ফুটবল বিশ্বকাপ শুরুর আগে বিভিন্ন ব্যক্তি বা ওয়েবসাইট নিজ নিজ প্রেডিকশনস তৈরি করেছিল। আপনি নিজেও হয়তো এরকম প্রেডিকশন তৈরি করেছিলেন। প্রেডিকশনে কতখানি মিল ঘটবে তা নির্ভর করে ফুটবল দলগুলো ও খেলোয়াড়দের নৈপুণ্যের ব্যাপারে আপনার কত ভালো জ্ঞান আছে তার উপর। অনেক সময় এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান নেই বা বিশ্লেষণী ক্ষমতা রাখেন না, এমন ব্যক্তির প্রেডিকশনও শতভাগ মিলে যায়। যেমন আমার ৮ বছর বয়সী ছোটো ছেলে লাবিব। ও আমাদের হৈচৈ বা লাফালাফি দেখে নিজে হৈচৈ করে ও লাফায়। আমরা যে দল জিতবে বলে প্রেডিক্ট করি, লাবিব সাধারণত তার উলটোটা বলে। এর ফলে এবারের বিশ্বকাপে লাবিবের প্রেডিকশনে সাফল্যের হার আমাদের চেয়ে বেশি।
ফেইসবুকে ব্লগার আদনান শাহরিয়ারকে প্রতিদিন প্রেডিকশন করতে দেখেছি। দুঃখের সাথে লক্ষ করেছি যে, তাঁর প্রেডিকশন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হচ্ছে। আসলে এবারের বিশ্বকাপে অঘটনের সংখ্যা মনে হয় সবচেয়ে বেশি। এ কারণে শুধু আদনান শাহরিয়ারই নন, যাঁদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা খুব উঁচু মাপের, এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই যাঁরা প্রেডিকশন করছেন, তাঁদের প্রেডিকশনই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হচ্ছে।
২০১০ বিশ্বকাপ ফূটবলে প্রেডিকশনের উপর আমি গোটা তিনেক পোস্ট দিয়েছিলাম। দ্বিতীয় রাউন্ডে উন্নীত ১৬টি দলের মধ্যে ১৩টি দল আমার প্রেডিকশন অনুযায়ী উঠেছিল, যেখানে সাফল্যের হার ৮১.২৫%। সাফল্যের হার বেশ ভালো বলা যায়। গত বিশ্বকাপে ফিফা’র অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে প্রেডিকশনের উপর একটা কমপিটিশন ছিল- প্রতি ম্যাচেই সেই প্রেডিকশন কমপিটিশনে পার্টিসিপেট করা যেতো। আমি সেটাতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছিলাম। সাফল্যের হার খারাপ ছিল না। এবারও ঐরকম প্রেডিকশন কমপিটিশনে অংশগ্রহণ করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ফিফা বা অন্য কোনো ওয়েব সাইটে এরকম কোনো আয়োজন খুঁজে পাই নি। তবে, এবারের প্রেডিকশনে সাফল্যের হার যে খুব নিম্নমানের হতো, তা এ পর্যন্ত হয়ে যাওয়া খেলার ফলাফল থেকেই বুঝতে পারছি।
তবে, ইন্টারনেট খুঁজে এরকম বেশকিছু প্রেডিকশন পেয়েছি। এই প্রেডিকশনে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ যেমন আছে, তেমনি আছে ব্যক্তিগত পছন্দের দলের প্রতি বায়াসনেস। এজন্য দেখা যায় ব্রাজিল আর চিলি ফাইনালে উঠে গেছে, অন্যদিকে আর্জেন্টিনা আর স্পেইন তৃতীয় অবস্থানের জন্য মারামারি করছে। তবে, বেশিরভাগ প্রেডিকশনেই ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে খেলতে দেখা গেছে।
