সন্ধ্যায় একটা জরুরি মিটিং ছিল। মিটিঙের মাঝখানে কয়েক মিনিটের বিরতি। এমন সময়ে মোবাইলে ৫০ টাকার ফ্লেক্সি আসে। এ সময়ে কোনো ফ্লেক্সি আসার কথা না। দুতিন মিনিটের মাথায় টিএন্ডটি থেকে একটা মেয়ের কল। সে বলে, ‘ভাইয়া, ভুল করে আপনার নাম্বারে ৫০ টাকা ফ্লেক্সি করে ফেলেছি। টাকাটা কি ফেরত দেয়া যায়?’ আমি অবাক হই। বলি, ‘অবশ্যই। আপনার নাম্বার বলুন।’ ও নাম্বার পাঠায় এসএমএস করে। আমি ভাবি, মেয়েটা গরীব ঘরের হবে হয়তো। তা না হলে এভাবে একজন অপরিচিত লোকের কাছে রং ফ্লেক্সির টাকা ফেরত চাইতো না। মেয়েটা বোকা, হাবাগোবা বা উদাসীন টাইপেরও হতে পারে। নিজের সেল-নাম্বার এভাবে কেউ ভুল করে? আমি কিছুটা দয়াপরবশ হয়ে, কিছুটা ফান করার উদ্দেশে ৫০-এর সাথে আরো ১৫ টাকা যোগ করে ওর নাম্বারে ৬৫ টাকা ব্যালেন্স ট্রান্সফার কররি। ও খুশি হয়ে তৎক্ষণাৎ এসএমএস করে আমাকে 'থ্যাঙ্কস' জানায়।
রাত বারটার দিকে ও আমাকে কল করে। আমার ‘মহানুভবতার’ জন্য পুনর্বার ধন্যবাদ জানায়। দু মিনিটের কথাবার্তায় সে জানতে চায় আমি কী করি, আমার পেশা কী। এতো রাতে তার কল পেয়ে আমি ডিস্টার্ব্ড ফিল করছি কিনা সে জানতে চায়। বাচ্চারা ঘুমিয়ে, আমি আর স্ত্রী দুজনে টেলিভিশন দেখছিলাম, তাকে এ-কথা বলার পর সে বিব্রত ও লজ্জিত হয় এবং আমি বিরক্ত হয়েছি মনে করে 'স্যরি' বলে রেখে দেয়।
এর দুদিন পর বিকেলে সে হঠাৎ কল করে বলে, ‘ভাইয়া, আপনি কি আমার নাম্বারে ৫০ টাকা ফেক্সি করেছেন?’
‘না তো!’ আমি আশ্চর্য হয়ে বলি।
সে কিছুটা ইনডিয়ান এ্যাকসেন্টে বলে, ‘আই ডু নট নোও হু হ্যাজ সেন্ট মি দ্য ফেক্সি। হুয়াট শুড আই ডু নাউ? আই এ্যাম রিয়েলি ইন গ্রেট টেনশন।’
ঠিক ৫ মিনিট পর সে আবার ফোন করে হাসি ভরা কণ্ঠে বলে, ‘স্যরি ভাইয়া, আপনাকে বার বার বিরক্ত করছি। আমার বড় বোন আমাকে ফ্লেক্সি করেছিল। এইমাত্র সে আমাকে ফোন করে জানালো। কিছু মনে করেন নি তো ভাইয়া?’
এক মিনিটে কথা শেষ। আমি মনে মনে হাসি আর বলি, শুধু একদণ্ড কথা বলার জন্যই সে এই গেইমটা করলো। অবশ্য আমার ধারনা ভুল হওয়াও অসম্ভব ছিল না।
আরো দু-তিন দিন পর বিকেলবেলা ওর একটা এসএমএস পাই। ‘ভাইয়া, আমার মনে খুব কষ্ট। আমি এখন চা খাচ্ছি। আপনি কি আমার সাথে বসে এক কাপ চা খাবেন? আমি চা পাঠিয়ে দিই?’ খুব মজা পেলাম এ ধরনের এসএমএস পড়ে। তবে ওর প্রতি আমার মনে একটু সহানুভূতি জন্মালো। আমি ছড়াকার হয়ে উঠি এবং ছড়াকারেই একটা রিপ্লাই দিই:
এমন যদি হতো,
আমার দুটি পাখা আছে বিহঙ্গদের মতো,
আকাশ-পাহাড় পাড়ি দিয়ে এক নিমিষের প্রায়
ইচ্ছে হলেই পৌঁছে যেতাম তোমার আঙিনায়।
রাত দশটার দিকে ওর আরেকটা এসএমএস আসে, ‘আমার ভাবতে খুব ভালো লাগছে যে, আমার একজন এসএমএস-বন্ধু আছে।’ এর সাথে আরো কী সব যেন লিখেছিল। আমি অল্প কথায় এসএমএস-এর উত্তর দিয়েছিলাম।
তার পরের দিন আরেকটা এসএমএস, ‘হাই ইনভিজিবল ফ্রেন্ড, হাউ আর ইউ?... ...'
