ইদানীং ১লা বৈশাখ এলেই ভাজা ইলিশ আর পান্তা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে ১লা বৈশাখে পান্তার সাথে এরকম ইলিশ ভাজা খাওয়ার ঐতিহ্য কি কোনোদিনই ছিল?
ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখে এমনিতেই ইলিশ মাছের স্বল্পতা থাকে। ফলে এই সময়ে বাংলাদেশে সারাজীবনই ইলিশের দাম চড়া ছিল। আদিকাল থেকেই ইলিশ ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তাদের প্রতিদিন প্রতিবেলা পুঁটিমাছ খাওয়ারও তেমন সৌভাগ্য ছিল না। ডাঁটাশাক (দারা), কলুইশাক, ধুধুল্লাশাক, পাটশাক, কলমিশাক, সেঁচিশাক, কচুশাক, শাপলা এবং বাড়ির আঁদাড়ে-পাঁদাড়ে, বন-বাদাড়ে আরো যে-সব শাক-লতা জন্মে থাকে, সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের মূল তরকারি ছিল এগুলো। এর সাথে যোগ হতো কালাই, মাষকালাইয়ের ডাল। আগের দিনে বাজারে ভাগা করে পুঁটি, খলসে, বইচা, চিংড়ি, ট্যাংরা, চাপিলা, জাটকা, রয়না, ইত্যাদি মাছ বিক্রি হতো। সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে ছিল এই ভাগা মাছ। রুই, কাতলা, ইলিশ কেটে ভাগা করে বিক্রি করা হতো। যাদের সামর্থ্য আরেকটু বেশি, তারা এই রুই-ইলিশের ভাগা কিনতো। সচ্ছল ও সামর্থ্যবানরা আস্ত মাছটাই কিনতো নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী। সমাজে সামর্থ্যবানদের সংখ্যা যে সেই সময়ে খুব কম ছিল তা আমরা সবাই জানি।
গ্রামের স্বল্প-সচ্ছল সাধারণ পরিবারে সাধারণত অনেকদিন পর পর, বিশেষ করে বাসায় কোনো মেহমানদারির আয়োজন করা হলে ইলিশ কেনা হতো। সচরাচর ইলিশ মাছটা কেটে কিছু অংশ প্রথম দিন তরকারি হিসাবে রান্না করা হতো। বাকিটা জ্বাল দিয়ে রেখে দেয়া হতো পরবর্তী দিনের জন্য। তখন কোনো ফ্রিজের প্রচলন না থাকায় এই ব্যবস্থা করা হতো।
এইসব স্বল্প আয়ের মানুষেরা এই যে একটা ইলিশ কিনে আনলো এতোদিন পর, এটি তারা সাধারণত তরকারি হিসাবে রান্না করে বিকেল বা রাতের খাবারের সাথে খেতো। ইলিশের টুকরোগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই একবেলা (রাতে বা বিকেলে) খাওয়ার পর শেষ হয়ে যেতো। মাঝে মাঝে হয়তো সকালের জন্য সামান্য বাসি তরকারি অবশিষ্ট থাকতো, যা সকালে অন্য যে কোনো তরকারির মতোই পান্তার সাথে খাওয়া হতো।
কিন্তু সকালে পান্তার সাথে এরূপ ইলিশের বাসি সালুন খাওয়া কোনো নিয়মিত দৃশ্য ছিল না। এবং সকালবেলা ইলিশ মাছ ভেজে পান্তার সাথে খাওয়া একটা বিরল ঘটনা ছিল। কালেভদ্রে কোনো অবস্থাপন্ন বাড়িতে এটা হয়ে থাকলেও তা যে কোনো নিয়মিত চর্চা ছিল না তা নিঃসন্দেহ।
তবে ইলিশ মাছ তরকারি হিসাবে রান্না করার পাশাপাশি কয়েক টুকরো ইলিশ ভাজাও হতো। এমন নজির খুব কম পাওয়া যাবে যে, ইলিশের তরকারি রান্না না করে পুরো মাছটাই ভাজা হয়েছে। বরং পুরো মাছটা তরকারি হিসাবে রান্না করাটাই ছিল সাধারণ ঘটনা। এবং সেই ইলিশভাজা বিকেল বা রাতে গরম ভাতের সাথেই সাবাড় হয়ে যেতো। রাতে বা বিকেলে গরম ভাতের সাথে ইলিশ না খেয়ে সকালবেলা পান্তার সাথে ভাজা ইলিশ খাওয়া একটা অকল্পনীয় বিলাসিতা ছিল, যার নজির কোথাও ছিল বলে মনে হয় না।
সকালবেলা কেন ইলিশ মাছ ভাজা হতো না? এর প্রধান কারণ হতে পারে এই যে, ইলিশ একটা দামি ও অভিজাত মাছ। বিকেলে শাক-ডাল বা পুঁটির তরকারি দিয়ে গরম ভাত খেয়ে সকালবেলায় পান্তার সাথে ভাজা ইলিশ খাওয়ার মতো আহাম্মকি ইচ্ছে বা কল্পনা কারো মাথায় কখনো আসবে, এমনটা অস্বাভাবিক। এ দ্বারা ইলিশ মাছটাকে নষ্ট বা ‘অপচয়’ করা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ইলিশের মতো সুস্বাদু মাছ গরম ভাতের সাথে যতোখানি মজাদার ও উপাদেয় হবে, পান্তা দিয়ে সেই স্বাদ কখনো হবার নয়। মানুষ পান্তা ভাত খেতো, তার কারণ, বিকেলের বেঁচে যাওয়া ভাত তখন ফ্রিজে রাখার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে বিকেলে বেশি হওয়া ভাতগুলোতে রাতের বেলা পানিতে ভিজিয়ে পচন রোধ করা হতো। অন্যদিকে, শীতের দিনে ন্যাচারাল ঠান্ডাতেই বিকেলের বেঁচে যাওয়া ভাতগুলো পানিতে না ভিজিয়ে সকালের জন্য রেখে দেয়া হতো।
তাহলে সকালবেলা সাধারণ মানুষ কী খেত? সকালে পান্তার সাথে অবধারিতভাবে কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ ছিল। কখনো কখনো শুকনো মরিচ পুড়িয়ে কিংবা তেলে ভেজে গুঁড়ো করে পান্তার সাথে মাখিয়ে খাওয়া হতো। আর থাকতো বাসি সালুন, টক হয়ে যাওয়া বাসি ডাল (লাউ আর ডাল)। ছিল আলুভর্তা, বেগুনভর্তা।
যে সময়ের কথা বলা হলো তা যে খুব পেছনে, তাও না। আজ থেকে ৩৫-৪০ বছর আগের কথা বলছি। বৈশাখে ইলিশ মাছ খাবার মতো সামর্থ্য আজ যেমন মুষ্টিমেয় কিছু ধনী মানুষের রয়েছে, তখনও এমনই ছিল। আর বৈশাখে ইলিশ খাওয়া একটা বাঙালি রেওয়াজ, এটা আমরা তখন জানতাম না। আমরা ছোটোবেলায় ‘হালখাতা' দেখেছি। বাজারে যাদের দোকান থেকে সওদা কিনতাম, ঐদিন বাজারে গেলে তারা 'রসগোল্লা' খাওয়াতো। আমাদের বড় আনন্দ ছিল বিকালে মেলায় যাওয়া। মেলায় মাটির পুতুল, বাঁশি, মাটির হাতি, ঘোড়া, কাগজের রঙিন ফুল খুব লোভনীয় ছিল। আর ছিল সার্কাস, পুতুল নাচ।