খেলা শুরুর আগে ইন্টারনেট ঘেঁটে এরকম প্রেডিকশনের কিছু ছবি আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। সেগুলো দেখে আপনারা মিলিয়ে নিতে পারেন কোন্ প্রেডিকশনটি কতভাগ সফল হয়েছে। এসকল প্রেডিকশনকারীর নামধাম কিছু জানা নেই। আপনাদের মধ্যেও যদি কেউ এরকম প্রেডিকশন করে থাকেন, সেগুলো নিজে নিজে মিলিয়ে দেখতে পারেন, এখানে শেয়ারও করতে পারেন।
(ছবির ফলাফল দেখার জন্য পেইজের জুম বড় করে নিন, অথবা ইমেজ ডাউনলোড করে জুম বড় করে দেখুন)
***
এই পোস্ট পাবলিশ করার আগ পর্যন্ত (২১ জুন ২০১৪, দুপুর ২টা) মোট ২৭টি খেলা হয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অঘটন যা ঘটেছে তা হলো বর্তমান ও সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেন ও ইংল্যান্ডের বিদায়। নেদারল্যান্ডস, চিলি, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা ও ফ্রান্স ২য় রাউন্ডের টিকিট নিশ্চিত করেছে। ব্রাজিল ১ জয় ও ১ ড্র-তে ৪ পয়েন্ট পেয়ে ধুঁকছে, ইটালি ১ জয় ও ১ হারে ৩ পয়েন্ট পেয়ে শেষ ম্যাচের ভরসায় বুক বেঁধে আছে। আর্জেন্টিনা আজ রাতে এশিয়ার দল ইরানের সাথে খেলবে- এ খেলায় আর্জেন্টিনা জিতলে সরাসরি ২য় রাউন্ডে উঠে যাবে; ড্র বা হার হলে অপেক্ষা করতে হবে গ্রুপের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত।
যাই হোক, এক ঝলক দেখে নিন এ পর্যন্ত খেলার হালচাল ও গ্রুপে দলগুলোর অবস্থান।
প্রেডিকশনের বিপদ
আপনি হয়তো মনের আনন্দে এরকম প্রেডিকশন করে থাকেন যে-কোনো কমপিটিশনের সময়েই। প্রেডিকশন মিলে গেলে যেমন আনন্দ পান, ভুল হলে তেমনি ব্যথিত হয়ে থাকেন। আপনার প্রেডিকশন ভুল বা সঠিক যাই হোক না কেন, অন্য আরেকটি বিষয় আপনাকে খুব পীড়িত করতে পারে- তা হলো অন্যান্য প্রেডিক্টর বা সাপোর্টারদের আক্রমণ। আপনার প্রেডিকশন যার সাথে মিলে যাবে, তিনি আপনাকে বন্ধু করে নেবেন, যার সাথে মিলবে না তিনি বা তাঁরা আপনাকে আক্রমণ করবেন ক্রমাগত। এমনকি, আপনার প্রেডিকশন যদি মিলে যায়ও, তবুও আপনি বিপক্ষ দলের আক্রমণের শিকার হতে পারেন। কখন? ধরুন, আপনি আর্জেন্টিনা দলের সাপোর্টার, আমি ব্রাজিলের। আপনি প্রেডিক্ট করেছেন আর্জেন্টিনা আজ ৪-০ গোলে ইরানকে হারাবে, এবং বাস্তবে ঘটলোও তাই। আর্জেন্টিনা কেন জিতলো- একজন ব্রাজিল-সমর্থক হিসাবে এটা আমি মেনে নিতে পারবো না। আর্জেন্টিনার সাথে তো আমার যুদ্ধ ঘোষণার কোনো সামর্থ্য নেই, অতএব আপনাকে যদি একহাত নিয়ে নেয়া যায়, তাতেই আমার চরম শান্তি লাভ হবে।
প্রিয় দলকে সাপোর্ট করা এবং তা থেকে উদ্ভূত মনোমালিন্য
ফুটবল টিমকে সাপোর্ট করা নিয়ে মনোমালিন্য ও ঝগড়া-ফ্যাসাদ সৃষ্টি বোধ হয় বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। খেলা উপভোগ করার মধ্যে যে কত আনন্দ আছে তা আমরা ভুলে যাই। ব্লগ আর ফেইসবুক জুড়ে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা দলের সাপোর্টারদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি ও তিক্ততার শেষ নেই। এ বিষয়টা আমরা জানি, এবং এটা খুব স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশে, যেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও তাঁর প্রিয়দলের নাম বলার সময়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখা যায়।
