যে মেয়েটি আমাকে প্রথম প্রেম শিখিয়েছিল
সে আমার দু বছরের বড় ছিল আর স্কুলে এক ক্লাস উপরে পড়তো। সে খুব মারকুটে ও ডানপিটে ছিল; আমি খুব গোবেচারা ছিলাম। আমাকে দু চোখে দেখতে পারতো না।
সে পড়ালেখায় ব্যাকবেঞ্চার ছিল, আমি নাকি খুব মেধাবী ছিলাম, মেয়েটার চেয়ে; এজন্য আমার প্রতি তার প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল; অবশ্য এটা আমি জানতে পেরেছিলাম অনেক অনেক দিন পর- সে যখন মুচকি মুচকি হাসছিল, আর তার স্বামীর কাছে অনুযোগ করছিল, অনেক অনেক দিন পর পথে যেতে যেতে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে।
তার সাথে একদিন স্কুলে ঝগড়া হয়েছিল। আমি শিক্ষকের কাছে নালিশ করেছিলাম। শিক্ষক তাকে ভর্ৎসনা সহ বেত্রাঘাত করেছিলেন। আমার প্রতি মেয়েটার প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল।
তারপরের দিন একটা বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছিল।
স্কুল ছুটির পর। আমাদের বাড়িতে আসতাম মেয়েটার বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে। ওত পেতে থাকা মেয়েটা আমাকে দেখেই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এবং ছুটে পালাবার আগেই বাঘিনীর মতো আমার পিঠের উপর বড্ড একটা কামড় বসিয়েছিল। আমার হৃদয়বিদারক কান্নায় মেয়েটার মা ছুটে এসে আমাকে আদর করেছিলেন, আর মেয়েটাকে মারবার জন্য তাড়া করেছিলেন। এই মর্মান্তিক ঘটনার কথা জানতে পেরে আমার মা অনেক মর্মাহত হয়েছিলেন।
এ ঘটনার পরের বছর আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলাম, আর ফাঁকিবাজ, দজ্জাল মেয়েটা ফেল মেরে দ্বিতীয় শ্রেণিতেই রয়ে গেলো। প্রকৃতি মানুষকে এভাবেই শিক্ষা দিয়ে থাকে।
আর প্রাকৃতিক নিয়মে মেয়েটা আমার প্রতি নরম হতে থাকে। আমার জন্য সে গাছপাকা বরই নিয়ে আসতো; ওদের আমতলায় ঝড়ের দিনে আম কুড়োনোর দাওয়াত দিত; চড়ুইভাতিতে আমাকেও সঙ্গে নিত। পুতুল বিয়ের সময় ছেলে হিসেবে একমাত্র আমাকেই ডাকতো মেয়েটা ওদের দলে। প্রথম বৃষ্টির নতুন পানিতে পুকুর ভরে যেতো, রাতভর ব্যাঙ ডাকতো; সকালে আমরা একসাথে সেই ব্যাঙ তাড়াতাম, আর সারা দুপুর ভরা পুকুরে ডুবসাঁতার খেলতাম।
আরও কিছুকাল পর মেয়েটা বলেছিল, ‘তোকে একদিন একটা জিনিস দেখাবো, কাউকে বলবি না তো?’
আমি সে কথা কাউকে বলি নি।
একদিন মেয়েটা শাড়ি পরেছিল; পুতুলবিয়ের দিনে। আমাকে পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরতে বলে নি; এসব কি ছাই আমরা জানতাম? তেঁতুলখোসায় ভাত রেঁধে দিয়েছিলেন ওর মা; পুরো একতেঁতুল ভাত সে আমাকেই দিয়েছিল। তারপর মুখ টিপে হেসে বলেছিল, ‘দেখবি?’
‘দেখবো’- বলতেই ‘আয়’ বলে ইশারায় ডেকে নিয়ে যায় ওদের কোনার দিকের অন্ধকার ঘরটায়। খুব আলগোছে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘কাউকে বলবি না তো?’
