সুপ্তি ভালোবেসেছিল। এমন ভালোবাসা অমর কাব্যে গাঁথা থাকে। রুমন সেই ভালোবাসায় হয়েছিল সিক্ত। সেই সিক্ততা খুব বেশিই ছিল।
দুজনের মাঝখানে ঝড়ের মতো যার আবির্ভাব ঘটলো সে হলো আনান। আনান বিধ্বংসী। সর্বগ্রাসী। রুমনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু সে। বন্ধুর প্রেমিকাকে কখনো নিজের প্রেমিকা বলে কল্পনা করে না আনান। সত্যি বলতে কী, প্রেম জিনিসটা তার অভিধানে নেই। যা আছে তা অতি ভয়ংকর। কারণে-অকারণে রুমন আর সুপ্তির অন্তরঙ্গ মুহূর্তে সে উপস্থিত হয়। দুজনের পিঠ চাপড়ে সহজাত হাসিঠাট্টা করে।
আনান একদিন হাস্যচ্ছলে আচমকা হাত বাড়িয়ে সুপ্তির বুক ছুঁয়ে দিল। মুহূর্তে কী হয়ে গেলো! সুপ্তি ঝিম মেরে বসে পড়ে, অবাক হয়। ভর্ৎসনা করে আনানকে। আনান এতে আহত বা লজ্জিত হয় না। এ খুব মামুলি ব্যাপার অধুনার ছেলেমেয়েদের। সুপ্তি এতখানি ব্যাকডেটেড কেন তা ভেবে আনান খুব আশ্চর্য হয়; হাসতে হাসতে সে কুটিকুটি। রুমনও কি ওর সাথে এসব করে না? এতে কত সুখ সুপ্তি তা জানে। সুযোগ কখনো হাতছাড়া করা ঠিক না।
কিন্তু সুপ্তি আনানের কথা মানে না। রুমনের সাথে ওর বহুদিনের প্রেম। ওরা একসাথে কত গভীর ও গোপন সময় কাটিয়েছে। রিকশায় হুড ফেলে ঘুরে বেড়িয়েছে। দুষ্টুমি করে রুমন কখনো সুপ্তির পিঠ কিংবা উরুতে চাপ দেয় নি, তা কিন্তু না। কিন্তু এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো রুমন আর সুপ্তির ভালোবাসা নদীর দু কূল ছাপিয়ে যায়। তারা আকাশে ওড়ে। ঘূর্ণির মতো বাতাসে পাক খায়। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ডানা মেলে। বিকেলের নরম আলোয় ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে যুগল কণ্ঠে কবিতা পড়ে। গান গায়- ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা।’ এ এক অনির্বচনীয় প্রেম। অপার আনন্দময়। তারা ভুলে থাকে দিন ও রাত্রির বাস্তবতা।
আরেকদিন সুযোগ পেয়ে আরো আচমকা সুপ্তিকে একটু বেশি পিষ্ট করলো আনান। ওর প্রতিক্রিয়া এবার খুব দুর্বোধ্য হলো। আনানটা এতো বেপরোয়া হয়ে উঠছে কেন? রুমনকে সবকিছু খুলে বলবে কিনা ভাবতে লাগলো সে। ভাবতে ভাবতে, যেভাবে আনান ওকে জড়িয়ে ধরেছিল, পেছন হতে হঠাৎ এসে দুদিক থেকে দুহাতে খুব শক্ত ভাবে বুকের উপর হাতের মুঠি গেড়েছিল, কল্পনা করতে করতে সুপ্তি একটা অন্যরকম শিহরণ অনুভব করে। এর আগে কোনোদিন এমন অনুভূতি হয় নি। রুমন কি এভাবে পারে না? রুমনকে সে খুব ভালোবাসে। এভাবে রুমন তাকে কোনোদিন আদর করে নি। আদর? আদর কথাটা মনে আসতেই কেমন যেন লাগে। এটাই কি তাহলে প্রেম? রুমনকে সে ঠকাতে চায় না। এই শরীর এই মন সবই রুমনের জন্য সংরক্ষিত, সেখানে অন্য কারো অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ। আনানকে এ কথাটা খুব পরিষ্কার করে জানিয়ে দেয়া দরকার।
‘আনান শোনো। প্লিজ, তুমি আর কখনো অমন করো না। প্লিজ।’
আনান হেসে দেয়। বলে, ‘অমনটা কী জিনিস, সোনাপাখি?’ বলে সে সুপ্তির আরেকটু কাছে আসে। সুপ্তি মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকায়। বলে, ‘তুমি তো জানো আমি একজনকে ভালোবাসি।’
‘অফ কোর্স জানি। একজনকে কেন, একশ জনকে ভালোবাসলেই বা আমার কী ক্ষতি? কারোই কোনো ক্ষতি নেই। তোমারও ক্ষতি নেই। কিন্তু তোমার কী হয়েছে, সোনা?’ বলে সুপ্তির কাছ ঘেঁষে বাম কাঁধের ওপর দিয়ে একটি হাত রাখে, ডান হাতে সুপ্তির থুতনি টেনে নিজের দিকে টানে।
‘ভালোবাসা কী জিনিস তা কি তুমি জানো, আমার ঘুঘুপাখি? তুমি জানো না। তোমাকে ভালোবাসা শেখাতে চাই; আমার খুব শখ।’ বলতে বলতে আনানের শ্বাস দ্রুত ও ঘনতর হয়। সুপ্তির মধ্যেও একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সে বুঝতে পারে না এমন লাগছে কেন। আনান আলতো করে সুপ্তিকে নিজের বুকের কাছে টানে। চুম্বকশক্তির কাছে অনায়াসে সুপ্তি হয়ে যায় সমর্পিতা।
সুপ্তি ভেবে পায় না এর চেয়ে মধুর, এর চেয়ে গভীর কোনো ভালোবাসা হয় কিনা। অপূর্ব এ ভালোবাসা। বিগত এতো বছরে রুমন তাকে যা দিতে পারে নি, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি, অসম্ভব, অতুলনীয় ভালোবাসার স্বাদ দিয়েছে আনান।
এরপর কমতে কমতে একদিন সুপ্তি বুঝতে পারলো রুমনের জন্য ওর মনে আর একবিন্দু ভালোবাসাও বেঁচে নেই- যা আছে তা কেবল আনানের জন্য।
১৫ অক্টোবর ২০০৯