রীতু আরাশিগে - ১ম পর্ব
রীতু আরাশিগে - ২য় পর্ব
মাত্র কিছুক্ষণ জেনারেল ভাবলেন। তারপর কন্ডাক্টিং অফিসারকে নিজের ইচ্ছের কথাটি জানালেন।
শ্রীলংকায় বটগাছের সংখ্যা কেমন তা জেনারেলের জানা নেই। তাঁর ইচ্ছে ছিল একটা বটবৃক্ষের চারা রোপণ করবেন। কিন্তু বটবৃক্ষ কেন, অদূরে কোথাও কোনো নার্সারির সন্ধান না পাওয়ায় অন্য কোনো গাছের চারা সংগ্রহ করাও সম্ভব হলো না।
তীক্ষ্ণ প্রত্যুৎপন্নমতি কন্ডাক্টিং অফিসার ত্বরিত জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে এলেন। স্থানীয় এক লোকের সাহায্যে রাস্তার ধার থেকে একটা অজানা চারাগাছ উত্তোলন করলেন।
‘আমি এটা কোথায় রোপণ করতে পারি?’ জেনারেল জিজ্ঞাসা করেন কন্ডাক্টিং অফিসারকে।
‘মাতুগামা সবচাইতে উপযুক্ত স্থান হয়’, কন্ডাক্টিং অফিসার বলেন। ‘কিন্তু সেখানে এটা রোপণ করবার জন্য কোনো পতিত জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
জেনারেল আর কিছু বলেন না। চারাটি সমেত গাড়িতে উঠে কলম্বোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে বলেন।
মাতুগামা থেকে বের হয়ে মিনিট দশেক গাড়ি চালাবার পর রাস্তার একধারে একটা ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায়। সেখানে গাড়ি থামাতে বললেন জেনারেল।
‘আমি যদি ঐ মাঠের এক কোনায় এই চারাগাছটি রোপণ করি তাহলে কেমন হয়?’ জেনারেল জিজ্ঞাসা করেন।
‘উত্তম প্রস্তাব। আমার মনে হয় এটা পতিত জায়গা। এখানে আগামী পঞ্চাশ বছরেও বসতি গড়ে উঠবার কোনো সম্ভাবনা নেই।’ কন্ডাক্টিং অফিসার বলেন।
‘তাহলে অনুগ্রহ করে এখানে এটা রোপণ করবার ব্যবস্থা করুন।’
গ্রামবাসীদের সহায়তায় অজানা বৃক্ষের চারাটি ওখানে রোপণ করে কলম্বোর উদ্দেশ্যে পুনরায় গাড়িতে উঠে বসলেন।
সমস্ত রাস্তা অত্যন্ত করুণ নীরবতার মধ্য দিয়ে পার করে নিজ কক্ষে ফেরত এলেন জেনারেল। বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে আরো ঘণ্টা দুয়েক সময় অবশিষ্ট আছে। ইচ্ছে করলে তিনি শহরে বেরোতে পারেন। কিন্তু বেরোবেন না। ঘোরাঘুরির অভ্যাস তাঁর আগে ছিল। তাঁর ছেলেমেয়েরা যখন ছোটো ছিল স্ত্রীসহ তাদের নিয়ে তিনি প্রচুর ঘুরতে বেরোতেন। প্রায় বছর খানেক ভোগান্তির পর যে বছর রীতুর ক্যান্সারে মৃত্যু হলো মূলত সে-বছর থেকেই তিনি অনেক গুটিয়ে গেছেন— বহুদিন পর্যন্ত তাঁর কেবলই মনে পড়তো, তিনি গোসল সেরে বাইরে বেরিয়েছেন, রীতু দৌড়ে ছুটে এসে তাঁর শরীর শুঁকছে আর বলছে, ‘আব্বু, তোমার শরীরে কী যে ঘ্রাণ! এত ঘ্রাণ কি সাবানে হয়? আমার হয় না কেন?’
