আমার বাবাকে যেভাবে কবরে শোয়াবো
আমাকেও ঠিক ওভাবে ভূ-গর্ভে ঢেকে দেবে
আমার সন্তান কিংবা স্বজনেরা
এর আগে বেশ ক’বার আমাকে মৃত্যুর
মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সেবার আমি যদি
মরে যেতাম, আমি জানি সেই ঘাতের কষ্ট
আমার বাবা সইতে না পেরে তিনিও
আমার সাথেই সহযাত্রী হতেন।
আমার আগেই আমার বাবার মৃত্যু হলে
আমি অতটা কষ্ট পাব না, যতটা বাবার আগে
আমার মৃত্যু হলে বাবা পাবেন। কেননা, আমার বাবা
আমাকে যতটা গভীর ভালোবাসতে পেরেছেন, আমি তাকে
তার এককণাও ভালোবাসতে শিখি নি, না পেরেছি
বাবার মতো আমার সন্ততিদের ভালোবাসতে।
আমার শৈশবে কী সুমধুর কণ্ঠে আমার বাবা গান গাইতেন-
‘দয়াল আর কান্দাইবা কতকাল
আজ আমার দুঃখেরই কপাল…’
বাবার পাশে নিঝুম বৃষ্টি ও তীব্র দহনে
অনর্গল লাঙল টেনেছি, ধান কেটেছি, ইটামুগুরে
ইটা ভেঙেছি, ক্ষেত নিড়িয়েছি
বাবার কণ্ঠে দুঃখ ঝরে পড়তো ধীর-লয় গানের সুরে সুরে-
‘ওওও রে দুঃখ কানলে যায় না…’
কোমরগঞ্জ আর শিবরামপুর হাটে, আগলা আর গোবিন্দপুরের
পথে পথে, যশোর-ফরিদপুর-চরভদ্রাসনে
আড়িয়াল বিল, গাংকুলা আর বোয়ালির চকে মাটির পাষাণে
আমাদের জন্য সুখ খুঁজতে খুঁজতে, ভবিষ্যতের সোনাবীজ
বুনতে বুনতে আমার বাবা শরীরের হাড় আর মাংস
অঙ্গার করে এখন তিনি নিবুনিবু চোখে নক্ষত্রের আলো গোনেন
আমি জানি না, আমার বাবা আর ক’দিন
পৃথিবীর বায়ুতে শ্বাস ফেলতে পারবেন
কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি-
সুখের উপর দিব্যি পা দুলিয়ে, উন্মুক্ত
আসমানে আনন্দে দাপাদাপি করে
নির্জলা বৈভবের সবটকু নির্যাস শুষে খেয়েও
আমার বাবার ‘দুঃখের কপাল’ অদ্যাবধি
আমি ঘোচাতে পারি নি।
আমার বাবা মর্মে মর্মে আজও সেই হৃদয়ক্ষয়ী
গানের মূর্ছনা তোলেন। সেই বক্ষভেদি সুর
আমার সমগ্র উচ্ছলতাকে ছাপিয়ে যায়।
আমিও কুরে কুরে ক্ষয় হতে থাকি।
সব কথা সবাইকে কি বলা যায়? কিছু অভিমান
মনে মনেই মরে যায়, কেউ কোনোদিন
জানতে পারে না। এমনকি প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছেও
অব্যক্ত থেকে যায় কতশত অনুযোগ, পুঞ্জীভূত
অভিমান। সুদীর্ঘদিন একই আধারে নিশ্বাস ছুঁয়েও
হয়ত-বা অজানা থেকে যায় হৃৎপিণ্ডের ঘ্রাণ।
কিছু কথা, অভিমান, কিছু রক্তাক্ত বেদনা
বুকে নিয়েই একদিন শেষবারের মতো
ঘুমিয়ে পড়বো। আমি যদি
আমার বাবার আগেই মরে যাই, প্রিয় বন্ধুরা, আমার
বাবাকে অন্তত তোমরা একটু সুখ দিও, যা আমি পারি নি।
২৭ মে ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:০৮