‘না।’ আমিও ফিসফিস করে জবাব দিই। মেয়েটা কাঁপা হাতে খাটের উপর জাজিমের নিচ থেকে কী যেন বের করে এনে আমার হাতে তুলে দেয়।
‘পড়্। কাউকে বলবি না তো?’
‘না।’ বলে আমি পড়তে থাকি। এক আনা যদি পড়তে পারি, ষোল আনা তার অর্থ বুঝি না।
‘প্রেমপত্র। বুঝলি?’
‘তুই লিখেছিস?’
‘না। বকুলা ম্যাডামকে দিতে বলেছিল, তুহিন স্যার। দিই নি। কাউকে বলবি না তো?’
‘না।’
‘আমিও একটা লিখবো। তুই নিবি?’
‘নিব।’
তারপর মেয়েটা একদিন আমাকে একটা ‘প্রেমপত্র’ লিখেছিল; আর একটা অনবদ্য জিনিস দেখিয়েছিল।
আমি সে কথা কাউকে বলি নি।
* পুরোনো, ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ২:০৭
একটা কবিতার গোড়াপত্তন ও এর অর্থবোধকতার পর্যায় সমূহ
আমাদের ছোটোবেলায় পদ্মা নদী খুব উত্তাল, বিশাল ও ভয়াবহ ছিল। নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘বাবা, গাঙের কি ঐ-পাড় নাই?’ বাবা হেসে জবাব দিতেন, ‘আছে। অনেক দূরে। দেহা যায় না।’
আমি তখন গাঙের বুকে পালতোলা নাওয়ের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবতাম, আহা, একদিন যদি ঐ-পাড়ে যাইবার পারতাম!
কলেজবেলায় গ্রামে গিয়ে মাঝে মাঝে পদ্মাপাড়ে যেতাম বন্ধুদের সাথে বেড়াতে। পদ্মা ডুবে গেছে চরের বালুতে। কলাপাতায় সবুজের ঢেউ দেখি, আর শুকনো তীরে দাঁড়িয়ে দেখি পদ্মার বুকে সাদা বালু খাঁ-খাঁ করছে। চিকন খালের মতো মরা নদী বুড়ির মতো ধুঁকে ধুঁকে হেঁটে যাচ্ছে যেন।
অনেকদিন পর দেখা।
গুলিস্তান থেকে শুরু। বাবু বাজার ব্রিজ কিংবা পোস্তগোলার চীনমৈত্রী সেতু পার হয়ে ঢাকা-মাওয়া সড়ক ধরে চলতে থাকুন।
শ্রীনগর।
সদর পার হয়ে কামারগাঁও ছাড়িয়ে শাইনপুকুর।
দোহার উপজেলা শুরু।
কিছুদূর গিয়ে নারিশা। ছোটোবেলায় এখানে অনেক এসেছি। ছোটো চোখে নদীর ঐ-পাড় ধু-ধু করতো। কলেজবেলায় এখানে ধু-ধু বালুচর।
আজ।
নারিশা গ্রাম ভেঙে ডুবে যাচ্ছে নদীগর্ভে। গ্রামবাসীর প্রাণান্ত চেষ্টা তা প্রতিরোধে।
গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ি। পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখি ও-পাড়ে সূর্য পাটের উপরে, স্রোতোময়ী পদ্মার শরীরে ঢেউয়ের ভাঁজে ভেঙে পড়া রোদ চিকচিক করছে।
এই পথে, একটু দূরে প্রমীলাদের বাড়ি। স্কুলজীবনে শুধু প্রমীলার সাথে কাকতালে দেখা হবার সম্ভাব্যতায় এখানে ঘোরাঘুরি করতাম। আর আছে সায়ন্তনীদের বাসা। ওর মতো সুন্দরী মেয়ে আমার চোখে আর একটাও পড়ে নি আজও। মিনাদের বাড়ি আর ইমরানদের বাড়ি পাশাপাশি। মিনার সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়। ইমরান বাবা হয়েছে বছর দুই আগে, ও এ-খবর দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে।
আর সোহানা? রাতুলের চাচাত বোন সোহানা। স্কুলজীবনের পর ওর সাথে আর দেখাই হলো না। প্রমীলা বলে, ‘সোহানার দিনে দিনে বয়স কমে।’ শামীম ওর সাথে প্রেম করতো। ওদের দু পরিবারে অহিনকুল পরিস্থিতি সারাজীবন। ও-বাড়ির মেয়ে এ-বাড়িতে? এ-বাড়ির ছেলে ও-বাড়িতে? পৃথিবী উলটে গেলেও না। এসএসসির পর পর ওর বিয়ে হলো এক গণিতজ্ঞের সাথে। রাতুলের সাথে দেখা করতে গেছি; এগিয়ে এলো ভুবনমোহিনী সোহানা ওর হৃদয়হরা হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে।
