সনির্বন্ধ ঘোষণাঃ এটা একটা ভয়-জাগানিয়া সুলম্বা পোস্ট
১
যদ্দূর মনে পড়ে, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় কোনো এক সন্ধ্যায় কুপির আলোতে বিছানায় উপুড় হয়ে পেন্সিল দিয়ে ৩-৪ লাইনের ছড়া জাতীয় একটা কিছু লিখেছিলাম। কী লিখেছিলাম মনে থাকার কথা নয়; প্রায় ৩৫-৪০ বছর আগের কথা। এখন স্পষ্টই মনে পড়লো, চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালেই ছড়াজাতীয় একটা 'বিখ্যাত বস্তু' লিখেছিলাম, যার পরিণতি খুব ভয়াবহ ছিল। এ পোস্টের শেষের দিকে ঘটনাটার উল্লেখ আছে - রেফারেন্স হিসাবে জুড়ে দিলাম।
এরপর ৮ম শ্রেণিতে উঠে। পাঠ্যবইয়ে একটা গল্প ছিল। সেটাকে কবিতা বানানোর চেষ্টা চলে প্রায় পুরো বছর ধরে, কিন্তু দু লাইনের বেশি এগোতে পারি নি।
খুব অস্পষ্ট মনে পড়ে, ক্লাস ওয়না-‘বি’-তে জীবনের প্রথম ছড়াটা পড়েছিলাম জসীমউদ্দীনের ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা’, অথবা ‘বাক বাকুম পায়রা মাথায় দিয়ে টায়রা (বাক বাকুম কার ছড়া ওটা মনে নেই) ; এখনকার মতো তখন আমাদের ডাইয়ারকুম গ্রামের মারুয়াপোতা প্রাইমারি স্কুলে প্লে গ্রুপ, নার্সারি, কেজি বা স্ট্যান্ডার্ড ওয়ান, টু, ইত্যাদি শ্রেণি ছিল না। এর পরের ছড়া ছিল সম্ভবত নজরুলের ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি’। তখন ছিল যে-কোনো ছড়ার/কবিতার প্রথম ৮ লাইন কবির নামসহ মুখস্থ করে পরীক্ষা দেয়ার যুগ এবং যে-ক্লাস পর্যন্ত এই নিয়ম ছিল, শুধু নজরুলের কবিতা মুখস্থ করেই পরীক্ষা দিয়ে খালাস পেয়েছি কেন নজরুলের কবিতা পড়তাম তার কারণ জানি না, তবে নজরুলের কবিতাটাই বইয়ের প্রথম কবিতা থাকতো, এটা হতে পারে প্রধান কারণ।
৯ম শ্রেণিতে উঠে হঠাৎ কবি হয়ে যাই, প্রেমট্রেম ছাড়াই। কবিতায় নজরুলের প্রকট ছায়া, শিক্ষকরা বলেন, ‘তুই তো নজরুলের পর আরেকটা বিদ্রোহী কবি হইতে যাইতেছস।’ আমি গর্বে স্ফীত হই।
প্রতিদিন চারপাঁচটা কবিতা লিখি। বন্ধুরা আরো বেশি লিখতে বলে। কখনো লিখিও। রবীন্দ্র-নজরুলের রেকর্ড ভাঙার স্বপ্ন দেখি।
কবিতার খাতায় ট্রাংক ভরে গেলো। চারদিকে কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে খুব দ্রুত।
ইতোমধ্যে কবিতা কিছুটা বুঝতে শিখি। তাই, একদিন ট্রাংক থেকে সবগুলো কবিতার খাতা (১৫-২০টার মতো) বের করে ছোটো ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলি, ‘এগুলো বেইচ্যা চানাচুর খাইয়া ফালাইস।’
মুদি দোকানদারের ছোটোভাই পরদিন দুপুরে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে, ‘সর্বনাশ হইয়া গেছিল খলিল ভাই।’ সবগুলো কবিতার খাতা আমার সামনে রেখে সে বলে, ‘দেখেন, আপনার ছোটোভাই এইগুলো বেইচ্যা আসছিল আমাগো দোকানে।’
আমি ওকে বলি, ‘এইগুলো নিয়া যাও, এইগুলো কবিতা না।’
আমার প্রায় সাড়ে চারশ কবিতা থেকে মাত্র ২০টার মতো রেখে বাকিগুলো ওভাবেই ফেলে দিয়েছিলাম।
কবিতা লেখার আরো কত মজার কথা আছে, যেমন আছে আপনাদেরও।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠে স্কুলের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করি। সেটি ১৯৭৯ সালের কোনো একটা জাতীয় দিবস ছিল। আর আমি হাইস্কুলের সর্বকনিষ্ঠ শ্রেণির অতি লাজুক স্বভাবের এক ছাত্র, সহপাঠী খবিরউদ্দীনের হাত থেকে ‘অগ্নিবীণা’ তুলে নিয়ে নাম লেখালাম কবিতা আবৃত্তিতে- ‘ধূমকেতু’। কনিষ্ঠ থেকে শুরু, এবং যথারীতি আমার নাম সবার আগে ঘোষিত হলো। মাইক্রোফোনের সামনে ছয়-সাতশ ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকগণের দিকে তাকিয়ে আমি তীব্র উত্তেজনা বোধ করি। আমার উত্তেজনা শীর্ষে উঠলো, যখন শুরু করলাম :
আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু...
আবৃত্তি শেষ হলে তুমুল করতালি আর অভিবাদন পেতে থাকি। খুব কৃতার্থ বোধ করি। আমার কাছে নিজের আবৃত্তি খুব আহামরি গোছের কিছু ছিল না, এর আগে পাঠ্যবইয়ের কবিতা পড়া ছাড়া কোথাও আবৃত্তি করার সুযোগও হয় নি। কিন্তু দর্শকদের প্রতিক্রিয়া থেকে আমি খুব আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি এবং ভাবতে থাকি, হয়ত আবৃত্তি ভালোই হয়েছে। তবে কনিষ্ঠ হওয়ার কারণে একটু বেশি করতালি পেয়ে থাকতে পারি, তা অনস্বীকার্য।
এই ‘ধূমকেতু’র পর থেকে নিজের ভেতর নতুন একটা বোধের জন্ম হতে থাকে। খবিরউদ্দীনের ‘অগ্নিবীণা’ বইটি বাসায় নিয়ে যাই। সেখান থেকেই ‘বিদ্রোহী’র সাথে পরিচয়; কিন্তু ‘বিদ্রোহী’র খ্যাতি ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে তখনো আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান ছিল না। তবে ‘অগ্নিবীণা’র কবিতাগুলো আগুনের ফুলকির মতো আমার সর্বান্তশরীরে জ্বলে উঠতে থাকলো। আমার নাগালে কখনো বইয়ের প্রাচুর্য ছিল না; আমাদের অজপাড়াগাঁয়ে কোনো গ্রন্থাগার ছিল না, দৈনিক পত্রিকা ছিল না; বাজারের বইয়ের দোকানগুলোতে পাঠ্যবইয়ের বাইরে ‘উপহার’ দেয়ার মতো কিছু বই দেখা গেলেও ওগুলো পড়ার প্রতি তখনো আমার কোনো আগ্রহ সৃষ্টি হয় নি। তাই অনেক অনেকদিন ধরে ‘অগ্নিবীণা’ আমার কাছে থেকে যায়। সব অনুষ্ঠানেই এ বই থেকে কবিতা আবৃত্তি করি।
পুরোদমে ‘ভূরি ভূরি’ কবিতা লিখতে শুরু করি নবম শ্রেণি থেকে। বিষয়বস্তু পুরোপুরি নজরুলীয়। শিক্ষকদের মতো বন্ধুবান্ধবরাও বলে- ‘তুই তো দেখি সত্য সত্যই ‘বিদ্রোহী’ কবি হইয়া যাইতেছস।’ খবিরউদ্দীন, আব্দুল করিম, জাহিদ, শের খান, সোহরাব, আমিনুল, বায়েজীদ নামক আমার কয়েকজন ক্লাসমেট নিয়মিত আমার কবিতা পড়তো, কবিতা লেখার জন্য তাগিদ দিত; প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার পথে কিংবা ক্লাসে যাওয়ার পর আমরা আমার কবিতা পড়তাম ও বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা করতাম
আমার খুবই ঘনিষ্ঠ ক্লাসমেট আমাদের গ্রামের জসিম, প্রতিবেশী খোর্শ্বেদ কাকা (যাঁর কাছে আমার পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়) ও প্রতিবেশী চাচাত ভাই মেহেদী হাসান, আমার কয়েকজন ছাত্র, যেমন ইসলাম খান, এবং কয়েকজন অনুগত ভক্ত, যারা সব সময় আমার সাথে লেগে থাকতো, যেমন আইয়ুব মোল্লা- নিয়মিত আমার কবিতা পড়তো। স্কুলে আমাদের বিজ্ঞান স্যার সফিকুল ইসলামও মাঝে মাঝে আমার কবিতা শুনতেন এবং আমকে খুব উৎসাহ দিতেন, এবং তিনি খুব কবিতাভক্ত ছিলেন।
দশম শ্রেণিতে একটা ম্যাগাজিনে আমার একটা কবিতা ছাপা হয়, নাম ‘হুঁশিয়ারী’। দুনিয়ার তাবত অত্যাচারীদের আমি হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম ঐ কবিতায় এ পোস্টটি লেখার সময় অনেক চেষ্টা করলাম সেই কবিতা থেকে দু-এক ছত্র মনে করার জন্য, কিন্তু অ্যান্টেনায় কিছুই ধরা পড়লো না। তবে ওটা একটা অগ্নিঝরা বিখ্যাত কবিতা ছিল এটা পড়ে স্কুলের মৌলভী স্যার মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, তর কবিতায় বিদ্রোহী বিদ্রোহী ভাব আছে রে!
