একটা মানুষ আর একটা কুকুরের পা গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে গেল। কার ব্যথা বেশি?
***
কামালুদ্দিন পাগাম সাহেব ডানে সালাম ফেরালেন, এমন সময় টের পেলেন তার ডান হাতের উপরে একটা মশা কামড় বসিয়েছে। সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘরে মশার সমারোহ বাড়তে থাকে। আর তিনিও মাগরিব শেষ করেই মশারি খাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন। খাওয়াদাওয়া, টিভি দেখা ভেতরে বসেই চলে।
নামাজে দাঁড়িয়ে পারতপক্ষে তিনি নড়াচড়া করেন না। তবে কঠিন কামড়ের চোটে মাঝে মাঝেই তার হাত আপনিআপনিই উঠে যায়; খুব আলোগোছে কামড়খাওয়া জায়গায় নরম করে হাত বুলিয়ে মশা তাড়িয়ে দেন এবং হালকা করে আঙুলে ঘষা দিয়ে চুলকানি উপশম করেন। হাতের দাপটে যাতে কোনো মশা মারা না পড়ে যায়, সেদিকে খুব খেয়াল রাখেন। নামাজরত অবস্থায় মশামাছি, পিঁপড়া, ইত্যাদি মারা মাকরূহ। এটা তাঁর স্ত্রী বলেছেন। তিনি নিজে কখনো সত্যমিথ্যা যাচাই করেন নি।
মশাটি খুব গভীরে শূঁড় ঢুকিয়ে দিয়ে আরামসে রক্ত টানতে শুরু করে দিয়েছে। ততক্ষণে তিনি বামে সালাম ফিরিয়ে মশাটির উপর চোখ স্থির করে গভীরভাবে তাকালেন। তিনি ভাবছেন, দেখা যাক মশাটি কতখানি রক্ত খেতে পারে। পুঁচকে মশাটা রক্ত খেতে খেতে একসময় টগবগে হয়ে উঠবে, পেছনে পাখার নীচে স্বচ্ছ চামড়ার ভেতর একদলা টলটলে রক্তও বেড়ে উঠতে থাকবে। এরকম রক্তাভ মশা দেখতে তার খুব মজা লাগে। প্রায় প্রতিদিন সকালবেলা এরকম মজার খেলা দেখেন পাগাম সাহেব। কিছু মশা রক্ত খেয়ে উৎকট কালো আকার ধারণ করে মশারির গায়ে ঝিম মেরে বসে থাকে। ওগুলোকে তখন নেশাগ্রস্ত মদ্যপের মতো মনে হয়। মশারির কোনা ধরে ঝাঁকি দিলে, কিংবা হাত দিয়ে সরাতে গেলে আহত পাখির মতো সামান্যটুকু উড়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে বসে ওরা।
মশারা মূলত খুব চতুর ও চটপটে প্রাণী। উড়ন্ত মশাকে দেখে খুব নাদুস-নুদুস ও অলস, গোবেচারা প্রাণী মনে হয়; কিন্তু কখনো উড়ন্ত মশাকে ধপ করে দু’হাতে চাপ দিয়ে ধরতে পেরেছেন? শরীরের উপর বসলেই বা কয়টা মশাকে ধাপ্পড় দিয়ে মারতে পেরেছেন? মশার চোখ চারদিকে। ওরা আপনার মনের খবরও পড়তে জানে। আপনি থাপ্পড়ের জন্য হাত উঠানোমাত্র ওরা খবর পেয়ে যায় আর মুহূর্তেই চম্পট। মশাদের অতো বলদ ভাবতে নেই।
‘আর কত খাবি রে বাবা? পেট ভরে নাই এখনো?’ পাগাম সাহেব মনে মনে বলেন। ব্যথা আর চুলকানির এক অদ্ভুত মিশ্রণ। প্রায় অসহ্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। শরীরে এত রক্ত নিয়ে এ মশাটা উড়তে পারবে না। রক্ত খাওয়া শেষ হলে কোনোমতে ডানা ঝাপটে হাতের পাতা থেকে সে পাশাপাশি একটা কাপড়ের গাদায় অন্ধকারে ঢুকে পড়ে জনমের মতো ঘুমিয়ে পড়বে, তারপর যখন তার ঘুম ভাঙবে, তখন কতদিন পার হয়ে যাবে সে জানবে না। আচ্ছা, মশারা কি শুধু রক্তই খায়? না, তা হবে কেন? যেসব মশা বনেজঙ্গলে থাকে, যারা কোনোদিন অন্য পশপাখি চোখে দেখে নাই, তারা হয় জন্ম থেকেই অনাহারী, অথবা ময়লা-আবর্জনা খেয়ে বড়ো হয়েছে। সেই হিসাবে, যেসব মশা রক্ত খাওয়ার সুযোগ পায়, বিশেষ করে মানুষের রক্ত, সেগুলোকে খুবই ভাগ্যবান মশা বলতে হবে। আশরাফুল মাখলুকাতের রক্ত খেয়ে তাদের জীবন ধন্য হয়ে যায়।