১লা বৈশাখ যে খুব ঘটা করে উদ্যাপন শুরু হয়েছে, তা বেশিদিনের ঘটনা নয়। ১লা বৈশাখ উদ্যাপন খুব আড়ম্বরপূর্ণ হয়ে উঠেছে আমাদের প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলোর কল্যাণে। এমনকি ৮৪, ৮৫, ৮৬ সনের দিকেও ১লা বৈশাখে সকালের 'ইত্তেফাক' খুলে 'শহরতলী'তে কী কী আছে তাতে নজর দিলে দেখা যেতো বাংলা একাডেমীর বটমূলে বিকেলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, কলাবাগান/ধানমন্ডির মাঠে মেলা, শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠান, ইত্যাদি।
১লা বৈশাখ মূলত 'গ্রামজ' উৎসব হলেও গ্রাম বাংলায় উৎসবমূখরতা যতোখানি দেখা যায়, অধুনা তার চেয়ে বহুগুণ দেখি শহর ও নগরে। এরও কারণ আছে। শহরে আপনি শহরের 'আদি বাসিন্দা' পাবেন খুব কম- এখানে যাদের বাস তাঁদের শেকড় হলো গ্রামে। শহর আর গ্রামকে পার্থক্য করাও ক্রমশ দুরূহ হয়ে উঠছে। যে পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে বসতি গড়েছে, ইদ মৌসুমের মতো তাঁরা কিন্তু গ্রামে ছুটে যান না। তাঁরা নিজস্ব শহরেই প্রাণের উৎসবে মেতে ওঠেন।
আমাদের গ্রামবাংলায় শুধু চৈত্র-বৈশাখেই না, বছরের অন্য কোনো সময়েও সকালবেলা ভাজা ইলিশ বা তরকারি ইলিশের সাথে পান্তা খাওয়ার রেওয়াজ কোনোদিন ছিল না। বর্তমানে চলমান এই কৃত্রিম ইলিশ-পান্তার প্রচলন হয়েছে খুব বেশিদিন হয় নি। আপনারা বছর গুনলেই খেয়াল করতে পারবেন যে ১০ বছর আগেও ১লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার এমন হিড়িক ছিল না। এই কৃত্রিম ঐতিহ্যচর্চার পেছনে বৃহৎ এক ব্যবসায়িক চাল রয়েছে বলে আমার মনে হয়। সাধারণত জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ইলিশ মাছ ধরা নিষেধ থাকে। কিছু সুচতুর ব্যবসায়ী বিপুল পরিমাণ ইলিশ গুদামজাত করে রাখেন কেবল এই ১লা বৈশাখকে সামনে রেখে। ১লা বৈশাখের আগ দিয়ে ১ থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশের দাম কেজি প্রতি গিয়ে দাঁড়ায় ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা। কিছু অবুঝ ভোক্তা ১লা বৈশাখে ইলিশ খাওয়া ইবাদত সমতুল্য মনে করেন, ফলে ইলিশের উপর বাড়তি চাপ পড়ে এবং হু হু করে দাম বাড়তে থাকে।
এবার হিসাবটা মিলিয়ে দেখুন। গ্রামের সাধারণ মানুষ সারাবছর যা দিয়ে ভাত খেয়ে থাকে, ১লা বৈশাখেও তাদের মেনুতে তাই-ই থাকে। যাদের সামান্য সামর্থ্য আছে, কেবল তারাই স্বপ্নের ইলিশের দেখা পান আর ১লা বৈশাখের সকালে গরম ভাতে পানি মিশিয়ে পান্তার সাথে ইলিশভাজা খান আর ভাবেন আহ, বাঙালি ঐতিহ্য পালন করছি।
বাংলাদেশে যখন থেকে পান্তা-ইলিশের ১লা বৈশাখ উদ্যাপনের অপংস্কৃতি শুরু হয়েছে, বন্ধুবান্ধবসহ যে-কোনো ফোরামে এ প্রসঙ্গে কথা উঠলেই আমি বলতে চেষ্টা করেছি যে, ১লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া কোনোদিনই বাঙালি সংস্কৃতি ছিল না। এটা একটা কৃত্রিম সংস্কৃতি, যার পেছনে ব্যবসায়িক মতলব রয়েছে।
আমার ভালো লাগছে এটা দেখে যে, বর্তমানে, বিশেষ করে এ বছর ফেইসবুক ও ব্লগে, এমনকি কোনো কোনো টিভি চ্যানেলও এই ‘অপসংস্কৃতির’ বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। এজন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব উল্লসিত। কোনো একসময় মনে হচ্ছিল, এই যে ১লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের বিরুদ্ধে আমি কথা বলছি, এটা আমার হীনম্মন্যতা। অথবা, আমি হয়তো এদেশের ঐতিহ্য সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। আজ দেখতে পাচ্ছি, আমি একা নই। আরো অনেক মানুষ বহু আগে থেকেই এ বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন। এ প্রসঙ্গে আমি ৮ এপ্রিল ২০১৫ রাতে ফেইসবুকে একটা স্টেটাসও দিয়েছিলাম এবং সেখানে এ মতের বিপক্ষে ভাবছেন, আমার ফ্রেন্ডলিস্টে এমন কাউকে দেখি নি। আমার স্টেটাসে যাঁরা মন্তব্য করলেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ কমেন্টদাতাই সরাসরি ‘একমত’ পোষণ অথবা ‘সহমত’ জ্ঞাপন করেছেন। এঁদের মধ্যে ব্লগার মাহমুদ রহমান, সাবরিনা সিরাজী তিতির, আবু শাকিল, আদনান শাহরিয়ার তপু, দীপ্র হাসান, মতিউর রহমান সাগর (সাগর রহমান), পার্থ তালুকদারের নাম উল্লেখযোগ্য। কেউ কেউ অবশ্য অন্যমত দিয়েছেন, কিন্তু বিষয়টাকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়ার মতো কাউকে পাওয়া যায় নি।
এ বিষয়ে স্টাডি করার সময়ে ব্লগার শারমিন রেজোওয়ানার একটা পুরোনো পোস্ট সামনে উঠে এলো, যার শিরোনাম- ‘কর্পোরেট বাণিজ্যের চাপে পড়া আমাদের বেচারা পহেলা বৈশাখ' তাঁর পোস্টটির সূচনা খুবই ইন্টারেস্টিং।
গতকাল প্রথম আলোর ‘নকশা’ খুলে দেখি পান্তা ভাত রাঁধার রেসিপি দেয়া হয়েছে... ‘গরম ভাত রান্না করে এতে পরিষ্কার পানি ঢেলে ঢেকে রাখতে হবে!’