তিন-চার দিন পর সকালের দিকে ও ফোন করে। তার মন খুব উৎফুল্ল। কথায় কথায় সে ফান করতে থাকলো। আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে। আমার পেশা সম্পর্কে জানতে চায়। আমি নাকি খুব বুদ্ধিমান। তবে ওর কথাবার্তায় ওকে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত, সমাজসচেতন, শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিবোধ সম্পন্ন মনে হয়। ওর ব্যক্তিত্ব আমার ভালো লাগে। সত্যি কথা, আমার বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা প্রচুর হলেও 'মেয়ে-বন্ধু' বলতে যা বোঝায় সে-রকম ঘনিষ্ট কেউ নেই। তবে সহপাঠিনী, বাল্যবান্ধবী, এ-ধরনের কিছু মেয়ের সাথে এখনো জানাশোনা আছে, এবং তাদের অর্থাৎ মেয়েদের পুরুষ-বশীকরণ মোহনীয় গুণাবলি সম্পর্কে আমি সচেতনভাবে জ্ঞাত আছি। এ মেয়ের সাথে কথা হচ্ছে, কিন্তু তাকে কোনোক্রমেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মনে হয় না। আমার স্ত্রী কিংবা সহপাঠিনীদের চেয়ে ওর কণ্ঠস্বর অধিক মাধুর্যমণ্ডিত নয়। কথা বলার স্টাইল অন্যদের চেয়ে অধিক মাদকতাময় ও আকর্ষণীয় নয়। তবু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, ওর সাথে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগছে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সহজাত টান। আমার পেশা সম্পর্কে জানতে সে অনেক জোরাজুরি করে। আমি একজন পকেটমার, নাপিত, জুতাপালিশঅলাও হতে পারি, এহেন কটূক্তিপূর্ণ কৌতুক করতেও ছাড়লো না। আমি একটু চড়া সুরে কথা বললে বিভিন্ন মেয়েলি-কলায় আমাকে নরম করতেও সে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিল।
২
কে এই মেয়েটা? কোথা থেকে আমার মোবাইল নাম্বার সে পেলো? আমার মোবাইল নাম্বার যত্রতত্র, যার-তার কাছে চলে যাওয়ার সুযোগ খুব কম; কারণ, আমাকে মোবাইল ব্যবহার খুব কমই করতে হয়। অনেক সময় ভুল করে অফিসের ড্রয়ারে মোবাইল রেখে আসি, হয়তো রাতে কোথাও একটা কল করতে হবে, তখনই মোবাইলের খোঁজ পড়ে। ফ্লেক্সিশপ থেকেও আমার নাম্বার পাবলিক হবার সুযোগ দেখি না, কারণ, আমি স্ক্র্যাচকার্ড ব্যবহার করি। তাহলে কোথা থেকে আমার নাম্বার সে পেলো?
‘আপনি কি আমার অফিস থেকে নিয়েছেন মোবাইল নাম্বার?’ জিজ্ঞাসা করতেই জবাব না দিয়ে সে পালটা প্রশ্ন করে, ‘আপনি চাকরি করেন? ও আল্লাহ্, আপনার অফিসটা কোথায় ভাইয়া? বেড়াতে আসি?’ বলেই সে হাসতে থাকে।
‘আপনি কি আমার বসের মেয়ে? বসের বোন? শ্যালিকা? বসের মোবাইল থেকে আমার নাম্বারটা নিয়েছেন নিশ্চয়ই! সত্যি বলছি না?’
