উপক্রমণিকা
বাংলাদেশে যায়যায়দিন, প্রথম আলো, ইত্যাদি পত্রিকাগুলো যখন আমাদের আজন্ম-পরিচিত বানানগুলোকে অন্য ভাবে লেখা শুরু করলো, তখন এর প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। আমার অনুসন্ধানের ফলেই জানতে পেরেছিলাম এ পত্রিকাগুলো বাংলা বানানের প্রমিত নিয়ম অনুসরণ করছে। এরপর প্রমিত বানান-রীতি বুঝবার চেষ্টা করি। এটি আমার কাছে একটা সম্পূর্ণ নতুন ভুবন হিসাবে উন্মোচিত হয়েছিল। এর অনেক আগে, ১৯৮০-৮১ সালের দিকে আমাদের ক্লাস-টিচার ‘জানুয়ারি’, ‘ফেব্রুয়ারি’ বানানগুলোকে ‘রি’ দ্বারা লিখে আমাদেরকে চমকে দিয়েছিলেন, এবং ওটি ‘অশুদ্ধ’ বলে শিক্ষককে ভুল প্রমাণিত করতে আমরা সচেষ্ট হয়েছিলাম। এর পর যখন বানান প্রমিতীকরণের ইতিহাস পড়ি, তখন জানতে পারি ঐ শিক্ষক এরূপ বানান প্রমিতীকরণ আন্দোলনের সাথে আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন।
বানান-বিশুদ্ধতার ব্যাপারে ছোটোবেলা থেকেই আমার প্রচুর আগ্রহ ছিল। কর্মজীবনে প্রতিনিয়ত স্বল্প সময়ে অজস্র ডকুমেন্ট ও প্রেজেন্টেশন প্রস্তুত, সংশোধন ও পরিমার্জন করার প্রয়োজন পড়ে বিধায়, এবং লেখালেখির কিছুটা অভ্যাস থাকায় ‘বিশুদ্ধ বানান’ বিষয়টা মজ্জাগত হয়ে গেছে। এজন্য সামান্যতম ত্রুটি ও বিচ্যুতি খুব সহজেই চোখে ধরা পড়ে, এবং ভুলের বাহুল্য অনেক সময় বিরক্তিরও উদ্রেক করে। ব্লগে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে যেমন বানান-বিষয়ে অনেক সচেতন এবং নির্ভুল বানানে লিখে থাকেন, এবং বানান-বিষয়ে অগাধ জ্ঞানও রয়েছে, তেমনি অনেকে আছেন যাঁরা বানানের ব্যাপারে বেশ উদাসীন। আমরা বেশিরভাগ সময়েই পত্রপত্রিকা, বইপত্র বা ব্লগ ও ফেইসবুকের বানান দেখেই শব্দগুলো শিখে বা লিখে থাকি, এবং ছাত্রজীবনে পাঠ্যপুস্তক থেকে লব্ধ বানান-জ্ঞানই আমাদের বড় সম্বলরূপে কাজ করে। কোনো শব্দের বানানের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে কোনো অভিধানের পরিবর্তে আমরা ব্লগ, ফেইসবুক, পত্রপত্রিকা বা বইপত্রে-দেখা বানানকেই বিশুদ্ধ মনে করি। এতে কোনো দোষ নেই, কিন্তু সমস্যা হয় তখনই যখন ব্লগ, ফেইসবুক বা বইপত্রে মুদ্রণজনিত কারণে কোনো শব্দের ভুল বানানটি দেখে আমরা সেটিকেই বিশুদ্ধ বানান বলে সাব্যস্ত করি এবং এ নিয়ে অহেতুক বিতর্কে লিপ্ত হই। এতে বানান সম্পর্কে আমাদের দৈন্যদশা ও অজ্ঞানতা প্রকাশ পায়। কোনো শব্দের সঠিক বানান সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য কোনো বই বা পত্রপত্রিকা বা ব্লগ না দেখে প্রথমেই আমাদের দেখা উচিত একটা অভিধান। বাংলা একাডেমী অনেকগুলো অভিধান প্রকাশ করেছে; এসব অভিধান ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতের বেশ কিছু অভিধান বাংলাদেশে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। একজনের পক্ষে এতগুলো অভিধান নিজের সংগ্রহে রাখা হয়তো সম্ভব নয়, এবং এতগুলো অভিধান পর্যালোচনা করাও হয়তো সব সময় সম্ভব হয়ে উঠবে না। এজন্য যাঁরা সঠিক বানানে লিখতে চান, আমার মতে, তাঁদের কাছে দুটো অভিধান থাকলে বেশ সুবিধা হয়- শব্দকোষ হিসাবে ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক অভিধান’ এবং বানানের জন্য ‘বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধান’। অনেকের কাছে ‘সংসদ বাংলা অভিধান’ রয়েছে; ওটি বানানের জন্য আমাদের অথোরিটি নয়, কারণ, ঐ অভিধানটি ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রবর্তিত বাংলা বানানের নিয়ম, ১৯৩৬’ মোতাবেক রচিত, যার সাথে বাংলা একাডেমী প্রবর্তিত প্রমিত বানান-নীতির সাথে সামান্য তারতম্য রয়েছে। তবে শব্দকোষ হিসাবে ‘সংসদ বাংলা অভিধান’ খুব কার্যকর।
তবে অভিধানেও যে বানান-ভুল থাকবে না তা নয়, কেননা ওটি একজন মানুষই প্রণয়ন করেছেন; মানুষ মাত্রেই ভুল হতে পারে। অভিধানের বানানটির ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিলে বানানের প্রমিত নিয়মটি দেখে নিন- প্রমিত নিয়মটি দেখবার পর আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন অভিধানে প্রদর্শিত বানানটি সঠিক, নাকি ভুল। আর অভিধানে বানানটি খুঁজতে হবে এর সঠিক বর্ণানুক্রম অনুযায়ী; অনেক সময় অভিধানের অন্যত্র কোনো বানান ‘ভুল’ হিসাবে চোখে ধরা পড়লে ওটির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে এর সঠিক স্থানে খুঁজুন, যেখানে বর্ণক্রম অনুযায়ী শব্দটিকে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। শব্দকোষে সচরাচর শব্দের উৎপত্তি, ব্যুৎপত্তি, প্রকৃতি, প্রত্যয়, ইত্যাদি দেয়া থাকে। এর সাথে বানানের প্রমিত নিয়ম মিলিয়ে নিলেও সঠিক বানান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যেতে পারে।
ব্লগে অধুনা প্রচুর বানান-সচেতনতা লক্ষ করা যাচ্ছে ব্লগারগণের মধ্যে। এটা অনেক ভালো লক্ষণ। আমি ২০০৮ সাল থেকে সামহোয়্যারইনব্লগসহ আরো কয়েকটি বাংলা ব্লগে ব্লগিং করছি। ঐ সময়ে ব্লগ ও ফেইসবুকসহ ইন্টারনেটের কোথাও বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম তন্ন তন্ন করে খুঁজে না পেয়ে ব্লগারদের উপকারিতার কথা ভেবে আমার অন্য নিক থেকে এটি সামহোয়্যারইনব্লগে পোস্ট করি। বাংলা একাডেমীর প্রমিত নিয়মটি প্রকৃতপক্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মেই রচিত হয়েছে, তবে এখানে সামান্য রদ-বদল রয়েছে। উৎসাহী ব্লগারগণ হয়তো দুটো নিয়মই পাঠ করতে চাইবেন, এবং তাঁদের জ্ঞানপিপাসার কথা চিন্তা করেই এই ব্লগে ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রবর্তিত বাংলা বানানের নিয়ম, ১৯৩৬’ এবং আমাদের বাংলা একাডেমীর প্রমিত নিয়ম নিচে জুড়ে দেয়া হলো, যাতে তাঁরা পাশাপাশি অবস্থিত দুটো নিয়ম পর্যালোচনা করে নিজের জ্ঞানতৃষ্ণা ও অনুসন্ধিৎসা নিবারণ করতে পারেন। এবং উল্লেখ্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মটিও অদ্যাবধি ইন্টারনেটের কোনো সাইট/ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে হলো না, কেননা আমি কোথাও খুঁজে পাই নি।
বাংলা বানান প্রমিতকরণের ইতিহাস মোটামুটিভাবে বুঝবার জন্য ‘বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধান’ বইটির ‘প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ’ (জামিল চৌধুরী), ‘পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা’ (জামিল চৌধুরী) এবং ‘বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম – মুখবন্ধ’ পাঠ করা প্রয়োজন। ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক অভিধান’ ও ‘বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধান’-এ লিখিত বিভিন্ন সংস্করণের ভূমিকা ও মুখবন্ধের আলোকে লিখিত বাংলা বানান প্রমিতীকরণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস শুরুতে দেয়া হলো; এর নিচেই উপরোল্লিখিত মুখবন্ধ ও ভূমিকাসমূহ হুবহু বই থেকে তুলে দেয়া হলো। সবার নিচে থাকবে যথাক্রমে ‘বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ ও ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম, ১৯৩৬’।
বানান প্রমিতকরণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৯ শতকের আগে পর্যন্ত বাংলা বানানের নিয়ম বলতে বিশেষ কিছু ছিল না। উনিশ শতকের সূচনায় যখন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক পর্ব শুরু হলো, বাংলা সাহিত্যিক গদ্যের উন্মেষ হলো, তখন মোটামুটি সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসন-অনুযায়ী বাংলা বানান নির্ধারিত হয়। (বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধান, পৃষ্ঠা ৮৮৪)
রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম প্রকাশ করে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৯ সালে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ সরকার মৌলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ-র নেতৃত্বে East Bengal Language Committee গঠন করে। এরপর ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমীর তদানীন্তন পরিচালক সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে বানান-সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। ১৯৬৭ সালে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ব্যক্তিগত আগ্রহে ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষা পর্ষদে বাংলা বানান সরলায়নের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠিত হয়। ১৯৬৮ সালে মুহম্মদ এনামুল হক, মুহম্মদ আবদুল হাই এবং মুনীর চৌধুরী এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে একটি বিবৃতি দেন। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে কমিটির মাধ্যমে বাংলা বানানের নিয়মের একটি খসড়া তৈরি করে।
বানানের ক্ষেত্রে দীর্ঘদীন কোনো সর্বজনগ্রাহ্য নিয়ম চালু করা সম্ভব হয় নি। বাংলা একাডেমী ১৯৯২ এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটির রিপোর্ট জরিপের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো হয়। প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রকাশ করে, যা ১৯৯৮-এ পরিমার্জিত হয়ে ২০০০-এ পুনরায় সংশোধিত হয়। ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমী বাংলা-অভিধান-এর প্রথম প্রকাশনা বের হয়।
কোনো নিয়মনীতিই জোর করে চাপিয়ে দেয়া যায় না। তবে যেখানে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক একটি নিয়ম প্রণয়ন করা হয়েছে, তা মেনে চলা উচিৎ। বাংলা একাডেমী তাদের সকল কাজে প্রমিত বানান রীতি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। সাহিত্যিক, পত্রিকা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই রীতি ব্যবহারের সুপারিশ ও অনুরোধ করেছে।