দেখে একটু ভ্যাবাচেকা খেলাম, তবে সেটাই শেষ না, এরপর গেলাম মীনা বাজারে মাছ কিনতে, দেখি দুই কেজি বা দেড় কেজির মতো এক একটা ইলিশ মানুষ হাসি মুখে ৩৩৫০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছে!
এরপর শারমিন রেজোওয়ানা ইতিহাস খুঁড়ে ও ঘেঁটে পেলেন যে, ‘ভাত সাধারণত খাওয়া হতো শাক সহযোগে! নিম্নবিত্তের প্রধান খাবারই ছিল শাক!’ প্রাচীন বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য অনেক খুঁজেও তিনি পান্তা-ইলিশ আর সাদা শাড়ি, লাল পাড় দেখতে পেলেন না। সঙ্গতভাবেই তাঁর প্রশ্ন : ‘তাহলে কেন আমাদের যেভাবেই হোক ৩৩৫০ টাকা দিয়ে হলেও ইলিশ খেতেই হবে, সাধ্যে কুলাক আর না কুলাক সাদা শাড়ি, লাল পাড় পরতেই হবে?’
তাঁর পোস্টের উপসংহার প্রণিধানযোগ্য :
‘আমরা উৎসবপ্রিয় জাতি; অবশ্যই উৎসব পালন করবো ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে। তবে সেখানে কোনো কর্পোরেট বাণিজ্যিক হেজিমনি যেন ফায়দা না লুটতে পারে, সেটাও কি ভেবে দেখার সময় আসে নি এখনো?
এই ইলিশের দাম ১৫ তারিখেই কমে অর্ধেক হয়ে যাবে! না হয় এদিন আমরা নাই খেলাম ইলিশ! এখন ইলিশের প্রজননঋতু, এই সময়টা ধৈর্য ধরে নিজের জিভকে একটু সংবরণ করলে পরের অনেকগুলো মাস অনেক সুলভে ইলিশ খেতে পারবো আমরা। আসলে আইন করে এই সময়ে ইলিশ ধরা বন্ধ করা উচিত!
ব্লগার নীল সাধুর অভিজ্ঞতালব্ধ মন্তব্যটি অসাধারণ। তিনি লিখেছেন :
রমনার বটমূলে বৈশাখের আয়োজনে যোগ দেয়ার শুরুটা ছিল খুব ছোটোবেলা থেকেই। ১৯৮৬/৮৭ সনের দিকের কথা বলছি আমি। মনে আছে সে সময়ের বৈশাখের প্রথম দিনে রমনার বটমূলে শুধু যেখানে গান হতো সেখানে দু/আড়াই শ মানুষ হতো। আর আশেপাশে কিছু মানুষ বেড়াতে বা ঘুরতে আসতো। এই ছিল পরিবেশ। অনেক সময় রমনার আয়োজন শেষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দিয়ে টিএসসির গেট দিয়ে বের হবার সময়ে উদ্যানের ভেতরে এই নিয়ে হৈচৈ চোখে পড়ে নি। শিশু পার্কের গেটের সামনে ফকির আলমগীরের ‘ঋষিজ’ গান পরিবেশনা শুরু করে তার বেশ ক’বছর পর থেকে। আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময় বৈশাখের প্রথম দিনটিতে শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবনের রাস্তাটি খোলাই থাকতো। কারণ রাস্তা বন্ধ করে অনুষ্ঠান করার প্রয়োজনীয়তা বা লোক সমাগম তেমন হতো না। শিক্ষিত সংস্কৃত-মনা মানুষজন এবং ঢাকার বিশেষ একটি শ্রেণির মানুষ ছাড়া এই আয়োজনের কথা তেমন কেউই জানতো না। আমজনতার কো্নো অংশগ্রহণ ছিল না ঢাকা কেন্দ্রিক এই আয়োজনে। আয়োজন ছিল খুবই সুশৃঙ্খল। দুপুরের মধ্যেই সবকিছু সমাপ্ত হয়ে যেতো। তখন মিডিয়া বলতে সংবাদপত্র এবং একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি। সেই আয়োজনে কিছু দোকানি পসরা সাজিয়ে বসে পান্তা খাওয়ার প্রচলন শুরু করে।
বাঙালি যদিও পান্তার সাথে কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ খেতো কিন্তু এই আয়োজনে কিছুটা নতুনত্ব এবং আভিজাত্য আনতেই কিনা সেই পান্তার সঙ্গে আইটেম যুক্ত হল ইলিশ। আমার মনে হয় এভাবেই ১লা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশের সংযুক্তি। আর কিছুই নয়। কোনোক্রমেই ১লা বৈশাখের সংস্কৃতির সঙ্গে বা বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে ইলিশ ছিল না। আমি তো মনে করি এখনো নেই। এটা হুজুগে বাঙালির তৈরি ইস্যু মাত্র!