‘হায় আল্লাহ্, আপনার বসের মোবাইল থেকে আপনার নাম্বার নেব? আপনি কি খুব নামকরা কেউ যে আপনার নাম আপনার বসের মোবাইলে দেখেই তুলে নিয়ে তড়িঘড়ি কল দেব? এটা একটা কাকতাল জনাব! কাকতালীয় ঘটনা।’
কাকতালীয় বটে! ওর আর আমার মোবাইল নাম্বারের ডিজিটগুলো হুবহু এক। ওর কথাবার্তায় আমার মনে হতো ও খুব একা এবং দুঃখিনী, ওর কিছু বন্ধুর দরকার। সুতরাং একটা পরিকল্পিত খেলার মাধ্যমে ও হয়তো বন্ধু সংগ্রহ করছে। আমি ভাবতাম, মোবাইল নাম্বারের ডিজিটগুলো উলটা-পালটা করে সাজিয়ে যে নাম্বার পাওয়া যায়, তাতেই সে ফ্লেক্সি পাঠায়, পরে ঐ নাম্বারে ফোন করে রং ফ্লেক্সিলোডের টাকা ফেরত চায়; দৈবাৎ কাউকে ভালো লাগলে তার সাথেই বন্ধুত্ব করে। আমার ভাবনা অমূলক ছিল না। ও বলেছিল, ওর নাকি প্রায়ই এমনটা হতো। আগেও এক-আধবার এমন হয়েছে, তবে অব্যবহৃত নাম্বারে ফ্লেক্সি চলে যাওয়ায় টাকা ফেরত পায় নি। আমি অনেকভাবে জেরা করে বের করার চেষ্টা করেছি, আমার সাথে এই খেলাটাই খেলেছে কিনা।
পেশাগত কারণে অনেক অপরিচিত নাম্বার থেকে আমার কাছে কল আসে। ওর বাসায় আমার বস না হয়ে জুনিয়র কোনো কলিগও থাকতে পারেন- ওর বড় ভাই, বাবা, চাচা, যে কেউ। ওদের ফোন ডাইরেক্টরি থেকে হয়তো আমার নামসহ নাম্বার পেয়ে আমাকে সে খুঁজে বের করেছে। ও এসব স্বীকার করে না। বলে, ও নাকি খুব ভুলোমনা। ওর নিজের নাম্বার মনে থাকে না বলেই মাঝে মাঝে এমন হয়ে যায়। আমি অর্ধেক বিশ্বাস করতাম।
আমার আরেকটা ভয় ছিল। ভাসমান পসারিনিদের ব্যাপারে আমার ধারনা একেবারে অস্বচ্ছ; হোটেলে, পার্কে, সিনেমায়, ঘাঁটিতে কীভাবে ওদের বেচাকিনি হয়, আমার সে-ধারনা বোকা বালকদের চেয়ে কিছু বেশি ছিল না। এক পর্যায়ে আমার মনে হলো, মেয়েটা এভাবে কোনো খদ্দের খুঁজছে না তো! আমি কি ওর খদ্দেরে পরিণত হচ্ছি?
মেয়েটার নাম জিজ্ঞাসা করি। আশ্চর্য, সে তার নাম বলে না। শেষমেষ একদিন জানালো তার নাম 'তিশা', এবং কয়েকদিন পরই জানালো 'তিশা' তার আসল নাম নয়।
একদিন একটা সকাল ছিল অন্য সকল সকালের চেয়ে অনেক আলাদা ও সুন্দর। সেই সকালে তিশা ফোন দিল। দু-চার কথার পর খুব আবেগঘন স্বরে তিশা বললো, ‘ভাইয়া, আপনার কণ্ঠস্বর আমার কী যে ভালো লাগে!’