রীতুর মৃত্যুর পরের বছর যখন তাঁদের ছেলেটাও চলন্ত বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা গেলো— তার পর থেকে তিনি অন্তরে অন্তরে ধু-ধু মরুভূমি হয়ে আছেন। তাঁর কিছুই ভালো লাগে না। ছোটো একটা মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন। মেয়েটির আসল নাম পালটে তার নাম রেখেছেন রীতু আরাশিগে। রীতু আরাশিগে খুব অদ্ভুত মেয়ে। রীতুর মতোই বড্ড জেদি। সে দিনে দিনে এতটা জেদি ও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে যে মাঝে মাঝেই উঁচু স্বরে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘আমার নাম রীতু আরাশিগে রেখেছো কেন, আমার নাম রেহানা।’
জেনারেলের তন্দ্রা ছুটে যায়। আসলে রীতু আরাশিগে কখনোই বলে নি, ‘আমার নাম রীতু আরাশিগে রেখেছো কেন, আমার নাম রেহানা।’ এ কথাটি তিনি তন্দ্রার মধ্যে স্বপ্নে শুনেছেন।
তিনি আজকাল খুব নিষ্ঠুরও হয়ে উঠেছেন। ই-মেইল, ফোন, ইত্যাদি কত সুবিধাদি আছে, অথচ দেশে একবারও ফোন করেন নি— এ কথা মনে হতেই তাঁর মন খুব খারাপ হয়ে যায়। হঠাৎ বোধোদয় হয়, হাতের কাছেই টেলিফোন; তিনি ডায়াল করতে থাকেন।
জেনারেলের স্ত্রী অপর প্রান্ত থেকে বলে ওঠেন, ‘কী ব্যাপার, এত ঘন ঘন ফোন করছো কেন? এরই মধ্যে দু বার হয়ে গেলো। খুব খারাপ লাগছে?’
‘না না, খারাপ লাগছে না। রীতু আরাশিগের হাতে দাও। ওর জন্য কী কী আনবো জেনে নিই।’
‘রীতু আরাশিগে কে?’
‘ঐ যে আমাদের দত্তক মেয়েটা!’
‘তুমি যে কী! রীতু আরাশিগে সেই কবে চলে গেছে না? আর ওর নাম তো রীতু আরাশিগে ছিল না, ওর নাম ছিল আরিশেগা। এখনো তুমি ওর কথা মনে রেখেছো? এসব কথা কেন তুমি এত মনে করো? এসব ভাবতে ভাবতেই তুমি শেষ হয়ে গেলে। তুমি আর ফোন করো না লক্ষ্মীটি, চোখ বন্ধ করে সারাক্ষণ শুধু আল্লাহ্র নাম জপবে, বুঝেছো? তবেই দেখবে তোমার ঠিক সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি।’
জেনারেলের আজকাল যেন কিছুই মনে থাকে না। তাঁর কি মাথায় কিছু ঘটেছে? তাঁর হাতে সর্বদাই একটা মোবাইল থাকে। বাসা থেকে স্ত্রী ফোন করেন, এখান থেকে তিনি। প্রতিদিনই তিনি দু-একবার করে স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন, কিন্তু এখন তাঁর সেসব কিছুই মনে পড়ছে না। তাঁর কী হয়েছে? মাতুগামায় গেলেন, আরাশিগেকে খুঁজলেন, চারা রোপণ করলেন, সব মনে পড়ে, কিন্তু তারপরেও মনে হচ্ছে তাঁর মাথায় সবকিছু জট পাকিয়ে আসছে। মদ্যপান করলে মানুষের এমন হয়, নিজে যদিও জীবনে একফোঁটা মদ চেখে দেখেন নি। তিনি ভেবেই পাচ্ছেন না তাঁর এরূপ স্মৃতিভ্রম হচ্ছে কেন। তিনি কি খুবই ক্লান্ত?
অতিসত্বর বিশ্রাম নেয়া দরকার। জেনারেল মনে মনে ভাবেন।
দরজায় টোকা দিয়ে কন্ডাক্টিং অফিসার কক্ষে প্রবেশ করেন। বলেন, ‘স্যার, আপনার জন্য কি সামান্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা করবো?’
‘নো নো ইয়াং ম্যান, আরেকটু পরে তো ডিনারই করবো। তুমি বরং একটু বসো, তোমাকে আমি একটা কাজ দিতে চাই, আশা করি হাসিমুখে তা করবে।’
‘নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই স্যার। দয়া করে আপনার কাজের কথাটি আমাকে বলুন।’
‘আজ যেখানে আমি চারাটি রোপণ করে এলাম, তুমি আরেকবার সেখানে যাবে। আমি এ কাগজটায় লিখে দিচ্ছি, একটা বোর্ডের উপর সুন্দর করে এ কথাগুলো লিখাবে। তারপর গাছটির গোড়ার সন্নিকটে বোর্ডটা পুঁতে দিবে। আর এজন্য যাবতীয় খরচ বাবদ তোমাকে সামান্য এই রুপি ক’টা দিচ্ছি।’
‘আমি সবই করবো, স্যার, এগুলো সুসম্পন্ন করতে পারাটা আমার জন্য অনেক আনন্দের হবে, তবে এ সামান্য কাজটুকুর জন্য আমি কোনো রুপি গ্রহণ করতে রাজি নই, প্রিয় মহোদয়।’
‘অবশ্যই তুমি রুপি গ্রহণ করবে।’
‘কিন্তু এ তো প্রচুর রুপি!’