ফেইসবুকারদের মন্তব্যগুলো আপনাদের জন্য নীচে তুলে দিলাম।
কুনোব্যাঙ/স্কাই ওয়াকার
ছোটোবেলায় কাজিনদের সাথে পহেলা বৈশাখে এক-আধবার ঘুরতে গিয়ে দেখেছি তৎকালীন উঠতি টিভি তারকারা রমনায় সানকিতে করে প্রতি প্লেট এক/দেড় হাজার টাকায় পান্তা ইলিশ বিক্রি করতো। এটা ছিল মূলত বোশেখে উঠতি তারকাদের আয়ের একটা পথ, যে প্রথাটা এখনো আমরা মফস্বলের বৈশাখী মেলায় দেখে থাকি। আমার ধারণা সেই শোবিজ তারকাদের পান্তা ইলিশ বেচা থেকেই আস্তে আস্তে এটা একটা কালচারে পরিণত হয়েছে। পান্তা আর ইলিশের মতো আমাদের দুইটা ঐতিহ্যবাহী খাবার নিয়ে যদি কালচার হয় ব্যাপারটা খারাপও না মনে হয়, অন্তত পিজা-বার্গার কালচার যে হচ্ছে না সেটিও একটি সান্ত্বনা। আবার এটিও খেয়াল রখতে হবে, একটি কালচার তৈরি করতে গিয়া সাধারণ মানুষকে আমরা দুঃখে ফেলছি কিনা। আনন্দের একটি দিনে পান্তা ইলিশ খাওয়ার যে একটা নিয়ম চলে আসছে এই সময়ে ইলিশের দুর্মূল্যের বাজারে এদেশের অধিকাংশ পরিবারের পক্ষেই এটা সম্ভব না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এটা একটা আনন্দের দিনে তাদের জন্য হতাশা আর হীনম্মন্যতা আনবে। যেহেতু আর্থিক অসংগতি এবং দুষ্প্রাপ্যতার কারণে ইলিশ অধিকাংশ বাঙালির হাতে থাকে না, সেহেতু আমজনতার থাকে না সেহেতু ব্যক্তিগতভাবে আমি এই ইলিশে আগ্রহ পাই না। আর ব্যাপারটা কিছুটা অপচয়ই মনে হয় আমার কাছে। অবশ্য পাড়া-প্রতিবেশীর দাওয়াত পেলে সে দাওয়াতও অগ্রাহ্য করি না, কেননা ইলিশ ভাঁজা আমার অত্যন্ত প্রিয় খাবার
লাইলী আরজুমান খানম
আমার বাড়ি গ্রামে, আমি কখনোই দেখি নি পান্তার সাথে ইলিশ খায়, নতুন শাড়ি পরে… পহেলা বৈশাখকে এখন পূজা আর ইদের চেয়েও বেশি করে দেখানো হচ্ছে আর তার চর্চাও হচ্ছে… একদিন তো আমাদের নতুন প্রজন্ম এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান ভুলে যাবে… আর তারা চর্চা করবে যতসব ফালতু সংস্কৃতি, যেমন পহেলা বৈশাখ যা কর্পোরেটরা তৈরি করেছে তাদের স্বার্থে…
শাহেদ খান
খলিল ভাই, সংজ্ঞামতে ‘আমরা যা, সেটাই আমাদের সংস্কৃতি।‘ চৈত্র-বোশেখে অসময়ে ইলিশ খোঁজা, কিংবা ফিউশন-মিউজিকে লালনের জন্মোৎসব পালন করা, ইত্যাদি এখন আমাদের সংস্কৃতি কিনা সে বিতর্কের কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখি না; বরং ‘সমসাময়িক হুজুগে গা-ভাসানো’টাই আমাদের সংস্কৃতি। শত বছর ধরে সেটাই চলে আসছে। অতএব যা হচ্ছে, সংস্কৃতি-মোতাবেকই হচ্ছে।
যে কোনো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আধুনিক উত্তেজনার স্রোতে আমাদের গা ভাসানোর দৃষ্টান্ত ঐতিহাসিক পর্যায়ের। রবিঠাকুর সেই ১৮৯১-৯২ সালেই এক গল্পে লিখেছিলেন, ‘সে সময়ে তখনকার সেকালের লোক তখনকার একালের লোকের ব্যবহার দেখিয়া হতবুদ্ধি হইয়া অধিক তামাক টানিত।‘
অন্ধবিন্দু
‘অপসংস্কৃতি’ শব্দটি নির্দিষ্ট নয়। কথা বললে আলোচনা বিরাট আকার ধারণ করবে। লিখাটি ব্লগে পোস্ট করতেন? অপরিহার্য অনুষঙ্গ কারা বানাচ্ছে, যারা সামর্থ্য রাখেন তারা, নাকি যারা সামর্থ্য অর্জন করতে চাইছেন তারা? বাঙ্গালীরা বাঙালী থেকে বাঙালি হয়েছে, তবে সময়ের সাথে নিজ সংস্কৃতির তাল না মেলাতে পেরে কাঙাল হতে হচ্ছে। অবশ্য বিশ্বসংস্কৃতিও সেদিকে আগে বাড়ছে। রাশিয়া, ইংল্যান্ড বা এ্যামেরিকাতেও (ইত্যাদি) এই কাঙালপনা দেখতে পাচ্ছি। মোরালি ক্যাপিটালিজমকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে, আশা আছে। অন্যথায় ...