ক্লাসমেট ও শিক্ষকসহ সবার বিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ মতামত ও উৎসাহে আমি দারুণ উজ্জীবিত হতে থাকি এবং দেখতে দেখতে একসময় ভীষণ ফুলেফেঁপে উঠলাম- নিজেকে অনেক বড়ো কবি মনে হতে লাগলো। এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পাঠ করি, হাততালিও কম জোটে না আমার আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবুলকে একদিন অনেকগুলো কবিতা পড়ে শোনালাম, এবং বললাম, আমার মতো এত ভালো কবিতা লেখার কোনো কবি বর্তমানে বাংলাদেশে নাই আবুল শুনে খুব খুশি হলো, ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো- কারণ, আমি ওর বন্ধু এবং আমি একজন বড়ো কবি, এটা নিশ্চয়ই ওর জন্য খুব গর্বের
এমন সময়ে স্কুললাইব্রেরির খোঁজ পাই; আমাদের স্কুলের খুব ছোটো এককোনায় কিছু বইপত্র আছে, তা এর আগে জানা ছিল না। স্কুল লাইব্রেরির দায়িত্ব ছিল সহকারী প্রধান শিক্ষক মান্নান স্যারের হাতে। তিনি লাইব্রেরির চাবি আমার হাতে দিয়ে তালা খুলে পছন্দমতো বই নিয়ে নিতে বললেন। আগেই বলেছি, সেই সময়ে এখনকার মতো দৈনিক পত্রপত্রিকা পাওয়ার কোনো সুযোগ আমাদের ছিল না। তাই সমসাময়িক কবিলেখকদের নামধাম জানার তেমন কোনো সুযোগও ছিল না। আমরা মূলত স্কুলপাঠ্য বইয়ে যেসব কবির কবিতা পড়েছি, তাঁদের ব্যাপারেই আগ্রহবোধ করতাম। আমি লাইব্রেরিতে ঢুকে বিভিন্ন বই নাড়াচাড়া করতে করতে একটা কবিতার বই পাই- ‘সুকান্ত সমগ্র’। তখনো পর্যন্ত সুকান্তের কোনো কবিতা স্কুলপাঠ্য বইয়ে আমরা পাই নি। লাইব্রেরিতে দাঁড়িয়েই বেশ কিছু কবিতা পড়ে ফেলি। এটা ছিল আমার জন্য এক বিস্ময়কর ভুবন। একেকটা কবিতা পড়ি, আর আমার ভেতর যেন বারুদ বিস্ফোরিত হতে থাকে। আমি আরেক নজরুলের সাক্ষাৎ পাই।
এরপর অনেকদিন পর্যন্ত আমি ‘সুকান্ত সমগ্র’তে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকি। বলতে ভুলে গেছি, এর আগে উৎপলচন্দ্র সাহা নামক আমাদের এক ইংরেজি শিক্ষক (যিনি বাংলা-ইংরেজি সবই পড়াতেন) প্রায়ই সুকান্ত ভট্টাচার্যের নাম বলতেন। তিনি একদিন ক্লাসে ‘ছাড়পত্র’ পাঠ করে শুনিয়েছেনও। তিনি সুকান্ত বন্দনায় খুব মুখর ছিলেন; এবং ‘ছাড়পত্র’ বাংলাসাহিত্যে একটা উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে, তিনি বলতেন। তবে তাঁর পঠিত ‘ছাড়পত্র’ শুনে আমি মোটেও মুগ্ধ হতে পারি নি। কারণ, ওটা একটা গদ্যকবিতা। গদ্যকবিতা সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল নেতিবাচক। ভাবতাম, আজকালকার কবিরা অন্ত্যমিল সৃষ্টি করতে পারে না বলেই কবিতার নামে যত্তসব গল্প লেখা শুরু করেছেন। আমি বড়াই করে বন্ধুবান্ধবদের বলতাম, ছন্দ না থাকলে সেটা কবিতা নাহ প্রতিভাবান কবিদের পক্ষে ছন্দ মেলানো কঠিন কিছু না। আমার অন্ত্যমিল সম্পন্ন কবিতাগুলো ওদের পড়ে শুনিয়ে বলতাম, তোরা দেখ, কত সুন্দর ছন্দে কবিতা লিখছি এবং আমার ঐ সময়ের কবিতাগুলো ছিল অন্ত্যমিলযুক্ত। কিন্তু ‘সুকান্ত সমগ্র’ হাতে আসার পর ‘ছাড়পত্র’ পড়ে আমি বিস্ময়ে ও মুগ্ধতায় আপ্লুত হয়ে উঠলাম। গদ্যকবিতা সম্পর্কে আমার ধারণা পালটে গেলো। আমি মুগ্ধ হতে থাকি- কীভাবে লিখলেন সুকান্ত এমন কবিতা! কবি-পরিচিতিতে তাঁর ২১ বছর বয়সে মৃত্যুর কথা লেখা রয়েছে। আমি অবাক হই; আমার বয়স কত- আমি নিজের বয়সের হিসেব করি আর ভাবি, ২১ বছর বয়সে কি আমি সুকান্তের মতো আগুনঝরা অন্তত একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারবো?
যেটা পড়ি সেটাই ভালো লাগে। বন্ধুদের ডেকে আবৃত্তি করে শোনাই। অনেকেই কবিতা বোঝে না, তবে আবৃত্তির জন্য বাহবা জানায়।
খবর, চারাগাছ, একটি মোরগের কাহিনী, সিঁড়ি, কলম, প্রার্থী, আগ্নেয়গিরি, লেনিন, অনুভব, সিগারেট, দেশলাই কাঠি, বোধন, রানার, আঠার বছর বয়স, হে মহাজীবন, বিদ্রোহের গান, পূর্বাভাস- এ কবিতাগুলো আমার খুব প্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু একটি মোরগের কাহিনী, সিঁড়ি, কলম ও দেশলাই কাঠি- এ কবিতা ক’টি আমার ভেতরে একদম গেঁথে গেলো। আমি কবিতা যা লিখি, সবই এ চারটি কবিতার আদলে হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো কবিতাকে অন্যটি থেকে আলাদা করতে পারি না, নিজের কবিতা হওয়া সত্ত্বেও। কখনো মনে হয়, সুকান্তের কবিতার একেকটা সংস্করণ লিখছি আমি; আমি সুকান্ত থেকে বেরোতে পারি না।
সেই সময়ে লেখা কিছু কবিতা আপনাদের জন্য এখানে দিলাম। কবিতা হয়েছে তা বলছি না, বলছি আমার ভেতর সুকান্ত কতখানি গেঁথে আছেন, সেই কথা।
প্রথম দিকে কবিতার নীচে তারিখ লিখে রাখতাম। এক খাতা থেকে আরেক খাতায় যেতে যেতে দেখি এখন শুধু সনটাই লেখা রয়ে গেছে।
এগুলো নবম-দশম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় লেখা, তবে কোনটি আগে, কোনটি পরে লেখা তা আজ আর বলার উপায় নেই।
শেষাংক
তোমরা মাংস খেয়ে উচ্ছিষ্ট হাড় ছুঁড়ে ফেলো আমাদের গায়
সে হাড় চিবুই
আর চেয়ে চেয়ে তোমাদের নিষ্ঠুর ভোজোৎসব দেখি
আমরা অসহায় ক্ষুধার্ত কুকুর
তোমাদের ছুঁড়ে ফেলা শুষ্ক হাড় আমরা চিবুই বটে
কিন্তু দুঃসহ যন্ত্রণায় হাহাকার করে ওঠে
আমাদের ক্ষুধার্ত উদর সারাক্ষণ : আমাদের মেটে না ক্ষুধা
অনেক কাল কেটে গেছে দেখতে দেখতে
তোমাদের নিষ্ঠুরতা।
আর কত দেখবো, বলো?
