একজন নবীন লেখকের প্রথম বই ছাপা হবার 'সকরুণ' ইতিহাস
আমাদের প্রাণের বন্ধু পিয়ালের খ্যাতি চাওয়াটা একটু ভিন্ন ধরণের। নারীমহলে সে সারাজীবন এখনো বিয়ে করা হয়নি বলে কুমারত্বের খ্যাতি পেতে চায়। আমি জানি না একটা বিবাহিত ছেলে মেয়েদের সামনে অবিবাহিত সাজলে তার আকর্ষণ কতোগুণ বৃদ্ধি পায়। অবিবাহিত তরুণীদের সামনে একথাটি বলে হয়তো তাদের স্বপ্নের পুরুষ হওয়া যায়, কিন্তু বিবাহিত রমণীদেরকে না-বিয়ে করার খবরটি বলার কোন্ অর্থ হয়? আমি দেখেছি, বিবাহিত নারীদের কাছেও নিজেকে অবিবাহিত জাহির করার এরূপ স্বভাব কিছু কিছু পুরুষের আছে, যেমনটি আছে পিয়ালের।
পিয়ালের ইংরেজি-বাচনকে সজল আর কৌশিক কটাক্ষ করলেও দু-একটা মেয়ে ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল বইকি- কারণ পিয়ালের তখনো বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। পাত্র হিসাবে সে মোটেও মন্দ হয়, তার ওপরে সে দারুণ মিশুক, তেমনি সাহসীও। জাহিদ, সজল, এমনকি আমি নিজেও যখন কৌশিকের বারান্দায় ভীরুর মতো গুঁটিসুটি মেরে বসে থাকি, সজল তখন অবলীলায় ওদের মাঝে ঢুকে পড়ে সহজ হাসি-ঠাট্টায় মজে যায়। এমন বীরোচিত কাজ সবাই পারে না।
পিয়ালের এরূপ আচরণ আমাদের সবার কাছেই পীড়াদায়ক মনে হতো। কৌশলে ওকে বাদ রেখে কৌশিকের ওখানে যাওয়া শুরু করেছিলাম। তারপরও সে একা একা হঠাৎ আমাদের মাঝে উদয় হয়ে রাগে পুরো কোচিং সেন্টারটি মাথায় তুলে নিত, ওকে না জানিয়ে এসেছি বলে। ওর এরূপ রাগারাগিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে আমরা প্রচুর বিব্রতবোধ করতাম। ওকে নিয়ে যে ছাত্র-ছাত্রীরা বেশ হাসাহাসি করছে এটা কিন্তু সে বুঝতো না। তখনই মনে হতো পিয়াল একটা বিরক্তিকর অপদার্থ।
কৌশিকের ছাত্রছাত্রীরা একদিন পিয়ালের ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়েছিল।
প্রফেসর পিয়াল কোচিং সেন্টারে এসেই সেদিন যথারীতি তার প্রফেসরগিরির কাজে লেগে পড়েছিল। কিন্তু সবার মুখ কালো ও কঠিন। তার হাসি-ঠাট্টায় ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ যোগ দেয় না।
গম্ভীর কণ্ঠে রিনা নামের চঞ্চল ছাত্রীটি বলে, স্যার, আপনি কোন্ ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন?
কেন, ঢাকা ভার্সিটিতে।
সত্যি?
কী আশ্চর্য, তোমরা আমাকে চ্যালেঞ্জ করছো?
অবশ্যই চ্যালেঞ্জ করছি। আপনি নিজেকে যতোখানি ফুটাচ্ছেন আসলে আপনি ততোখানি নন। আপনি এতো ইংরেজি বাজান কেন বলুন তো? আপনি কি কোন ইংরেজি বলতে পারেন? বাংলাই তো ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেন না।
কিছু একটা হয়েছে আন্দাজ করে কৌশিক ভিতরে ঢোকে। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীরা এক যোগে বলে ওঠে, স্যার, আপনার এ বন্ধুটা একটা ঠগ, মিথ্যুক। সে বিবাহিত অথচ আমাদের কাছে বলে বেড়াচ্ছে অবিবাহিত। এই লোচ্চাটার আসল উদ্দেশ্য কী বলুন তো? সে এতো ঘন ঘন এখানে আসে কেন? কী চায়?