আমি যদি বলি- ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হবে, আর্জেন্টিনা দলের সাপোর্টারগণ তেড়ে আসবেন, অবস্থাটা এরকম যে আমি বলার কারণেই ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে। অন্যদিকে যদি আর্জেন্টিনার কথা বলি, ব্রাজিল সাপোর্টারগণও অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠবেন। অবস্থাদৃষ্ঠে মনে হতে পারে আমরা নিজেরাই নিজেদের শক্তি ঢেলে মাঠে খেলতে নেমেছি।
কোনো দল খারাপ খেললে যেমন তাদের গোনার বাইরে ফেলে দিই, আবার কেউ ভালো খেললেও তা আমাদের সহ্য হয় না। ব্রাজিল আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হোক, ব্রাজিলিয়ানরা খুব ছোটোলোক- আর্জেনটিনা সাপোর্টারগণ এটা বলে সুখ পান। আবার ব্রাজিল সাপোর্টাগণও কম যান না। বাড়ির টয়লেট বা টাট্টির বেড়া দেয়া হয় আর্জেন্টিনার পতাকা দিয়ে। নতুন সংযোজন হল্যান্ড ক্রেজ। স্পেন ১ম রাউন্ডে বিদায় নিয়েই ভিলেনে পরিণত হয়ে গেলো। যে ‘টিকিটাকা’ ফুটবলে এক নান্দনিকার জন্ম দিয়েছিল, এখন সেই টিকিটাকাকেই আমরা সহ্য করতে পারছি না।
আমি কট্টরপন্থা অপছন্দ করি। আমাদের মন এমন হয়ে গেছে যে, নির্দিষ্ট কোনো একটা দেশের নাম বললেই আমাকে নাস্তা-নাবুদ হতে হবে। ২০১০/২০১১ সনে ফুটবল ও ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলার সময় আমি জাতিসংঘের একটা ফোরামে ছিলাম বেশ কিছুদিন, যেখানে খেলায় অংশগ্রহণকারী অনেকগুলো দেশসহ প্রায় ২৫টি দেশের খুব উচ্চ পর্যায়ের অফিশিয়ালগণ ছিলেন। তাঁদের মধ্যেও ক্রেজ দেখেছি, কিন্তু সেটা ছিল শুধু খেলা উপভোগের আনন্দ। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-ইংল্যন্ড-ইটালি-ফ্রান্স-জার্মানির মানুষগুলো অনেক উপভোগ্য আলোচনা বা ডিবেট করেছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব বা মুখ কালাকালি দেখা যায় নি।
ফুটবলে আমারও প্রিয়দল রয়েছে। সম্প্রতি ফেইসবুকে ব্লগার কাণ্ডারি অথর্ব ভাইয়ের একটা স্টেটাসে কমেন্ট করতে গিয়ে দেখি নিজের অজান্তেই মনের কথাটা বলে ফেলেছি। ফুটবল টিমকে সাপোর্ট করার ব্যাপারে আমি কট্টরপন্থা এড়িয়ে চলি, তা উপরে একবার বলেছি। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম ওয়ার্ল্ডকাপ খেলার আগ পর্যন্ত ক্রিকেটের জন্যও সাপোর্টারদের মধ্যে তীব্র উন্মাদনা ও বাকবিতণ্ডা লক্ষ করা যেত। এটা অনেক গর্ব ও অহংকারের ব্যাপার যে আমরা এখন ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট খেলছি এবং আমাদের মোস্ট ফেভারিট ক্রিকেট টিম হলো আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ টিম। এতে আরেকটা ভালো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তা হলো বিদেশি ক্রিকেট টিমকে সাপোর্ট করা নিয়ে আমাদের মধ্যে এখন আগের মতো ঝগড়া-ফ্যাসাদ নেই (কিছু বিদেশি ক্রিকেটারকে নিয়ে অবশ্য অতিরঞ্জিত আবেগ দেখা যায় কিছু ‘অড’ বাংলাদেশির মধ্যে)।