আমরা সইবো না আর,
চেয়ে দেখো :
আমাদের চোখে আজ আগুন জ্বলছে বিক্ষুব্ধতার
চেয়ে দেখো :
কী ভীষণ হিংস্রতায় কাঁপছে থরোথরো
সুতীক্ষ্ম আমাদের থাবা
অকস্মাৎ আমরা একদিন
তোমাদের ধরবো গলা চেপে।
*১৯৮৪
কতদিন অনশনে
আমার জঠরে আজ দুঃসহ যন্ত্রণা :
নিষ্ঠুর ক্ষুধার রাক্ষসীরা
ঝাঁটিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে কবে আমার কবিতাকে
আমি আর লিখবো না কবিতা, লিখবো না।
দু’মুঠো অন্ন জোটে নি সারাবেলা
বড়োই আনন্দহীন শুষ্ক এ কবিতা লয়ে খেলা,
এ শুধু ব্যর্থ প্রয়াস আনন্দকে আটকে রাখার
তোমাকে বিদায় দিলাম, কবিতা আমার।
কতদিন তুমি বন্ধু লিখবে কবিতা অনশনে?
কবিতার ফুল মুকুলেই ঝরে যাবে হৃদয়-কাননে।
আমার কাননে কত ফুল ফুটেছিল,
ঝরে গেছে সব
ক্ষুধার বায়সীরা কেবলই চেঁচায়, কেবলই রুক্ষ কলরব।
*১৯৮৪
একজন বাবার বিলাপ
জোটে নি কপালে আজ আটার লোঠানিও
আমার অবুঝ বাছাদের
হায়রে জোটে নি
জোটে নি
জোটে নি
কিছুই জোটে নি
মুখর শহরে অন্ন-গুদামে গুদামে
উদর সাধন করছো তোমরা
লক্ষ লক্ষ লোক
কত কাকচিল
শেয়ালকুকুর
ক্ষুধিত ভিখারি
অবীরা জননী
অনাথ বালক
একসাথে বসে ক্ষুধায় মেতে
এখানে তারা ডাস্টবিনের খুঁটছে পঁচা
আমিও বন্ধু আজ ও-দলের নতুন সাথি
ক্ষুধিত শিশুর অক্ষম পিতা
দুঃখবিধূর।
*১৯৮৪
আমি সেই দলে
একঝাঁক ক্ষুধার্ত মানুষ প্রতিদিন ডাস্টবিন খুঁটতো :
তোমরা আমাকে সেই দলে দেখেছিলে।
একসারি অসহায় ভিক্ষুক রাজপথে ভিক্ষে মাঙতো,
তোমরা আমাকে সেই দলে দেখেছিলে।
একজন নিরন্ন মা ফুটপাতে সারারাত কেঁদেছিল,
একদল নিঃস্ব জনতা, কুলি,
কয়েকজন পরিশ্রান্ত মাঝি
বুকের রক্ত জল করেছিল রোদ্দুরে,
তোমরা আমাকে সেই দলে দেখেছিলে।
একদিন ডাস্টবিন খুঁটছিলাম,
তোমরা থুথু ফেলেছিলে আমাদের গায়, ঘৃণায়।
ভিক্ষে চাইতেই
আমাদের প্রতি কঠিন কটাক্ষে তাকিয়েছিলে।
আমাদের নিরন্ন মাকে তোমরা কখনো একমুঠো দাও নি ভাত,
তোমাদের বুটের আঘাতে একদিন পিষ্ট হয়েছিলাম
আমরা দিনমজুরেরা।
অতিষ্ঠ জনতার দেখো চোখ, ধিক্ ধিক্ জ্বলছে আগুন।
উঠে আসছে ডাস্টবিনের ক্ষুধার্ত মানুষ,
ভিক্ষুকের প্রতিবাদী চিৎকারে কাঁপছে আকাশ
তোমাদের মুখ হতে লুটে নেবে গ্রাস অন্নহীনা মা,
জাগ্রত মানুষ, দেখো
আসছে...
তোমরা সবিস্ময়ে দেখবে- আজও আমি সেই দলে।
*১৯৮৪
মুক্তি
খাঁচার দুয়ার খুলে যে পাখি ছুটলো আকাশে
মুক্তির স্পর্শ পেতে
আমি তার কাছে পেয়েছি অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
শোনো কি আকাশে ঐ মুক্ত পাখির ডাক?
তরুণ কণ্ঠে তার
স্বাধীনতার বাজে সুর।
তোমরা গণ্ডির দ্বার খুলে দাও
দুর্গত লাঞ্ছিত প্রাণ যেখানে নিষ্ঠুর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে
মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে
তাদের মুক্তির দাও দিন।
নতুবা, মুক্তির মিছিলে কখনো যে-হাত হয় নি উত্তোলিত
সে-হাতে দেখবে বজ্রমুষ্ঠি,
দুরন্ত ত্রাসে যে কণ্ঠ কখনো করে নি প্রতিবাদ
অন্যায়ে,
হুংকারে আজ সে-কণ্ঠ উঠবে গর্জে,
যে-পথে পায়ের শব্দ শোনো নি কোনোদিন
প্রচণ্ড পদধ্বনি ধ্বনিবে সে পথে
ভেঙে ফেলবে গণ্ডির দ্বারকা
তারপর আনবে মুক্তি।
*১৯৮৪
সুখ
তোমরা যদি
লুটে নিয়ে যাও আমার হাজার কবিতার কলি
আমি দুঃখ করবো না।
তোমরা যদি
লুটে নিয়ে যাও আমার গানের সমস্ত সুর
আমি একটুও হবো না বিষণ্ণ।
তোমরা যদি
লুটে নিয়ে যাও সকল রিক্থ আমার
আমি কাঁদবো না কখনো।
আমার শিশুর রুপালি হাসিটুকু তোমরা
নিও না কেড়ে
সকল রিক্থ ঐ শিশুটি
ওর মিষ্টি হাসিতে লুকিয়ে আছে
আমার কবিতার কলি, গানের সকল সুর।
*১৯৮৪
অর্থী
আমি পাষাণের চেয়েও নিষ্ঠুরতা দেখেছি
তোমাদের হৃদয়ে। পথের ধুলোয় লুটিয়ে নিত্য কেঁদেছি
আজন্ম এক অনাথ বালক; আমাকে
আদরে কোলে তুলে স্নেহশীলা জননীর মতো
বোলাও নি মাথায় হাত
হৃদয়হীনা তোমরা রমণীরা।
তোমাদের হৃদয়ের নিবিড় সান্নিধ্য চেয়েছিলাম, তোমাদের
নিস্প্রেম প্রাণের মৃণালতা
আমার হৃদয়কে বিক্ষত করেছে প্রতি পলে।
তোমাদের একটি শুষ্ক প্রাণ আছে, প্রেমপূর্ণ
মানুষের মন তোমাদের নেই।
আমাকে কে দেবে এতটুকু স্নেহ-ভালোবাসা?