নীল সাধু, শাহেদ খান… সুযোগের অভাব প্রচলিত হতে থাকলেই হুজুগের অধ্যায়টি আসে। তার সাথে জাতীয়তার সম্পর্ক নেই। আপনাদের কথাতেও ভেবে দেখার মতো যুক্তি আছে।
রবি বাবুর কাছেই ফিরে আসি, বলছেন- ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।‘ তা এইসব ইলিশ-পান্তা/প্রপাগান্ডা আসলে বাঙালিকে তার চিরন্তন-রূপ প্রকাশে বড় বাধা হিসেবে দেখছি। সোনাবীজ অথবা ধুলোবালিছাই, আমার অবস্থান এই লিখাটিতে স্পষ্টত প্রকাশ করেছিলুম।
আমি এ মুহূর্তে একটা জবাব দিলাম : শত শত বছর ধরে আমি লুঙ্গি বা ধুতি পরি। লুঙ্গিধুতিই আমার পোশাকের সংস্কৃতি। মেয়েদের জন্য শাড়ি বা সেলোয়ারকামিজ। গণ মানুষের জীবনচর্চাই হলো সংস্কৃতি। শহর আর গ্রামের সংস্কৃতিতে পার্থক্য থাকতে পারে। সারাদেশের মানুষ যদি বলে পহেলা বৈশাখে আমরা প্যান্টশার্ট আর স্কার্টের বদলে লুঙ্গি বা শাড়ি পরবো, এটা খুব ন্যাচারাল হবে। কারণ, যুগ যুগ ধরে বাঙালিদের পোশাক এগুলোই ছিল।
সংস্কৃতির সাথে ধনী হওয়া বা গরীব থাকার কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হচ্ছে না।
আমাদের দেশে কোনো কালেই সাধারণ মানুষের সকালবেলা পান্তা আর ইলিশ খাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। এটা কোনো রেওয়াজও ছিল না। এই যখন অবস্থা তখন ১লা বৈশাখে সার বেঁধে পান্তা ইলিশ খাওয়ার মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির কোনো চর্চা হয় বলে মনে হয় না।
এখন প্রশ্ন করতে পারেন, খেলে দোষ কী? হ্যাঁ, কোনো দোষ নেই পান্তা ইলিশ খেতে, কিন্তু এটাকে যখন বাঙালি ঐতিহ্য বলে চালানো হয়, দোষ হয় সেটাতে। এসব প্রপাগান্ডার কুফল অনেক।
অপর্ণা মম্ময়
কদিন আগেই এ বিষয়ে কলিগদের সাথে কথা হচ্ছিল। যে ব্যাপারগুলো আগে পালিত হতো কোনো উৎসবকে ঘিরে, এখন সেটা চেপে বসার মতো ব্যাপার হয়ে গেছে। সেটা না করলে ‘জাত’ থাকবে না টাইপ ভয়, দ্বিধা ঢুকে যাচ্ছে হয়তো!
মনোয়ারা মণি
অপসংস্কৃতি, ধার করা সংস্কৃতি আর লোকদেখানো সংস্কৃতি পালনে আমরা অতুলনীয়। সর্বক্ষেত্রে এগুলো দিনদিন বেড়েই চলেছে। পহেলা বৈশাখ পালনে ইলিশ মাছ খাওয়া এদের মধ্যে একটা বলে মনে হয়। ছেলেবেলায় বন্ধুদের কাছে শুনেছি বিজয়া দশমীতে ইলিশ খাওয়ার প্রচলনের কথা। এখন মনে হচ্ছে এখানে পাল্লাপাল্লি বিষয়টিও কাজ করতে পারে। দেশবিদেশে উৎসবগুলো ব্যবসাকেন্দ্রিক। বেশভূষায় নয়, চালচলনে নয়, ইলিশ খাওয়া দিয়ে দেখাতে চাই আমরা বাঙালি। জাতীয় মাছ অন্তত একটা নতুন বছর পালনে না খেলে জাত থাকবে না যে! ইলিশ মাছের ব্যবসায় যারা সম্পৃক্ত তাদের কয়জনের ছেলেমেয়েরা মাছের কাঁটা বাছতে জানে সে বিষয়েও আমার সন্দেহ আছে। বিদেশে এখন ইলিশ মাছের ব্যবসা তুঙ্গে। কখনো বার্মার, কখনো চাঁদপুরি আবার কখনো ইন্ডিয়ান ইলিশ বলে চালিয়ে দেয়া হয় অথচ ইন্ডিয়ান কিংবা বার্মার দোকানে ইলিশ দেখি না। যে কথা বলতে চাই আমাদের দেশ যাঁদের পরিশ্রমের ফসলে বেঁচে থাকে তাঁদের ভাগ্যে ইলিশ জোটে না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষকে যারা বাঁচিয়ে রাখেন তাঁদের ভাগ্যে বছরে একবারও হয়তো ইলিশ মাছ খাওয়া হয় না। বাঙালিয়ানা যদি দেখাতেই হয় সেটা ‘বাঙ্গালী’ বানান পরিবর্তন করে নয়, মন থেকে বাংলার মানুষের কষ্ট অনুভব করে তা দেখানো উচিৎ। শুধু পহেলা বৈশাখে নয় ইলিশ মাছ এমন ভাবে বর্জন করা উচিৎ যাতে ব্যবসায়ীরা সংস্কৃতি নিয়ে ব্যবসা করতে না পারে।
১লা বৈশাখে পান্তা ভাতের সাথে (যদিও গরম ভাতে পানি মিশিয়ে বানানো হয়) কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচই হোক বাংলা নববর্ষের খাবার। জাতীয় মাছ জুটুক আমাদের মতো দুর্ভাগা জাতির সাধারণ মানুষের কপালে।
এবারের শ্লোগান হোক :
১লা বৈশাখে ইলিশ নয়।
ইলিশ যেন বারোমাসেরই খাবার হয়।
রিয়া ফারিয়া
ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক ভাবেই কোনো না কোনো কিছুকে উপলক্ষ করে ব্যবসা করবে; শুধু বৈশাখ না, সকল প্রকার জাতীয় দিবস বা বিশেষ দিনেই এসব চলে। ইলিশ এক্ষেত্রে সফল, কেননা ইলিশের চাহিদা এই ব্যবসার ফলে প্রচুর পরিমাণে বাড়ছে, আর আমাদের দেশে চাহিদা বেশি হলে দাম বেশি হাঁকানো চলে। আমাদের বাড়িতে ইলিশের চেয়ে ভর্তা খাবার একটা আলাদা রেওয়াজ ছিল।
ডার্কম্যান বা সৈকত
সবই মিডিয়ার খেল। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আগে তেমন কনসার্ট দেখতাম না। কিন্তু গত ৫/৬ বছর ধরে তা পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিনের লোক-দেখানো বাঙালি হওয়ার চেয়ে মননে বাঙালি হওয়াটা মূল প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত।
আবু জাকারিয়া
আমার মনে হয় এটা সমাজের জন্য তেমন খারাপ কিছু না। যদিও পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রকৃত ইতিহাস আলাদা। আগে গ্রামের মানুষ সাধারণত প্রতিদিন সকালে অভাবের কারণে মরিচ অথবা বাসি তরকারি দিয়ে পান্তা ভাত খেত। সকালের পান্তার সাথে মাঝে মাঝে বাসি ইলিশ মাছও খাওয়ার সুযোগ হতো তাদের। কিন্তু তারা কেউ শখ করে পান্তার সাথে মরিচ বা বাসি তরকারি খেতো না। বরং তা তাদের প্রয়োজন ছিল।
পারভেজ রবিন
বৈশাখের সাথে ইলিশের সম্পর্ক ছিল না। এই সময়টাতে এমনিতেই ইলিশ কম পাওয়া যেতো। বৈশাখ এলে বোঝাও যেতো না। একমাত্র ‘হালখাতা’ই ছিল এর প্রকাশ। হালখাতা আমার খুব পছন্দের ছিল। একে একে সব ঐতিহ্যা হারিয়ে বসা বাঙালি যা মনে করতে পারছে তার সব মিলিয়ে ডালখিঁচুড়ি বানাচ্ছে। আর এটা এখন একটা ভ্যালেন্টাইনস ডে!
