ও খোলসে মাছও পাই।
একদিন বিকেলে হঠাৎ দুটো ছেলেমেয়ে আমার পাশে এসে বসলো। ছেলেটা লুঙ্গি পরা, মেয়েটা শাড়ি। মেয়েটার শাড়ি পরা আমার কাছে খুব ভালো লাগলো। বাড়িতে আমার ছোটোবোন নলেছাকে মা মাঝে মাঝে শখ করে তার নিজের শাড়ি পরায়। বোনের তুলনায় শাড়ির ওজন অনেক বেশি হওয়ায় সে শাড়ি পরে বেশি নড়াচড়া করতে পারে না। কিন্তু এ মেয়েটি পরেছে ছোটোদের শাড়ি; এবং পরেছে খুব সুন্দর করে। আমি বার বার ওর দিকে তাকিয়ে ওর শাড়ি পরা দেখি। ওর হাসিটা খুব সুন্দর। ওরা কারা জানি না, কোনোদিন আমাদের গ্রামে দেখি নি। ছেলেটা আমার খালুইটা নেড়েচেড়ে দেখছে। মেয়েটা ওর খালুই নাড়াচাড়া দেখে, আর আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। ওর হাসিতে আমার প্রাণ ভরে যায়।
‘তুমাগো বাড়ি কই?’ আমি জিজ্ঞাসা করি।
‘বিলাসপুরের চরে।’ ছেলেটা বলে।
‘বিলাসপুর কুন জাগায়?’
‘পদ্মার পাড়ে।’
‘তুমরা বেড়াইতে আইছাও?’
‘হ।’
‘কাগো বাইত্তে?
‘আদম ফকিরের বাইত্তে আইছি। নতুন বিয়া করছি তো, তাই বউ নিয়া বেড়াইবার আইছি।’
আমি এ কথায় খুব আশ্চর্য হই। ওরা আমার চাইতে বড়োজোর দু বছরের বড়ো হবে। ১০-১১ বছরের ছেলেমেয়েদের বিয়ে হতো আমার দাদার আমলে, আমার দাদির কাছে শুনেছি; কিন্তু এ আমলে এমনটা হয় তা আমার জানা ছিল না।
‘তুমার বউডা খুব সুন্দর। ওর নাম কী?’ আমি বলি।
‘ওর নাম জয়নব। মাদবর বাড়ির মেয়া তো, তাই এত সুন্দর।’ এটা বলতে যেয়ে ছেলেটা সুখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এবং একটা চাপা অহংকারে চোখদুটো সামান্য সরু করে ও আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসে।
‘আমার নাম চানু। তুমার নাম কী?’ চানু নিজের নাম বলে আমার নাম জানতে চায়। আমি যখন ‘আমার নাম কুডিমিয়া’ বললাম, তখন জয়নব হাসতে হাসতে প্রায় গলে পড়ে গেল।
‘কুডিমিয়া কি কুনো নাম অয়? জীবনেও এই নাম হুনি নাই।’ জয়নবের হাসি আর থামে না।
চানু ওর বউরে বলতে থাকে, ‘ও অইলো ভাইবোনের মধ্যে সবার ছুডো। ছুডোগো নাম কুডিমিয়াই অয়।’
এমন সময় বড়শিতে বেশ বড়ো একটা কুইচ্চা ধরা পড়লো। কুইচ্চা কেউ খায় না, তবে, গরীব মানুষেরা কেউ কেউ বড়ো আকারের কুইচ্চা পেলে খায়। আমি কুইচ্চাটাকে বড়শির মুখ থেকে খুলতে গেলে ওটা সাপের মতো আমার বাম হাত পেঁচিয়ে ধরলো, এবং আমি একটু ভয়ও পেলাম, কেমন সাপের মতো মোচড় দিচ্ছে, জোঁকের মতো বিদ্ঘুটে শরীর; আমার শরীরটা একটু ঝাঁকি দিয়ে উঠলো, কিন্তু নিজেকে সংযত রেখে ধীরে ধীরে বড়শির মুখ থেকে কুইচ্চাটাকে খুললাম। ওটার মাথা ধরে ঘুরিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারতে যাব, এমন সময় চানু বলে উঠলো, ‘করোছ কী, করোছ কী? ঐডা ফালাছ ক্যা? আমাগো দে।’ আমি ভাবলাম, ওরা হয়ত ধনীলোক ঘরের কেউ না বলেই কুইচ্চাটা নিতে চাইছে। ও দ্রুত কাছে এসে খুব উচ্ছ্বাসের সাথে আমার হাত থেকে কুইচ্চাটা তুলে নিল। এরপর সুন্দর করে খালের পানিতে ধুলো। ওর হাতে কুইচ্চাটা তখনো সাপের মতো মোচড়াচ্ছে। এরপর দুজনে পেছনের একটু উঁচু জায়গায় যেয়ে ঘাসের উপর বসলো। ওরা নেড়েচেড়ে কুইচ্চাটা দেখতে লাগলো; মনে হলো ওটাকে ওরা আদর করছে; হয়ত বহুদিন পর অনেক খায়েশের একটা মাছ পেয়ে ওরা নিজেদের খুব ভাগ্যমান মনে করছে। আমি আপন মনে বড়শিতে মাছ ধরতে থাকলাম। ওরা দুজন টুকটাক কথা বলতে থাকলো।