৩
স্কুলজীবনে একবার আবৃত্তি ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। কলেজের ক্লাসে একবার আমার আট লাইনের আবৃত্তি শুনে ক্লাসমেটরা প্রশংসা করেছিল। ঐ সময়ে কোনো এক বিয়ে-বাড়ির মাইকে আমার খালি গলায় গাওয়া 'আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়' শুনে একটা কিশোরী প্রেমে পড়েছিল। ‘বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল...’ আমি যখন পথ দিয়ে হাঁটতাম, আমার মুখে এ কবিতা খইয়ের মতো ফুটতো। আমি কবিতা লিখতাম। আমার কবিতা পড়ে শাহনাজ কোনোদিন বলে নি, 'এত্ত ভালো লিখিস!' আমার প্রতিভা এটুকুই। আমার মধ্যে কোনো এক্সট্রা-অর্ডিনারি গুণ আছে, সেই বিশ্বাস আমার কোনোকালে ছিল না।
ও যখন বললো, ‘আপনার কণ্ঠস্বর আমার কী যে ভালো লাগে’, বাস্তবিকই আমি গলে গেলাম; ওর প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা সৃষ্টি হলো না, আমার মনে হলো আমি আমার সত্তাকে খুঁজে পেয়েছি। আমি বিমুগ্ধ হলাম। কিন্তু যুগপৎ ভেবেছি, এটা ওর তোষামোদিও হতে পারে। ও বলে, ‘আপনি তো আমার বস নন, আপনার তোষামোদি করে আমার লাভ কী?’ কথা তো ঠিকই, আমি ভাবি। ও আরো বলে, ‘আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। আপনি খুবই ব্রিলিয়ান্ট। আপনি অনেক বেশি বুদ্ধিমান।’ আমি চমৎকৃত হই। এমন করে কেউ কোনোদিন আমার প্রশংসা করে নি। ওর স্তুতিবাক্যগুলো সারাদিন, আরো কিছুদিন পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে বাঁশির সুরের মতো অনুরণিত হতে থাকলো।
একবার তিশা আমাকে মেসেজে লিখেছিল, ‘প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই যেন আপনার একটা মেসেজ পাই। আর রাতে ঘুমোবার আগে আপনার মেসেজ না পেলে আমার কিন্তু ঘুমই হবে না।’
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলতে ভুলে গেছি। আরেকটা মেয়ের সাথে টিএন্ডটি ফোনে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেই মেয়েটির সাথে অবসর সময়ে প্রচুর কথা হতো, রাজনীতি, সাহিত্য, বিবিধ বিষয়ে। তার সাথে আমার কোনো প্রেমের বা বন্ধুর সম্পর্ক ছিল না। ইন্টারনেটের কোনো এক সাইটে তার কিছু সমস্যার কথা জানতে পারি; তাকে সাহায্য করার ইচ্ছেয় ফোন করেছিলাম। সেখান থেকেই শুরু। ছেলেরা এমন মেয়েদেরই খুঁজে, যাদের খুব বিপদ! সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারলে সে-মেয়ে আপনা-আপনি কব্জাগত হয়ে পড়ে; আমি তো ছেলেই; ছেলেদের সহজাত কাজটিই করেছিলাম। সে মেয়ে খুব রহস্যময়ী ছিল। একেক সময়ে তার একেক নাম বলতো। বিবাহিতা। সংসারের নানা টানাপোড়েনের কথা বলতো। স্বামীর সাথে তার ইগোয়িস্টিক মনোমালিন্যের কথা বলতো। আমার সাথে আলাপ করে সে খুব আনন্দ পেতো তা বলতো। সে তার মোবাইল নাম্বার আমাকে কখনো দেয় নি। আমার পরিবারের সব কথা তাকে বলতাম। তার প্রতি আমার কোনোদিন যৌনাকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয় নি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার শক্তি ও ইচ্ছে দুটোই আমার ছিল। আমাদের কোনোদিন দেখাসাক্ষাৎ হবে না, চুক্তি ছিল। এ মেয়েও কোনোদিন তার নাম বলে নি। আমি তার নাম দিয়েছিলাম ‘নিশি’।