হাতের দিকে পাগাম সাহেব তাকিয়ে আছেন। মশাটি ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। রাতে ঘুমের সময় যেসব মশা মশারির ফাঁক-ফোকড় গলিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে, সেগুলো খুব নিরুপদ্রপে চামড়া ফুটো করে সময় নিয়ে মনের সুখ মিটিয়ে রক্ত পান করার সুযোগ পায়। পাগাম সাহেব এই মশাটিকেও সেই সুযোগ দিচ্ছেন। তিনি টের পাচ্ছেন, চামড়ার নীচে সুঁইয়ের মতো মশার শূঁড়টা ঢুকে আছে, আর সেই শূঁড় দিয়ে তরতর সুড়সুড় করে রক্ত টেনে নিয়ে একদম পাকস্থলির গভীরে ছেড়ে দিচ্ছে সেই রক্ত। কামড়ের জায়গাটা শিরশির করতে করতে এবার তিনি ব্যথায় একটু কোঁ করে উঠলেন। শরীরটাও একটু দুলে উঠলো কিংবা কেঁপে উঠলো। নাহ, আর সহ্য হচ্ছে না। না। না! না! সপাৎ করে তার বাম হাতটা উঠে এলো। কিন্তু তিনি খুব সতর্ক। হাতের পাঁচটা আঙুল তিনি মেলে ধরেছেন। ধীরে ধীরে সেই হাত থাবার মতো নেমে আসছে মশার দিকে। মশাটা এখন পুরোপুরি নেশাগ্রস্ত। তার কোনোদিকে খেয়াল কিংবা ভ্রূক্ষেপ নেই। সে টের পাচ্ছে না তার মাথার উপর নিষ্ঠুর খড়্গ নেমে আসছে। হাতের থাবা একটু দ্রুত গতিতে নেমে এসে মশার শরীরে লাগবে, ঠিক অমন সময়ে মশাটা মৃদু পাখা নাড়ালো, তারপর উড়বার চেষ্টা করতেই পাগাম সাহেবের আঙুলের সাথে ধাক্কা লেগে ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ে গেলো। পাগাম সাহেব বাম হাতে কামড়খাওয়া জায়গাটি ঘষছেন আর দেখছেন, আহত মশাটি উড়বার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, কিন্তু উড়তে পারছে না। একটু পর সে এক জায়গায় ক্লান্ত শরীর নিয়ে থামলো। পাগাম সাহেবের মজা দেখা শেষ হয় নাই। তিনি সামনে ঝুঁকে পড়ে নীচু হয়ে মশাটিকে দেখতে থাকলেন। ওটা যেন হাতির মতো শূঁড় উঁচু করে তাকে অভিবাদন জানালো। পিটপিট করে তার দিকে তাকাচ্ছে। পাগাম সাহেবের মনে দুষ্টুবুদ্ধি চাপলো। ঠিক দুষ্টুবুদ্ধিও বলা যাবে না, তার মনে একটা শিশুসুলভ ইচ্ছে জাগলো। তিনি হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে দু আঙুলের নখের মাথায় মশাটির পাখা চিমটি দিয়ে ধরে তুলে এনে ডান হাতের তালুতে রাখলেন। এবার চোখের খুব কাছে এনে ওর দিকে তাকালেন। তালুর উপরে ওটা পা চেগিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। না জানি কত রক্ত সে খেয়েছে। শরীর তার এত ভারী হয়েছে যে, নড়তেই পারছে না। পাগাম সাহেবের মুখ দিয়ে ‘চু-চু-চু’ শব্দ বেরিয়ে এলো। একবার তার মেয়ে অনেকগুলো হেলিকপ্টার আকৃতির প্রজাপতি ধরে এনে পাখা ছিঁড়ে