‘তুই না খুব চিকন আছিলি? মাত্র কয় মাসেই এতো মোটা হইয়া গেছস?’ আমার কথা শেষ হবার আগেই, ‘স্টুপিড!’ বলে এক ঝামটায় আমার গাল টেনে দিয়ে পৃথিবীকাঁপানো একটা হাসি হেসে ঘাড় বাঁকিয়ে বেণি দুলিয়ে চলে গেলো সোহানা। ওর সেই হাসি চোখের সামনে ভাসে, ওর কথা মনে হলে, বা না হলেও।
আমাকে ভর্ৎসনা করে রাতুল বলেছিল, ‘তুমি এতো বোকা কেন? ও প্রেগন্যান্ট হইছে বোঝো না?’
আরো অনেকে। শাপলা। ঝিনুক।
একেকটা মেয়ে একেকটা অনবদ্য কবিতা, ভিন্ন ভিন্ন রস ও স্বাদের। এই দেখুন, কোনো ছেলের নামই আমার মাথায় আসছে না এখন। আমরা মেয়েদের কথা বেশি মনে রাখি; ওরা আমাদের নিয়ে কী ভাবে তা জানতে খুউব খুউব সাধ হয়। আমার মতো সবগুলো ছেলেই হয়তো এমন করেই সবগুলো মেয়ের কথা ভাবে। আর মেয়েগুলো? ওরা মনে হয় আমাদের আর মনে রাখে না। আমরা যেমন বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আর তার বুকের উপর শুয়ে একবার হলেও ওদের প্রত্যেকের কথা ভাবি, ওরা কি স্বামীর বুকে মাথা রেখে একটি মুহূর্তের জন্যও মনে করেছে আমাদের কথা? আমার কথা? ওরা খুব স্বার্থপর। ওরা স্বামীদের সাথে বেইমানি করে না, আমরা যেমন বউদের সাথে করি। ওরা নয় প্রেমিকা, নয় বান্ধবী। ওরা আমাদের কেউ না।
একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রমীলা বলেছিল, ‘তোরা এতো নিষ্ঠুর কেন রে? তোদের কথা ভেবে ভেবে মরি... ।’ তারপর ওর কণ্ঠ গলে যেতে থাকে, করুণ ফিসফিসে স্বরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘তোর কথা কতো ভাবতাম... খুব নিষ্ঠুর রে তুই!’
আমি যখন পদ্মার গভীর থেকে স্কুলবান্ধবীদের ছিনিয়ে নিয়ে আসছিলাম, দেখি আমার সরলা বউ আর সন্তানেরা উজ্জ্বল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আনন্দে ঝলমল করছে।
এখানে একটা কবিতার ভাব জাগে। সর্বপ্রথম যে শব্দটা মাথায় টোকা বা উঁকি দিল, সেটা হলো- ‘দিধিষু’। কবে কোথায় এই শব্দটা পড়েছিলাম মনে নেই। অর্থটাও ততো পরিষ্কার নয়। কিন্তু ‘দিধিষু’ দিয়েই কবিতা শুরু করি।
দিধিষু শরীর নদীর বিভায় ঘুমিয়ে পড়ে পাখিদের অগোচরে। জলের জোনাকিরা
কোমল বাতাসে ভেঙে ভেঙে মাছের সারিতে মিশে যায়।
এই হলো কবিতা। এর কী অর্থ দাঁড়ায় তা জানি না। আদতে এর কোনো অর্থ নেইও। সব কবিতার অর্থ থাকে না।
অহনার সাথে যদি আবার আরেকদিন, কালের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কোনো এক চরের কন্দলীবনের হরিৎ ছায়ায় অলৌকিকভাবে দেখা হয়ে যায়, এ দু চরণ কবিতা ওকে শোনাবো। এ কবিতা শুনে সে যারপরনাই খুশি হবে; খুশির ঘোরে বহুক্ষণ কেটে যাবে, তারপর যথাস্বভাবে বলবে, ‘এবার এর অর্থটা আমাকে বুঝিয়ে বল্, সোনাপাখি।’
আমি অহনাকে অতি চমৎকারভাবে কবিতাটার অর্থ বুঝিয়ে দেব। সে বিস্ময়ে ডগমগ হয়ে শুধু এ কথাটাই বলবে, ‘তোর মতো কবি হয় না রে পাগল; তুই একদিন অনেক বড় কবি হবি!’