পিয়ালের মুখ শুকিয়ে চিমসে গেছে। কৌশিক ওদের থামাবার চেষ্টা করে। কিন্তু ওদের দাবি একটাই, তাকে জুতার মালা গলায় দিয়ে ন্যাংটো হয়ে এখান থেকে দৌড়ে পালাতে হবে।
ছেলেমেয়েদের অভিযোগ খুব গুরুতর। যা জানা গেল তা হলো, ভিতরে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে টাস্ক দিয়ে কৌশিক আমাদের সাথে পত্রিকার কাজের জন্য বারান্দায় ছিল, আমি আর সজল ওখানে থাকলেও পিয়াল তখনো আসেনি। এমন সময়ে টেলিফোন বেজে উঠলে রিনা দৌড়ে পাশের রুমে গিয়ে রিসিভার তোলে।
হ্যালো স্লামালাইকুম।
ওআলাইকুম আসসালাম। কে বলছেন?
আমি রিনা বলছি, কৌশিক স্যারের ছাত্রী। আপনি কে বলছেন?
আমি কৌশিক সাহেবের বন্ধুর স্ত্রী বলছি।
ও- কৌশিক স্যারকে ডেকে দিব?
না, তাকে না। আচ্ছা, এখানে কি পিয়াল সাহেব এসেছেন?
জ্বি না, উনি তো আসেন নি।
কিন্তু উনি তো ওখানে যাবার কথা বলেই বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন।
তাহলে হয়তো আসতেও পারেন। উনার অন্য কয়েকজন বন্ধু অবশ্য কিছুক্ষণ আগে এসেছেন। আসলে কিছু বলতে হবে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, এখানে আসামাত্র বলবেন জলদি বাসায় ফেরত আসতে।
জ্বি বলবো। আচ্ছা আপনার নামটা কী বলবো?
নাম বলতে হবে না, বলবেন আপনার স্ত্রী তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে।
জ্বি? (রিনা আশ্চর্য হয়)।
বলবেন আপনার স্ত্রী অতি তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে।
আপনি কি পিয়াল সাহেবের স্ত্রী বলছেন?
জ্বি।
ফোন রেখে রিনা ভিতরে গিয়ে সবাইকে একথা বলে দিলে ক্ষোভ জমতে থাকে। তারা আগেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল যে এ লোকটা মোটেও প্রফেসর নয়, একটা 'ফোর টুয়েন্টি', কিন্তু চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। আজ থলের বিড়াল বের হয়ে পড়লে তার মিথ্যাচার সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়ে যায়। তারা প্রস্তুত হয় প্রফেসর সাহেবকে উচিৎ শিক্ষা দেয়ার জন্যে।
কৌশিক এমনিতেই ভালো টিউটর হয়নি। ওর গুণ আছে, আর সেজন্যই ওর ছাত্র-ছাত্রীরা ওকে এভাবে শ্রদ্ধা করে, মান্য করে।
জুতার মালা পরে ন্যাংটো হয়ে দৌড়াতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু এ কথাগুলোর দ্বারাই পিয়াল যতোখানি খ্যাতি উপভোগ করেছিল তা ইহজীবনে ভুলবার নয়, অবশ্য যদি তার সামান্য লাজলজ্জা থেকে থাকে।
ঋতুর মা-বাবাও খ্যাতি চেয়েছিলেন, এমনকি ঋতু নিজেও।
ঋতুর সাথে আমার শেষ দেখা হওয়ার পর সে আমাকে বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছিল, কিন্তু কোন চিঠিতেই সে আমাকে ভালোবাসার কথা লিখেনি। আমি জানি, ভালোবাসা মুখ দিয়ে প্রকাশ করার কোন বিষয় নয়, এটা অন্তরের অনুভব। জ্ঞআমি তোমাকে ভালোবাসতে চাইঞ্চ কথা বলার কোন অর্থ নেই। আমি একটি জামা কিনতে চাই বলা যায় কিন্তু ভালোবাসতে চাওয়া যায় না- অন্তরের একেবারে অদৃশ্য গভীরে আপনা থেকেই ভালোবাসার জন্ম হয়- কাউকে ভালোবাসলে তার আচরণেই সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, মুখে প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়ে না। ঋতু আমাকে আর ভালোবাসে কিনা তা জানতে চাইনি কখনো, কেননা জানতে চাওয়াটাও আমার কাছে এক ধরণের বোকামি মনে হয়েছিল। আমার প্রতি তার আচরণই প্রমাণ বহন করে- সে আমাকে আজও ভালোবাসে কি বাসে না।
ঋতু যদিও চিঠিতে ভালোবাসার কোন সংকেত রাখেনি, তবু আমি নিশ্চিত সে আমাকে আমরণ ভালোবাসবেই। কারণ, আমার ধারণা, কাউকে একবার ভালোবাসলে তাকে কখনো ভোলা যায় না। জ্ঞঅতীত দিনের স্ম্বতি কেউ মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারে না, পারবে না ঋতুও। আমাকে আপনারা প্রবঞ্চক মনে করবেন করুন, কিন্তু আমার ভিতরের সত্যটাকে আমি আপনাদের বলতে চাই- সেই কিশোরী ঋতু, তারপর বড় হয়ে ওঠা উদ্দাম তরুণী ঋতু, আমার মনে এখনো দোলা দিয়ে যায়- আমরণ দিবে, আমি জানি।