নিশির সাথে প্রায় বছর খানেক যাবত কোনো যোগাযোগ নেই। নতুন ‘মোবাইলভাষিণী’র সাথে কথা বলতে বলতে একদিন হঠাৎ মনে হলো, এ নিশি নয়তো! কেননা, বিশেষ বিশেষ সময়ে নিশির স্বর আহ্লাদিত হয়ে উঠতো, তিশার মধ্যেও তা লক্ষ করি। আমার বিশ্বাস হয়, নিশি হয়তো আরো রহস্য সৃষ্টির উদ্দেশে নতুন একটা গল্প তৈরি করে আবির্ভূত হয়েছে 'তিশা' নাম নিয়ে।
একদিন আচমকা তিশাকে প্রশ্ন করি, ‘আপনি কি নিশি?’ ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এরপর নিশিকে নিয়ে গল্প চলে তিশার সাথে। নিশির সাথে কী কী বিষয় নিয়ে কথা হতো, ঠিক ঐ কথাই তিশার সাথে চলতে থাকে। আশ্চর্য, তিশা আমার প্রতি আরো আকৃষ্ট হতে থাকে। নিশি আমাকে ‘জ্ঞানের সাগর’ ভাবতো, তিশাও কথায় কথায় আমার অসাধারণ জ্ঞান আর বুদ্ধিমত্তার তারিফ করে। মহামতি আলেকজান্ডার পারেন নি, আমি কী করে এই প্রশংসা অ-গ্রহণ করবো? আমি ফুলে-ফেঁপে উঠি।
কিন্তু ক্রমশ তিশাও রহস্যময়ী হয়ে উঠলো। প্রথম দিনের মেসেজে সে তার নাম বলেছিল 'কলি'। বাসা বলেছিল নারায়নগঞ্জ। পরে তার নাম হলো 'অহনা'। বাসাবোয় তার বাসা। বিয়েশাদি হয় নি। সম্ভাব্য দুই পাত্র আছে। একজন কানাডায়, আরেকজন দেশে। দুজনের কাছেই ছবি পাঠানো হয়েছে। কানাডার পাত্র সবদিক থেকেই শ্রেয়তর, কিন্তু তার পছন্দ দেশের পাত্রকে। কারণ তিশা দেশে থাকতেই ভালোবাসে।
একবার আমি বাসা ছেড়ে দিন দশেকের জন্য অন্যত্র চলে যাই। প্রচুর ব্যস্ততা। তার মধ্যেও তিশার কল আসে, মেসেজ আসে। আমার ভালো লাগে। বলে রাখি, ওর জন্যও আমার মধ্যে কোনো প্রেমভাব বা যৌনভাবের উন্মেষ হয় নি, তখনো। অথচ আমরা রাজ্যের গল্প বলি।
সন্ধ্যায় ওকে বলি, ‘আমরা কোন্ কোন্ বিষয়ে আলাপ করতে পারি তা কি বেছে নিতে পারি না?’
‘হ্যাঁ পারি।’
‘কী কী বিষয়?’
‘আপনিই বলুন।’
‘এমন কী বিষয় আছে যা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি না?’
‘এমন কিছুই নেই।’
‘আমরা কি সেক্স নিয়েও আলোচনা করতে পারি?’
‘আমি তো কোনো অসুবিধা দেখছি না।’
আমি হুট করে বলি, ‘আচ্ছা, আপনাকে যদি এখন চুমু খাই, আপনার কোনো ফিলিংস হবে?’
‘নাহ্।’ ও খুব নির্বিকারভাবে বলে।
‘কেন?’ আমি জানতে চাই।
‘জানি না কেন। আমার সেক্স খুব কম।’
আমি বলি, ‘আমরা একটা শর্ত বা চুক্তি করি আজ?’
‘কী রকম?’
‘আমাদের সকল যোগাযোগ মোবাইলেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আমাদের কোনোদিন দেখাসাক্ষাৎ হবে না। কথা বলাই আমাদের যাবতীয় বিনোদন। রাজি?’
‘রাজি।’
৪
একদিন দুপুরে তিশা জিজ্ঞাসা করলো, ‘আচ্ছা, আপনি আমার কাছে কী চান?’ ওর কাছ থেকে কিছু চাই বলে আমার কখনো মনে হয় নি। এবং আমাদের মধ্যে বোধহয় একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, তাতে আমার চেয়ে ওর ভূমিকাই বেশি। তাহলে এই প্রশ্ন আসে কেন? আমারই বরং জিজ্ঞাসা করার কথা ছিল, 'আপনি আমার কাছে কী চান?'
‘আমি তো কিছু চাই না।’ আমি বলি।
‘সত্যিই কিছু চান না আপনি?’ ও বলে।
আমি : ‘নাহ্, আমি কিছুই চাই না। আমার কোনো দাবি নেই।
সে :‘তা হলে আর সম্পর্ক রেখে কী লাভ?’
আমি : ‘আপনি কি কিছু চান আমার কাছে?’
সে: ‘নাহ্, আমি আবার আপনার কাছে কী চাইব?’
আমি : ‘আমিও কিছুই চাই না।’
সে : ‘সত্যি?’