আমার এ বুক বেদনায় জর্জরিত, অযুত বছরের তৃষ্ণার্ত আমি
হৃদয়ের পেয়ালা হতে কেউ
আমায় দিলে না ঢেলে একবিন্দু স্নেহের শরাব।
*১৯৮৪
২
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৭ বছর বয়সে লেখা ছড়া ৮০/৮১ বছর বয়সে পড়ে হেসেছিলেন, নাকি আফসোস করেছিলেন, সে বিষয় আমার জানা নেই। তবে আমি নবম-দশম শ্রেণিতে লেখা কবিতাগুলো আমার প্রথম বইয়ে (৩৫ বছর বয়সে) অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম সগর্বেই। কেননা, আমার মৃত্যুর পর ‘খলিল মাহ্মুদের অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র’ নামে কোনো বই প্রকাশিত হবার সম্ভাবনা নেই; তাই জীবদ্দশায়ই এগুলোকে বইয়ে জায়গা করে দিলাম। উপরের কবিতাগুলো আমার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘অন্বেষা’য় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর নীচের কবিতাটি খুব সম্ভবত ১৯৮৩’র শেষের দিকে বা ১৯৮৪’র প্রথম দিকে লেখা।
এ কবিতাটা নিয়ে একটা মিষ্টি স্মৃতি আছে। সে সময়ে খুলনা বেতারে প্রতি শুক্রবারে দুপুর শোয়া একটায় ‘অঙ্কুর’ নামে ১৫-২০ মিনিটের একটা সাহিত্যের অনুষ্ঠান হতো, যাতে নবীন লিখিয়েরা লেখা পাঠাতেন, আর তা সংক্ষিপ্ত সমালোচনাসহ পাঠ করে শোনানো হতো।
সেখানে আমিও কবিতা পাঠাই। কবিতা পাঠিয়ে অস্থির হয়ে সবান্ধব শুক্রবারের ‘অঙ্কুর’ শোনার জন্য বসে থাকি; যথারীতি শুক্রবারে মন খারাপ হয়, সবার কাছে লজ্জা পাই আমার কবিতা প্রচারিত না হবার জন্য।
এভাবে বছর দুই তো হবেই, চলে গেছে। কত কত পত্রিকায় লেখা পাঠাই, কোনোদিনই তা ছাপা হয় না।
তিন্নিরা আমাদের প্রতিবেশী, তিন ঘর পরই ওদের ঘর। ওদের একটা রেডিও ছিল; আমাদের সাত বাড়ির মধ্যে ঐ একটাই। তিন্নির কাছেই আমি সবচেয়ে বেশি লজ্জা পেতাম, কারণ, আমার কবিতা ‘অঙ্কুর’-এ শোনার জন্য তিন্নির উৎসাহ ছিল সর্বাধিক, আর তিন্নিই খুব ডামাডোল করে আমাদের সবাইকে ‘অঙ্কুর’ শুনতে ডাকতো।
সেদিন দুপুরে তিন্নি চিৎকার করে বলে উঠেছিল- ‘খলিল ভাইয়া, এই যে আপনার কবিতা হচ্ছে রেডিওতে....।’ তিন্নির বড় ভাই, তিন্নির মা, আমি ওদের উঠোনে ছিলাম... দিগ্বিদিক সব ফেলে তিন্নির কাছে আমি ও আমরা ছুটে যাই... আমি হাঁপাচ্ছি, আর শুনছি একটি মিষ্টি মেয়েকণ্ঠ আমার কবিতাটা পড়ছেন। আমি নিশ্বাস ফেলতে পারি না, এত উত্তেজনা। কবিতা পাঠ শেষে মেয়েটার অনেকগুলো ভালো কথার মধ্যে যেটা আমাকে উদ্বেলিত করলো তা হলো... না থাক, ওটি খুব লজ্জার কথা।
এরপর প্রায় নিয়মিত আমার কাঁচা কবিতা ‘অঙ্কুর’-এ প্রচারিত হতো। আর বিশ্বাস করুন, তিন্নিও আমার প্রতি দুর্বল হতে থাকে...
মুক্তি
আমাকে তোমরা যদি
নির্বাসন দাও আলেকজান্ডারের নির্জন দ্বীপে
আমি বরণ করে নেব।
আমাকে তোমরা যদি
অনেক অন্ধকারে বন্দি করে রাখো একাকী, যেখানে জোনাকিরাও
জ্বালে না আলোর একটি প্রদীপ
আমি নীরবে সইবো অন্ধকারের অতিষ্ঠতা।
তবু তোমরা আমাকে পৃথিবীর এই কোলাহল হতে
ছুটি দাও, যেখানে একটি ক্ষুধিত শিশুর আর্তনাদ শুনে
দুঃসহ বেদনায় কেঁদে ওঠে আমার হৃদয়
এবং
একটি নৃশংস নরপশুর প্রচণ্ড গর্জনে
আমার বুক
নিমেষে তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে তার তাঁজা রক্তের নেশায়।
৩
একাদশ শ্রেণির শেষের দিকে আমি প্রেমে পড়ি; আমার প্রথম নারী, যে আমার জীবনের মোড় সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিয়ে গেলো।
হারিকেনের ঘুমু আলোর কাছে মাথা নুয়ে আমি রাত জেগে চিঠি লিখি। পাতার পর পাতা দীর্ঘ হয় সেই চিঠি। অংকের খাতা পুরোটাই কখনো শেষ হয়ে যায়। খুব ভোরে বাহক সেটা প্রেমিকার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসে, বিনিময়ে তার কাছে থেকে পাওয়া আরেকটা সুদীর্ঘ চিঠি।
আমার ক্লাস পারফরমেন্স ছিল দুর্দান্ত। হোস্টেল জুড়ে আমার নাম ছিল। হোস্টেল সুপারের সুদৃঢ় ধারণা, মেধাতালিকায় প্রথম দু-একজনের বাইরে আমি কিছুতেই বেরোবো না।
আমার প্রেম আমাকে বই-বিমুখ করলো। আমার মুখ ভরে গেলো দাঁড়িতে। যুবকেরা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে দাঁড়ি রাখে, আমি প্রেমগ্রহণের প্রথম দিন থেকেই শ্মশ্রূসজ্জিত হতে থাকি।
প্রেমে খুব কষ্ট। ভয়ানক বেদনা। মনের উথালপাথাল উত্থান আর পতন; অস্থিরতা। এমন অস্থির সময়ে আমি যা লিখি, তাই কবিতার মতো হয়ে যায়।
তাকে একদিন ছোট্ট একটা চিঠি দিলাম। আমি কী এক যন্ত্রণায় মুমূর্ষুপ্রায়! সেই চিঠি ফেরত এলো তার পরদিন। চিঠির অপর পাতায় ওর খুব কাঁচা হাতের লেখা : ‘আমাকে এখন তোমার কাছে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে।’
সেটা ১৯৮৬ সনের কথা। ট্রাংকের পুরোনো জিনিস ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হঠাৎ ওটা চোখে পড়ে, এক বান্ডিল চিঠির সবগুলোর নীচে সেই চিঠি। চিঠিটা আদতে চিঠি নয়, চিঠির অধিক অন্য কিছু। চিঠিটা একটা কবিতা হয়ে উঠেছে। ঐ সময়ে আমার বেশকিছু চিঠিই কবিতা বা কবিতার মতো হয়ে যেত। চিঠিটা পরে ‘দেয়ালিকা’ নাম নিয়ে আমার একটা কবিতা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়, যা ‘অন্বেষা’ কাব্যে স্থান পেয়েছে।
‘দেয়ালিকা’ নিয়েও সুখস্মৃতি আছে।