*পুরোনো, ২৩ এপ্রিল ২০০৯
আমরা মেয়েদের কথা মনে রাখি, মেয়েরা ভুলে গেছে
আদি রূপ - খসড়া
পারুলের মতো সুন্দরী মেয়ে আজও দেখি না; সারাদিন কেটে গেছে ওর উড়ন্ত ওড়নার রংধনু দেখে, 'আমার দিকে ফিরেও তাকায় নি'- কেটে গেছে দিনের পর দিন এভাবেই; বহু বহুদিন।
ওর বিয়ে হয়ে গেলো। যুবকেরা দলে দলে সন্ন্যাসে গেলো। গেলাম আমিও। চৈত্রনিদাঘে, জলসঙ্গমে খুন হয়েছি পারুলের কথা ভেবে। পারুল পলকে সব দিয়ে দিল ওর বরকে- কোথাকার কোন্ উড়ো পুরুষ, উড়ে এসে পেয়ে গেলো আজীবন স্বত্বাধিকার। আকৈশোর বিন্দু বিন্দু যত্নে ওর বাড়ন্ত বুকে জমতে দিয়েছি মধু, একদিন আমাদেরই সম্পদ হবে ভেবে - আমাদের গ্রাস কেড়ে নিল উপনিবাসী বর! আমার কথা একবারও ভাবে নি পারুল- না কাউকে কখনো।
বীনা সুলতানা; ঝিনুক; নার্গিস; ওরা খুব সুখে আছে স্বামীদের সংসারে। ওদের অঢেল আহ্লাদ আর স্বামীদের সাথে উৎফুল্ল ঢলাঢলি দেখি, আর করাতের মতো কে যেন চিড়ায় আমাদের পাঁজরের হাড়। মেয়েরা পাষণ্ডিনী; ওরা কেবল বরকেই বোঝে, আর তীর্থের প্রেমিকদের বিমর্ষ বিলাপে ওদের ব্যাপক বিনোদন হয়।
'কষ্ট নিস না দোস্।' শাহনাজকে আজ কবিতা শোনালে ও শুধু এটুকু সান্ত্বনাবাক্য আওড়ালো। আর বললো, 'যাকে নিয়ে এসব মহৎ কবিতা লিখেছিস, সে খুব ভাগ্যবতী রে!' আমার খুব সাধ হয়েছিল শাহনাজ বলবে, 'তুই কি জানিস, আমিও কতোরাত নির্ঘুম কাটিয়েছি তোর কথা ভেবে? তোর কথা মনে পড়তেই বুক থেকে ঠেলে নামিয়ে দিয়েছি বরকে!' শাহনাজ বললো না। মেয়েরা পাষণ্ডিনী; ওরা কেবল বরকেই বোঝে।
সংবিধান সংশোধনের একচ্ছত্র ক্ষমতা যদি আমার হাতে থাকতো, মাইরি বলছি, স্বামীদের সাথে মেয়েদের এহেন রংতামাশা, ঢলাঢলি আইন করে করতাম সংবিধানবিরোধী, অবৈধ। এসব মূলত ক্লাসমেট আর বিয়েপূর্ব-প্রেমিকগণের ফুর্তির বেসাতি, যাদের বিরান জীবনে একখানা বউ জোটে নি অদ্যাবধি।
নায়িকাদের নামবদল, স্বামীদের ভয়ে - চূড়ান্ত রূপ
শিমুলের মতো সুন্দরী মেয়ে আজও দেখি না; সারাদিন কেটে গেছে ওর উড়ন্ত ওড়নার রংধনু দেখে, ‘আমার দিকে ফিরেও চায় নি’- কেটে গেছে দিনের পর দিন এভাবেই; বহু বহুদিন।
ওর বিয়ে হয়ে গেলো। যুবকেরা দলে দলে সন্ন্যাসে গেলো। গেলাম আমিও। চৈত্রনিদাঘে, জলসঙ্গমে খুন হয়েছি শিমুলের কথা ভেবে। শিমুল পলকে সব দিয়ে দিল ওর বরকে- কোথাকার কোন্ পামর পুরুষ, উড়ে এসে জুড়ে গেলো আজীবন দখলে। আকৈশোর বিন্দু বিন্দু যত্নে ওর বাড়ন্ত বুকে জমতে দিয়েছি মধু, একদিন আমাদের সম্পদ হবে এ ভেবে- মোক্ষম গ্রাস কেড়ে নিল উপনিবেশী বর! আমার কথা একবারও ভাবে নি শিমুল; নয় কাউকে কখনো।