ঋতুর খ্যাতিলোভী মা-বাবা এক ডাকসাইটে ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে ওর বিয়ে দিয়েছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট-পত্নী হিসাবে ঋতুর স্ট্যাটাস আকাশ-ছোঁয়া হবে, ওর মা-বাবা বুক ফুলিয়ে বলবেন, আমাদের জামাই একজন নামজাদা ম্যাজিস্ট্রেট। পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে সেই ম্যাজিস্ট্রেট একদিন আরো কত্তো ওপরে যাবেন! চারদিক থেকে সালাম ম্যাডাম শব্দাবলিতে ঋতুর কান ঝালাপালা হবে- কিন্তু সেই কান ঝালাপালার ভিতর থেকেই তার জন্য কেবল সুখ আর সুখ উত্থিত হবে।
খ্যাতি সবাই চায়, আমার বাবাও চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর চাওয়াটা ছিল বড্ড বাড়াবাড়ি। লেখাপড়া শিখে আমি হীরার টুকরো হয়েছিলাম, আমার বাবা আমার সম্পর্কে তা-ই ভাবতেন; যে ছেলে দেশের একটা সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করতে পারে সে কি হীরার টুকরো না হয়ে যায়?
আমার খালা-খালুরা আমার মা-বাবার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, নানীজানের কথামতো তাঁরা ঋতুকে আমার হাতে তুলে দেননি, কারণ আমার সুনিশ্চিত ভবিষ্যত ছিল না, এখনো নেই, হাতের কাছে ম্যাজিস্ট্রেট-পাত্র পেয়ে কে তা হাতছাড়া করে- যে পাত্র যৌতুকের জন্য একটা কানাকড়িও আপত্তি করেননি, কেবল পরীর মতো একটা অসম্ভব সুন্দরী মেয়েকে পেয়েই যিনি নিজের জীবন ধন্য মনে করেছেন!
আমার বাবা আমার খালাকে বলেছিলেন, তোমার মাইয়ার চাইতে চইদ্দগুণ ভালো মাইয়া আমার করিমের লাইগ্যা আনুম।
আমি লজ্জার মাথা খেয়ে বলেছিলাম, বাবা, আমার একটা পছন্দের মেয়ে আছে।
বাবার মুখের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি কোনদিন কল্পনাও করেননি যে কোন ছেলে তার বাবার মুখের ওপর এরূপ অশালীন কথা উচ্চারণ করতে পারে।
অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে রেগে বলেছিলেন, লেখাপড়া শিইখ্যা আধুনিক হইছাও। পছন্দের মাইয়া তো থাকবোই। কয়ডা মাইয়া পছন্দ কইরা রাখছাও, ডজন খানেক অইব তো?
বাবার রাগের সামনে আমি আমার পছন্দের পাত্রীর কথা বলতে আর সাহস পাইনি।
আমার বাবা গাঁও-গেরামের মানুষ, একজন গণি মিয়া, পুত্রকে লেখাপড়া শেখান বুকের মধ্যে অনেক আশা জিইয়ে রেখে। আমি লেখাপড়া শিখে হীরার টুকরো হবো- একেকটা পাশ দিব আর আমার মূল্যও ধাপে ধাপে বিরাট অংকে বাড়তে থাকবে- লাখ লাখ টাকার নগদ যৌতুক হাতে নিয়ে রূপসী কিংবা অরূপসী সব মেয়ের বাবারাই আমার বাবার পিছে পিছে ঘুরবেন- আমি একটা মনের মতো বউ পাই কি না পাই শ্বশুর মহাশয়ের কাছ থেকে আমার বাবা বিশাল অংকের টাকা পাবেন, স্ত্রীর সূত্রে তাঁর সম্পত্তির ভাগ পাবেন- সেই টাকার গদিতে বসে আমার বাবা সুখ করবেন- রাতারাতি আমাদের সংসার বদলে যাবে- আমার বাবা গর্বের সাথে বলে বেড়াবেন- আমার করিমরে বিয়া করাইয়া আমি পাঁচ লাখ টাকা পাইছি। চইদ্দ গেরামের মধ্যে কেওই এতো টাকা পায় নাই।
আমার গাঁয়ের সবচাইতে সম্ভ্রান্ত এক পরিবারের মেয়ের সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলতে থাকলো, এখনো পর্যন্ত যৌতুকের পরিমাণ মাত্র চার লাখ, তবে আমার বাবার পক্ষ পাঁচ লাখ টাকার নিচে নামবেনই না। ঘটক জানালেন, শহর থেকে মেয়ের দুলাভাই আসবেন, জামাইকে তাঁর পছন্দ হলেই হাজার পঞ্চাশেক বাড়বে, পুরো এক লাখ নয়।
ছোটবেলায় প্রবাদ শুনেছি, হাতি মরলেও লাখ টাকা, বাঁচলেও লাখ টাকা। হাতির মরা-বাঁচা নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না, আমি এক লাখ টাকার কথা শুনেই করুণ হয়ে ভাবতাম- ইশ্, আমার যদি একটা হাতি থাকতো তবে আমিও এক লাখ টাকার মালিক হতে পারতাম।
সেই আমি আজ হীরার টুকরো। এক লাখ নয়, এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত চার লাখ, চারটা হাতির দামের চেয়েও বেশি; আমাকে যদি দুলাভাই সাহেব পছন্দ করেন তবে আমার দাম আরো পঞ্চাশ হাজার টাকা বাড়বে। কিন্তু তিনি যদি পছন্দই না করেন, তবে কি বিয়েই হবে না? আমার বাবা কি তখন ছাড় দিবেন, ঠিক আছে, চার লাখ নয়, তিন লাখেও আমি রাজি?