আমার প্রেম ততদিনে প্রায় হাওয়া হয়ে গেছে। পরীক্ষার সময় মানসিক যন্ত্রণায় পরীক্ষা ঠিকমতো দিতে পারি নি, কারণ, পরীক্ষা শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে আমার প্রেমিকার বিয়ে ঠিক হয়ে যায় অন্য নায়কের সাথে; প্রেমিকা কাঁদে, খবর পাঠায় গ্রামে গিয়ে তাকে উদ্ধার করার জন্য; আমি পরীক্ষা ফেলে যেতে পারি না, আবার পড়ায়ও মন বসাতে পারি না। ফলাফল- খুব টেনেটুনে পরীক্ষা দিলাম, এবং মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া তো দূরের কথা, পাশ করতে পারবো কিনা সেটা নিয়েই সন্দেহ দেখা দিল। লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুদিনের মাথায় প্রেমিকা পালকিতে চড়ে অত্যন্ত উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে এবং আমার হৃৎপিণ্ড শতচ্ছিদ্র করে স্বামীর বাড়ি চলে গেলো। আমি দেবদাস হলাম। বুকের যন্ত্রণা বোঝানো যায় না; কীভাবে বেঁচে থাকবো বাকিটা জীবন? এত কষ্ট সহ্য করা যায় না।
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে থাকি। খুব কষ্টে ভান করি যে আমার কোনো কষ্টের কাহিনি নেই। আর কবিতা লিখি যথারীতি। পত্রিকায় পাঠিয়ে উন্মুখ হয়ে থাকি ছাপার হরফে নিজের নাম দেখবো বলে, কিন্তু আশা পূর্ণ হয় না কোনোদিনই।
খুলনা বেতারের ‘অঙ্কুরে’র মতো ঢাকা বেতারে বিকেল চারটায় ‘অন্বেষা’ নামক একটা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান হতো। ‘অন্বেষা’র একটা অংশ ছিল ‘সৃজনী’ যার দৈর্ঘ্য ১২-১৫ মিনিট; এতে নবীন লিখিয়েদের লেখা পাঠ ও সমালোচনা করা হতো। আমি ‘সৃজনীতে’ও কবিতা পাঠাই। মাঝে মাঝেই সেখানে আমার কবিতা নির্বাচিত ও প্রচারিত হয়।
অষ্টম ও দশম শ্রেণির দু’ভাইবোনকে পড়াই এইচএসসির পর মাস তিনেক। ওদের কাছে আমার কবি-কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল, কোনোদিনও পত্রিকায় লেখা বের হয় নি বলে। তবে, আমার কবিতা ‘অঙ্কুর’ ও ‘সৃজনী’তে নিয়মিত প্রচারিত হয়, এই কথা জোরের সাথে বলে ওদের কাছে নিজের ট্যালেন্ট জাহির করি, আর ওরা আমার কথায় মুখ টিপে হাসে; কারণ, ওরা ভেবে নেয় ওদের বাহবা পাবার জন্য এসব কথা আমি বানিয়ে বলছি।
একদিন বৃহস্পতিবারে ওদের পড়াচ্ছিলাম। পাশের ঘরে ছোটো রেডিওটা মৃদু স্বরে বাজছিল, শুনছিলাম। ‘অন্বেষা’র সময়। আমার কান খুব সচেতনে খেয়াল করছিল কখন ‘সৃজনী’ শুরু হয়, আর তাতে আমার নাম ভেসে ওঠে।
ওদের আব্বু খুব সাহিত্যরসিক মানুষ ও অমায়িক ভদ্রলোক; তিনি আমার কবিতা পড়েন আর আমার মধ্যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখেন লিটন ভাই- ওদের বড় ভাই (ঢাকা কলেজে আমার রুমমেট ও এক ক্লাস সিনিয়র), মিল্টন- ওদের মেঝভাই (ঢাকা কলেজে কমার্সে পড়তো, আমার সমক্লাসী; আমার সায়েন্স গ্রুপ ছিল), ওদের বড় দুই বোন (আমার এক ও দুই ক্লাস জুনিয়র)- ওরা টিটকিরি দেয় আর মুচকি হাসে আমার কবিতার কথা উঠলেই- কাগজে কবিতা না উঠলে তাকে কবি বলা আর কাক বলা একই কথা কবে ছাপার অক্ষরে আমার নাম ওদের সামনে তুলে ধরে মিষ্টি প্রতিশোধ নেব, মনের মধ্যে এই বাসনা খুব যন্ত্রণা দেয়।
আমি ওদের পড়াচ্ছি। ‘সৃজনী’র কথা ভুলে গেছি। এমন সময় লিটন ভাই রেডিও হাতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকলেন : ‘খলিল, এই যে তোমার কবিতা বলতেছে।’ আমি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠি। এর চেয়ে মোক্ষম মুহূর্ত আর হয় না। ‘সৃজনী’তে ‘দেয়ালিকা’ পাঠ হচ্ছে, আমি উত্তেজনায় কাঁপছি; দেখি ওদের বাবা, মা, পড়ালেখা না-জানা দাদি, ওদের মেঝভাই, ওদের বড়ো দুই বোন, সবাই এসে জড়ো হয়েছেন; তাঁদের চোখেমুখে বিস্ময়, ঘোর- আমার কবিতা তাহলে রেডিওতে প্রচারিত হয়! সবাই অধীরভাবে বসে শুনছেন আমার কবিতা : মাত্র আড়াই মিনিটের উচ্ছ্বাস।
কলেজ হোস্টেলে লিটন ভাই ছাড়াও শরীত উল্লাহ নামক আমার হাইস্কুলের এক ক্লাস সিনিয়র এক বড়ো ভাই ছিলেন, এবং অনার্স পড়ুয়া আরেকজন বড়ো ভাই (নাম ভুলে গেছি) সিট না পেয়ে আমাদের সাথেই ডাব্লিং করতেন। শরীয়ত ভাই এবং অনার্সের ভাইও আমার কবিতা নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, অনার্সের ভাইয়ের তখন প্রেম চলছিল, তিনি কিছুদিন পর পরই আমার কবিতার খাতা থেকে বেছে বেছে কবিতা নিয়ে তাঁর প্রেমিকার কাছে পাঠাতেন ‘ছায়া’ নামক কবিতাটি তাঁর অনেক প্রিয় ছিল।
নীচে ‘দেয়ালিকা’সহ অনেকগুলো কবিতা দেয়া হলো। মূলত এটা আমার নিজস্ব সংকলন, তবে কোনো পাঠক দু-এক লাইন পড়লেই আমি খুশি; কেউ না পড়ে পোস্ট ওপেন করে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলেও আমি খুশি এগুলোর রচনাকাল হলো ১৯৮৪-১৯৮৬, নবম-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে।
‘আশা’ ও ‘স্বপ্নকুসুম’ কবিতা দুটিতে দুটো সংকেত দেয়া আছে। খুঁজে বের করে দেখতে পারেন সংকেত দুটো কী কী
দেয়ালিকা
আমার বক্ষে যন্ত্রণার বৃক্ষেরা নিত্য শেকড় মেলে। দুঃখেরা
জয়ের মিছিল করে প্রচণ্ড জ্বালাতনে
হৃদয়ে রঙিন ফাল্গুন নামে না এখন
প্রেমের ফোটাতে ফুল। বুকের পিঞ্জরে সতত ঝাপটায় ডানা
ভালোবাসার বন্দি পাখিরা সব
দিনান্তে এখন নামে না কবিতাসন্ধ্যা আমার ভুবনে।
হাসনাহেনার বনে দুজনে কাটাবো প্রহর- মেলে না মধুর অবকাশ এমন
মুক্তির নেশায় দুঃখগণ্ডির মাঝে আমি মত্ত উন্মাদনায়
তবু ব্যর্থ বার বার, তাই প্রাচীরে লিখে যাই
আমার ব্যর্থতার বিরাট ইতিহাস
এখন একান্ত দুঃসময়ে আমার এক দুঃখিনীর কথা মনে পড়ে
কতকাল হয় নি খোঁজ নেয়া তার
জানি না, কত রাত সে কাটিয়েছে আমার পথে চেয়ে
তেমন সুখ কি আর পেরেছি তাকে দিতে
হায় অসহায় প্রেমিক আমি!