১৯৯১ সালে আনন্দ পাবলিশার্স তাদের আনন্দ বাজার পত্রিকার জন্য নিজস্ব বানানরীতি প্রণয়ন করেছিল। ২০০৬ সালে প্রথম আলো তাদের পত্রিকার জন্য নিজস্ব ভাষারীতি প্রণয়ন করে। প্রথম আলোর ভাষারীতি এই লিংক থেকে ডাউনলোড করে দেখা যাবে। কৃতজ্ঞতা : ব্লগার ফিউশন ফাইভ।
প্রত্যেক মানুষ, বিশেষত সাহিত্যিকের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা থাকে, কমবেশি। তাই তাঁরা কোনো চাপিয়ে দেয়া রীতি, যদি তাঁদের মত-বিরুদ্ধ হয়, সহজে মেনে নিতে চান না। বাংলা একাডেমীর কমিটির সদস্যগণও বেশ কিছু বানানের ক্ষেত্রে একমত হতে পারেন নি, যা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। একটা পত্রিকা ভাষার ক্রম বর্ধমান, পরিমার্জন, ও সংশোধনের ইতিহাস, আবার এসবের সহায়কও। যায়যায়দিন তাদের পত্রিকায় বিশেষ কিছু বানানের উদাহরণ ছাপতো যা লেখকগণকে অনুসরণ করতে বলা হতো।
‘বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধান‘ বইটি বানানের জন্য অথোরিটি হিসেবে ব্যবহার করি, এবং অর্থের জন্য বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক অভিধান' বইটি ব্যাপকভাবে কনসাল্ট করি। আমি সর্বত্র বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম অনুসরণ করবার চেষ্টা করি, ভুল হলে সেটা মনে না থাকার কারণে, বা ভুলে যাবার কারণে ঘটে যায়। শব্দকোষ হিসেবে যে-কোনো অভিধানই ভোকাবিউলারি বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে, তবে আমি মনে করি, বানানের ক্ষেত্রে যে-কোনো একটি নিয়মই অনুসরণ করা উচিৎ, আর সেটা হলো বাংলা একাডেমী প্রমিত বানান-রীতি, এর আলোকে প্রণীত ‘বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধান’।
******
বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধানের ‘প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ’ - জামিল চৌধুরী
আভাষ
বানান অভিধান প্রচলিত অভিধান থেকে ভিন্ন। প্রচলিত অভিধানগুলো শব্দার্থ অভিধান, যার মূল লক্ষ্য প্রতিটি অন্তর্ভুক্তির নির্ভুল বানানের শাশাপাশি শব্দটির অর্থ ও উৎস নির্দেশ। বানান-অভিধানের লক্ষ্য কেবল শব্দের শুদ্ধ বানানরীতি নির্দেশ করা। প্রশ্ন উঠতেই পারে শব্দার্থের অভিধানেও তো বানান আছে, তাহলে এ ধরনের অভিধানের প্রয়োজনীয়তা কোথায়। প্রয়োজনীয়তা এখানে যে, ভাষায় ব্যবহৃত অনেক শব্দ একাধিক বানানে লেখা যায় এবং হয়ও (কখনও ভুল কখনো শুদ্ধ উভয়তই), যা আদেৌ বাঞ্ছনীয় নয়। বানান-অভিধানের লক্ষ্য তাই মূল শব্দ ও তা থেকে উদ্ভূত যাবতীয় শব্দের প্রমিত, এবং সম্ভব হলে, বিকল্পহীন বানান নির্ধারণ করে দেওয়া।
বাংলায় বানান-অভিধানের ধারণা খুব প্রাচীন নয়। ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কুমিল্লা কর্মশিবিরে আলোচ্য বিষয়সমূহের মধ্যে ছিল ‘...পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের একটা পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা ও বানান-নির্দেশিকা প্রণয়ন করা’। এর আগে বানানের সমতাবিধানের লক্ষ্যে ২৪ ফাল্গুন ১৩৪২ বঙ্গাব্দে (৮ মার্চ ১৯৩৬) আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত “বাংলা বনান সমস্যা” প্রবন্ধে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ঘোষ একটি মাঝারি আকারের অভিধান প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ঘোষের মতে:
ক) বানান সমস্যার সমাধান অল্পসংখ্যক বা বহুসংখ্যক নিয়ম প্রণয়ন বা উদাহরণ সংগ্রহের দ্বারা হইবে না।
খ) বহু যত্নে লিখিত নতুন ব্যাকরণের দ্বারা বানান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হইলেও এ যুগে উহা বাঞ্ছনীয় নহে।
গ) একখানি মাঝারি অকারের অভিধান প্রণয়নই এ সমস্যার সমাধান বলিয়া মনে হয়।
অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ঘোষের প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার পর ইতোমধ্যে প্রায় ইতোমধ্যে প্রায় ষাট বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু বাংলায় কোনো পণ্ডিত অদ্যাবধি বানান সংক্রান্ত কোনো অভিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেন নি, যদিও অন্যান্য ভাষায় Orthographic Dictionary–র প্রচলন রয়েছে। উচ্চারণ-অভিধানও এতকাল ছিল না বাংলায়, সম্প্রতি উভয় বঙ্গেই এ ধরনের একাধিক অভিধান প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলায় বোধকরি এটিই প্রথম এ জাতীয় অভিধান। কিছুকাল আগে কলকাতা থেকে অধ্যাপক ও সাহিত্য-সমালোচক অরুণ সেন ‘বানানের অভিধান—বাংলা বানান ও বিকল্প বর্জন’ (ডিসেম্বর ১৯৯৩) নামে যে গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন তা সমগোত্রীয় হলেও তাতে কেবল কিছুসংখ্যক বিতর্কিত বানানের শব্দাবলি গ্রহণ করা হয়েছে। সে অর্থে বাংলা বানানের পূর্ণাঙ্গ অভিধান সেটি নয় এবং সে লক্ষ্যও সংকলকের ছিল না।
বাংলা বানানের যত ধরনের অসমঞ্জসতা ও বৈচিত্র্য দেখা যায় তা ব্যাকরণের নিয়মসূত্র প্রয়োগ করে ঠিক করতে গেলে শুধু বানান-বিষয়েই এক বৃহদাকার ব্যাকরণ রচনা করবার দরকার হয়ে পড়বে। কোনো যোগ্য ব্যক্তি ভবিষ্যতে হয়ত সে-কর্ম সম্পাদন করবেন। কিন্তু এ মুহূর্তে যা নিতান্ত প্রয়োজন, তা হলো বাংলা ভাষায় সাম্প্রতিককালে বানানের যে-ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্য বিরাজ করছে তাকে যতটুকু সম্ভব শমিত করা, স্বেচ্ছাচার বন্ধ করা। বর্তমান অভিধানের উদ্দেশ্য এর অধিক কিছু নয়।
ধরে নেয়া হয়েছে, যাঁরা অভিধানটি ব্যাবহার করবেন তাঁরা অভিধানে অন্তর্ভুক্ত শব্দগুলোর সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত। এ সব শব্দের বানানের ব্যাপারে নিশ্চিত না হলে অথবা একাধিক অভিধানসিদ্ধ বানানের মধ্যে কোনটিকে গ্রহণ করবেন তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হলে এই অভিধান তাঁদের সাহায্য করবে।
এ পর্যন্ত বাংলা বানান-সংস্কার ও প্রমিতীকরণের যত চেষ্টা হয়েছে এখানে সে সম্পর্কে আলোকপাত করা সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
বানান বিতর্ক
বানান বিতর্ক বিষয়টি ব্যাপক। অনেকের ধারণা বাংলা বানানপদ্ধতি অত্যন্ত জটিল ও দুরূহ। দুটি জ, দুটি ণ, তিনটি শ, ত এবং ৎ-র প্রয়োগ, হ্রস্ব-দীর্ঘ স্বরের জন্য একাধিক চিহ্ন এবং কতক যুক্তব্যঞ্জনের অস্বচ্ছ রূপ বানান ও মুদ্রণ পদ্ধতিকে আরো সমস্যাসংকুল করেছে।
দীর্ঘকাল যাবৎ বাংলা বানান সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসন অনুযায়ী চলে আসছিল। উনিশ শতকের গোড়ায় বাংলা গদ্যরীতিতে তদ্ভব, দেশী ও বিদেশী শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন থেকে ক্রমান্বয়ে অ-তৎসম শব্দের বানানে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে আরম্ভ করে।
বর্তমান শতাব্দীর বিশের দশকে বিশ্বভারতী চলতি ভাষার বানানের একটি নিয়ম স্থির করে। বানানের এই নিয়ম নির্ধারণ করে দেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং তা দেখে দিয়েছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের উদ্যোগে ও রবীন্দ্রনাথের অনুমোদনক্রমে বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলি ঐ বানানরীতি অনুসরণে মুদ্রিত হতে থাকে। এই নিয়মাবলি ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩৩২ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯২৬) সংখ্যায় ছাপা হয়।
এর পর ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে কয়েকজন মনীষীকে নিয়ে ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কার সমিতি’ গঠিত হয়। ৮ মে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম প্রকাশ করে এবং তার পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ বের করে ১৯৩৭-এর মে মাসে।
লক্ষ করবার মতো বিষয় হলো এই যে, বিশ্বভারতী বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রচারিত বাংলা বানানের নিয়মকানুন দেশের বিদ্বৎসমাজের প্রশ্নাতীত সমর্থন যেমন পায় নি, তেমনি সৃজনশীল সাহিত্যিকবর্গও তা সর্বাংশে মান্য করেন নি; ফলে বানানের বিসৃঙ্খলা রয়েই গেল।
দেশ বিভাগের পর ১৯৮৯ সালে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ সরকার মৌলানা মোহম্মদ আকরম খাঁ-র নেতৃত্বে East Bengal Language Committee গঠন করে। এই কমিটি গঠনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষাকে ‘পাকিস্তানের মানুষের প্রতিভা ও কৃষ্টির সংঙ্গে সংগতিপুর্ণ করা এবং সে–লক্ষ্যে বর্ণমালা সংস্কার, বানান-সংস্কার, লিপি-সংস্কার, (আরবি বা রোমান হরফে বাংলা লেখা) ইত্যাদি প্রসঙ্গ বিবেচনা করা। পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য পূর্ববঙ্গ সরকার এই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ সমীচীন মনে করে নি। রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হবার পর।