টেবিলের উপর ছেড়ে দিয়েছিল। ওগুলো তখন হেঁটে বেড়িয়েছিল। মেয়ে তাতে খুব মজা পেয়েছিল। পাগাম সাহেব এবার এই মশাটিরও পাখা ছিঁড়ে ফেলবেন বলে ভাবলেন। তিনি খুব আনন্দের সাথে, নিবিড় চিত্তে, সন্তর্পণে মশাটির পাখা আলাদা করে দিলেন। পাখাবিহীন মশাটি আগের মতোই তার হাতের তালুতে চেগিয়ে নড়াচড়া করতে লাগলো। কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলেন না তিনি। কিন্তু খুব মজা পেলেন। যাও রক্তচোষা মশা, দেখো তোমার রক্ত চোষার পরিণাম। রক্ত চুষতে এসে ধরা পড়লে, সারা জনমের জন্য পাখাই হারিয়ে ফেললে। রক্ত খাওয়ার সাধ এবার মিটলো তো?
কিন্তু তিনি ক্ষান্ত হলেন না। অর্থাৎ, তার খেলা এখনো শেষ হয় নি। তিনি মশাটাকে একটা পরিষ্কার কাঁচের উপর রাখলেন। ভদ্র লোকের মতো মশাটি কাঁচের উপর স্থির হয়ে থাকলো, যেমনটা সে হাতের তালুতে ছিল। পাগাম সাহেব উপুড় হয়ে সামান্য ফুঁ দিলেন, তাতে মশাটা ছোটো একটা হালকা দানার মতো ঘুরতে ঘুরতে একটু দূরে সরে গেলো। মরে যায় নি তো? নাহ। তিনি খেয়াল করে দেখলেন শূঁড় নড়ছে। পা নড়ছে। কিন্তু হঠাৎ তার ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে। কী ছেলেমানুষি কাণ্ডই না তিনি করছেন! তার কি এসব খেলার বয়স আছে? এসব মশামাছি নিয়ে খেলাধুলা করা কি মানুষের কাজ! তিনি নিজের উপর খুব বিরক্ত হোন।
কিন্তু অবাক হলেন তিনি। হঠাৎ করে এই মশাটি নিয়ে খেলা করার এই অদ্ভুত ইচ্ছে কেন হলো তার? তিনি সুস্থ আছেন তো! হ্যাঁ, তিনি সুস্থ। সুস্থ মনেই তার মনের ভেতর আরেক উদ্ভট প্রশ্নের উন্মেষ ঘটলো। এই যে মশাটি নিয়ে তিনি খেলছেন, যার দুটো পাখা তিনি ছিঁড়ে ফেললেন- তার পরও মশাটি প্রায় নির্বিকার, পাখা ছাড়াই পা চেগিয়ে হাঁটছে- এতে কি মশার শরীরে একটুও ব্যথা লাগে নি? চোট লাগে নি? আমার শরীর আর এই মশার শরীরে পার্থক্য কী? আমি মানুষ, খিদে লাগলে খাবারের জন্য হন্যে হয়ে যাই, সারাবিশ্ব তোলপাড় করি, মশারাও কি তাই করে না? কী পার্থক্য একটা মানুষের জীবনে আর এই তুচ্ছ মশার জীবনে? একজন মানুষের হাত কাটা গেলে, পা কাটা গেলে যে যন্ত্রণা পায়, একটা মশার পা ছিঁড়ে ফেললে কি যন্ত্রণা তার চাইতে কিছু কম হয়? পথ চলতে কত পিঁপড়ে পিষ্ট হয় পায়ের তলায়; আমরা কি কখনো ভেবেছি- এই পিঁপড়েরাও মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করেছে? আমরা কি কখনো ভেবেছি- একটা তাজা মাছ যখন ঘ্যাচঘ্যাচ করে বটিতে কোটা হচ্ছে, তখন ঐ মাছটাও আর্তনাদ করতে থাকে! বড়োজোর একটা মুরগি, একটা ছাগল বা গরু জবাইয়ের সময় আমরা কিছুটা ভাবি, যাতে এদের কষ্টটা দীর্ঘস্থায়ী না হয়; কিন্তু, এক থাপ্পড়ে একটা মশা, একটা মাছি, পায়ের এক ঘষায় একদঙ্গল পিঁপড়া, বা তেলাপোকা যখন শেষ করে দিই, তখন কি একবারও মনে হয়- এদেরও জীবন ছিল, যা মাত্র এক ফুঁৎকারে নিভিয়ে দিয়েছি? তাহলে মানুষের জীবনের এত মূল্য, আর তুচ্ছ কীটপতঙ্গের কোনো জীবনই নাই?