*১৯৮৬
সেই সময়
(১৯৮৬ সাল। ঢাকা কলেজ, ১০১ নম্বর উত্তর ছাত্রাবাস। একজন টোকাই প্রতিদিন
আমাদের হোস্টেলের সামনে ময়লা কুড়াতো, ডাস্টবিনে খাবার খুঁটতো)
প্রতিদিন হোস্টেলের বারান্দায়
কুড়োয় সে কাগজ। কখনো চেটে খায়
কাগজে লেগে থাকা উচ্ছিষ্ট সালুন কিংবা হালুয়া।
কখনো-বা নর্দমায় ফেলে দেওয়া
পঁচা রুটি কুড়িয়ে সে খায়, যদি পায়।
নোংরা-ইতর বলে থুথু ফেলি আমরা তার গায়।
তবু সে প্রতিদিন আসে
আমাদের হোস্টেলের বারান্দার পাশে।
কাঁধের ওপর দিয়ে তার
পিঠে ঝোলে বাম হাতে মুঠিচাপা চটের ঝুলি। বার বার
উবু হয়ে একটি একটি করে
কাগজ কুড়িয়ে ঝুলির ভেতরে
সে পুরে রাখে।
ঝুলিটার আস্তে আস্তে বুক ফুলে উঠতে থাকে।
তখন তার চোখ দেখে মনে হয়,
এক ঝুলি কাগজেই এ টোকাই একান্ত বিশ্বকে করবে জয়।
কখনো রাতের তিন প্রহরে হোস্টেলে ফিরি-
সামনে একধাপ সিঁড়ি
এবং তার নীচেই আধখণ্ড
ইটে মাথা রেখে তীব্র শীতে কিংবা মশার প্রচণ্ড
উৎপাতেও শুধু প্রাণপ্রিয় ঝুলিটাকে গায়ে জড়িয়ে
টোকাইকে দেখি কেমন নিশ্চিন্তে আছে ঘুমিয়ে।
কখনো সিঁড়ির ধারে, কখনো-বা বিরান ফুটপাতে
এমনি দেখেছি তাকে অজস্র রাত-বিরাতে-
এমনি সে বেঁচে আছে, এমনি সে রাত্রি কাটায়।
এ অনাথ কিশোর জানে, এ ধরায়
সে একা, লোকারণ্য এ বিশাল পৃথিবীতে
তার কেউ নেই একবিন্দু স্নেহস্পর্শ দিতে।
তবুও সে বাঁচতে চায় পথে পথে কাগজ কুড়িয়ে আর
ডাস্টবিনে খুঁটে খুঁটে আমাদের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খাবার ।
এমনি সময় চলে গেছে, এমনি সময় চলে যায়, তবুও কারো
একটুও সময় যেন নেই কিঞ্চিৎ ভাববার-
জ্বরাক্লিষ্ট, নামগোত্রহীন এ বালকেরও সাধ আছে পৃথিবীতে বাঁচবার।
এমনি কেটে গেছে বহুকাল,
পৃথিবীর সভ্যতার আজও সে পায় নি নাগাল।
তবুও মনে হয়,
সুনিশ্চিত একদিন আসবেই সময় :
হয়ত কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে,
কিংবা ১৬ই ডিসেম্বরে,
কিংবা ধরুন কোনো এক ২৬শে মার্চের উজ্জ্বল সকালে
জেগে উঠবেন উদ্ভাসিত, সহৃদয় একজন,
শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়াবেন তিনি, বুকে রাখবেন হাত,
তারপর করবেন দৃঢ় উচ্চারণ :
এ আমার অঙ্গীকার- ডাস্টবিন হতে
অসহায় এ শিশুকে তুলে আমি আনবো রাজপথে,
আমার শিশুদের সাথে
একপাতে
তাকেও তুলে দেব সুষম খাবার;
তার
ছেঁড়া কাগজের ঝুলিটাকে ফেলে সুর্য-খচিত ঐ হাতে
তুলে দেব একটি বই, জীবনের কুসুম ফোটাতে।
• ১৯৮৬
এমন একটি ছবি
এমন একটি ছবি আঁকে নি কোনো শিল্পী :
যেখানে পাহাড়ের কোলে
ছলছল ঝরনাধারার রোদে ঝিলিমিলি
উদার আকাশে
চপলা মেঘ-পরীদের মত্ত নাচানাচি
কিংবা
রুপালি নদীর তটে তটে
হাওয়ায় হাওয়ায় দোদুল সাদা কাশবন।
এমন একটি ছবি আঁকে নি কোনো শিল্পী :
যেখানে সবুজে ঘেরা
হাজার পাখির একটি নিবিড় বন
ঝিলের জলে
সাদা সারসের এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যাবলি
মাঝিরা রঙিন পাল তোলে নায়ে পুবালি বাতাসে
কাজল দিঘিতে
প্রস্ফুটিত একটি শাপলার মোহন হাসি
কৃষানের হাতে ধানের একগুচ্ছ সোনালি শিষ
এবং
সারি সারি পাটের সবুজ বীথি।
এমন একটি ছবি আঁকে নি কোনো শিল্পী।
অথচ এই ছবিটি
আমি প্রতিদিন নয়ন ভরে দেখি।
তুমি যদি ছবিটি দেখতে চাও
একবার তাকাও এই বাংলায় :
কোনো নিপুণ শিল্পীর তুলিতে আঁকা নয়,
অথচ কেমন সতেজ
শ্যামল সুন্দর এই ছবিটি।
• ১৯৮৬
অব্যক্ত
দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি-
আমার তখন সামনে ধু-ধু পথ,
করুণ চোখে তাকিয়ে ছিলে প্রিয়ে,
বিদায় নেবার পাই নি ফুরসত।
অনেক আশায় এসেছিলে জানি
বলতে তোমার কী জানি কোন কথা,
সেই কথাটি আর হলো না জানা-
আর গেলো না বুকের অস্থিরতা।
• ১৯৮৬
স্বপ্নকুসুম
হাজার রজনি একাকী হয়েছে পার,
ওখানে আজও বাসর-দুয়ার খুলে
আমি সাজিয়েছি আমার ফুলদানিতে
রাতের বাগানে রজনিগন্ধা তুলে।
নীরব নিশীথে মলিন দীপের শিখায়
আমি জেগে আছি কবিতার খাতা হাতে,
মাতাল গন্ধ রজনিগন্ধা ছড়ায় :
কেউ যদি হতো নিঃসঙ্গ এ রাতে!
ভাবি যত কথা যত কবিতাই লিখি
লক্ষ্মী কে মেয়ে করে নাচানাচি এসে
বাগানে সহসা ডাকলো ভোরের পাখি-
ফুটেছে সেখানে স্বপ্নকুসুম হেসে।
• ১৯৮৬
প্রতীক্ষা
প্রতিটি প্রহর কাটছে প্রতীক্ষাতে
সহসা সে বুঝি ডাকবে শেকল নেড়ে,
অমনি দরজা খুলে দিয়ে আচানক
দেখবো হয়ত তারি অপরূপ মুখটি।
সাতটি রঙে কত যে স্বপ্ন আঁকি,
মনের বাসর রঙিন কুসুমে সাজাই-
আমার কণ্ঠে কে পরালে প্রেমমালা?
অপরূপা সেই আমার ‘স্বপ্নিলা’ কি?
সমীরে কী যেন স্বনন শুনেই কাঁপি-
ও কি বাজে তার কাঁকনের রিনিঝিনি?
কোথায় মিলায় বাতাশের শোঁশোঁ ধ্বনি,
সে যে আসে না, ডাকে না : দুয়ার খোলো।
এমনি অনেক ব্যর্থ প্রহর গোনি,
পাশের শয্যা বিষম শূন্য খাঁ-খাঁ,
বুকের ভেতরে কী যে দুঃসহ জ্বালা,
শুধু প্রতীক্ষা : আসবে সে কতদিনে।
• ১৯৮৬
ছায়া
আমি পৃথিবীতে
জন্মেছিলাম হৃদয়ের প্রেম ঢেলে দিতে
তৃষ্ণার্ত অন্তরে তোমার।
যুগের যন্ত্রণা-তিরে বিক্ষত আমি বার বার,
তাই পারি নাই
কবিতা-সন্ধ্যায় হাসনাহেনার বনে তোমার পাশে নিতে ঠাঁই।
আমার এ অক্ষমতা ক্ষমা করো যদি,
শান্তি পাবে আমার এ বহ্নিমান মন, হে দরদি।
আমার মৃত্যুর পরে রঙিন চরাচরে
আমাকে খোঁজো না ভুল করে।
যেখানে অতিষ্ঠ মানুষেরা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে
উদ্যত হাতে
মুক্তির সংগ্রামে মাতে,
সেখানে দেখবে সেই জাগ্রত জনতার মাঝে
আমার ছায়া পড়ে আছে।
• ১৯৮৬
আশা
এখনো ফুল ফোটে
হাসনাহেনার বনে,
ওখানে এখনো সে
আশায় সঙ্গোপনে
রাতের নির্জনতায়
নীরবে প্রহর গোনে।
আমার বাহুতে বন্ধন,
রক্তে উত্তেজনা,
জন্ম-জন্মান্তরের
নরক-যন্ত্রণা,
মেঘের মুক্তি-নেশায়
আকুল উন্মাদনা।
মিলন-মুক্তি শুনি