‘অনেক মজা রে!’ চানুর কথায় আমি পেছনে ফিরে তাকাই এবং যা দেখলাম তা কোনোদিনই আমার কল্পনায় আসে নি। কুইচ্চাটার একমাথা ধরে ছেলেটা চিবিয়ে খাচ্ছে, আরেক মাথা ধরে খাচ্ছে মেয়েটা। এই দেখে মুহূর্তে আমার বমি আসার উপক্রম হলো। কাঁচা ডিম বা কাঁচা মাংস তেল-মসলা দিয়ে মাখিয়ে খাওয়ার গল্প অনেক শুনেছি, কিন্তু কাঁচা মাছ, তাও কুইচ্চা কেউ এভাবে খেতে পারে, তা দেখে আমার পাকস্থলি দুমড়ে-মুচড়ে পাক দিয়ে উটকি আসতে শুরু করলো। আমি জোরে শব্দ করে ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে থাকলাম। এবং একসময় আমার জ্ঞান চলে গেল। যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখলাম, ওরা দুজন আঁজল ভরে খাল থেকে পানি এনে আমার মাথা ধোয়াচ্ছে। আমি গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ওদের গা থেকে একটা উৎকট চ্যাংটা গন্ধ বের হচ্ছে, তাতে আমার আবারো বমি হতে পারে ভেবে আমি দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে বাড়িতে চলে গেলাম।
বাড়ির কাছে আসতেই একটা সুমিষ্ট গন্ধে আমার বুক ভরে গেল। দুয়ারে পা ফেলে দেখি একটি অতি রূপবতী যুবতী আমার মায়ের পাশে বসে খুব সুন্দর করে হাসছে আর আমোদ করছে। আমাকে দেখেই যুবতী দ্রুত এগিয়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিল- ‘আল্লারে আল্লা, আমার বাজানডার শরীলের এই অবস্থা ক্যা রে বাজান? আইজক্যা কি পানিটুকুনও মুখে দেস নাই?’ আমার জন্য যুবতী রমণী হাহাকার করে উঠলো। আমি মুহূর্তেই বুঝে ফেললাম, এ আমার সুফী খালা! মায়ের মুখে খালার কত্ত গল্প শুনেছি! খালার চেহারা আমার মোটেও মনে নেই - আমার খুব ছোট্টবেলায় অল্প বয়সে খালার বিয়ে হয়ে গেলে খালুর সাথে সুফী খালা শহরে চলে গেছে, আজ এতদিন পর আমার প্রতি আকুলতা দেখে বুঝতে বিন্দু দেরি হলো না, এ আমার আজন্মচেনা প্রিয়তমা সুফী খালা।
‘তোর লগ দিয়া এত গন্ধ ক্যান রে বাজান? মাছের আইশটা গন্দে শরীল বইরা গেছে। নু, নাওয়াইয়া দেই।’ বলেই আমাকে হাত ধরে দুয়ারের একটা কোনায় নিয়ে কলশ থেকে পানি ঢেলে খালা আমাকে গোসল করিয়ে দিল। কলশের পানি বেশ ঠান্ডা ছিল, এবং শীতের দিন না হওয়া সত্ত্বেও একটু কাঁপতে থাকলাম। এমন সময় আমাকে অবাক করে দিয়ে, একটা ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে, খুব সুন্দর ও মায়াবী, বয়স ৪ বা ৫ বছর হবে, অবিকল জয়নবের মতো সুন্দর করে শাড়ি পরেছে মেয়েটি, আমার দিকে একটা গামছা বাড়িয়ে দিয়ে বললো- ‘বাই, গামছা নেও। তোমার ঠান্ডা লাকতেছে?’ বলেই ও আমার দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসতে লাগলো। ওর কণ্ঠটা আর হাসিটা এতই মিষ্টি, আমার বুক ভরে আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো। আমার ছোটোবোন নলেছা, ওর চাইতে ছোটো, এখনো ভালো করে কথা বলতে পারে না, আমার প্রাণ আনচান করে উঠলো, হায়, নলেছা কবে ওর মতো করে ‘বাই’ বলে ডেকে উঠবে?
গল্প এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু শেষ হতে পারলো না খালার কথায়। খালা বললো, ‘এইডা তর আরেকটা বইন। ওর নাম জয়নব।’
কী করে সম্ভব? চানুর ছোট্টবধূ জয়নব আর আমার খালাতো বোন জয়নবকে পাশাপাশি দাঁড় করালে হয়ত সহজেই সহোদরা দু’বোনের মতো মনে হবে। ওদের বয়স সমান হলে হয়ত যমজ বোন বলেও অনেকে ভুল করতে পারতো। হাসিটা, চাহনিটা, সবকিছুতে কী অদ্ভুত মিল!