সায়ন্তনি; কনকচাঁপা; রঞ্জনা; ওরা খুব সুখে আছে ‘পরপুরুষের’ ঘরে। ওদের অঢেল আহ্লাদ আর স্বামীদের সাথে অবাধে উৎফুল্ল ঢলাঢলি দেখি, আর করাতের মতো কে যেন চিড়ায় আমাদের পাঁজরের হাড়। মেয়েরা পাষণ্ডিনী; ওরা কেবল বরকেই বোঝে, আর তীর্থের প্রেমিকদের বিমর্ষ বিলাপে ওদের ব্যাপক বিনোদন হয়।
‘কষ্ট নিস না দোস্।’ জুঁইকে আজ কবিতা শোনালে ও শুধু এটুকু সান্ত্বনাবাক্য আওড়ালো। আর বললো, ‘যাকে নিয়ে এসব মহৎ কবিতা লিখেছিস, সে খুব ভাগ্যবতী রে!’ আমার খুব সাধ হয়েছিল জুঁই বলবে, ‘তুই কি জানিস, আমিও কতোরাত নির্ঘুম কাটিয়েছি তোর কথা ভেবে? তোর কথা মনে পড়তেই বুক থেকে ঠেলে নামিয়ে দিয়েছি বরকে!’ জুঁই বললো না। মেয়েরা পাষণ্ডিনী; ওরা কেবল বরকেই বোঝে।
সংবিধান সংশোধনের একচ্ছত্র ক্ষমতা যদি আমার হাতে থাকতো, মাইরি বলছি, স্বামীদের সাথে মেয়েদের এহেন রংতামাশা, ঢলাঢলি আইন করে ঘোষণা করতাম সংবিধানবিরোধী, অবৈধ। এসব মূলত ক্লাসমেট আর বিয়েপূর্ব-প্রেমিকগণের ফুর্তির বেসাতি, যাদের বিরান জীবনে অদ্যাবধি বউ জোটে নি... একদা একখানা অর্বাচীন বউ জুটে গেলেও বউমণিরা ঘড়ায় তোলা নিত্যব্যবহার্য জল, বান্ধবীরা সুগভীর সন্তরণদিঘি।
__________________________________________
‘কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায়-তোলা জল- প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা সে রইল দিঘি, সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।’- শেষের কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
*পুরোনো, ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:৪১
প্রিয় বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে গেলে
প্রিয় বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে গেলে উঠতি যৌবনে আমরা সবগুলো ছেলেবন্ধু পারস্পরিক শত্রুতা ভুলে দল বেঁধে দেবদাস হতাম। আমাদের চরণসমুদয় অনাথের মতো নিস্তেজ হয়ে পড়তো। বিরহীসংঘের সমাবর্তনে বিগত বান্ধবীকে প্রতারণার দায়ে গোষ্ঠি উদ্ধারে লিপ্ত হতাম।
বয়স বাড়ে; সময় বদলায়; দৃষ্টি ও দর্শন বদলে যেতে থাকে। পৃথিবীর সবখানে, সবকিছুতে ছড়িয়ে আছে আর জড়িয়ে আছে প্রেম।