তুফানে প্রচণ্ড বাজে
মাটির কাঁপিয়ে বুক
রিক্ত প্রাণের মাঝে,
হয়ত একদা রাতে
বঁধুকে পাবই কাছে।
• ১৯৮৬
জানালাটি বন্ধ থাক
[আমি তখন একাদশ শ্রেণির দ্রোহগ্রস্ত এক যুবক। আমি তখন একটা ‘দিয়াশলাইয়ের কাঠি’, বিন্দুঘর্ষে জ্বলে উঠে ছারখার হবার মতো অবস্থা। হতাশা ও সম্ভাবনার মাঝখানে ভবিষ্যৎ তখন জ্বলছিল। এমন সময়ে আমি এ কবিতাটি লিখি। আমার ভালো লাগে এই ভেবে যে, আমার বন্ধুমহলে কবিতাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আবদুল করিম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ কবিতাটি আবৃত্তি করতো। এখনো আবদুল করিমের কণ্ঠস্বর আমি যেন শুনতে পাচ্ছি।]
ঐ জানালাটি প্রতিদিন খোলা থাকতো, ঐ পথে প্রতিদিন
আমার চলতো আনাগোনা
তুমি প্রতিদিন জানালার পাশে থাকতে দাঁড়িয়ে-
তুমি আমাকে দেখতে।
কখনো কোথাও হতে
যদি গান গেয়ে গেয়ে আমি ফিরতাম,
আমার কণ্ঠস্বর শুনে তুমি তোমার বন্ধ জানালাটি খুলে দিতে
এবং আমাকে দেখতে।
যখন জোসনা রাতে ও-পথে আমার আনাগোনা চলতো,
বাবা ও মায়ের চোখের কঠোর শাসন এড়িয়ে
তুমি তখন চাইতে দরজা পার হতে, তবু পারতে না।
তখন পড়তে বসে থুথু ফেলার ছলে জানালার ফাঁকে চাইতে
এবং আমাকে তুমি দেখতে।
যদিবা কখনো দক্ষিণ বাংলোয় গিয়ে বসতাম, আমাকে ঘিরে
কৌতুকহাস্যে মেতে উঠতো ছোটোরা সবাই।
তুমি তখন বলতে,‘পরী, পড়তে বসো, লজেন্স দেব।
অথবা সখীদের ডাকতে, ‘আয়লো রূপা।’
কিংবা কখনো নিজেই
সে-ঘরে ঢুকে বলতে, ‘কে যে বইগুলো এ ঘরে এনে রাখে’
আমি ঠিক বুঝতে পেতাম, আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই
তোমার এই অপ্রয়োজনীয় সংলাপমালা।
কেন যে কখনো পারি নি সাড়া দিতে তোমার ডাকে,
রাখতে পারি নি চোখে চোখ :
ওগো, এ আমার অহংকার নয়,
হয়ত অনেক কালের পুঞ্জীভূত অভিমান কোনো, যা তুমি জানো
কিংবা জানো না,
কোনোদিন জানবে না অন্য আর কেউ।
আজ ভুলে গিয়ে সব মান-অভিমান
আমি এসে দাঁড়িয়েছিলাম তোমার জানালার পাশে,
চোখের ভাষায় বলতে অব্যক্ত বহু কথা।
অথচ আমার মৃদু পদধ্বনি শুনে তোমার খোলা জালানাটি
আজ সপাট করে বন্ধ করে দিয়েছো, কেন জানি না।
তোমার জালানাটি বন্ধ থাক :
কখনো ভুল করেও আর খোলো না আমাকে দেখার জন্য
এ পথে আমি আর আসবো না…
• ১৯৮৬
আমাকে মনে রেখো না
আমাকে মনে রেখো না, যাকে কখেনো পাবার নয়
তার কথা ভেবে কী লাভ, বলো?
নীড়হারা হয়ে কোনো এক দুরন্ত ঝড়ে
এসেছিলাম আমি এক বিপন্ন পাখি।
কখনো আবার যদি ফিরে পাই সেই হারানো পথের দিশা,
তাই চলে যাই, আমাকে মনে রেখো না।
তোমার দুয়ারে আমি ক্ষণিকের জন্য এসেছিলাম,
যতটুকু ভালোবেসেছিলাম
তার সবটুকু হৃদয় নিংড়ানো আমার।
ক্ষণিকের এই প্রেম, ক্ষণিকের এইসব স্মৃতি
শুধু কাঁদাতেই জানে, তাই আমাকে মনে রেখো না।
বকুলের ফুলে যে মালা গেঁথেছিলে
সে আমাকে পরাবার নয়।
কী লাভ জানালায় ঝুলিয়ে রেখে গন্ধহীন শুখনো সে মালাটি?
সে মালাটি ছিঁড়ে ফেলো তুমি।
আমি বহুদূর চলে যাব :
তোমার চোখের আড়ালে যখন চলে যাব
জানি, জানালায় থাকবে চেয়ে উদাস আকাশের পানে;
তখন অলস দুপুরে ক্লান্ত ঈগলের কান্নায় তোমার চোখেও
জল আসবে জানি। তখনও
আমাকে চেয়ো না নিবিড় করে।
আমাকে আর মনে রেখো না, যাকে কখনো পাবার নয়
তার কথা ভেবে কী লাভ, বলো, তার কথা ভেবে কী লাভ?
• ১৯৮৬
কেমন ছড়া
কেমন মজা ভাই!
নুন মরিচে পান্তা এবং
আটার লোঠানি খাই।
দারুণ মজা ভাই!
কেমন সুখে থাকি!
ঘরের ভেতর ঢুকে শেয়াল
করেন ডাকাডাকি।
বেশ তো সুখেই থাকি!
কেমন পোশাক গায়!
তালির ওপর একশ তালি
দেখতে সবাই পায়!
রাজার পোশাক গায়!
কেমন আপন জন!
প্রাণটি খুলে ডাকটি দিলে
কেউ না কথা কন!
সবাই আপন জন!
লোকটা কেমন বটে!
একটুখানি হাওয়াতেও
ধাক্কা খেয়েই মটে।
তাগড়া পুরুষ বটে!
হ্যাঁ ভাই, তাগড়া জোয়ান বটে!
• ১৯৮৬
ক্ষুধার জন্য
যখন ক্ষুধায় উদর হা হা করে
ভাতের হাঁড়ি থাকে শূন্য পড়ে
ভাবনা তখন বিরক্তিতে ভরে
প্রিয়ার মুখও কোথায় লুকিয়ে থাকে।
আটা ও লবণে মা লোঠানি রাঁধেন
বাসন ভরে ভাইবোনদের সাধেন
খায় না ওরা- যখন তিনি কাঁদেন
তখন ঝেঁটে তাড়াই কবিতাকে।
বৃদ্ধ বাবা যখন করুণ বেশে
সাঁঝের বেলায় ফিরেন কামলা বেচে
দেখি তাহার সূর্য ডুবে গেছে
চক্ষে আমার বন্যা তখন ডাকে।
এখন আমার উদর হা হা করে
কাজ জোটে নি সারা শহর ঘুরে
ঐ যে রঙিন পায়রাগুলো ওড়ে
খাব গিলে মস্ত দালানটাকে।
• ১৯৮৬
রাত্রি জাগরণ
পৃথিবী ঘুমায়, বুক জুড়ে তার নিজ্ঝুম নীরবতা,
আমি রাত জেগে লিখি মানুষের বেদনার কিছু কথা।
আঁধার রাতের স্তব্ধতা চিরে উদাসীন এ বাতাসে
মা-হারা শিশুর রোদনের সুর দূর হতে ভেসে আসে।
আমি শুনি এক অবীরা মায়ের চাপা কান্নার ধ্বনি
সম্বলহীন বৃদ্ধ পিতার দীর্ঘশ্বাস শুনি।
বিরহের কাল গুনে গুনে কাঁদে বিরহিনী কোন নারী,
সারা নিশিরাত আমি শুনি শুধু বেদনার সুর তারি।
মাথা গুঁজবার আশ্রয়টুকু পায় নি সর্বহারা,
দ্বারে দ্বারে ঘুরে একটি পয়সা পায় নি ভিক্ষে যারা,
যাদের দু’মুঠো আহার জোটে নি, জঠরে ক্ষুধার জ্বালা,
তাদের বুকের শত যন্ত্রণা আমারও এ বুকে, বালা।
আমার দু’চোখে ঘুম নেই বঁধু, তুমি ঘুমিয়েছো বুঝি?
আমি রাত জেগে কেবলি এদের মুক্তির পথ খুঁজি।
কান পেতে শুনি দুখী মানুষের অসহায় ক্রন্দন
তাদের হৃদয়-বেদনাকে করি কবিতায় অংকন।
• ১৯৮৪
কতদিন অনশনে
আমার জঠরে আজ দুঃসহ যন্ত্রণা :
নিষ্ঠুর ক্ষুধার রাক্ষসীরা
ঝাঁটিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে কবে আমার কবিতাকে
আমি আর লিখবো না কবিতা, লিখবো না।
দু’মুঠো অন্ন জোটে নি সারাবেলা
বড়োই আনন্দহীন শুষ্ক এ কবিতা লয়ে খেলা,
এ শুধু ব্যর্থ প্রয়াস আনন্দকে আটকে রাখার
তোমাকে বিদায় দিলাম, কবিতা আমার।
কতদিন তুমি বন্ধু লিখবে কবিতা অনশনে?