আমি : ‘সত্যি।’
সে : ‘আচ্ছা তাহলে। রাখি। খোদা হাফেজ।’ ও ফোন রেখে দেয়।
প্রায় বছর হতে চললো নিশিদের ফোনে 'নো-রিপল্লাই' হচ্ছিল। কিন্তু ঐদিন বিকেলবেলা ওদের বাসায় ফোন করলে ঝলমলে কণ্ঠে যে মেয়েটি ‘হ্যালো স্লামালাইকুম’ বললো সে নিশি। আমি খুব উৎফুল্ল হলাম, নিশিও। নিশি এতোদিন স্বামীর বাসায় ছিল, ব্যস্ত ছিল পড়ালেখা, স্বামীসংসার নিয়ে। আমার কথা তার মাঝে মাঝে মনে পড়তো, কিন্তু ফোন করার সুযোগ হতো না। আমি নাকি ওর কাছে বিরাট রহস্যময় পুরুষ। এতোদিন একটা সন্দেহ ছিল- হয়তো নিশিই 'তিশা' নামে আবির্ভূত হয়েছে, নিশিকে আজ পেয়ে আমার সেই ভুল ভাঙলো। নিশিকে তিশার কথা বললাম, ‘অবিকল আপনার কণ্ঠস্বর। আপনার মতোই ওর সব আচরণ। হুঁম, হায় আল্লাহ্ শব্দগুলো আপনার মতোই উচ্চারণ করে সে।’ নিশি বলে, ‘বাহ্, ভালো তো। আপনি আরেকটা নিশি পেয়ে গেছেন। আমি না থাকলেও তো আর ক্ষতি নেই, তাই না?’
দুপুরে তিশা ফোন রেখে দেয়ায় আমার মনে একটা ব্যথা হয়েছিল, ও আমাকে আর কখনোই কল করবে না এই ভেবে। নিশির সাথে কথা হবার পর বুক হালকা হয়ে গেলো, কিন্তু তিশার সাথে এ সুখটা শেয়ার করার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। অবশেষে সন্ধ্যায় তিশাকে এসএমএস করি- ‘হ্যালো তিশা, আমার আজ খুব ভালো লাগছে। প্রায় এক বছর পর আজ নিশিকে খুঁজে পাওয়া গেছে। নিশিকে আপনার কথা বলেছি। ও হাসে আপনার কথা শুনে।’
তিশার উত্তর আসে, ‘তাহলে তো আজ আপনার ঈদের দিন। ঈদ করুন।’
ঘণ্টা দুয়েক পর তিশাকে কল করি। ও অভিমানে ফেটে পড়ে বলে, ‘আপনার তো আজ আনন্দের সীমা নেই। নিশির সাথে যোগাযোগ হয়েছে। আমার আর কী দরকার?’
তিশাকে বুঝিয়ে শান্ত করি। অনেকক্ষণ কথা বলার পর বলি, ‘আমি যদি এখন আপনাকে একটা চুমু দিতে চাই?’
‘আপনার ব্যাপার।’
‘আপনি সুখ পাবেন না?’
‘আমার কোনো ফিলিংস নেই।’
‘দিই?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে আমি চার-পাঁচটা চুমু দিই শব্দ করে। তারপর বলি, ‘এবার আপনি দিন।’
‘আমি চুমু দিতে পারি না।’
‘প্লিজ তিশা। প্লিজ।’
‘না।’
আমি আরো কয়েকটা চুমু দিয়ে বলি, খুব উত্তেজিতভাবে, ‘প্লিজ... প্লিজ।’
ও কিছুই দেয় না।
সকালে খুব শান্তভাবে আমার ঘুম ভাঙে। আমার ব্যস্ততাময় দিন শুরু হয়।
আমি বাসায় আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তিশার ফোন। সে খুব আহ্লাদ করতে শুরু করলো। আমি ফোন রেখে দিতে চাই ব্যস্ততার জন্য। সে বলে মোবাইল অন করে যেন টেবিলের উপর রেখে দিই। আমি কাজ করতে থাকবো, কার সাথে কী কথা হয় এসব সে শুনতে থাকবে। এমন পাগল কেউ কোনোদিন দেখেছে? কিন্তু ওর এ আহ্লাদ আমার খুব ভালো লাগে। আমি ওর কথা মতো মোবাইল অন করে টেবিলের উপর রেখে দিই। কাজের লোকদের সাথে খুটফরমায়েস করতে থাকলাম, ও শুনছে সবই।