ফুটবল বিশ্বকাপে আমার সমর্থন একটু অন্য রকমের। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন, হল্যান্ড, জার্মানি- এ থেকে যে-কোনো ২ দল ফাইনালে গেলেই আমি খুশি, এবং এদের যে-কোনো একটা দল চ্যাম্পিয়ন হলেই আমার আনন্দ উপচে পড়বে। তবে সেরাদের সেরা হিসাবে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে দেখতে পেলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবো।
এরপর, এশিয়ান টিমগুলোর জন্য আমার বিশেষ টান আছে। এ দলগুলো খুব জ্বলে উঠুক, এটা চাই। এর সাথে বসনিয়া এন্ড হারজেগোভিনার জন্য টান তো থাকতেই পারে, এবং ওদের প্রথম খেলা দেখার পর আমি মুগ্ধ হয়েছি।
যদিও আমি কোনো খেলাই খেলতে পারি না, কিন্তু স্পোর্টস ওয়ার্ল্ডের সব খেলাতেই আমার আনন্দ আছে। নিয়ম-কানুন বুঝি না, কিন্তু আমি রাগবি খেলা দেখি, এবং প্রচুর আনন্দ পাই। খেঁজুরের আঁটি দিয়ে ‘চার গুঁটি, ষোলো গুঁটি’ থেকে শুরু করে গল্ফ পর্যন্ত আমি ছুঁয়ে দেখেছি। খেলতে যেয়ে আনন্দ, খেলা দেখতে দেখতে আনন্দ।
কিন্তু আপনি ব্রাজিলের সমর্থক, আমি আর্জেন্টিনা- আপনাকে দেখে আমি মুখ কালো করে চলে যাবো- এটা আমি ঘৃণা করি। সু্স্থ ডিবেট হতে পারে, কিন্তু দল সাপোর্ট করা নিয়ে কঠিন তিক্ততার জন্ম হবে, আমি তা পছন্দ করি না।
এই তিক্ত অভিজ্ঞতার সাথে ক্রিকেটের কথা যদি তুলনা করি, তাহলে দেখা যায়- ফুটবলে বিশ্ব অঙ্গনে আমাদের নিজস্ব কিছু নেই বলেই পাগলের মতো অপর দলগুলোকে সাপোর্ট করতে থাকি, এবং ভিন্ন মতের কাউকে পেলেই তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি।
বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচই আমি দেখতে চেষ্টা করি। আমি খেলা উপভোগ করতে ভালোবাসি। মাঝরাতে খেলা দেখতে দেখতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়তে মজা লাগে। এ আনন্দ খুব নির্মল বা নির্ভেজাল।
এই যে ফুটবল বিশ্বকাপে আমি একাধিক দলকে আমার ‘প্রিয়’ তালিকায় রেখেছি, তা দেখে আমার দেশি ভাই ব্লগার আবু শিথি ফান করে আমাকে ‘সুবিধাবাদী’ বলেছেন ব্লগার ‘ভারসাম্য’ও তাঁর সাম্প্রতিক পোস্টে বলেছেন, ‘সমর্থনের অবস্থান বদলায় বারবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। অনেকে এটাকে সুবিধাবাদী অবস্থা বলতে চাইলেও বলতে পারে।’ আমি ব্লগার ভারসাম্য’র ঐ পোস্টে নিজের ‘সুবিধাবাদী’ হওয়ার ব্যাপারে কিছুটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছি। ‘সুবিধাবাদের’ প্রশ্ন ওঠে তখনই যেখানে কোনো বিশেষ সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা বা সম্ভাবনা থাকে। আমি ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন, হল্যান্ড, জার্মানি- এ দলগুলোকে একসঙ্গে সাপোর্ট করলে সবগুলো দল থেকে, বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা দেশের কাছ থেকে আমি বিশেষ কোনো সুবিধা পাচ্ছি কি? পাচ্ছি না। তাহলে আমি সুবিধাবাদী হলাম কীভাবে?