প্রিয় সহেলিরা সংবিধিবদ্ধ প্রেমিকা আমাদের সকলের। বিয়ের আগে ওরা একেকটা ব্যক্তিগত, হস্তান্তর-অযোগ্য মূল্যবান সম্পদ; আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী বন্ধুদের সহজাত শত্রু ভেবে নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর সংগ্রামী হয়ে উঠি।
বিয়ের পর বান্ধবীরা কারো ব্যক্তিগত সম্পদ থাকতে পারে না, না তার স্বামীর, না কোনো পুরনো প্রেমিকের। ওরা তখন আমাদের সর্বজনীন প্রেমিকা হয়ে ওঠে।
প্রিয় বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে গেলে এখন আমাদের মনে আগের মতো বিরহভাব জাগে না; যেসব পরমা সুন্দরীর বিয়ে হয়েছিল অনেক অনেকদিন আগে, তাদের এখন নতুন করে চিনি। রম্য আড্ডায় আগের চেয়েও সুনির্মল, সতেজ আর লাবণ্যময় ওরা, আর ওদের প্রাণোচ্ছল হাসি। অনাবিল সান্নিধ্যে আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত ওরা বাঙ্ময় ও স্মরণীয় করে তোলে।
আমাদের বান্ধবীরা আজকাল বড্ড উদার ও অমায়িক। স্বামী ও সংসার বিলকুল ঠিক রেখে নিত্যনৈমিত্তিক আচারের মতোই ওরা আমাদের নিয়মিত প্রেম সম্প্রদান করে।
এসব রম্যকথা স্ত্রীদের জন্য নয়; এ হলো প্রিয় সহপাঠিনীর প্রতি অনাঢ্য প্রেমিকগণের অভবিষ্য প্রেমবাঞ্ছা।
* পুরোনো, ২০ শে মার্চ, ২০১০ রাত ১২:৫৯
কবিতার বিবর্তন
সর্বশেষ সংস্করণ : অয়োময় সুপুরুষ
কিছুই নেবে না সে। তার কোনও লোভ নেই।
তার কোনও আবেগ অথবা অনুভূতি নেই।
নিঝুম অন্ধকারে গা ঘেঁষে দাঁড়ালে তার শরীরও অন্ধকারময় নিরুত্তাপ
সে খেলে না আমায় নিয়ে যেমন তার অভ্যাস
আমার অঙ্গে অঙ্গে বিপুল মাৎসর্য দাহন
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করি তার সংসার
আমাকে সুখ দেয় অনিন্দ্য রহস্যের পরকীয়া পাপ
একটা ধারালো তরবারি তার চোখের সামনে খাপ থেকে খুলে
হাতে নেবো তুলে
আর তার নির্জন শয্যায় একটা আগুন শরীর বিছিয়ে দেবো
ভেবেছি কতোদিন
ও একটা বড্ড সুপুরুষ, সারাবেলা প্রেম দেয়
ও একটা বউপোষা কাপুরুষ, নিপাতনে সঙ্গম শেখে নি
ও এতো ভালো কেন, ও এতো পাষণ্ড কেন, জানি না।
আমরা যাই লং ড্রাইভে, রিক্শায় সারা শহর
পার্কে, রেস্তরাঁয় ঘুরি; সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখি
আলগোছে অন্ধকারে ওর হাতের আঙুল নাড়ি মুঠো ভরে
তারপর ব্লাউজের ভাঁজ গলিয়ে বুকের উপর ঠেঁসে ধরি ওর রোমশ হাত
'তামাম পৃথিবী তোর', ফিশফিশিয়ে বলি, 'এই নে! নে না! তামাম পৃথিবী তোর!'