আমি গামছা দিয়ে গা মুছলাম। তারপর কৌশলে গামছাটা পরে ভেজা থামিটা পালটে ফেললাম। থামি চিপড়ে পানি ফেলে একটা ঝাড়া দিয়ে বেড়ায় মেলে দিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছি, জয়নব ছুটে এসে দু'হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো, ‘বাই, কোলে নেও।’ আহ! আবারো আমার বুক জুড়িয়ে গেল! কত মিষ্টি করে জয়নব আমাকে ‘বাই’ বলে ডাকছে! আমার সামনে হাত বাড়িয়ে কোলে ওঠার জন্য আহ্লাদী বালিকার মতো হাঁটু দুলিয়ে নাচছে। ওকে আমি পাঁজাকোল করে তুলে নিলাম। ও দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো। নলেছাকে কোনোদিন এভাবে কোলে নিই নি। জয়নবের মাথার দু’দিকে লাল রঙের দুটো ফিতা ঝুলছে। ওর সারা শরীরে একটা অজানা ফুলের গন্ধ। ও আমাকে আরো জোরে গলা জড়িয়ে ধরলো। আমি আদরে ওর গলার কাছে মুখ নিয়ে চুমু খাই। আহ! কী সুন্দর ফুলের গন্ধ জয়নবের সারা গায়ে। ও খিলখিল করে হেসে ওঠে।
জয়নবের শোনাশুনি নলেছা আমাকে ঘন ঘন ‘বাই’ ‘বাই’ বলে ডাকতে শুরু করেছে। আমার খুব ভালো লাগছে। আমি যেখানে যাই, ওরা দু’জন আমার পিছে পিছে যায়। আমার খুব ভালো লাগে। অনেক আদরের দুটো বোন আমার গলায় গলায় ঝুলে থাকবে, এমনটা ভাবতেই আমার খুব ভাল লাগতে থাকে।
রাতে আমার একপাশে নলেছা, অন্যপাশে জয়নব শুলো। ওরা দুজন খুব শক্তভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। জয়নব নানা ধরনের বায়না ধরতে থাকলো। জয়নবের দেখাদেখি নলেছাও বায়না ধরতে শিখছে। আমাদের বাড়ির পাশে একটা দইল্লা গাছ আছে। দইল্লা গাছে আমি রোজ দোলনা বেঁধে দোল খাই। জয়নব বললো, কাল সক্কালেই ওকে দোলনায় চড়াতে হবে। নলেছারও একই বায়না। জয়নবকে নিয়ে দুপুরে ঘুড়ি উড়াবো। ওকে বাবুই পাখির বাসা দেখাতে নিয়ে যাব মাদবর বাড়ির তালগাছতলায়। হঠাৎ জয়নব বলে উঠলো, ‘বিয়ালে আমারে কিন্তু বড়শি দিয়া মাছ ধরতে নিবা।’
সকালে মা আমাকে ধাক্কাধাক্কি করে ঘুম থেকে উঠালো। আমার পাশে বাবা শুয়ে আছে। নলেছা ঘরে নেই, জয়নবকেও দেখছি না। ওরা কখন উঠে বাইরে গেছে কে জানে! দরজা দিয়ে উঁকি দিলাম- না, ওদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কোথাও কারো কথাও শোনা যাচ্ছে না।
‘খালায় কইরে মা?’
‘কুন খালায়?’ মা একটু অবাক হয়ে পালটা জিজ্ঞাসা করে?
‘সুফী খালা!’
‘সুফী খালায় কই গনে আইবো?’
‘কইগনে আইবো মানি? খালায় না ঘরে আছিল?’
‘পুলায় কয় কী? খালায় ঘরে আইবো কইগনে?’
‘কী আবুলতাবুল কছ? রাইত্রে তো খালায় ঘরেই আছিল। জয়নব আছিল আমার পাশে।’
মা চোখ সরু করে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী অইছে রে বাজান? তর খালায় দেহি কুন জনমে মইরা গেছে? মরা খালায় ঘরে আইবো কইগনে?’
**
আমার মনটা খুব ভার। ভার মনেই দইল্লা গাছে যেয়ে দোলনা বাঁধলাম। দোলনায় চড়ে একমনে উত্তরের বিরাণ চকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হচ্ছে, এই সকালটাতেই সারা চক ভরে রোদের খরা ধু-ধু করছে। খুব দূরে আবছা ধুলোর ভেতর ধীরপায়ে আমার সুফী খালা হেঁটে যাচ্ছে। তার পরনে একটা শাড়ি। এতদূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে, আমার সুফীখালা খুব সুন্দর করে শাড়ি পরেছে, আর রোদের ভেতরে তার শরীরের রূপ চিক চিক করে জ্বলছে।
খালা যে বছর মারা গেল, তার পরের বছরই মারা গেল নলেছা। আমার খালা নেই, নলেছাও নেই। অথচ, পুরো পৃথিবীর সবখানেই যেন ওদের ছায়া লুকিয়ে আছে। কান পাতলেই ওদের কণ্ঠ শুনি, চোখ বুঝলে ওদের মুখ দেখি। ওরা কি আমাকে দেখে?
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯
&&&
বিয়ালে – বিকালে
বাই – ভাই
কইগনে – কোথা থেকে
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২০ রাত ১০:৪৯