জিয়া চৌধুরী
রমনা বটমূল বা চট্টগ্রামের ডিসি হিলে পান্তা ইলিশ না খেয়ে একদিন গ্রামে ফিরে যাই। গ্রামের মানুষ যা খায় তা দিয়ে একবেলা আহার করি। আসল বাঙালিয়ানার স্বাদ উপলদ্ধি করি।
একদিন গ্রামে গিয়ে যে কোনো একটা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারে মেহমান হওয়া যায়। ধরুন ৫-১০ জনের একটা করে টিম। নিজেদের খরচে বাজার করে একটা দিন হাসি আনন্দে তাদের সাথে কাটানো। তাদের সাথে তাদের মতো করে চলা। তাদের সুখদুঃখ শেয়ার করা। গ্রামের মানুষকে বুঝতে শেখা। চাইলেই আমরা পারি। কর্পোরেট পান্তা ইলিশ ব্যবসায়ীদের কাছে গলা বাড়িয়ে দিয়ে বাঙালি না সেজে প্রকৃত বাঙালির স্বাদ অনুভব করি। ইলিশের ধারণা ঢুকিয়েছে কর্পোরেট ধান্দাবাজরা। আগামীকাল যদি সবগুলো মিডিয়ায় বলা হয় ইলিশ নয়, পান্তা-চিংড়ি আমাদের ঐতিহ্য। দেখবেন সবাই সেটাই গিলবে।
এই মতের পক্ষে আবেগাপ্লুত হয়ে জিয়া চৌধুরী ফেইসবুকে একটা ‘ইভেন্ট’ খুললেন: পহেলা বৈশাখ : চলুন, গ্রামে ফিরে যাই, কৃত্রিম পান্তা-ইলিশ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।
তাঁর ইভেন্ট বর্ণনায় জিয়া চৌধুরী লিখলেন : আসুন, আজ আমরা একদিনের জন্য প্রকৃত বাঙালি সাজি। আমরা আমাদের শিকড়ে ফিরে যাই। প্রত্যেকেই গ্রামের একেকটি গরীব ফ্যামিলির সাথে একটি দিন কাটাই। একবেলা খাবার খাই। উপলদ্ধি করতে চেষ্টা করি তাদের জীবন যাপনটুকু। আমাদের বাচ্চারা তাদের বাচ্চাদের সাথে মিশবে, খেলবে। তাহলেই আমরা এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে বাঙালিয়ানা কী জিনিস, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য কী ছিল। আমাদের মা বাবারা কোন ধরনের জীবন যাপন করতেন। আমরা কোথা থেকে উঠে এসেছি। কোথায় আমাদের শিকড়।
নববর্ষের সাথে, ঐতিহ্যের সাথে ইলিশের কোনো সম্পর্ক নেই, এই জিনিসটা সবাই কবে অনুধাবন করতে পারবে?’
অভিষেক পাল অন্তু
লেখটা মন দিয়ে পড়লাম। প্রতিটি যুক্তিই যথার্থ। বিষয়টা ময়নাতদন্ত করতে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, এটা আগে কোনদিন ছিলো না। এই বর্তমান সময়ে এটা চালু হয়েছে। নির্বাচনের সামনে পান্তা ইলিশ খাইয়ে প্রচারণা কিংবা গার্লফ্রেন্ডকে পকেটের গরম দেখানোর জন্য পান্তা ইলিশ খাওয়ানো কখনোই বাংলা সংস্কৃতির অংশ নয়।
***
বিভিন্ন ফেইসবুকার ও ব্লগারদের মন্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার হলো যে, পান্তার সাথে ভাজা ইলিশ কোনোদিন বাঙালির ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি ছিল না। এটা একটা ব্যবসায়িক কূটচালের ফল, যাতে মানুষ ১লা বৈশাখে এলেই ইলিশের প্রতি ঝোঁকে পড়ে, আর ইলিশের দাম যতোই হোক না কেন, এক টুকরো ইলিশ গলাধঃকরণ করে যেন সারা বছরের অতৃপ্তি নিবারণ করে।
আমাদের একটা মানসিক জাগরণের খুব দরকার। যখন টিভিতেও ফলাও করে ১লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রচারণা চালানো হয়, আর ইলিশের জোড়া ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়, তখন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের শরীরে রাগ না উঠে পারে না। এই রাগ চরমে ওঠে যখন দেখা যায় কিছু আবাল শ্রেণির মানুষ টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁত বের করে বলে- ১লা বৈশাখ বলে কথা, ইলিশ আর পান্তা তো খাইতে হইবই।
আমরা মিডিয়ার কাছে বন্দি, কিংবা পরাজিত। তবু, ব্লগ কিংবা ফেইসবুকে আমাদের একটা স্ট্যান্ড থাকা চাই, বিশেষ করে সমভাবাপন্ন মানুষদের একটা ঐক্যমত থাকা প্রয়োজন। অন্তত আমরা এ কজন মানুষ হলেও বৈশাখ মাসে ইলিশ-বিমুখ হয়ে ইলিশের দাম খানিকটা হলেও স্থিতিশীল থাকার জন্য অবদান রাখতে সক্ষম হবো, তা যত নগণ্যই হোক না কেন।
আমাদের এই অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। অযথা ইলিশকে ১লা বৈশাখের অপরিহার্য অনুষঙ্গ বানিয়ে এর দাম আকাশছোঁয়া করা অনুচিত। এই হুজুগে সংস্কৃতি থেকে বেরোনো গেলে ইলিশের দাম সারাবছর মোটামুটি স্থির থাকবে এবং নিম্নমধ্যবিত্তদের নাগাল থেকে ইলিশ মাছ আর বাইরে ছিটকে যাবে না।
সুপারিশ
১। ১লা বৈশাখ উপলক্ষে যাতে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া না হতে পারে সেজন্য ১লা বৈশাখের ১৫দিন আগে বাজারে ইলিশ কেনাবেচা বন্ধ করে দেয়া উচিত। তা না হলে হয়তো এমন একদিন আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হবে যেদিন ১লা বৈশাখে ইলিশ খাওয়াকে বাংলার মানুষ ‘ফরজ’ বিবেচনা করবে।