মোমের মতো গলতে গলতে বের হয়ে এলে হাত
আমার নপুংসক প্রেমিক বলে, 'ঘরে তোর বর, আমারও একটা সাদাসিধে বউ,
থাক না এসব!'
যার সবই আছে, না চাইতেই সব সে পেয়ে যায়
সব পাওয়া যার নিয়তি, সে কিছুই নেয় না
কিছুই নেয় না সে। তার কোনও লোভ নেই।
তার কোনও আবেগ অথবা অনুভূতি নেই। ছিল না।
মাটি কিংবা পাথরের শরীর তার।
সে একটা পাষাণ সুপুরুষ।
আদিতে কবিতা (ইনস্ট্যান্ট পয়েম) : আমি তাকে সবই দিতে চেয়েছিলাম
কিছুই নেবে না সে। তার কোনও লোভ নেই।
তার কোনও আবেগ অথবা অনুভূতি নেই। ছিল না।
মাটি কিংবা পাথরের শরীর তার।
নিঝুম অন্ধকারে গা ঘেঁষে দাঁড়ালে তার শরীরেও অন্ধকারময় নিরুত্তাপ
সে খেলে না আমায় নিয়ে তার বউয়ের মতোন
আমার অঙ্গে অঙ্গে বিপুল মাৎসর্য দাহন
আমি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করি তার সংসার
আমাকে সুখ দেয় অনিন্দ্য রহস্যের পরকীয়া পাপ
একটা ধারালো তরবারি তার চোখের সামনে খাপ থেকে খুলে তার হাতে দেবো তুলে
আর তার নির্জন শয্যায় একটা আগুন শরীর বিছিয়ে দেব
ভেবেছি কতোদিন
ও একটা বড্ড সুপুরুষ, সারাবেলা বউকে প্রেম দেয়
ও একটা বউপোষা কাপুরুষ, নিপাতনে সঙ্গম শেখে নি
ও এতো ভালো কেন, ও এতো পাষাণ কেন?
আমরা যাই লং ড্রাইভে, রিক্শায় সারা শহর
পার্কে, রেস্তরাঁয়, সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখি
আলগোছে অন্ধকারে ওর হাতের আঙুল নাড়ি মুঠো ভরে
তারপর ব্লাউজের ভাঁজ গলিয়ে বুকের উপর ঠেঁসে ধরি ওর লোমশ হাত
'তামাম পৃথিবী তোর', ফিশফিশিয়ে বলি, 'নে! নে না! তামাম পৃথিবী তোর!'
মোমের মতো গলতে গলতে বের হয়ে এলে হাত
আমার নপুংসক প্রেমিক বলে, 'ঘরে তোর বর, আমারও একটা সাদাসিধে বউ,
থাক না এসব!'
কিছুই নেবে না সে। তার কোনও লোভ নেই।
তার কোনও আবেগ অথবা অনুভূতি নেই। ছিল না।
মাটি কিংবা পাথরের শরীর তার।
সে একটা নিরেট নপুংসক।
পাদটীকা নিষ্প্রয়োজন নয়। একটা লেখা প্রথমে যে থিমটার উপর দাঁড়িয়ে যায়, কোনো কোনো সময় বার বার এডিট করার পর তার আদি রূপ অনেকখানিই বদলে যায়, এমনকি মূলভাবও। আমার ক্ষেত্রে এটা ঘটে থাকে।
* পুরোনো , ৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১১:১৯
সনির্বন্ধ ঘোষণা
আর কোনো চোরকাঁটা লেগে নেই
যতোদিন যতোবার তোমাদের দেখেছি, কোমল প্রার্থনার স্বননে
শুনেছি রোদনের রাগ; আমিও শরীরে মেখেছি রোদের পরাগ
তোমাদের কথা ভেবে
তোমাদের ওড়না হাসে উড়ন্ত স্মৃতির দেশে, অনেক ক্রন্দন আর অশ্রুরা
মিশে যায় প্রখর সন্তাপে
স্মৃতির ললনারা, তোমাদের ঘ্রাণের পেলবতা,
বুকের উষ্ণতা, রাতভর মাধুর্যময় কণ্ঠসান্নিধ্য কাম ও মননে আমাকে
দিয়েছিল সজীব ঋদ্ধতা
কন্দলীখোসা সকলেই ছুঁড়ে ফেলে। জহরততুল্য মাৎসর্যের শিস আমিই কি
দিই নি গেঁথে
তোমাদের অহমে? কী বিপুল দর্পে ফুটে ওঠে তোমাদের উদ্ভাস, ভেবে দেখো
সে কার দান!