১৯৬৩ সালে পুনরায় বাংলা একাডেমীর তদানীন্তন পরিচালক সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে বানান-সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সদস্যের মধ্যে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, কাজী মোতাহার হোসেন, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ, মুহম্মদ ফেরদৌস খান, মুনীর চৌধুরী এবং আবুল কাসেম। এই কমিটি বাংলা বর্ণমালা থেকে ঙ, ঃ, ঈ এবং ী-কার বাদ দেবার সুপারিশ করে। ২৮ মার্চ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ব্যক্তিগত আগ্রহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পর্ষদ বাংলা ভাষা, ব্যাকরণ ও বর্ণমালা সংস্করণের ও সরলায়নের জন্য আরো একঠি কমিটি গঠন করে। অন্যান্যদের মধ্যে ড. মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ, কাজী দীন মুহাম্মদ আব্দুল হাই, মুনীর চৌধুরী এবং আবুল কাশেম এই কমিটির সদস্য ছিলেন। গঠনের ১১ মাস পরে এই কমিটি শিক্ষা পর্ষদের বিবেচনার জন্য একটি সুপারিশ পেশ করে। যতদূর জানা যায় এই কমিটি বাংলা বর্ণমালা থেকে ঈ ঊ ঐ ঔ ঙ ঞ ণ ষ এবং ঈ-কার, ঊ-কার, ঐ-কার এবং ঔ-কার ইত্যাদি বর্জন, যুক্তবর্ণের উচ্ছেদ, ব-ফলা ও য-ফলার পরিবর্তে বর্ণদ্বিত্ব গ্রহণ, জ-য এবং স-শ ব্যবহারের জন্য নতুন নিয়ম উদ্ভাবন, এ-কার এবং ই-কারকে ব্যঞ্জনের ডান পাশে বসানোসহ কয়েকটি উদ্ভট প্রস্তাব ঐ সুপারিশের অন্তর্ভুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সুপারিশটি গ্রহণ করলেও কখনো এই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করে নি। উক্ত কমিটির সদস্যদের মধ্যে একমাত্র ড. মুহম্মদ এনামুল হক ছিলেন বাংলা ভাষা ও বানান সংস্কার প্রস্তাবের ঘোর বিরোধী এবং পূর্বাপর স্বমতনিষ্ঠ। তিনি কোনো সংস্কার প্রস্তাবে সই করেন নি। পরবর্তী পর্যায়ে মুহম্মদ এনামুল হক, মুহম্মদ আব্দুল হাই এবং মুনীর চৌধুরী ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ তারিখে স্বাক্ষরিত একটি যুক্ত বিবৃতিতে সংস্কার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এই মর্মে মত প্রকাশ করেন: ‘... আমরা মনে করি যে, বাংলা লিপি ও বানান সরলায়ন ও সংস্কারের কোনো আশু প্রয়োজন নাই। এইরূপ কাজে হাত দিলে নিশ্চিতরূপে ভ্রান্তি বিভ্রান্তিতে পরিণত হইবে এবং পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙলা ভাষার দ্রুত উন্নয়ন বিশেষভাবে ব্যাহত হইবে।’ বলা বাহুল্য যে পূর্ববঙ্গের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই সংস্কার প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতা করেন।
১৯৮০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলা বানানের নিয়ম সমিতি’ বাংলা বর্ণমালা থেকে ঙ, ঞ, ণ, ঈ-কার এবং য-ফলা বাদ দেবার প্রস্তাব করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলা বনানের নিয়ম সমিতি’র এই প্রয়াস সফল হয় নি।
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রতিষ্ঠানলগ্ন থেকেই লিপি সংস্কার, বানান সংস্কার, উচ্চারণ ও পরিভাষা কোষ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও মতবিনিময়ের সূত্রপাত করে। ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত সেমিনারের উপর ভিত্তি করে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ‘বাংলা বানান সংস্কার : একটি ভিত্তিপত্র’ প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়ে তাঁদের মতামত সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়।
১৯৯১ সালে আনন্দ পাবলিশার্স নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন’ নামে আনন্দবাজার পত্রিকার নিজস্ব ব্যবহার–বিধি প্রকাশ করে। এ ছাড়াও উভয় বঙ্গে ভাষা বা বানান সংস্কারের কয়েকটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেওয়া হয়। এঁদের মধ্যে আবুল হাসানাৎ, আবুল কাসেম, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুহম্মদ ফেরদাউস খান, জগন্নাথ চক্রবর্তী প্রমুখের প্রয়াস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম
বাংলা একাডেমীর ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’–এ (ডিসেম্বর ১৯৯২, পরিমার্জিত সংস্করণ জানুয়ারি ১৯৯৪) বানান বা লিপি সংস্কারের প্রয়াস করা হয় নি। কেবল বানানকে অভিন্ন ও প্রমিত করবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এর আগে পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের সমতা বিধানের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড–এর উদ্যোগে কুমিল্লায় তিন দিনের (২১–২৩ অকটোবর) একটি কর্মশিবির অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মশিবিরের বিবেচ্য বিষয় ছিল:
‘১. এ পর্যন্ত বাংলা বানানের যেসব নীতিমালা প্রণীত হয়েছে, তা পর্যালোচনা করা;
২. একই শব্দের হ্রস্ব–দীর্ঘ বানানের মধ্যে কোন্টি গ্রহণীয়, সে সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ করা;
৩. যুক্তবর্ণের স্বচ্ছ ও স্পষ্ট রূপ ব্যবহারের প্রণালি স্থির করা;
৪. বিদেশী শব্দের প্রতিবর্ণীকরণের নিয়ম নির্ধারণ করা;
৫. উপরিউক্ত বিষয়ে সুপারিশের ভিত্তিতে পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের একটা পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা ও বানান–নির্দেশিকা প্রণয়ন করা।’
কুমিল্লা কর্মশিবিরে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় ‘পাঠ্য বইয়ের বানান’ নামে একঢি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এই পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ নিয়ম অনুসরণ করে বোর্ডের বিদ্যালয়পাঠ্য পুস্তকাদি মুদ্রিত হতে আরম্ভ করে।
বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধানে অনুসৃত বানান–নীতি
বাংলা একাডেমীর ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ অনুসরণ করে এই অভিধানে তৎসম শব্দের বানান অপরিবর্তত রাখা হয়েছে।
• যে–সব তৎসম শব্দে হ্র্স্ব ও দীর্ঘ স্বরচিহ্ন উভয়ই সিদ্ধ সে–সব শব্দে কেমল হ্রস্ব স্বর ব্যবহৃত হয়েছে।
• রেফের পরে ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব বর্জন করা হয়েছে (যেমন ধম্ম>ধর্ম, সূর্য্য>সূর্য) ।
• ক খ গ ঘ এবং ক্ষ–র পূর্বে নাসিক্যবর্ণ যুক্তকরণের জন্য সর্বত্র ঙ লেখা হয়েছে।
এই নিয়ম পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীয় নিয়মের সঙ্গে অভিন্ন। সদ্ধিতে প্রথম পদের শেষে ম্ ধাকলে ক–বর্গের পূর্বে ম স্থানে ং এবং বিকল্পে ঙ লেখা হয়েছে। ‘ব্যাংক’ শব্দটি প্রচলন অনুসরণ করে ং দিয়ে লেখা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বানান–নীতিতে কোনো বিকল্প না রেখে ম্ স্থানে কেবল ং লিখবার বিধান দেওয়া হয়েছে।
অ–তৎসম, তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, অজ্ঞাতমূল এবং মিশ্র শব্দে ই এবং উ স্বর এবং আলি প্রত্যায়ান্ত শব্দে ই–কার ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বনাম পদরূপে এবং বিশেষণ ও ক্রিয়া–বিশেষণ পদরূপে কী শব্দ ঈ–কার দিয়ে এবং অব্যয় পদরূপে কি শব্দ ই–কার দিয়ে লেখা হয়েছে।
সংস্কৃত মূল অনুসরণ করে ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত ক্ষ দিয়ে লেখা হয়েছে।
বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানানের নিয়মে অ–তৎসম এবং বিদেশী শব্দের বেলায় ণত্ববিধি ও ষত্ববিধি মানা হয় নি। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নিয়মে চ–বর্গের পূর্বে সর্বত্র ঞ এবং অঘোষ চ–বর্গের কেবল শ, ট–বর্গের পূর্বে সর্বত্র ণ এবং অঘোষ ট–বর্গের পূর্বে কেবল ষ এবং ত–বর্গের পূর্বে সর্বত্র ন এবং অঘোষ ত–বর্গের পূর্বে স লিখবার সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নিয়মে ইসলাম ধর্ম–সংক্রান্ত কতকগুলো শব্দের বানান উচ্চারণ অনুসরণ করে জ–এর পরিবর্তে ষ দিয়ে লিখবার বিধান দেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমীর প্রমিতীকরণের নিয়মে এসব শব্দের বানানে য এবং বিকল্পে জ লিখবার বিধান দেওয়া হয়েছে। ও, এ এবং অ্যা–স্বরের জন্য পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলা একাডেমী, বিশ্বভারতী এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অভিন্ন।
বাংলা একাডেমীর ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ সম্পর্কে লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, বাংলা একাডেমী কোনোরূপ বানান সংস্কারের প্রয়াস করে নি, কেবল দু–একটি ক্ষেত্রে বিকল্প বর্জন করেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-অনুসৃত নিয়মাবলির ব্যতিক্রম বাদে সবই একাডেমী গ্রহণ করেছে। বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম বিশ্বভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানের নিয়ম থেকে খুব দূরবর্তী নয়।
বর্তমান অভিধান সঙ্কলন ও স্বহস্তে বর্ণবিন্যাস করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা থেকে জোর দিয়ে বলা যায় কয়েকটি বিকল্প বর্জন ব্যতীত কোনো প্রকার বানান সংস্কার বা বর্ণ বর্জনের প্রয়োজনীয়তা কখনো অনুভূত হয় নি। এ মুহূর্তে যা আশু প্রয়োজন তা হলো বাংলা লিপির নতুন ডিজাইন (সংস্কার নয়), যাতে সকল ব্যঞ্জন ও যুক্তব্যঞ্জনের সঙ্গে অভিন্ন ু ূ ৃ ্ (আরো তিনটি চিহ্ন আছে যেগুলো দেয়া গেলো না- সংযুক্ত ন, সংযুক্ত ম, সংযুক্ত ল) চিহ্ন যুক্ত করা যায়। একটি উদাহরণ দিলে এই বাক্যের অর্থ পরিষ্কার হবে। যেমন ক গ অথবা ঘ–এর নিচে বা পাশে এই চিহ্নগুলো বসালে হবে খু গৃ ঘ্ন়়়, কিন্তু ক–এর (অথবা ছ ঝ ড় হ ক্ত ক্র ক্ষ ঞ্চ ঞ্ছ ষ্ণ ইত্যাদি বর্ণের) নিচে বা পাশে এই চিহ্নগুলো দিলে হবে কু কৃ ছু ডু হু ক্ম (ক্+ম) ক্ষ্ণ (ক্ষ+ণ) ইত্যাদি। আবার এই বর্ণগুলোর জন্য স্বতন্ত্র চিহ্ন ব্যবহার করলে চেহারা হবে কু কূ কৃ ক্ম ক্ষ্ণ ছু ডু হু হূ হৃ (এই অংশটুকু ব্লগে সঠিকভাবে দেখানো গেলো না – সোনাবীজ)। এইসব চিহ্নযুক্ত কয়েকটি ব্যঞ্জন ও যুক্তব্যঞ্জনের নন্দনতাত্ত্বিক শ্রীবর্ধনের জন্য এক দিকে যেমন অতিরিক্ত সময় নষ্ট হয় অন্য দিকে কমপিউটারের বাড়তি স্মৃতিশক্তি ব্যবহার করতে হয় এবং এ জন্য LASER মুদ্রণে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৮৮ সালে সংকলকের নেতৃত্বে বাংলা একাডেমীর একটি কমিটি কমপিউটার ও মুদ্রাক্ষরযন্ত্রে ব্যবহারের জন্য প্রতিটি বর্ণ, বর্ণভেদ ও চিহ্নের জন্য registration mark–সহ পরিমাপ ও আপেক্ষিক অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাপ অনুযায়ী টাইপ ফন্ট ডিজাইন করলে মুদ্রণে জটিলতা অনেকটা কমবে বলে আশা করা যায়।
বর্ণানুক্রম
অভিধানে অনুসৃত বর্ণানুক্রমে অনুস্বার, বিসর্গ এবং চন্দ্রবিন্দুকে স্বরবর্ণ থেকে স্বতন্ত্র এবং ব্যঞ্জনবর্ণের ঠিক পূর্বে বিন্যাস করা হয়েছে। ড় ঢ় এবং য়–কে স্বতন্ত্র বর্ণের মর্যাদা দিয়ে যথাক্রমে ড, ঢ এবং য–এর পরে স্থান দেওয়া হয়েছে। বর্ণানুক্রমে হস্যুক্ত ব্যঞ্জন সাধারণত স্বরযুক্ত ব্যঞ্জনের পরে এবং যুক্তবর্ণের অব্যবহিত পূর্বে বিন্যাস করা হয়ে থাকে। সে যুক্তিতে ৎ–র (ত্=ৎ) অবস্থান হওয়া উচিত স্বরযুক্ত ত–এর পরে এবং ত–এর যুক্তবর্ণ আরম্ভ হবার অব্যবহিত পূর্বে। বর্তমান অভিধানে ৎ–কে স্বতন্ত্র বর্ণের মর্যাদা দিয়ে এবং ত–এর যুক্তবর্ণের পরে বর্ণানুক্রমে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে:
অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ
ং ঃ ঁ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ড় ঢ ঢ় ণ ত ৎ থ দ ধ ন
প ফ ব ভ ম য য় র ল শ ষ স হ
বানান–অভিধানে সাধারণত ব্যাকরণের সূত্র–নির্দেশ থাকবার কথা নয়। কিন্তু সংকলকের বিবেচনায় মনে হয়েছে– অন্তর্ভুক্ত শব্দটি বিশেষ্য, বিশেষণ না অব্যয় ইত্যাকার পদ পরিচিতি কিংবা শব্দটি ইন্–প্রত্যয়ান্ত কি না তার নির্দেশনা থাকলে অভিধানটির ব্যবহারযোগ্যতা বাড়বে। কাছাকাছি উচ্চারণের কিছু কিছু শব্দের এবং যে–সব শব্দের অর্থ গ্রহণে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা রয়েছে, কেবল সে–ধরনের কিছু কিছু শব্দের অন্তর্ভুক্তির পাশে তৃতীয় বন্ধনীতে অর্থ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঁকা অক্ষরে উচ্চারণ, এবং কয়েকটি শব্দের প্রয়োগ নির্দেশ করা হয়েছে। প্রয়োগ দেখাবার জন্য যে–সব উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে স্থান সংকুলানের জন্য তাদের রচয়িতার নাম দেওয়া হয় নি।
প্রণেতা দীর্ঘকাল যাবৎ বাংলাদেশ সরকারের পরিভাষা–সংক্রান্ত সচিব কমিটির সদস্য থাকার সূত্রে যে–সব পারিভাষিক শব্দ সরকার কর্তৃক গৃহীত বলে জানেন, এই অভিধানে সে–সব শব্দ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; তার মধ্যে কিছু কিছু অন্তর্ভুক্তির প্রতিশব্দ, বোধগম্যতার স্পষ্টতার লক্ষ্যে, ইংরেজিতে দেওয়া হয়েছে।
পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে ং এবং বিকল্পে ঙ লেখার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বিশেষ কয়েকটি আরবি শব্দের z ধ্বনির উচ্চারণ নির্দেশ করবার জন্য য এবং বিকল্পে জ লিখবার কথা হয়েছে। বাংলায় এমন কিছু শব্দ আছে যে–সব শব্দ চন্দ্রবিন্দু দিয়ে অথবা চন্দ্রবিন্দু ছাড়া লেখা যায় এবং এর ফলে অর্থ গ্রহণে কোনো বিভ্রান্তি ঘটে না। এই তিনটি ক্ষেত্র ছাড়া যতদূর সম্ভব এই অভিধানে বিকল্প বানান বর্জন করা হয়েছে।
অভিধানে নতুন শব্দ আসে লেখকের কাছ থেকে। সাংবাদিক ও সাহিত্যিকেরা নতুন শব্দ তৈরি করেন, যা শব্দার্থ অভিধানে স্থান পেতে অনেকখানি সময় লেগে যায়। ঐ জাতীয় শব্দ বানান–অভিধানে থাকা সংগত বলে বিবেচিত হয়েছে। সময়ের স্বল্পতার জন্য এ কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় নি। কিছুটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেল। ভুলভ্রান্তি একেবারে নেই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। এই অভিধানের বর্ণবিন্যাস নিজ হাতে ব্যক্তিগত কমপিউটারে করা; এবং ভুলভ্রান্তির সমগ্র দায়দায়িত্ব সংকলকের নিজের। বাংলা একাডেমীর বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী স্বরচিহ্নের একাধিক রূপ বর্জন করে কেবল একটি করে রূপ রাখা হয়েছে এবং কয়েকটি যুক্তবর্ণের রূপকে স্বচ্ছ করা হয়েছে। নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনায় কিছু কিছু যুক্তবর্ণের প্রথাসিদ্ধ রূপ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
কাজী আবদুল ওদুদ - ব্যবহারিক শব্দকোষ
জাতীয় গণমাধ্যম ইনসটিটিউট - ব্যবহারিক উচ্চারণ অভিধান
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস - বাঙ্গালা ভাষার অভিধান
রাজশেখর বসু - চলন্তিকা
শৈলেদ্র বিশ্বাস - সংসদ বাঙ্গালা অভিধান
সুবলচন্দ্র মিত্র - সরল বাঙ্গালা অভিধান
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় - বঙ্গীয় শব্দকোষ
জামিল চৌধুরী - বানান ও উচ্চারণ
A M Macdonald - CHAMBERS TWENTIETH CENTURY DICTIONARY
Monier Monier-Williams - A SANSKRIT-ENGLISH DICTIONARY এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সাময়িকী ও সরকারি নথিপত্র
ব্যবহৃত সংকেত–চিহ্ন
এই অভিধানে অনুজ্ঞা বা অনুরোধ ক্রিয়াস্থলে অনু–ক্রি, অব্যয়স্থলে অব্য, অশুদ্ধ প্রয়োগ বা প্রচলনস্থলে অশু–প্র, অসমাপিকা–ক্রিয়াস্থলে অস–ক্রি, ক্রিয়াস্থলে ক্রি, ক্রিয়া–বিশেষণস্থলে ক্রি–বিণ, ক্রিয়া–বিশেষ্যস্থলে ক্রি–বি, বিশেষণস্থলে বিণ, বিশেষণীয় বিশেষণস্থলে বিণ–বিণ, পুংলিঙ্গস্থলে পুং এবং স্ত্রীলিঙ্গস্থলে সংক্ষেপে স্ত্রীং লেখা হয়েছে। ইন্–প্রত্যয়ান্ত শব্দের পাশে বিন্, –ধিন্, –নিন্ ইত্যাদি সংকেত ব্যবহার করা হয়েছে।
কৃতজ্ঞতা
এই অভিধান প্রণয়নের কাজে যাঁরা সংকলককে বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন তাঁদের সবার নাম লিখে শেষ করা যাবে না। কিন্তু যাঁদের নাম উল্লেখ না করলে কাজটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক মোহাম্মদ হারুন–উর–রশিদ। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্র্রহ, উৎসাহ ও সহায়তা ছাড়া এত অল্প সময়ের মধ্যে এই অভিধান প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন বশীর আল্হেলাল, আনিসুজ্জমান ও হায়াৎ মামুদ। প্রুফ সংশোধনের কাজে সাহায্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যাপক মাহবুবুল হক এবং বাংলা একাডেমী প্রেস ব্যবস্থাপক আশফাক–উল–আলম। সহায়তা দিয়েছেন ওবায়দুল ইসলাম এবং গবেষণা সংকলন ও ফোকলোর বিভাগ এবং বাংলা একাডেমী মুদ্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ। এই অভিধান প্রণয়নের জন্য ব্যবহৃত শহীদলিপি সফটওয়্যারে কয়েকটি বর্ণভেদ এবং যুক্তবর্ণ তৈরি করে দিয়েছেন সাইফুদ্দাহার শহীদ ও শাব্বির শফিউল্লা। প্রতিটি পৃষ্ঠায় শিরোনাম বসাবার কাজে মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম ও সাইদুর রহমান নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন।
ঢাকা ২৫ বৈশাখ ১৪০১ - জামিল চৌধুরী
*********
বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধান-এর ‘পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা’ – জামিল চৌধুরী
বানাননীতি
রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ১৯৩৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম প্রকাশ করার পর (১৯৩৭–এ সংশোধিত) ৭০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে মোটামুটিভাবে কলিকাতা বিশ্বাবিদ্যালয়ের বানাননীতি অনুসৃত হলেও বাংলা বানানে বিভ্রান্তি আজও পুরোপুরি কাটে নি।
বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের উদ্যোগে ১৯৮৮ সালে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পটভূমিতে পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের সমতাবিধানবিষয়ক জাতীয় কর্মশিবিরে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের একটি পূর্ণাঙ্গ সুপারিশমালা গৃহীত হয় এবং তার উপর ভিত্তি করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ও অন্যান্যদের সম্পাদনায় একটি নির্দেশিকা প্রণীত হয় (১৯৯২)। এর পর ১৯৯২–এ ঢাকার বাংলা একাডেমীও প্রমিত বাংলা বানানের নিয় (১৯৯৮–এ পরিমার্জিত এবং ২০০০–এ পুনরায় সংশোধিত) প্রকাশ করে ।
পশ্চিমবঙ্গে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানানের নিয়ম সমিতি (১৯৭৯) বাংলা বর্ণমালা থেকে কয়েকটি বর্ণ ও স্বরচিহ্ন বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রয়াস সফল হয় নি। ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে আলোচনার ধারাবাহিকতায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি বাংলা বানান সংস্কার : একটি ভিত্তিপত্র প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়ে তাঁদের মতামত গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালে আকাদেমির বানানবিধি গৃহীত হয়। ১৯৯১ সালে আনন্দ পাবলিশার্স নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন’ নামে আনন্দবাজার পত্রিকার নিজস্ব ব্যবহারবিধি প্রকাশ করে। ২০০৬-এর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ‘প্রথম অলো ভাষারীতি’। কলকাতার শিশু সাহিত্য সংসদ ও সাহিত্য সংসদ প্রকাশন সংস্হারও আছে নিজস্ব বানানবিধি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাংলা বানান সংস্কারের প্রথম উদ্যোক্তা সম্ভবত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৩৫ বঙ্গাব্দ)। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বানান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে যাঁরা ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করেন তাঁদের মধ্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ আবদুল হাই, আবুল হাসনাত, আবুল কাসেম, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুহম্মদ ফেরদাউস খান, শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র সরকার, জগন্নাথ চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ সেন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম অনুসরণ করে বাংলা একাডেমী বানান অভিধান প্রণীত হয় ১৯৯৪ সালে। এখন তার পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে। এই অভিধানে কিছু কিছু শব্দের যে বানান দেওয়া হয়েছে তার ব্যাখ্যা আবশ্যক। সংস্কৃতে ‘তীর’ শব্দের অর্থ কূল বা তট এবং ফারসি ভাষায় এই শব্দের অর্থ বাণ বা শর । বাণ অর্থে ‘তীর’–এর উৎস ফারসি হওয়ায় শব্দটির দীর্ঘস্বর বর্জন করে ‘তীর’ > ‘তির’ করা হয়েছে। একই যুক্তিতে ফারসি থেকে আগত ‘দূরবীন’ শব্দের বানান বদলে ‘দুরবিন’ করা হয়েছে। ‘পন্থী’ শব্দটি বাংলায় দীর্ঘ ঈ–কার দিয়ে লেখা হয়ে আসছে। উৎস সন্ধান করলে দেখা যায় যে শব্দটি সংস্কৃত নয়। ‘দেশী’ শব্দটিও সংস্কৃত নয়। এই যুক্তিতে বাংলায় ‘দেশী’ ও ‘পন্থীর’ বদলে যথাক্রমে ‘দেশি’ ও ‘পন্থি’ বানান লেখাই সংগত।