কবিতার ফুল মুকুলেই ঝরে যাবে হৃদয়কাননে।
আমার কাননে কত ফুল ফুটেছিল,
ঝরে গেছে সব
ক্ষুধার বায়সীরা কেবলই চেঁচায়, কেবলই রুক্ষ কলরব।
• ১৯৮৪
আবার আপন হবো
কেউ কথা বলে না, ডাকে না, ফিরে তাকায় না কেউ
করে না কুশল জিজ্ঞাসা। এখন আমার বড়ো দুঃসময়।
সবার চোখে কাঁটা হয়ে ফিরি
তবু সুনিশ্চিত জানি, সবার চোখের মণি হবো একদিন।
আমরা আবার একসাথে স্নান করবো,
পুকুরে, খালে, আড়িয়াল বিলে মাছ ধরবো একসাথে।
দুপুরের ঠাটা রোদ্দুরে লাঙ্গলচষা মাঠে ভোঁ-ভোঁ দৌড়াবো,
ঘুড়ি উড়াবো, সিনেমায় যাব, বাংলোতে
জমবে গল্প, গানের আসরে উন্মত্ত ডামাডোল,
মাঠে আমাদের খেলা জমবে,
আমরা আবার পরস্পরের আপন হবো।
আজকের সবকিছুন দুঃখ, বেদনা ভুলে যাব,
শুধু স্মৃতিগুলো আজীবন বুকে জ্বলবে।
• ১৯৮৫
আমার স্মৃতিতে
তোমরা নিষ্ঠুর হবে না যেন
একটি গোলাপের মৃত্যু হতে পারে
এবং সেজন্য তোমরাই দায়ী থাকবে চিরকাল
এবং আমি বলবো
তোমরাই সে গোলাপকে করেছো হত্যা
প্রতিদিন হাজার গোলাপের নির্মম মৃত্যু ঘটে
প্রতিদিন আত্মহত্যা করে হাজার গোলাপ
তোমরা মাত্র কিছুক্ষণ তার জন্য কাঁদো
তারপর ভুলে যাও প্রিয় সেই গোলাপের কথা।
আমি তা ভুলতে পারি না কখনো
আমার স্মৃতিতে জেগে থাকে জীবন্ত কবিতা রূপে।
• ১৯৮৬
মুক্তির পথ
ভাষার জন্য দেশের জন্য যারা
বুকের রক্তে লিখেছিল শ্লোগান
চিরনির্ভীক মুক্তিপাগল তাঁরা
তাঁরা মহাবীর, তাঁরাই অমর প্রাণ।
যেখানে শোষণ যেখানে অত্যাচার
সেখানে তাঁদের সোচ্চার প্রতিবাদ
যেখানে অমোঘ অন্যায় অবিচার
সেখানে তাঁদের মুষ্টিবদ্ধ হাত।
আমাদের তাঁরা দেখিয়ে গেছেন
মুক্তির যেই পথ
নির্ভয়ে আজও এগোবো সে পথে :
দৃপ্ত এই শপথ।
• ১৯৮৪
এক মোহনা
আমি সাগর
তুমি নদী
আমরা দুজন এক মোহনায় মিলবোই।
তুমি দূর পাহাড়ের চূড়া হতে ঝরনা হয়ে নামবে
চটুল পায়ে নাচতে নাচতে
নাচতে নাচতে নাচতে
কবে যে নদী হয়ে বইবে
তোমার জন্য প্রসারিত আমার বিশাল বাহু।
আমি সাগর
তুমি নদী
আমরা দুজন এক মোহানায় মিলবোই।
• ১৯৮৬
বিনিদ্র
রাতে চোখে নেই ঘুম আমার
জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখি- তুমি এসেছো।
বাতায়নে সারাক্ষণ কান পেতে থাকি-
সহসা শুনতে পাব তোমার পায়ের মৃদু শব্দ।
বাতাসে পাতা ঝরার শব্দে চমকে উঠি : তুমি এসেছো।
কালো বিড়ালিটার পায়ের নরম শব্দে চমকে উঠি : তুমি এসেছো।
আমার প্রতিটি প্রহর কেটে যায়
তোমার আসার প্রতীক্ষায়।
• ১৯৮৬
ঘাতক
একটি গোলাপের হৃদয়ে কত ব্যথা
তা বুঝবে কী করে তোমরা?
সবাই তো আর বুঝতে পারে না
তাহলে সবাই কবি হতো
একটি গোলাপকে সবাই পেতে চায়
সবাই কি আর ভালোবাসে তাকে?
সবাই ভালোবাসতেও পারে না
তাহলে সবাই কবি হতো
একটি গোলাপের ব্যথা আমি বুঝতে পেরেছিলাম
এবং বেসেছিলাম ভালো-
আমি তাকে পারি নি দিতে সুখ
নির্জন আঁধারে করেছি হত্যা
তাই কবি হয়েও হলাম নিষ্ঠুর ঘাতক।
• ১৯৮৬
৪
৭ম শ্রেণিতে হয় খবিরউদ্দিন, অথবা জাহিদুল ইসলামের কাছ থেকে ‘শেষের কবিতা’সহ রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতার বই হাতে পাই, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আবৃত্তিও করি। ‘শেষের কবিতা’ ভালো লাগলেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমাকে বেশি টানলো না। নজরুলের কবিতা ও অন্যান্য বই বেশি টানলো। কোনো একসময় জসীমউদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’সহ আরো কিছু বই হাতে আসে, ওগুলোও গোগ্রাসে গিলতে থাকি। বন্ধুবান্ধবদের বড় ভাইয়েরা, যারা ঢাকায় থাকতেন, তাঁদের সৌজন্যে মাঝে মাঝে এসব বই পড়তে পেতাম। সুনীলের নাম প্রথম শুনি একাদশ শ্রেণিতে এক শিক্ষকের মুখে- ‘কেউ কথা রাখে নি’ কবিতার মাধ্যমে। এ পর্যন্ত কবিতায় আমার পড়ার গণ্ডি ছিল এত ছোটো। এর মাঝখানে আমাদের পাশের গ্রামের মিজানুর রহমান শমশেরী (১৯৪৬-১৯৮১) নামক এক কবির কবিতায় আমি খুব আকৃষ্ট হই। তিনি যুগপৎ প্রেম ও বিদ্রোহের কবি ছিলেন। তাঁর বিদ্রোহের কবিতাগুলোর মধ্যে সুকান্তের প্রভাব খুব স্পষ্ট, এমনকি কোনো কোনো কবিতায় সুকান্তের শব্দবন্ধ, এমনকি ছোটো ছোটো পঙ্ক্তিও ব্যবহার করেছেন। আমি শমশেরীর কবিতা পড়ে তাঁর কবিতার দ্বারাও তীব্রভাবে প্রভাবিত হতে থাকি।
এ পোস্টে যে কবিতাগুলো দেয়া হলো সেগুলো সুনীলের কবিতা পড়ার আগেই লেখা হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে আমি সুনীলের প্রচুর কবিতা পড়ার সুযোগ পাই। আমার কবিতায় সুনীলের প্রভাব হয়ত ততটা সুস্পষ্ট নয়, কিন্তু আমার জীবনে সুনীলের প্রভাবই হলো সবচেয়ে বেশি। এরপর নজরুল, সুকান্ত, জসীমউদ্দীন ও মিজানুর রহমান শমশেরীর প্রভাব সুস্পষ্ট, তা আমার কবিতা পড়লে যে-কেউ সহজেই বুঝতে পারবেন।
মিজানুর রহমান শমশেরীর নামে আমি এই ব্লগে একটা অ্যাকাউন্ট ওপেন করে তাতে কিছু কবিতা, ছড়া ও গান শেয়ার করেছি। আগ্রহীদের জন্য ঐ ব্লগের লিংকটা দেয়া হলো।
মিজানুর রহমান শমশেরী : দোহারের একজন অকালপ্রয়াত প্রতিভাধর কবি
সবাই ভালো থাকবেন।
ইদ মুবারক।
এ পোস্টের রচনাকালঃ ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:৩৫