মনে রেখো...শূন্য থেকেই শূন্য আসে...
Ex nihilo nihil fit
আর পূর্ণ কলশ চূর্ণ হয়ে গেলে শূন্যতাই নিজস্ব সম্পদ
আর
উলুক্ষেতে সোনাবীজ চিনবে না, তাও জানি
তাই
নিজ গুণে ক্ষমা করে দিয়েছি, বিদগ্ধ চোরকাঁটা, মনে রেখো
*পুরোনো, ৯ ই অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:২৯
যে গানটি শোনা হয় নি, যে কবিতাটি লেখা হয় নি...
যে গানটি শোনা হয় নি, যে কবিতাটি লেখা হয় নি...
একটা চিঠি হারিয়ে গেলে প্রথম প্রেমিকার
একটা সম্পর্ক ভেঙে গেলে, অনেক পুরনো ও মধুর
ভুলে গেছি তার কাঁকনের রং, চুলের গহনে নিঝুম আঁধার
খুব দূরে, খুব খুব দূরে একটা অচেনা সুর ভেসে যেতে যেতে দিগন্তে মিশে যায়
মধুরতম গানটি শোনা হলো না
এমন একটা গানের জন্য হু হু করে বুক, তৃষ্ণার মতো অতৃপ্তিময় জ্বালা
কী বাণী লেখা ছিল গানের শরীরে? কার কথা লেখা ছিল করুণ হরফে?
আমি কি চিনি সেই দুঃখিনী মেয়েটাকে? তার গায়ের বর্ণ, ‘উজান গাঙের নাইয়া’র পানে চেয়ে থাকা ছলছল চোখ; আমি কি দেখেছি কোনওদিন দুঃখিনী মেয়েটাকে?
প্রিয় কবিতাটি লেখা হলো না আজও
পেন্সিলের আনাড়ি দাগের মতো দুর্বোধ্য হস্তাক্ষরে
লেখা ছিল কাঁচা বয়সের প্রথম চিঠিটা
আমি কি সেই ভাষা বুঝি? সেও কি হায় বুঝতো অনাগত প্রেমের যন্ত্রণা?
শার্টের নিচপকেটে, লুঙ্গির কোঁচড়ে, বেড়ার ফাঁকে, বইয়ের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে
অমোঘ বিধানে চিঠিটা সত্যিই হারিয়ে গেলে হন্যে হয়ে ছুটতে ছুটতে
একদিন অনায়াসে বুঝি- এর নাম প্রেম নয়, কুহক
কী লেখা ছিল চিঠির ভাষায়? আহা, আজও রাহিমার ঠিকানা জানি না;
অনেক দূরে ঝাপসা গোধূলিতে ওড়না উড়িয়ে রাহিমা হেঁটে যায়
আর ওর চিঠিটার মতো একটা অচেনা সুর ভেসে যেতে যেতে মিশে যায় দিগন্তে
এমন একটা কবিতা লেখা হলো না, এমন একটা গান শোনা হলো না
রাহিমার চিঠিটা কোথায় হারিয়ে গেলো
আড়িয়াল বিলের ওপারে তার মায়ের বাড়ি, পশ্চিমে বাপের ভিটা
মাঝখানে সমুদ্র আর ঢেউ
তোমরা যদি কেউ কোনওদিন রাহিমাকে ভেসে যেতে দেখো
আমায় অন্তত একটুখানি খবর দিও
*পুরোনো, ২৬ শে অক্টোবর, ২০১০ বিকাল ৪:১৭
নারীরা
এসেছিল, কেউ থাকে নি; দুঃখ দিয়ে চলে গেছে, একে একে। দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।
*৩০ নভেম্বর ২০১০ বিকাল ৪:০৬
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৩:৩২