******
বাংলা একাডেমী বাংলা বানান-অভিধানের ‘পরিশিষ্ট গ’
[ব্যবহারিক অভিধানের পরিমার্জিত সংস্করণের পরিশিষ্ট হিসাবে মুদ্রণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ কমিটির নিকট ‘বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’-এর মধ্যকার কিছু অসঙ্গতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ২৭ নভেম্বর ২০০০ তারিখে উক্ত কমিটির একটি সভায় তা আলোচিত হয় এবং কিছু সংশোধনী গ্রহণ করা হয়। উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর আনিসুজ্জামান, প্রফেসর মহম্মদ মনিরুজ্জামান, জনাব জামিল চেৌধুরী এবং জনাব সেলিনা হোসেন। সংশোধিত ‘নিয়ম’টি এখানে মুদ্রিত হলো।]
বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম
মুখবন্ধ
উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত বাংলা বানানের নিয়ম বলতে বিশেষ কিছু ছিল না। উনিশ শতকের সূচনায় যখন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক পর্ব শুরু হলো, বাংলা সাহিত্যিক গদ্যের উন্মেষ হলো, তখন মোটামুটি সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসন-অনুযায়ী বাংলা বানান নির্ধারিত হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় বহু তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ থাকলেও অর্ধ-তৎসম, তৎভব, দেশী, বিদেশী শব্দের পরিমাণ কম নয়। এ ছাড়া রয়েছে তৎসম অ-তৎসম প্রত্যয়, বিভক্তি, উপসর্গ ইত্যাদি সহযোগে গঠিত নানারকমের মিশ্র শব্দ। তার ফলে বানান নির্ধারিত হলেও বাংলা বানানের সমতাবিধান সম্ভবপর হয় নি। তাছাড়া, বাংলা ভাষা ক্রমাগত সাধু রীতির নির্মোক ত্যাগ করে চলিত রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। তার উপর অন্য অনেক ভাষার মতো বাংলারও লেখ্য রূপ সম্পূর্ণ ধ্বনিভিত্তিক নয়। তাই বাংলা বনানের অসুবিধাগুলো চলতেই থাকে। এই অসুবিধা ও অসঙ্গতি দূর করার জন্য প্রথমে বিশ শতকের বিশের দশকে বিশ্বভারতী এবং পরে ত্রিশের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম নির্ধারণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র সহ অধিকাংশ পণ্ডিত ও লেখক সমর্থন করেন। এখন পর্যন্ত এই নিয়মই আদর্শ নিয়মরূপে মোটামুটি অনসৃত হচ্ছে।
তবু বাংলা বানানের সম্পূর্ণ সমতা বা অভিন্নতা যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নয়। বরং কালে কালে বানানের বিশৃঙ্খলা যেন বেড়ে গেছে। কতগুলি শব্দের ক্ষেত্রে দেখা যায় নানাজনে নানারকম বানান লিখছেন। বাংলার মতো উন্নত ভাষার পক্ষে এটি গৌরবের কথা নয়। বানানের এইসব বিভিন্নতা ও বিশৃঙ্খলার কী কী ভাষাতাত্ত্বিক, ধ্বনিতাত্ত্বিক, এমনকি সামাজিক কারণ থাকতে পারে এখানে সে-আলোচনার দরকার নেই। তবে অনেক চলমান ও বর্ধিষ্ণু ভাষাতেই দীর্ঘকাল জুড়ে ধীরে ধীরে বানানের কিছু কিছু পরিবর্তন হতে দেখা যায়। তখন এক সময় বানানের নিয়ম নতুন করে বেঁধে দেওয়ার বা সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়। পূর্বে বলেছি, এ-যাবৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দেশিত নিয়ম আমরা অনুসরণ করে চলেছি। কিন্তু আধুনিক কালের দাবি-অনুযায়ী, নানা বানানের যে-সব বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি আমরা দেখছি সেই পরিপ্রেক্ষিতে বানানের নিয়মগুলিকে আর একবার সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিশেষত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দেশিত নিয়মে বিকল্প ছিল কিছু বেশি। বিকল্প হয়তো একেবারে পরিহার করা যাবে না, কিন্তু যথাসাধ্য তা কমিয়ে আনা দরকার। এইসব কারণে বাংলা একাডেমী বাংলা বানানের বর্তমান নিয়ম নির্ধারণ করছে।
বাংলাদেশে এ–কাজ হয়তো আগে হওয়া উচিত ছিল। ১৯৪৭-এর পর সরকার, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও কোনো কোনো ব্যক্তি বাংলা বানান ও লিপির সংস্কারের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা কখনো সফল হয় নি। আমরা এই নিয়মে বানান বা লিপির সংস্কারের প্রয়াস না করে বানানকে নিয়মিত, অভিন্ন ও প্রমিত করার ব্যবস্হা করেছি। এ–কাজ করার দাবি অনেক দিনের এবং তা যে বাংলাদেশে একেবারে হয় নি সে–কথাও ঠিক বলা চলে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে কর্মশালা করে ও বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে বাংলা বানানের নিয়মের একটি খসড়া প্রস্তুত করেছেন। বোর্ড এই নিয়ম করেছেন প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারের জন্য। সেই নিয়মের খসড়া থেকে আমরা সাহায্য নিয়েছি এবং সেজন্য আমরা বোর্ডের প্রতি কৃতজ্ঞ। বলা বাহুল্য, বিশ্বভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই ক্ষেত্রে যে পথিকৃতের কাজ করেছিলেন তার জন্য সকল বাঙালিই তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। এ ছাড়া বহু অভিধানপ্রণেতার সাহায্য আমরা গ্রহণ করেছি। তাঁদের প্রতিও আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
এই নিয়ম সুপারিশ করার জন্য বাংলা একাডেমী নিম্নরূপ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন :
প্রফেসর আনিসুজ্জামান, সভাপতি;
প্রফেসর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সদস্য;
জনাব জামিল চৌধুরী, সদস্য;
অধ্যাপক ননের বিশ্বাস, সদস্য; এবং
জনাব বশীর আল্হেলাল, সদস্য–সচিব।
এখন থেকে বাংলা একাডেমী তার সকল কাজে, তার বই ও পত্র–পত্রিকায় এই বানান ব্যবহার করবে। ভাষা ও সাহিত্যের জাতীয় প্রতিষ্ঠানরূপ বাংলা একাডেমী সংশ্লিষ্ট সকলকে– লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং বিশেষভাবে সংবাদপত্রগুলিকে– সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে এই বানান ব্যবহারের সুপারিশ ও অনুরোধ করছে।
প্রতিটি নিয়মের সঙ্গে বেশি করে উদাহারণ দেওয়া হয়েছে যাতে নিয়মটি বুঝতে সুবিধা হয়। অদূর ভবিষ্যতে এই নিয়মানুগ, যতদূর সম্ভব বৃহৎ একটি শব্দকোষ সংকলন ও প্রকাশের ইচ্ছা আমাদের রয়েছে।
আর একটি কথা। আমরা আগে ইঙ্গিত করেছি, এটি কোনো বানান–সংস্কারের প্রয়াস নয়। আমরা কেবল বানানের নিয়ম বেঁধে দিয়েছি, বরং বলা যায়, বানানের নিয়মগুলিকে ব্যবহারকারীর সামনে তুলে ধরেছি। এইসব নিয়ম বা এইসব বানানে ব্যাকরণের বিধান লঙ্ঘন করা হয় নি।
তৎসম শব্দ
১.০১
তৎসম অর্থাৎ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অবিকৃত সংস্কৃত শব্দের বানান যথাযথ ও অপরিবর্তিত থাকবে। কারণ এইসব শব্দের বানান ও ব্যাকরণগত প্রকরণ ও পদ্ধতি নির্দিষ্ট রয়েছে।
১.০২
তবে যেসব তত্সম শব্দে ই ঈ বা উ ঊ উভয় শুদ্ধ সেইসব শব্দে কেবল ই বা উ এবং তার-কার চিহ্ন ই-কার উ-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন : কিংবদন্তি, খঞ্জনি, চিৎকার, ধমনি, পঞ্জি, ধূলি, পদবি, ভঙ্গি, মঞ্জরি, মসি, লহরি, সরণি, সূচিপত্র, উর্ণা, উষা।
১.০৩
রেফ-এর পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন : অর্চনা, অর্জন, অর্থ, অর্ধ, কর্দম, কর্তন, কর্ম, কার্য, গর্জন, মূর্ছা, কার্তিক, বার্ধক্য, বার্তা, সূর্য।
১.০৪
সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার (ং) লেখা যাবে। যেমন : অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত, শুভংকর, হৃদয়ংগম, সংঘটন। তবে অঙ্ক, অঙ্গ, আকাঙ্ক্ষা, গঙ্গা, বঙ্গ, লঙ্ঘন, সঙ্গ, সঙ্গী, প্রভৃতি সন্ধিবদ্ধ নয় বলে ঙ স্থানে ং হবে না।
অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দ
২.০১ ই ঈ উ ঊ
সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের-কার চিহ্ন ই-কার উ-কার ব্যবহৃত হবে। এমনকি স্ত্রীবাচক ও জাতিবাচক ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। যেমন গাড়ি, চুরি, দাড়ি, বাড়ি, ভারি (অত্যন্ত অর্থে), শাড়ি, তরকারি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, বাঙালি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি, সরকারি, মাস্টারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বে-আইনি, ছড়ি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, মামি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, ছুঁড়ি, নিচ, নিচু, ইমান, চুন, পুব, ভুখা, মুলা, পুজো, উনিশ, উনচল্লিশ।
অনুরূপভাবে- আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে। যেমন : খেয়ালি, বর্ণালি, মিতালি, সোনালি, হেঁয়ালি।
তবে কোনো কোনো স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারে। যেমন : রানী, পরী, গাভী।
সর্বনাম পদরূপে এবং বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন : কী করছ? কী পড়ো? কী খেলে? কী আর বলব? কী জানি? কী যে করি! তোমার কী। এটা কী বই? কী করে যাব? কী বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে। কী আনন্দ! কী দুরাশা!
অন্য ক্ষেত্রে অব্যয় পদরূপে ই-কার দিয়ে কি শব্দটি লেখা হবে। যেমন : তুমিও কি যাবে? সে কি এসেছিল? কি বাংলা কি ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি পারদর্শী।
পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে। যেমন : ছেলেটি, লোকটি, বইটি।
২.০২ ক্ষ
ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত শব্দ খির, খুর ও খেত না লিখে সংস্কৃত মূল অনুসরণে ক্ষীর, ক্ষুর ও ক্ষেত-ই লেখা হবে। তবে অ-তৎসম শব্দ খুদ, খুদে, খুর, খেপা, খিধে, ইত্যাদি লেখা হবে।
২.০৩ মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য ন
তৎসম শব্দের বানানে ণ, ন-য়ের নিয়ম ও শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে। এ-ছাড়া তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র কোনো শব্দের বানানে ণত্ব-বিধি মানা হবে না অর্থাৎ ণ ব্যব হার হবে না। যেমন : অঘ্রান, ইরান, কান, কোরান, গুনতি, গোনা, ঝরনা, ধরন, পরান, সোনা, হর্ন।