২। আমাদের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে ‘পান্তা-ইলিশ’ ১লা বৈশাখের বাঙালি সংস্কৃতি- এমনতরো কোনো বিজ্ঞাপন, খবর, নাটক, থিম যাতে প্রচারিত না হয় সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটা ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত হবে। আমাদের সচেতন জনগণকেও এ ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে হবে এবং ১লা বৈশাখে ইলিশভোজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩। ১লা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালা থেকে পান্তা-ইলিশের মেনু বর্জন করতে হবে। বিভিন্ন মেলাতে পান্তা-ইলিশের হোটেল নিষিদ্ধ করতে হবে।
৪। জনে জনে, যখন যাকে পান, এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করুন, বোঝান।
আমাদের সার্বজনীন শ্লোগান হোক :
১লা বৈশাখে ইলিশ নয়।
ইলিশ যেন বারোমাসেরই খাবার হয়।
অধিকতর অধ্যয়নের জন্য লেখক-নির্বাচিত কিছু পোস্টের লিংক
শূন্য (০) থেকে বাংলা সন শুরু হয় নি। ৯৬৩ হিজরির ১ মহররম=৯৬৩ বাংলা সনের ১ বৈশাখ । সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই
সাবধান, মাথায় চক্বর দিতে পারে ১০০ দ্বারা বিভাজ্য ইংরেজি সালগুলো লিপ-ইয়ার না, কিন্তু ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য সালগুলো লিপ-ইয়ার কেন? । সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই
কর্পোরেট বানিজ্যের চাপে পরা আমাদের বেচারা পহেলা বৈশাখ। রেজোওয়ানা
চৈত্রসংক্রান্তি আজ ।। আপডেট। শাহ আজিজ
পহেলা বৈশাখ- ১৪২২-শ্বাসত গ্রাম বাংলার কিছু চিরায়ত বাঙ্গালিয়ানার নিদর্শন ..। আমি ময়ূরাক্ষী
পহেলা বৈশাখ ; পান্তা-ইলিশ ; অতঃপর আমরা। সুমাইয়া আলো
'বাংলা নববর্ষ', 'পহেলা বৈশাখ', 'বঙ্গাব্দ', 'বাঙ্গালীর প্রানের উৎসব' অথবা 'তথাকথিত পান্তা ইলিশের দিন' এর কথাঃ (বাঙ্গালী ও বাংলাদেশী এইদিন এবং প্রতিদিন!!) শতদ্রু একটি নদী
বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ এবং বর্তমান উদযাপন (সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা)। বোকা মানুষ বলতে চায়
উৎসব হোক, আদিখ্যেতা নয়। শেগুফতা শারমিন
"পহেলা বৈশাখ" কিংবা "বাংলা নববর্ষ" পালন কি ইসলাম সম্মত?। দুরন্ত বেদুঈন
পান্তা-ইলিশের মধ্যবিত্ত রূপায়ণ। মুমাইন
বাঙালির বৈশাখ ও পান্তা ইলিশ সমাচার - ইফতেখার.আমিন
বৈশাখ ও বাঙালী; নববর্ষ ১৪২২। mahbubsujon/অণুষ
চৈত্র থেকে বৈশাখে। দীপংকর চন্দ
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। ইয়াকুব আলি
সকল ব্লগার ভাই বোনকে বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা এবং সাথে এর ইতিহাস। ব্লগার মাসুদ
বাংলা নববর্ষের মত একটি জাতীয় অনুষ্ঠান ধর্মনিরপেক্ষ এবং সার্বজনীন দেশীয় রীতি অবলম্বনেই পালিত হোক..। ফোজাইল ইমন
রঙে রঙে রাঙিয়ে উঠুক বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব---“পহেলা বৈশাখ ১৪২২”...হে বঙ্গসন্তান শুধায় তোমায়, লাল-সাদা রঙে বরণ করবে কি আমায়। রিকি
পহেলা বৈশাখ এ ইলিশ মাছ খাওয়া স্মার্টনেস না, আমাদের সংস্কৃতি ও না। ওয়েব রুলার
যে ভাবে এল বাংলা নববর্ষ....। ব্লগার শঙ্খচিল
আজ পহেলা বৈশাখ : প্রাণের উৎসবের বৈশাখ। রুপম হাছান
পহেলা বৈশাখ- দিল্লী থেকে বাংলায়। আফনান আব্দুল্লাহ্
বৈশাখের অপ সংস্কৃতি পান্তা ও ইলিশ। আহমেদ_শাহীন
জিয়া চৌধুরীর ফেইসবুক ইভেন্ট
পহেলা বৈশাখ : চলুন, গ্রামে ফিরে যাই, কৃত্রিম পান্তা-ইলিশ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই
****
ক্রোড়পত্র – ১লা বৈশাখের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
(এই অংশটুকু এ পোস্টের অংশ বিবেচ্য নয়।)