আমি খেলা উপভোগ করি প্রচণ্ডরকম ভাবে। আমার মনে কোনো খেদ বা ক্রোধ বা হিংসা থাকে না, কারণ, আমার কোনো প্রতিপক্ষ নেই। খেলা দেখতে দেখতে চেঁচিয়ে উঠি। এটা আমার আনন্দ।
আপনার পছন্দের দল ব্রাজিল, আমার আর্জেন্টিনা, তাই বলে আপনার সাথে মুখ কালাকালি, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, মারপিটে লিপ্ত হবো, এটা খুব অনভিপ্রেত। এই দলাদলি নিয়ে ভার্সিটির হলগুলোতে রেষারেষি ঘটতে দেখা যায়। আর্জেন্টিনার সাপোর্টারগণ টিভিরুমের সামনের সারিতে বসার সুযোগ পান, ব্রাজিল-সাপোর্টারগণ সেই সুযোগ পান না কেবল ব্রাজিল সমর্থন করার কারণে। অগত্যা কর্তৃপক্ষের মধ্যস্থায় উভয় ‘দলের’ জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করা হয়। আমার জ্ঞান খুব কম, জানি না অন্য কোনো দেশে এরকম ঘটনা দেখা যায় কিনা। তবে আমার স্বল্প পরিসরে যতটুকু দেখার সুযোগ ঘটেছে, আমি এরকম কোথাও দেখি নি।
আমাদের আরেকটি টেনডেন্সি হলো ওয়ার্ল্ড কাপের সময়ে নিজ নিজ দলের জার্সি পরে উল্লাস করা। এটাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে প্রিয় দলের পতাকার ব্যাপারটা একটু অতিরঞ্জিত মনে হয়। ব্লগার সুমন কর তাঁর এক পোস্টে পতাকা উড়ানোর ব্যাপারটা আনন্দ উপভোগ হিসাবেই উল্লেখ করেছেন। এতে আনন্দ আছে বৈকি, কিন্তু সেই আনন্দ ‘নির্ভেজাল’ থাকতে পারছে কিনা তা বলার অপেক্ষা রাখে। উক্ত পোস্টে ব্লগার মাঈনউদ্দিন মইনুল যে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, তাঁর সাথে আমার মতের শতভাগ মিল রয়েছে। ঐ পোস্টে তিনি তাঁর কমেন্টে বলেছেন : পতাকা ওড়ানোর বিষয়টিকে আমি মেনে নিতে পারি না কোনভাবেই। অন্য কোন দেশে এতো আতিশয্য দেখা যায় না। বিশাল সাইজের পতাকা বাড়ির ছাদে, উঠোনে বহুল পরিমাণে টাঙানো হচ্ছে। আমাদের জাতীয় দিবসে বাংলাদেশের পতাকা এভাবে উড়তে দেখা যায় না। যে-ক্রিকেট এখন আমাদের রক্তের সাথে মিশে গেছে, সেই ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপের সময় প্রতিটি ঘরের ছাদে, উঠোনে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়বার কথা ছিল। তা দেখা যায় না।
এক দশক আগেও আমাদের দেশে এত পতাকা দেখা যায় নি ওয়ার্ল্ড কাপের সময়, এবং তখনও ব্লগ বা ফেইসবুকের বহুল ব্যবহার না থাকায় দলভিত্তিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি দেখা যায় নি। এ ব্যাপারে যদি আমাদের সচেতনতা বাড়ানো না যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এ নিয়ে কঠিন ঝগড়াঝাটি ও হত্যাযজ্ঞ পর্যন্তও ঘটতে দেখা যেতে পারে। উপরে ভার্সিটি হলের সাম্প্রতিক ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি। ভবিষ্যতে