‘খরচের পর যা অবশিষ্ট থাকবে তা দিয়ে তুমি চকোলেট খাবে, প্রিয় বালক, কেমন? তোমরা তো বিশ্ববিখ্যাত চকোলেট প্রস্তুত করো, তাই না?’
‘জি স্যার। আপনাকে বলছি, আমার চেয়ে আমার স্ত্রীই চকোলেট অধিক পছন্দ করেন।’
‘আমার ভুল হয়ে গেছে, আমার উচিত ছিল তোমার স্ত্রীর জন্য একটা উপহার প্রদান করা।’
‘স্যার, এ আপনার অসামান্য বদান্যতা যে আপনি এতখানি সৌজন্য প্রকাশ করছেন। আমি অবশ্যই অখরচকৃত সবগুলো রুপি দিয়ে ব্যাগভর্তি চকোলেট কিনে আমার স্ত্রীর জন্য নিয়ে যাব, তাঁকে বলবো এক বাংলাদেশি সহৃদয় ও মহৎ জেনারেল এগুলো তোমার জন্য উপঢৌকন স্বরূপ পাঠিয়েছেন। তাতে আমার স্ত্রী যে কী পরিমাণ আহ্লাদিত হয়ে উঠবেন তা আপনাকে আমি বোঝাতে পারবো না।’
‘তোমাকে বাছা আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
‘দেশে ফেরত গিয়ে অবশ্যই ম্যাডামকে আমার সালাম ও শুভেচ্ছা জানাবেন।’
‘তুমিও তোমার স্ত্রীকে আমার ভালোবাসা আর মমতা পৌঁছে দিও।’
‘অবশ্যই, স্যার।’
‘একবার আমার দেশে তোমার বউকে নিয়ে বেড়াতে এসো। বাংলাদেশ পৃথিবীর সুন্দরতম দেশগুলোর একটি, যেমন তোমার দেশটিকেও আমার আমৃত্য ভালো লাগবে।’
‘সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা আপনার বাংলাদেশ, আমি এ কথা জানি, স্যার। আপনারা বীরের জাতি। মাতৃভাষার দাবিতে শহীদ-হওয়া জাতি আপনারা। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য হাসিমুখে আত্মাহুতি দেয়া জাতি আপনারা। এমন একটি দেশের মানুষের সঙ্গে আমি কিছুদিন কাটালাম, এ আমার সারা জনমের গৌরবোজ্জ্বল প্রাপ্তি। আপনার দেশে ভ্রমণে যাবার সুযোগ পেলে স্বর্গলাভের চেয়েও তা হবে শ্রেয়তর। অবশ্যই যাব এবং আপনার আতিথেয়তা গ্রহণ করবো।’
বিমান উড্ডয়নের পর জেনারেল লক্ষ করেন তাঁর পকেটে একটুকরো কাগজ পড়ে আছে। ওটা বের করে এনে চোখের সামনে ধরেন :
One Arachchige, My Beloved Daughter
Once I Met Her Here.
এখানে একদিন আরাশিগে নামক একটা মেয়ের সাথে দেখা হয়েছিল
যে ছিল আমার প্রিয়তমা কন্যার মতো।
কন্ডাক্টিং অফিসারের হাতে কি কাগজের টুকরোটা দেয়া হয় নি? ভালো করে চোখ বোলান তিনি। না, ভুল দেখেছেন। এটাতে সেই অফিসারের ঠিকানা লেখা রয়েছে। ঠিকানা লেখার জন্য আগে ছোটো নোটবই ব্যবহার করতেন। আজকাল ছোটো ছোটো কাগজের টুকরো ও ভিজিটিং কার্ড দিয়ে মানিব্যাগ ভরে ফেলেন। ভুলবশত মানিব্যাগ থেকে মাঝেমধ্যে টাকা ঝরে পড়ে যায়, ঠিকানাও।
জেনারেল হাতের কাগজটা তাঁর মানিব্যাগে পুরে রাখলেন।
২০ জুন ২০০৪
* কালের চিহ্ন, একুশে বইমেলা ২০১৬
কালের চিহ্ন ডাউনলোড করার লিংক
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১০:১৮