তৎসম শব্দে ট ঠ ড ঢ-য়ের পূর্বে যুক্ত নাসিক্য বর্ণ ণ হয়, যেমন : কণ্টক, লুণ্ঠন, প্রচণ্ড। কিন্তু তৎসম ছাড়া অন্য সকল শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ-য়ের আগেও কেবল ন হবে। ৪.০১ দ্রষ্টব্য।
৪.০১ ণত্ব-বিধি সম্পর্কে দুই মত
অ-তৎসম শব্দের যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারেন নি। একটি মতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ণ্ট ণ্ঠ ণ্ড ণ্ঢ হবে। যথা : ঘণ্টা, লণ্ঠন, গুণ্ডা। অন্যমতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ন্ট ন্ঠ ন্ড ন্ঢ হবে। যথা : ঘন্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লন্ঠন, গুন্ডা, পান্ডা, ব্যান্ড, লন্ডভন্ড।
২.০৪ শ, ষ, স
তৎসম শব্দে শ, ষ, স-য়ের নিয়ম মানতে হবে। এ-ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে সংস্কৃতের ষত্ব-বিধি প্রযোজ্য হবে না।
বিদেশী মূল শব্দে শ, স-য়ের যে প্রতিষঙ্গী বর্ণ বা ধ্বনি রয়েছে বাংলা বানানে তাই ব্যব হার করতে হবে। যেমন : সাল (=বৎসর), সন, হিসাব, শহর, শরবত, শামিয়ানা, শখ, শৌখিন, মসলো, জিনিস, আপস, সাদা, পোশাক, বেহেশ্ ত, নাশতা, কিশমিশ, শরম, শয়তান, শার্ট, স্মার্ট। তবে পুলিশ শব্দটি ব্যতিক্রমরূমে শ দিয়ে লেখা হবে। তৎসম শব্দে ট, ঠ বর্ণের পূর্বে ষ হয়। যেমন : বৃষ্টি, দুষ্ট, নিষ্ঠা, পৃষ্ঠা। কিন্তু বিদেশী শব্দে এই ক্ষেত্রে স হবে। যেমন : স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্টুডিয়ো, স্টেশন, স্টোর, স্ট্রিট।
কিন্তু খ্রিষ্ট যেহেতু বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ এবং এর উচ্চারণও হয় তৎসম কৃষ্টি, তুষ্ট ইত্যাদি শব্দের মতো, তাই ষ্ট দিয়ে খ্রিষ্ট শব্দটি লেখা হবে।
২.০৫ আরবি-ফারসি শব্দে 'সে', 'সিন', 'সোয়াদ' বর্ণগুলির প্রতিবর্ণরূপে স, এবং 'শিন'-এর প্রতিবর্ণরূপে শ ব্যব হৃত হবে। যেমন ; সালাম, তসলিম, ইসলাম, মুসলিম, মুসলমান, সালাত, এশা, শাবান (হিজরি মাস), শাওয়াল (হিজরি মাস), বেহেশ্ ত। এই ক্ষেত্রে স-এর পরিবর্তে ছ লেখার কিছু প্রবণতা দেখা যায়, তা ঠিক নয়। তবে যেখানে বাংলায় বিদেশী শব্দের বানান সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে স ছ-য়ের রূপ লাভ করেছে সেখানে ছ ব্যব হার করতে হবে। যেমন : পছন্দ, মিছিল, মিছরি, তছনছ।
২.০৬ ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশী s বর্ণ বা ধ্বনির জন্য স এবং sh, -sion, -ssion, -tion প্রভৃতি বর্ণগুচ্ছ বা ধ্বনির জন্য শ ব্যবহৃত হবে।
২.০৭ জ, য
বাংলায় প্রচলিত বিদেশী শব্দ সাধারণভাবে বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতি-অনুযায়ী লিখতে হবে। যেমন : কাগজ, জাহাজ, হুকুম, হাসপাতাল, টেবিল, পুলিশ, ফিরিস্তি, হাজার, বাজার, জুলুম, জেব্রা।
কিন্তু ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কয়েকটি বিশেষ শব্দে 'যে', 'যাল', 'যোয়াদ', 'যোই' রয়েছে, যার ধ্বনি ইংরেজি z-এর মতো, সেক্ষেত্রে উক্ত আরবি বর্ণ গুলির জন্য য ব্যবহৃত হওয়া সঙ্গত। যেমন : আযান, এযিন, ওযু, কাযা, নামায, মুয়ায্ যিন, যোহর, রমযান। তবে কেউ ইচ্ছা করলে এই ক্ষেত্রে য-এর পরিবর্তে জ ব্যবহার করতে পারেন। জাদু, জোয়াল, জো, ইত্যাদি শব্দ জ দিয়ে লেখা বাঞ্ছনীয়।
২.০৮ এ, অ্যা
বাংলায় এ বা এ-কার দ্বারা অবিকৃত এ এবং বিকৃত বা বাঁকা অ্যা এই উভয় উচ্চারণ বা ধ্বনি নিষ্পন্ন হয়। তৎসম বা সংস্কৃত ব্যাস, ব্যায়াম, ব্যাহত, ব্যাপ্ত, জ্যামিতি, ইত্যাদি শব্দের বানান অনুরূপভাবে লেখার নিয়ম রয়েছে। অনুরূপ তৎসম এবং বিদেশী শব্দ ছাড়া অন্য সকল বানানে অবিকৃত-বিকৃত নির্বিশেষে এ বা এ-কার হবে। যেমন : দেখে, দেখি, যেন, জেনো, কেন, কেনো (ক্রয় করো), গেল, গেলে, গেছে।
বিদেশী শব্দ অবিকৃত উচ্চারণের ক্ষেত্রে এ বা এ-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন : এন্ড (end), নেট, বেড, শেড।
বিদেশী শব্দে বিকৃত বা বাঁকা উচ্চারণে অ্যা বা অ্যা-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন : অ্যান্ড (and), অ্যাবসার্ড, অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাক, ম্যানেজার, হ্যাট।
তবে কিছু তদ্ভব এবং বিশেষবভাবে দেশী শব্দ রয়েছে যার অ্যা-কারযুক্ত রূপ বহুল-পরিচিত। যেমন : ব্যাঙ, চ্যাঙ, ল্যাঙ, ল্যাঠা। এসব শব্দে অ্যা অপরিবর্তিত থাকবে।
২.০৯ ও
বাংলা অ-কারের উচ্চারণ বহুক্ষেত্রে ও-কার হয়। এই উচ্চারণকে লিখিত রূপ দেওয়ার জন্য ক্রিয়াপদের বেশ কয়েকটি রূপের এবং কিছু বিশেষণ ও অব্যয় পদের শেষে, কখনো আদিতে অনেকে যথেচ্ছভাবে ও-কার ব্যবহার করছেন। যেমন : ছিলো, করলো, বলতো, কোরছ, হোলে, যেনো, কেনো (কীজন্য), ইত্যাদি ও-কারযুক্ত বানান লেখা হচ্ছে। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া অনুরূপ ও-কার ব্যবহার করা হবে না। বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে এমন অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে ও-কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব ঘটতে পারে। যেমন : ধরো, চড়ো, বলো, বোলো, জেনো, কেনো (ক্রয় করো), করানো, খাওয়ানো, শেখানো, করাতো, মতো, ভালো, আলো, কালো, হলো।
২.১০ ং, ঙ
তৎসম শব্দে ং এবং ঙ যেখানে যেমন ব্যবহার্য ও ব্যাকরণসম্মত সেইভাবে ব্যবহার করতে হবে। এ-সম্পর্কে পূর্বে ১.০৪ অনুচ্ছেদে কিছু নিয়মের কথা বলা হয়েছে। তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দের বানানের ক্ষেত্রে ওই নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এই ক্ষেত্রে প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে সাধারণভাবে অনুস্বার (ং) ব্যবহৃত হবে। যেমন : রং, সং, পালং, ঢং, রাং, গাং। তবে শব্দে অব্যয় বা বিভক্তি যুক্ত হলে কিংবা পদের মধ্যে বা শেষে স্বরচিহ্ন থাকলে ঙ হবে। যেমন : বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের। বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দ-দুটি ং দিয়ে লিখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে তাই করা হয়েছে।
২.১১ রেফ ও দ্বিত্ব
তৎসম শব্দের অনুরূপ বানানের ক্ষেত্রে যেমন পূর্বে বলা হয়েছে, অ-তৎসম সকল শব্দেও রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন : কর্জ, কোর্তা, মর্দ, সর্দার।
২.১২ বিসর্গ
শব্দের শেষে বিসর্গ থাকবে না। যেমন : কার্যত, মূলত, প্রধানত, প্রয়াত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ।
পদমধ্যস্থ বিসর্গ থাকবে। তবে অভিধানসিদ্ধ হলে পদমধ্যস্থ বিসর্গ বর্জনীয়। যেমন : দুস্থ, নিস্পৃহ।
২.১৩ আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দ
আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে ও-কার যুক্ত করা হবে। যেমন : করানো, বলানো, খাওয়ানো, পাঠানো, নামানো, শোয়ানো।
২.১৪ বিদেশী শব্দ ও যুক্তবর্ণ
বাংলায় বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণকে বিশ্লিষ্ট করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যুক্তবর্ণের সুবিধা হচ্ছে তা উচ্চারণের দ্বিধা দূর করে। তাই ব্যাপকভাবে বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণ বিশ্লিষ্ট করা অর্থাত ভেঙে দেওয়া উচিত নয়। শব্দের আদিতে তো অনুরূপ বিশ্লেষ সম্ভবই নয়। যেমন : স্টেশন, স্ট্রিট, স্প্রিন্ট, স্প্রিং। তবে কিছু কিছু বিশ্লেষ করা যায়। যেমন : সেপটেম্বর, অকটোবর, মার্কস (ক-এর নিচে হসন্ত), শেকসপিয়র (ক-এর নিচে হসন্ত), ইসরাফিল (স-এর নিচে হসন্ত)।
২.১৫ হস্-চিহ্ন
হস্-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন : কাত, মদ, চট, ফটফট, কলকল, ঝরঝর, তছনছ, জজ, টন, হুক, চেক, ডিশ, করলেন, বললেন, শখ, টাক, টক।
তবে যদি ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকে তাহলে হস্-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন : উহ্, যাহ্।
যদি অর্থের বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে তাহলেও তুচ্ছ অনুজ্ঞায় হস্-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন : কর্, ধর্, মর্, বল্।
২.১৬ ঊর্ধ্ব-কমা
ঊর্ধ্ব-কমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন : করল (=করিল), ধরত, বলে (=বলিয়া), হয়ে, দু জন, চার শ, চাল (চাউল), আল (=আইল)।
বিবিধ
৩.০১
যুক্ত-ব্যঞ্জনবর্ণগুলি যতদূর সম্ভব স্বচ্ছ করতে হবে অর্থাৎ পুরাতন রূপ বাদ দিয়ে এগুলির স্পষ্ট রূপ দিতে হবে। তার জন্য কতকগুলি স্বরচিহ্নকে বর্ণের নিচে বসাতে হবে। যেমন গু, রু, শু, দ্রু, শ্রু, রূ, ভ্রূ, হৃ, ত্র, ভ্র। (দু:খিত, কম্পিউটারে এগুলোর কোনোটাই বর্ণের নিচে দেয়া গেলো না- খলিল মাহমুদ)।
তবে ক্ষ, জ্ঞ, ঞ্জ, ষ্ণ, হ্ম, ভ্র, হ্ন- এইসব ক্ষেত্রে পরিচিত যুক্তরূপ অপরিবর্তিত থাকবে। কেননা তা বিশ্লিষ্ট করলে উচ্চারণবিকৃতির সম্ভাবনা থাকে।
৩.০২
সমাসবদ্ধ পদগুলো একসঙ্গে লিখতে হবে, মাঝখানে ফাঁক রাখা চলবে না। যেমন : সংবাদপত্র, অনাস্বাদিতপূর্ব, পূর্বপরিচিত, রবিবার, মঙ্গলবার, স্বভাবগতভাবে, লক্ষ্যভ্রষ্ট, বারবার, বিষাদমণ্ডিত, সমস্যাপূর্ণ, অদৃষ্টপূর্ব, দৃঢ়সঙ্কল্প, সংযতবাক, নেশাগ্রস্ত, পিতাপুত্র।
বিশেষ প্রয়োজনে সমাসবদ্ধ পদটিকে একটি, কখনো একটির বেশি হাইফেন (-) দিয়ে যুক্ত করা যায়। যেমন মা-মেয়ে, মা-ছেলে, বেটা-বেটি, বাপ-বেটা, ভবিষ্য-তহবিল, সর্ব-অঙ্গ, বে-সামরিক, স্থল-জল-আকাশ-যুদ্ধ, কিছু-না-কিছু।
৩.০৩
বিশেষণ পদ সাধারণভাবে পরবর্তী পদের সঙ্গে যুক্ত হবে না। যেমন : সুনীল আকাশ, স্তব্ধ মধ্যাহ্ন, সুগন্ধ ফুল, লাল গোলাপ, ভালো দিন, সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু যদি সমাসবদ্ধ পদ অন্য বিশেষ্য বা ক্রিয়াপদের গুণ বর্ণনা করে তাহলে স্বভাবতই সেই যুক্তপদ একসঙ্গে লিখতে হবে। যেমন : কতদূর যাবে, একজন অতিথি, তিনহাজার টাকা, বেশির-ভাগ ছেলে, শ্যামলা-বরন মেয়ে। তবে কোথাও কোথাও সংখ্যাবাচক শব্দ একসঙ্গে লেখা যাবে। যেমন : দুজনা।
৩.০৪