আর্জেন্টিনার পতাকা-উড়ানো বাসায় ব্রাজিল-সমর্থকরা হামলা দিতে পারেন, ব্রাজিল-সমর্থকরাও তেমনি আর্জেন্টিনা-সমর্থকদের হামলার শিকার হবেন। মহল্লায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। এ থেকে মারামারি, খুনাখুনি পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে। এ অবস্থায় পৌঁছবার আগেই আমাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত। মনে রাখতে হবে, এটা শুধু খেলা- খেলার অপর নাম নির্ভেজাল আনন্দ। বিশ্বকাপ চলাকালীন ১ মাস ৯ দিন সময় নিছক খেলা উপভোগের জন্য ব্যয় করা উচিত, যদিও এহেন অতিরঞ্জনের ফলে বর্তমানেই অনেকে খেলা উপভোগ না করে মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাটি, টেনশনে লিপ্ত হচ্ছেন।
পতাকা উড়ানোর ব্যাপারটাতে হয়তো দেশপ্রেমবিরোধী কোনো ইস্যু নেই, কিন্তু এটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টির পূর্বাভাষ হিসাবেও কাজ করতে পারে। আর যদি দেশপ্রেম টেনে আনিও, তবুও মনে করি আমাদের আরও উদার হতে হবে। ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপের সময়ে আমাদের বাড়িতে, উঠোনে, ঘরের ছাদে এভাবে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা যায় না। তাহলে কি ধরে নেয়া যে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে সাপোর্ট করতে আমাদের অনেক দ্বিধা হয়?
আমার যদ্দূর মনে পড়ে, এর আগে কোনো কোনো ওয়ার্ল্ডকাপের সময়ে দেখেছি, লাঠির মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে তার নীচে প্রিয় দলের পতাকা ঝুলিয়ে দিতে। ব্লগার সুমন করের উপরোল্লিত পোস্টে ব্লগার মামুন রশিদ অবশ্য পতাকা উড়ানোর ব্যাপারে এরকম পদ্ধতির ব্যাপারে তাঁর সায় রয়েছে বলে জানান : ‘আমি মনে করি কেউ তার প্রিয় দলের পতাকা টাঙ্গাতেই পারে, তবে ঐ পতাকার উপরে যেন নিজের দেশের পতাকাটাও থাকে।’
‘আমাদের পতাকা আমাদের মান,
সত্য সুন্দর বিজয় নিশান।’
পতাকা উড়ানো যদি একান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তাহলে শীর্ষে লাল-সবুজ পতাকা বেঁধে তার নীচে যত খুশি পতাকা উড়ানো যেতে পারে। আকাশে প্রিয়দলের পতাকা উড়বে, কিন্তু তারও শীর্ষে পতপত করে উড়তে থাকবে আমাদের রক্তে রাঙানো লাল-সবুজ, প্রিয় স্বদেশ সোনার বাংলাদেশ।
সবাই ভালো থাকুন। খেলা উপভোগ করুন। অপরের মতামতকে সম্মান দিন। ভালোবাসুন প্রিয় দলকে, তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি ভালোবাসুন নিজের দেশকে আর স্বদেশের পতাকাকে।
শুভকামনা সবার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১৪ বিকাল ৪:০৫