পাগাম সাহেব ভাবলেন- মানুষ আসলে মনে করে মানুষ ছাড়া আর কারো জীবন নাই; অন্য প্রাণীদের দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণা নাই। আমরা একপাল গরুর সামনে গরু জবাই করি; খোয়াড়ভর্তি হাঁসমুরগির সামনে হাঁসমুরগি জবাই করি। আমরা মনে করি- ওরা এই জবাই করাকে জবাই মনে করে না, মনে করে খেলা। ওরা সেই খেলা দেখতে থাকে প্রাণ ভরে। করাত দিয়ে গাছের ডাল কাটার সময় কি আমরা কখনো ভাবি, গাছটা ব্যথা পাচ্ছে কিনা? কাঁচি দিয়ে কচুর ডগা কেটে ফেলি, লকলকে ফুলটাকে বৃন্ত থেকে তুলে আনি- আমাদের ঘূণাক্ষরেও মনে হয় না, ওদেরও প্রাণ আছে, ওরাও ব্যথায় ককিয়ে ওঠে। মানুষের মতো এত নিষ্ঠুর প্রাণী কি দ্বিতীয়টি আর আছে?
পাগাম সাহেব ভেবেচিন্তে দেখলেন, প্রকৃতিতে এর একটা অদ্ভুত ভারসাম্য বিরাজমান রয়েছে। মানুষ যেমন এক-মুহূর্তে পিঁপড়ার জীবন, মশার জীবন, তেলাপোকার জীবন কেড়ে নিতে পারে, মাছ-মুরগি-গরু-ছাগলকে যেমন প্রাণী না ভেবে খাবার হিসাবে ভক্ষণ করে থাকে- এই মানুষরাই আবার হয়ে ওঠে বাঘের খাবার, সিংহের খাবার, হাঙরের খাবার। একটা রানাপ্লাজা কেড়ে খায় ১১৩৪টা জীবন, নিমতলীতে এক লহমা আগুন পুড়িয়ে ছাই করে ১২৪টা তরতাজা প্রাণ। বাস নামক একটা দানব মুহূর্তে আবরার নামক একটা যুবাকে খেয়ে ফেলে। পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় একটা দুর্ধ্বর্ষ বিমান ও তার উদরভর্তি ১৪৭টা মানুষ। একটা যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ, হিরোশিমার বোমা- লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষকে মিশিয়ে দেয় মাটির ধুলোয়।
কামালুদ্দিন পাগাম সাহেব কাচের উপর থেকে প্রায় নিথর-হয়ে-পড়া কালচে বিন্দুর মতো পাখাহীন মশার টুকরোটি ডান হাতের তালুতে তুলে নিলেন। ওটার শূঁড় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। পা-গুলো একবার মনে হয় নড়ছে, আবার মনে হয় জড়ো পদার্থের মতো শক্ত হয়ে গেছে। তিনি একধ্যানে বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মনে হচ্ছে তার হাত নেই, পা নেই। তিনি নড়তে পারছেন না। তিনি পাশের ঘর থেকে স্ত্রীকে ডাকবেন, তার গলা ফেটে স্বর বেরুচ্ছে না। যেন হাতের মশাটিও মৃত্যুর কালে তার প্রাণাধিক স্ত্রীকে ডেকে খুন হচ্ছে, কান্নায় তার বুক ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু তারও কণ্ঠ যেন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
২৬ মার্চ ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০২২ দুপুর ১২:৫৯