নাই, নেই, না, নি এই নঞর্থক অব্যয় পদগুলি শব্দের শেষে যুক্ত না হয়ে পৃথক থাকবে। যেমন : বলে নাই, যাই নি, পাব না, তার মা নাই, আমার ভয় নেই।
তবে শব্দের পূর্বে নঞর্থক উপসর্গরূপে না উত্তরপদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। যেমন : নারাজ, নাবালক, নাহক।
অর্থ পরিস্ফুট করার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভূত হলে না-এর পর হাইফেন ব্যবহার করা যায়। যেমন : না-বলা বাণী, না-শোনা কথা, না-গোনা পাখি।
৩.০৫
উদ্ধৃতি মূলে যেমন আছে ঠিক তেমনি লিখতে হবে। কোন পুরাতন রচনায় যদি বানান বর্তমান নিয়মের অনুরূপ না হয়, উক্ত রচনার বানানই যথাযথভাবে উদ্ধৃত করতে হবে। যদি উদ্ধৃত রচনায় বানানের ভুল বা মুদ্রণের ত্রুটি থাকে, ভুলই উদ্ধৃত করে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে শুদ্ধ বানানটির উল্লেখ করতে হবে। এক বা দুই ঊর্ধ্ব-কমার দ্বারা উদ্ধৃত অংশকে চিহ্নিত করতে হবে। তবে উদ্ধৃত অংশকে যদি ইনসেট করা হয় তাহলে ঊর্ধ্ব-কমার চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে না। তাছাড়া কবিতা যদি মূল চরণ-বিন্যাস অনুযায়ী উদ্ধৃত হয় এবং কবির নামের উল্লেখ থাকে সে-ক্ষেত্রেও উদ্ধৃতি-চিহ্ন দেওয়ার দরকার নেই। ইনসেট না হলে গদ্যের উদ্ধৃতিতে প্রথমে ও শেষে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দেওয়া ছাড়াও প্রত্যেক অনুচ্ছেদের প্রারম্ভে উদ্ধৃতি-চিহ্ন দিতে হবে। প্রথমে, মধ্যে বা শেষে উদ্ধৃত রচনার কোনো অংশ যদি বাদ দেওয়া হয় অর্থাত উদ্ধৃত করা না হয়, বাদ দেওয়ার স্থানগুলিকে তিনটি বিন্দু বা ডট্ (অবলোপ চিহ্ন) দ্বারা চিহ্নিত করতে হবে। গোটা অনুচ্ছেদ, স্তবক বা একাধিক ছত্রের কোনো বৃহত্ অংশ বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি তারকার দ্বারা একটি ছত্র রচনা করে ফাঁকগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে।
কোনো পুরাতন অভিযোজিত বা সংক্ষেপিত পাঠে অবশ্য পুরাতন বানানকে বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী পরিবর্তিত করা যেতে পারে।
৪.০১ ণত্ব-বিধি সম্পর্কে দুই মত
অ-তৎসম শব্দের যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারেন নি। একটি মতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ণ্ট ণ্ঠ ণ্ড ণ্ঢ হবে। যথা : ঘণ্টা, লণ্ঠন, গুণ্ডা। অন্যমতে বলা হয়েছে যে, এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ন্ট ন্ঠ ন্ড ন্ঢ হবে। যথা : ঘন্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লন্ঠন, গুন্ডা, পান্ডা, ব্যান্ড, লন্ডভন্ড।
চলতি ভাষায় ক্রিয়াপদের কতকগুলি রূপ
হ-ধাতু :
হয়, হন, হও, হস, হই। হচ্ছে। হয়েছে। হোক, হোন, হও, হ। হলো, হলে, হলাম। হতো। হচ্ছিল। হয়েছিল। হবো, হবে। হয়ো, হস। হতে, হয়ে, হলে, হবার (হওয়ার), হওয়া।
খা-ধাতু :
খায়, খাও, খান, খাস, খাই। খাচ্ছে। খেয়েছে। খাক, খান, খাও, খা। খেল, খেলে, খেলাম। খেত, খাচ্ছিল। খেয়েছিল। খাব, খাবে। খেয়ো, খাস। খেতে, খেয়ে, খেলে, খাবার (খাওয়ার), খাওয়া।
দি-ধাতু :
দেয়, দেন, দাও, দিস, দিই। দিচ্ছে। দিয়েছে। দিক, দিন, দাও, দে। দিল, দিলে, দিলাম। দিত। দিচ্ছিল। দিয়েছিল। দেবো, দেবে। দিও (দিয়ো), দিস। দিতে, দিয়ে, দিলে, দেবার (দেওয়ার), দেওয়া।
নি-ধাতু :
নেয়, নেন, নাও, নিস, নিই। নিচ্ছে। নিয়েছে। নিক, নিন, নাও, নে। নিল, নিলে, নিলাম। নিত। নিচ্ছিল। নিয়েছিল। ণেব, নেবে। নিও (নিয়ো), নিস। নিতে, নিয়ে, নিলে, নেবার (নেওয়ার), নেওয়া।
শু-ধাতু :
শোয়, শোন, শোও, শুস, শুই। শুচ্ছে। শুয়েছে। শুক, শোন, শোও, শো। শুল, শুলে, শুলাম। শুত। শুচ্ছিল। শুয়েছিল। শোব, শুয়ো, শুস। শুতে, শুয়ে, শুলে, শোবার (শোওয়ার), শোয়া।
কর্-ধাতু :
করে, করেন, করো, করিস, করি। করছে। করেছে। করুক, করুন, করো, কর। করল, করলে, করলাম। করত। করছিল। করেছিল। করব, করবে। কোরো, করিস। করতে, করে, করলে, করবার (করার), করা।
কাট্-ধাতু :
কাটে, কাটেন, কাটো, কাটিস, কাটি। কাটছে। কেটেছে। কাটুক, কাটুন, কাটো, কাট। কাটল, কাটলে, কাটলাম। কাটত। কাটছিল। কেটেছিল। কাটব, কাটবে। কেটো, কাটিস। কাটতে, কেটে, কাটলে, কাটবার (কাটার), কাটা।
লিখ্-ধাতু :
লেখে, লেখেন, লেখো, লিখিস, লিখি। লিখছে। লিখেছে। লিখুক, লিখুন, লেখো, লেখ। লিখল, লিখলে, লিখলাম। লিখত। লিখছিল। লিখেছিল। লিখব, লিখবে। লিখো, লিখিস। লিখতে, লিখে, লিখলে, লেখবার (লেখার), লেখা।
শিখ্-ধাতু :
শেখে, শেখেন, শেখো, শিখিস, শিখি। শিখছে। শিখেছে। শিখুক, শিখুন, শেখো, শেখ। শিখল, শিখলে, শিখলাম। শিখতো। শিখছিল। শিখেছিল। শিখব, শিখবে। শিখো, শিখিস। শিখতে, শিখে, শিখলে, শেখবার (শেখার), শেখা।
উঠ্-ধাতু :
ওঠে, ওঠেন, ওঠো, উঠিস, উঠি। উঠছে। উঠেছে। উঠুক, উঠুন, ওঠো, ওঠ। উঠল, উঠলে, উঠলাম। উঠত। উঠছিল। উঠব, উঠবে। ওঠো, উঠিস। উঠতে, উঠে, উঠলে, ওঠবার (ওঠার), ওঠা।
******
সংসদ বাংলা অভিধানের ‘পরিশিষ্ট ক’
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়–প্রবর্তিত বাংলা বানানের নিয়ম, ১৯৩৬
সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ
১। রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব– রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হইবে না, যথা– 'অর্চনা, মূর্ছা, অর্জুন, কর্তা, কার্তিক, কর্দম, বার্ধক্য, কর্ম, সর্ব'।
২। সন্ধিতে ঙ্-স্থানে অনুস্বার– যদি ক খ গ ঘ পরে থাকে তবে পদের অন্তস্থিত ম্–স্থানে অনুস্বার অথবা বিকল্পে ঙ্ বিধেয়, যথা– 'অহংকার, ভয়ংকর, শুভংকর, সংখ্যা, হৃদয়ংগম, সংঘটন, অথবা 'অহঙ্কার, ভয়ঙ্কর'' ইত্যাদি।
অসংস্কৃত অর্থাৎ তদ্ভব, দেশজ ও বিদেশী শব্দ
৩। রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব– রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হইবে না, যথা–'কর্জ, শর্ত, পর্দা, সর্দার, চর্বি, ফর্মা, জার্মানি'।
৪। হস্-চিহ্ন– শব্দের শেষে সাধারণতঃ হস্–চিহ্ন দেওয়া যাইবে না, যথা–'ওস্তাদ, কংগ্রেস, চেক, জজ, টন, টি–পট, ট্রাম, ডিশ, তছনছ, পকেট, মক্তব, হুক, করিলেন, করিস'। কিন্তু যদি ভুল উচ্চারণের সম্ভাবনা থাকে তবে হস্–চিহ্ন দেওয়া যাইতে পারে। হ এবং যুক্ত ব্যঞ্জনের উচ্চারণ সাধারণতঃ স্বরান্ত, যথা– 'দহ, অপরহ, কান্ড, গঞ্জ'। যদি হসন্ত উচ্চারণ অভীষ্ট হয় তবে হ ও যুক্ত ব্যঞ্জনের পর হস্–চিহ্ন দেওয়া উচিত, যথা– শাহ্, তখ্ত্, জেম্স্ বন্ড্। কিন্তু সুপ্রচলিত শব্দে না দিলে চলিবে, যথা– 'আর্ট, কর্ক, গভর্নমেন্ট, স্পঞ্জ'। মধ্য–বর্ণে প্রয়োজন হইলে হস্–চিহ্ন বিধেয়, যথা–'উল্কি, সট্কা'। যদি উপান্ত স্বর অত্যন্ত হ্রস্ব হয় তবে শেষে হস্–চিহ্ন বিধেয়, যথা–'কট্কট্, খপ্, সার্'।
বাংলার কতগুলি শব্দের শেষে অ–কার উচ্চারিত হয়, যথা–গলিত, ঘন, দৃঢ়, প্রিয়, করিয়াছ, করিত, ছিল, এস। কিন্তু অধিকাংশ শব্দের শেষের অ–কার গ্রস্ত অর্থাৎ শেষ অক্ষর হসন্তবৎ, যথা–অচল, গভীর, পাঠ, করুক, করিস, করিলেন। এই প্রকার সুপরিচিত শব্দের শেষে অ–ধ্বনি হইবে কি হইবে না তাহা বুঝাইবার জন্য কেহই চিহ্ন প্রয়োগ করেন না। অধিকাংশ স্থলে অ–সংস্কৃত শব্দে অন্ত্য হস্–চিহ্ন অনাবশ্যক, বাংলা ভাষার প্রকৃতি অনুসারেই হসন্ত উচ্চারণ হইবে। অল্প কয়েকটি বিদেশী শব্দের শেষে অ উচ্চারণ হয়, যথা– বাই–ল। কিন্তু প্রভেদরক্ষার জন্য অপর বহু বহু শব্দে হস্–চিহ্নের ভার চাপান অনাবশ্যক। কেবল ভুল উচ্চারণের সম্ভাবনা থাকিলে হস্–চিহ্ন বিধেয়।
৫। ই ঈ উ ঊ – যদি মূল সংস্কৃত শব্দে ঈ বা ঊ থাকে তবে তদ্ভব বা তৎসদৃশ শব্দে ঈ বা ঊ অথবা বিকল্পে ই বা উ হইবে, যথা–কুমীর, পাখী, বাড়ী, শীষ, ঊনিশ, চূন, পূব অথবা কুমির, পাখি, বাড়ি, শিষ, উনিশ, চুন, পুব। কিন্তু কতকগুলি শব্দে কেবল ঈ, কেবল ই অথবা উ হইবে, যথা– নীলা (নীলক), হীরা (হীরক), দিয়াশলাই (দীপশলাকা), খিল (কীল), পানি (পানীয়), চুল (চুল), তাড়ু (তর্দু), জুয়া (দ্যুত)।
স্ত্রীলিঙ্গ এবং জাতি, ব্যক্তি, ভাষা ও বিশেষণ–বাচক শব্দের অন্তে ঈ হইবে, যথা– কলুনী, বাঘিনী, কাবুলী, কেরানী, ঢাকী, ফরিয়াদী, ইংরেজী, বিলাতী, দাগী, রেশমী। কিন্তু কতকগুলি শব্দে ই হইবে, যথা– ঝি, দিদি, বিবি, কচি, মিহি, মাঝারি, চল্তি। পিসী, মাসী স্থানে বিকল্পে পিসি, মাসি লেখা চলিবে।
অন্যত্র মনুষ্যেতর জীব, বস্তু, গুণ, ভাব ও কর্মবাচক শব্দের এবং দ্বিরাবৃত্ত শব্দের অন্তে কেবল ই হইবে, যথা–বেঙাচি, বেজি, কাঠি, সুজি, কেরামতি, চুরি, পাগলামি, বাবুগিরি, তাড়াতাড়ি, সরাসরি, সোজাসুজি। নবাগত বিদেশী শব্দে ঈ ঊ প্রয়োগ সম্বন্ধে পরে দ্রষ্টব্য।
৬। জ ম –এইসকল শব্দে য না লিখিয়া জ লেখা বিধেয়, যথা–কাজ, জাউ, জাঁতা, জাঁতি, জুই, জুত, জো, জোড়, জোত, জোয়ান।
৭। ণ ন –অ–সংস্কৃত শব্দে কেবল 'ন' হইবে, যথা– কান, সোনা, বামুন, কোরান, করোনার। কিন্তু যুক্তাক্ষর 'ণ্ট, ণ্ঠ, ণ্ড, ণ্ঢ চলিবে, যথা–ঘুণ্টি, লুণ্ঠন, ঠাণ্ডা।
'রানী' স্থানে বিকল্পে 'রাণী' চলিতে পারিবে।
৮। ও–কার এবং ও উর্ধ্ব–কমা প্রভৃতি –সুপ্রচলিত শব্দের উদাহরণ, উৎপত্তি বা অর্থের ভেদ বুঝাইবার জন্য অতিরিক্ত ও–কার, উর্ধ্ব–কমা বা অন্য চিহ্ন যোগ যথাসম্ভব বর্জনীয়। যদি অর্থগ্রহণে বাধা হয় তবে কয়েকটি শব্দে অন্ত্য অক্ষরে ও–কার এবং আদ্য বা মধ্য অক্ষরে উর্ধ্ব কমা বিকল্পে দেওয়া যাইতে পারে, যথা– কাল, কালো, ভাল, ভালো, মত, মতো, পড়ো, প’ড়ো (পড়ুয়া বা পতিত)।
এই সকল বানান বিধেয়– এত, কত, যত, তত, তা, হয়তো, কাল (সময়, কল্য), চাল (চাউল, ছাত, গতি), ডাল (ডাইল, শাখা)।
৯। ং ঙ–'বাঙ্গলা, বাঙ্গালা, বাঙ্গালী, ভাঙ্গন' প্রভৃতি 'বাংলা, বাঙলা, বাঙালী, ভাঙন' প্রভৃতি উভয় প্রকার বানানই চলিবে। হসন্ত–ধ্বনি হইলে বিকল্পে ং ঙ বিধেয়, যথা–'রং, রঙ, সং, সঙ, বাংলা, বাঙলা'। স্বরাশ্রিত হইলে ঙ বিধেয়, যথা– 'রঙের, বাঙালী, ভাঙন'।
১০। ং ও ঙ–র প্রাচীন উচ্চারণ যাহাই হউক, আধুনিক বাংলা উচ্চারণ সমান, সেজন্য অনুস্বার স্থানে বিকল্পে ঙ লিখিলে আপত্তির কারণ নাই। 'রং–এর' অপেক্ষা 'রঙের' লেখা সহজ। 'রঙ্গের' লিখিলে অভীষ্ট উচ্চারণ আসিবে না, কারণ 'রঙ্গ' ও 'রং' এর উচ্চারণ সমান নয়, কিন্তু 'রং' ও 'রঙ' সমান।