১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে মুগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন বলে বেশিরভাগ পণ্ডিত মনে করেন। ঐ সময়ে বঙ্গে শক বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হতো, যার প্রথম মাস ছিল চৈত্র। বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রথমে ‘তারিখ-ই-এলাহী বা ‘ফসলি সন’নামে পরিচিত ছিল। ১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ মার্চ তারিখে এটি ‘বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। এ নতুন সালটি সম্রাট আকবরের রাজত্বের ২৯তম বর্ষে প্রবর্তিত হলেও তা গণনা করা হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে (Retrospectively)। সম্রাট আকবর ৯৬৩ হিজরী, ১০ রবিউল আউয়াল, রোজ শুক্রবার, ১৪৭৯ শকাব্দ, ১৬১৪ বিক্রমাসম্ভাত, এবং ইংরেজি ১৫৫৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। একই বছর, অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর, এবং ৯৬৪ হিজরির ১ মুহররম তারিখে মাত্র ১৩ বছর বয়সে সম্রাট হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্যকে ২য় পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত করেন। পানিপথের যুদ্ধে সম্রাট আকবরের বিজয়কে মহিমান্বিত করে রাখবার জন্য, এবং অধিকতর পদ্ধতিগত উপায়ে রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে এ বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়েছিল। সম্রাট যে মাসে সিংহাসনে অরোহণ করেন, তার নিকটতম হিজরি বছরের ১ম মাসকে ভিত্তি ধরা হয়। ৯৬৩ হিজরির ১ মহররম ছিল নিকটতম। ঐ বছর শকাব্দের ১ বৈশাখ এবং হিজরির ১ মহররম একই দিনে এসেছিল। বৈশাখ হলো শকাব্দের ২য় মাস, চৈত্র ১ম মাস। ৯৬৩ হিজরির ১ মহররমকে বাংলা ৯৬৩ সনের ১ বৈশাখ পরিচিহ্নিত করে বাংলা সন শুরু করা হয়। অর্থাৎ ১, ২, ৩ - এভাবে হিসেব না করে মূল হিজরি সনের চলতি বছর থেকেই বাংলা সনের গণনা শুরু হয়। ফলে জন্ম বছরেই বাংলা সন ৯৬৩ বৎসর বয়স নিয়ে যাত্রা শুরু করে। উল্লেখ্য, হিজরি সনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। মহানবী (সা.) স্বয়ং আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরি সন চালু করেন নি। এটি প্রবর্তন করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে। হিজরি সনের ক্ষেত্রে যে রকম হিজরতের দিন ও মাস (১২ রবিউল আউয়াল) সুনির্দিষ্টভাবে অবলম্বন না করে শুধুমাত্র সালটিকেই (৬২২ খ্রিষ্টাব্দে) সংরক্ষণ করা হয়, বাংলা সনের ক্ষেত্রেও তেমনি সম্রাট আকবরের রাজ্যাভিষেকের দিন ও মাস (১৪ইং ফেব্রুয়ারি) অবলম্বন না করে শুধুমাত্র বৎসরটি (৯৬৩ হিজরি) সংরক্ষিত হয়। হিজরি সনের প্রথম দিন হলো পহেলা মহররম। বাংলা সনে তা পরিবর্তন করে পহেলা বৈশাখ করা হয়।
৯৬৩ হিজরির ১ মহররম তারিখ ছিল ৯৬৩ বাংলা সনের ১ বৈশাখ। কিন্তু, আজ ধরুন ১৪২২ বাংলা সনের ১লা বৈশাখ, যে হিসেবে বাংলা সন প্রবর্তনের বয়স ১৪২২ - ৯৬৩=৪৫৯ বছর। অথচ, বর্তমান হিজরি ১৪৩৬ সনের হিসেবে ১৪৩৬-৯৬৩=৪৭৩ বছর পার হয়ে গেছে বাংলা সন প্রবর্তনের তারিখ থেকে। ৪৭৩ - ৪৫৯=১৪ বছরের তারতম্য কেন হলো? কোথায় গেলো এই ১৪ বছর?
খুব সরল হিসাব। হিজরি সন চান্দ্রবছর ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে হয়, বাংলা সন ৩৬৫ দিন হিসাবে গোনা হয়। তাহলে বাংলা সন প্রবর্তনের ৪৫৯ কে ৩৬৫ দিয়ে গুণ করলে দাঁড়ায়, ৪৫৯x৩৬৫=১৬৭৫৩৫ দিন। এবার এটাকে হিজরি বছরে কনভার্ট করুন ৩৫৪ দিয়ে ভাগ করে; ১৬৭৫৩৫÷৩৫৪=৪৭৩ বছর। ৪৭৩ বছরকে ৯৬৩ সনের সাথে যোগ করলে আপনি বর্তমান হিজরি সন ১৪৩৬ পেয়ে যাচ্ছেন।
৯৬৩ হিজরি সনে, অর্থাৎ ৯৬৩ বাংলা সনে ১৫৫৬ খ্রিষ্টীয় সন ছিল। ১৫৫৬ – ৯৬৩= ৫৯৩। পার্থক্য ৫৯৩ বছরের। এখন ২০১৫ খ্রিষ্টিয় এবং আজ ১৪২২ বাংলা সন। ২০১৫ – ১৪২২=৫৯৩। অর্থাৎ এখনো খ্রিষ্টীয় এবং বাংলা সনের মধ্যে পার্থক্য ৫৯৩ বছর। পূর্বে ইংরেজি সনের মতো বাংলা সনে কোনো লিপ-ইয়ার ছিল না। ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি বঙ্গাব্দ সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটি চার বছর পরপর চৈত্র মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে ৩১ দিনে গণনা করার পরামর্শ দেয়।
উপরের অংশটুকু নীচের সূত্রাবলম্বনে লিখিত :
বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ :
৫ম খণ্ড - পহেলা বৈশাখ
৬ষ্ঠ খণ্ড - , বাংলা বর্ষপঞ্জি
সৈয়দ আশরাফ আলী
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস : Click This Link
এবং (ইংরেজি) : Click This Link
উইকিপিডিয়া :
বাংলা ক্যালেন্ডার : http://en.wikipedia.org/wiki/Bengali_calendar
পহেলা বৈশাখ : http://en.wikipedia.org/wiki/Pohela_Boishakh
পহেলা বৈশাখ (বাংলায়) : Click This Link
হিজরি-ইংরেজি তারিখ কনভার্সন : http://www.islamicfinder.org/Hcal/index.php
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১:২১