২টার দিকে বাসে উঠলাম। এ সময় ওর একটা মেসেজ পাই, ‘যখন আপনার কালো জিন্স আর লাল গেঞ্জিটার কথা বললেন, তখন থেকেই আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। জিন্স আর লাল গেঞ্জি পরলে না জানি আপনাকে কেমন দেখায়।’ ওর এই মেসেজটা আমার মনে দারুণ রোমান্স সৃষ্টি করে।
পরদিন রাত দশটায় সে কল করে। ভীষণ অগ্নিমূর্তি সে। বাসায় গিয়ে তাকে কল দেয়ার কথা ছিল। কেন দিই নি? এতোটা সময় পার করে দিলাম, ওর কথা কি আমার একবারও মনে পড়ে নি? আমার সম্পর্কে ওর খুবই একটা বাজে ধারনা হয়, আমি হয়তো ঘরে স্ত্রী রেখে কয়েকদিন দূরে ছিলাম, ঐ সময়ে বিনোদনের সামগ্রী হিসেবে ওকে ব্যবহার করেছি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, স্ত্রীর গলা ধরে শুয়ে থাকলেও অবস্থা এমন হতে পারতো।
আমার মধ্যে ইতোমধ্যে একটা অনুশোচনা শুরু হয়েছে। আমি তাকে চুমু খেয়েছি, নিজেকে নিজের কাছেই অবিশ্বস্ত মনে হতে থাকলো। আমার বয়স, পরিবার সবকিছু বিশ্লেষণ করে আমি নিজেকে খুব খাটো ভাবতে থাকি। নিশির সাথে ততোদিনে বোধহয় আমার চার বছর হয়ে গেছে, এমন ‘অরুচিকর’ আচরণ ওর সাথে আমার স্বপ্নেও ভাবা হয় নি।
‘তিশা, আমাকে মাফ করবেন। আপনাকে চুমু খাওয়া আমার ঠিক হয় নি। আমি কোনোদিন এমন ছিলাম না।’ আমি বলি। তিশা ক্ষেপে যায়। বলে, ‘এখন খুব সাধু সাজা হচ্ছে, তাই না?’ আরো অনেক বিতণ্ডা হয়।
‘নিশি কেমন আছে? ওর সাথে নিশ্চয়ই দিনরাত কথা হচ্ছে!’
‘না, ওর সাথে কখনোই এতো ঘন ঘন কথা হয় নি।’
‘আমি কারো ছায়া হয়ে থাকতে রাজি নই।’
‘এর মানে কী?’
‘আমি কখনো শুনতে চাই না যে আমার কণ্ঠস্বর নিশির মতো।’
আমাদের অনর্গল কথা চলতে থাকে। এক ফাঁকে খুব হিসেব করে বলি, ‘তিশা, আপনার সাথে কথা বলতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত অগ্রসর হবো। তা অতিক্রমের উপক্রম হলে আমরা দুজনই পরস্পরকে সতর্ক করবো, কেমন?’
একদিন সন্ধ্যায় ঢাকা শহরের এক চাইনিজ রেস্তরাঁয় আমাদের মিলন হলো। আমার স্ত্রী ও সন্তানাদি। তিশা ও তার স্বামী। তিশার শরীর স্ফীত হয়ে পেট সামনে ঝুলে পড়েছে; সে মা হতে চলেছে; সর্বাঙ্গে লজ্জা জড়ানো। খাবারের টেবিলে আমাদের অনেক গল্প হয়। সেসব গল্পে নিশি অপাঙ্ক্তেয়া ছিল।
এর পরের গল্প খুব দীর্ঘ।
সে অহনা। ভোর। একটা সূর্যোদয়ের ভেতর তার প্রকাশ ও যবনিকাপাত। একটা পূর্ণাঙ্গ প্রেম। অসম্পর্কের গভীরে এমন মধুরতম সম্পর্কের কোনো ইতিহাস আমার জানা নেই। গল্প দীর্ঘতর হয়; অস্তাচলগামী সূর্যালোকের ছায়ার মতো। রং ফ্লেক্সিলোডের রম্যকথন হয়; হাসাহাসি হয়; আমার অনুসন্ধিত্সা আজও শেষ হয় না- কোথা পেয়েছিল অহনা আমার নাম্বার? ও যা বলে, তা কি সত্যিই সত্যি ছিল?
আমি ভেবে শুধু এতোটুকু কূল পাই, অহনার গল্পটা সত্যি হতে পারে, সবটুকু বানানো নয়।
*এপ্রিল ২০০৯
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৮:১৭