১১। শ ষ স– মূল সংস্কৃত শব্দ অনুসারে তদ্ভব শব্দে শ ষ বা স হইবে, যথা– আঁশ (অংশু), আঁষ (আমিষ), শাঁস (শস্য), মশা (মশক), পিসী (পিতুঃস্বসা)। কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম হইবে, যথা–মিন্সে (মনুষ্য), সাধ (শ্রদ্ধা)।
বিদেশী শব্দে মূল উচ্চারণ অনুসারে s স্থানে স, sh স্থানে শ হইবে, যথা– আসল, ক্লাস, খাস, জিনিস, পুলিস, পেনসিল, মসলা, মাসুল, সাদা, সিমেন্ট, খুশি, চশমা, তক্তাপোশ, পশম, পোশাক, পালিশ, পেনশন, শখ, শৌখিন, শয়তান, শরবত, শরম, শহর, শার্ট, শেক্সপিয়র। কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম হইবে, যথা– ইস্তাহার (ইশ্তিহার), গোমস্তা (গুমাশতাহ), ভিস্তি (বিহিশতী), খ্রীস্ট, খ্রীষ্ট (Christ)।
শ ষ স এই তিন বর্ণের একটি বা দুইটি বর্জন করিলে বাংলা উচ্চারণ বাধা হয় না, বরং বানান সরল হয়। কিন্তু অধিকাংশ তদ্ভব শব্দে মূল অনুসারে শ ষ স প্রয়োগ বহুল প্রচলিত এবং একই শব্দের বিভিন্ন বানান প্রায় দেখা যায় না। এই রীতি সহসা পরিবর্তন বাঞ্ছনীয় নয়। বহু বিদেশী শব্দের প্রচলিত বাংলা বানানে মূল অনুসারে শ বা স লেখা হয়, কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম বা বিভিন্ন বানানই দেখা যায়, যথা–সরবত, শরবত, সরম, শরম, সহর, শহর, শয়তান, সয়তান, পুলিস, পুলিশ। সামঞ্জস্যের জন্য যথাসম্ভব একই নিয়ম গ্রহণীয়।
বিদেশী শব্দের S ধ্বনির জন্য বাংলায় ছ অক্ষর বর্জনীয়। কিন্তু যেখানে প্রচলিত বাংলা বানানে ছ আছে এবং উচ্চারণে ছ হয়, সেখানে প্রচলিত বানানই বজায় থাকিবে, যথা–কেচ্ছা, ছয়লাপ, তছনছ, পছন্দ।
দেশজ বা অজ্ঞাতমূল শব্দের প্রচলিত বানান হইবে, যথা–করিস, ফরসা (ফরশা), সরেস (সরেশ), উসখুস (উশখুস)।
১২। ক্রিয়াপদ– সাধু ও চলিত প্রয়োগে কৃদন্ত রূপে 'করান, পাঠান' প্রভৃতি অথবা বিকল্পে 'করানো, পাঠানো' প্রভৃতি বিধেয়।
চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদের বিহিত বানানের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হইল। বিকল্পে উর্ধ্ব কমা বর্জন করা যাইতে পারে, –লাম বিভক্তি স্থানে –লুম বা –লেম লেখা যাইতে পারে।
হ–ধাতু– হয়, হন, হস, হই। হচ্ছে, হয়েছে। হক, হন, হও, হ। হল, হলাম। হত। হচ্ছিল। হব (হবো), হবে। হয়ো, হস। হতে, হয়ে, হলে, হবার, হওয়া।
খা–ধাতু –খায়, খান, খাও, খাস, খাই। খাচ্ছে। খেয়েছে। খাক, খান, খাও, খা। খেলে, খেলাম। খেত। খাচ্ছিল। খেয়েছিল। খাব (খাবো), খেয়ো, খাস। খেতে, খেয়ে, খেলে, খাবার, খাওয়া।
দি–ধাতু– দেয়, দেন, দাও, দিস, দিই। দিচ্ছে। দিয়েছে। দিক, দিন, দাও, দে। দিলে, দিলাম। দিত। দিচ্ছিল। দিয়েছিল। দেব (দেবো), দেবে। দিও, দিস। দিতে, দিয়ে, দিলে, দেবার, দেওয়া।
শু–ধাতু– শোয়, শোন, শোও, শুস, শুই। শুচ্ছে। শুয়েছে। শুক, শুন, শোও, শো। শুলে, শুলাম। শুত। শুচ্ছিল। শুয়েছিল। শোব (শোবো), শোবে। শুয়ো। শুস। শুতে, শুলে, শোবার, শোয়া।
কর্–ধাতু– করে, করেন, কর, করিস, করি। করছে। করেছে। করুক, করুন, কর, কর্। করলে, করলাম। করত। করছিল। করেছিল। করব (করবো), করবে। করো, করিস। ক'রতে, ক'রে, ক'রলে, করবার, করা।
কাট্ ধাতু– কাটে, কাটেন, কাট, কাটিস, কাটি। কাটছে, কেটেছে। কাটুক, কাটুন, কাট, কাট্,। কাটলে, কাটলাম। কাট্ত। কাটছিল। কেটেছিল। কাটব (কাটবো), কাটবে, কেটো, কাটিস। কাটতে, কেটে, কাটলে, কাটবার, কাটা।
লিখ্–ধাতু– লেখে, লেখেন, লেখ, লিখিস, লিখি। লিখছে। লিখেছে। লিখুক, লিখুন, লেখ, লেখ্। লিখলে, লিখলাম। লিখত। লিখছিল। লিখেছিল। লিখব (লিখবো), লিখবে। লিখো, লিখিস। লিখতে, লিখলে, লিখে, লিখলে, লেখবার, লেখা।
উঠ্–ধাতু– ওঠে, ওঠেন, ওঠ, উঠিস, উঠি। উঠছে। উঠেছে। উঠুক, উঠুন, ওঠ, ওঠ্। উঠলে, উঠলাম। উঠত, উঠছিল, উঠছিল। উঠব (উঠবো), উঠবে। উঠো, উঠিস। উঠতে, উঠে, উঠলে, ওঠবার, ওঠা।
করা–ধাতু– করায়, করান, করাও, করাস, করাই। করাচ্ছে। করিয়েছে। করাক, করান, করাও, করা। করালে, করালাম। করাত। করাচ্ছিল। করিয়েছিল। করাব (করাবো), করাবে। করিও, করাস। করাতে, করিয়ে, করালে, করাবার, করান (করানো)।
১৩। কতকগুলি সাধু শব্দের চলিত রূপ– 'কুয়া, সুতা, মিছা, উঠান, পুরান, পিছন, পিতল, ভিতর, উপর প্রভৃতি কতকগুলি সাধু শব্দের মৌখিক রূপ কলিকাতা অঞ্চলে অন্যপ্রকার।
যে শব্দের মৌখিক বিকৃতি আদ্য অক্ষরে (যথা পেছন, ভেতর) তাহার সাধু রূপই চলিত ভাষায় গ্রহণীয়, যথা–'পিছন, পিতল, ভিতর, উপর'। যাহার বিকৃতি মধ্য বা শেষ অক্ষরে তাহার চলিত রূপ মৌখিক রূপের অনুযায়ী করা বিধেয়, যথা– 'কুয়ো, সুতো, মিছে, উঠন, উনন, পুরনো'।
নবাগত ইংরেজী ও অন্যান্য বিদেশীয় শব্দ
Cut–এর u, cat–এর a এবং f, v, w, z প্রভৃতির প্রতিবর্ণ বাংলায় নাই। অল্প কয়েকটি নূতন অক্ষর বা চিহ্ন বাংলা লিপিতে প্রবর্তিত করিলে মোটামুটি কাজ চলিতে পারে। বিদেশী শব্দের বাংলা বানান যথাসম্ভব উচ্চারণসূচক হওয়া উচিত, কিন্তু নূতন অক্ষর বা চিহ্নের বাহুল্য বর্জনীয়। এক ভাষায় উচ্চারণ অন্য ভাষার লিপিতে যথাযথ প্রকাশ করা অসম্ভব। নবাগত বিদেশী শব্দের শুদ্ধি–রক্ষার জন্য অধিক আয়াসের প্রয়োজন নাই, কাছাকাছি বাংলা রূপ হইলেই লেখার কাজ চলিবে। যে–সকল বিদেশী শব্দের বিকৃত উচ্চারণ ও তদনুযায়ী বানান বাংলায় চলিয়া গিয়াছে সে–সকল শব্দের প্রচলিত বানানই বজায় থাকিবে, যথা–'কলেজ, টেবিল, বাইসাইকেল, সেকেন্ড'।
১৪। বিবৃত অ (Cut–এর u)– মূল শব্দে যদি বিবৃত অ থাকে তবে বাঙ্গালা বানানে আদ্য অক্ষরে আ–কার এবং মধ্য অক্ষরে অ–কার বিধেয়, যথা– ক্লাব (club), বাস্ (bus), বাল্ব (bulb), সার্ (sir), থার্ড (third), বাজেট (budget), জার্মান (German), কাটলেট (cutlet), সার্কাস (circus), ফোকাস (focus), রেডিয়ম (radium), ফস্ফরস (phosphorus), হিরোডোটস (Herodotus)'।
১৫। বক্র আ (বা বিকৃত এ–cat–এর a)– মূল শব্দে বক্র আ থাকিলে বাঙ্গালায় আদিতে 'অ্যা' এবং মধ্যে ‘্যা (য-ফলা+আ-কার)’ বিধেয়, যথা–'অ্যাসিড (acid), হ্যাট (hat)'।
এইরূপ বানানে, ‘্যা’-কে (য-ফলা+আ-কার) য–ফলা+আ–কার মনে না করিয়া একটি বিশেষ স্বরবর্ণের চিহ্ন মনে করা যাইতে পারে, যেমন হিন্দিতে এই উদ্দেশ্যে ঐ–কার চলিতেছে (hat=হিন্দি অক্ষর লেখা সম্ভব হয় নি)। নগরী লিপিতে যেমন অ–অক্ষরে ও–কার যোগ করিয়া–ও (হিন্দি অক্ষর ব্লগে লেখা সম্ভব হয় নি) হয়, সেইরূপ বাংলায় অ্যা হইতে পারে।
১৬। ঈ ঊ– মূল শব্দের উচ্চারণের যদি ঈ ঊ থাকে তবে বাংলা বানানে ঈ ঊ বিধেয়, যথা–'সীল (seal), ঈস্ট (east), ঊস্টার (Worcester), স্পূল (spool)'।
১৭। f ও v স্থানে যথাক্রমে ফ ভ বিধেয়, যথা–'ফুট (foot) ভোট (vote)'। যদি মূল শব্দে v-এর উচ্চারণ f–এর তুল্য হয় তবে বাংলা বানানে ফ হইবে, যথা– ফন (von)।
১৮। W স্থানে প্রচলিত রীতি–অনুসারে ঊ বা ও বিধেয়, যথা–'উইলসন (Wilson), উড (wood), ওয়ে (way)'।
১৯। য়– নবাগত বিদেশী শব্দে অনর্থক য় প্রয়োগ বর্জনীয়। 'মেয়র, চেয়ার, রেডিয়ম, সোয়েটার' প্রভৃতি বানান চলিতে পারে, কারণ য় লিখিলেও উচ্চারণ বিকৃত হয় না। কিন্তু উ–কার বা ও–কারের পর অকারণে য়, য়া, য়ো লেখা অনুচিত। 'এডোয়ার্ড ওয়ারবণ্ড না লিখিয়া 'এড্ওআর্ড, ওঅরবণ্ড' লেখা উচিত। 'হার্ডওয়ার' (hardware) বানানে দোষ নাই।
২০। s, sh– ১১ সংখ্যক নিয়ম দ্রষ্টব্য।
২১। st– ইংরেজির st স্থানে নূতন সংযুক্ত বর্ণ স্ট বিধেয়, যথা–'স্টেশন'।
২২। z স্থানে জ বিধেয়।
২৩। হস্–চিহ্ন–৪ সংখ্যক নিয়ম দ্রষ্টব্য।
সংসদ বাংলা অভিধান-সংকলকের মন্তব্য
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কার–সমিতি বাংলা বানানের এইসব নিয়ম প্রবর্তিত করেছিলেন পঁয়ষট্টি বছর আগে। ইতিমধ্যে প্রচুর বিতর্ক ও আলোচনা দাঁড়িয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বানানে পরিবর্তন এসেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবের মূল কাঠামো স্বীকার করে নিলেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংস্থা অনেকগুলি পরিবর্তন সাধন করেছেন, কিছু–কিছু পরিবর্তন ভাষায় স্বাভাবিকভাবে এসেও গেছে।
(১) পঞ্চম নিয়মে এখন আর বিকল্প নেই– কুমির, বাড়ি, পুব, পাখি চলছে। ইংরেজি, বিলাতি, দাগি, রেশমি, কেরানি চলছে।
(২) অসংস্কৃত শব্দে যুক্তাক্ষরে (৭ নং) ঠাণ্ডা, লুণ্ঠন, ডাণ্ডা চলছে। রানী নয়, রাণী নয়, এখন চলছে রানি।
(৩) বাঙ্গালা, বাঙ্গালী নয় (৯ নং), এখন চলছে বাংলা, বাঙালি।
(৪) প্রযোজক ক্রিয়ায় এবং ক্রিয়াবিশেষ্যে ও–কার প্রচলিত হয়েছে। এখন তাই করান, পাঠান, দেখান নয়। লিখতে হবে করানো, পাঠানো, দেখানো।
(৫) স্ত্রীলিঙ্গে এবং জাতিবাচক বা বিশেষণ শব্দেও এখন দীর্ঘ স্বরচিহ্ন বর্জিত। এখন লেখা হয় কলুনি, বাঘিনি, কাবুলি, কেরানি, চাকি, ফরিয়াদি, বিলতি, দাগি, আসামি প্রভৃতি।
(৬) বিদেশী শব্দে দীর্ঘ ঈ বা দীর্ঘ ঊ বর্জিত হয়েছে, মূর্ধন্য–ণ, মূর্ধন্য–ষ বর্জিত হয়েছে। এখন লেখা হচ্ছে–গ্রিক, উস্টার, ইস্ট, কর্নওয়ালিস, গ্রিস ইত্যাদি।
(৭) বহু শব্দে স্বাভাবিকভাবে তালব্য–শ এসেছে–শরবত, পুলিশ, মজলিশ। এসব ক্ষেত্রে এখন আর বিকল্পের প্রয়োজন নেই।
বানান সম্পর্কে আমাদের গৃহীত নীতির জন্য পাঠক সংসদ বানান অভিধান গ্রন্থখানি দেখতে পারেন।
******
আরও দেখুন :
বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম, ১১ জুন ২০০৯
বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম ২৭ শে মার্চ, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২৮
বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম সম্পূর্ণ (রিপোস্ট) ২৮ শে মার্চ, ২০০৯ রাত ১২:৫৫
কি ও কী এর ব্যবহার ৩০ শে মার্চ, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:১৭
পিডিএফ কপি
ব্লগার অনাহূত আপনাদের জন্য পুরো পোস্টের একটা পিডিএফ কপি তৈরি করছেন। ওটি এখান থেকে ডাউনলোড করা যাবে।
কপিরাইট
এগুলো অন্যত্র কপি-পেস্ট করুন, কিন্তু দয়া করে এ পোস্টের সূত্র উল্লেখ করুন।
শুভ কামনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:১৮