দুলাভাই সাহেব আমাকে দেখে বললেন, এ দেখি রাজপুত্র! আমাদের ভায়রাদের মধ্যে তুমিই মাশা'ল্লাহ্ এক নম্বর, যেমন আমার শ্যালিকাটিও।
গাঁও গেরামে সচরাচর এরূপ প্রথা নেই, তারপরও দুলাভাই সাহেব আমাকে আর মেয়েটিকে এক ঘরে দিলেন একান্তে কথা বলতে- যা কিছু তিক্ততা আছে ঘটনার আগেই জেনে নেয়া ভালো।
মেয়েটি প্রথম কথায়ই কঠিন শব্দে বলে উঠলো, আপনাদের লজ্জা নাই?
আমি বুঝে উঠতে পারি না। সে বলে, আপনাদের যদি লজ্জা থাকতো তবে আপনাদের গুষ্টি কোনদিনই আমাকে বউ হিসাবে চাইত না। আপনারা সব ভুলে গেছেন।
সাড়ে চার লাখ টাকার বিনিময়ে আমার ঐ বিয়েটা হলো না। আমার বাবাকে বললাম, বাবা, তোমার কি মনে আছে, ঐ জমির মাদবর তোমারে একবার জুতা দিয়া পিটাইছিল?
আমার বাবার মুখটা প্রথমে একটু কঠিন হলো, তারপর করুণ ও ফ্যাকাশে হয়ে উঠতে লাগলো। অবশেষে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
আমার চোখের সামনেই সেই ঘটনা ঘটেছিল। আমি খুব ছোট, সামান্য বুঝি। গ্রাম্য বিচারে আমার এই হতে পারতো শ্বশুরের আব্বাজান আমার বাবাকে অন্যায়ভাবে দশ জুতার বাড়ি উপহার দিয়েছিলেন।
আমার হতে পারতো বউয়ের কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ। সে আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। আমাকে প্রতিবাদ করার ভাষা যুগিয়েছিল। শিক্ষালাভ করে যে আমি অপদার্থ থেকে যাইনি সেজন্য সারাজীবন আমি তার কাছে মাথানত ও শ্রদ্ধাবনত।
বাবাকে বলেছিলাম, বাবা, তুমি কি চাও টাকার বিনিময়ে শ্বশুরের কাছে আমাকে বিক্রি করে দিতে? আমার শ্বশুর বাড়িতে তোমার মাথাটা উঁচু থাক এটা কি তুমি চাও না? যে বাড়ির লোক তোমাকে অন্যায়ভাবে জুতা-পিটা করেছিল তুমি সেই বাড়িতে কোন্ মুখে দাঁড়াবে, বল তো?
আমার বাবা তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন।
আমার পছন্দের পাত্রীকে আমার বাবা-মা অপছন্দ করলেন না। আমি সুখী হলেই তাঁদের সুখ।
আমার বউ দেখে অনেকে খুশি, অনেকে আফসোস করে। বলে, মেয়েটার বয়স খুব বেশি। কেউ বলে, বয়স বেশি তাতে ক্ষতি ছিল না, ক্ষতি হলো মেয়েটা একটু খুড়িয়ে হাঁটে।
শিমু আপাকে বিয়ে করতে পেরে আমি আমার অপরাধবোধ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি, তাঁর ভুল ভাঙ্গাতে পেরেছি যে আমি সত্যি সত্যি তাঁকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, তাঁর প্রতি আমার কোন লোভ বা প্রতারণা ছিল না।
শিমু আমার শুধু স্ত্রীই নয়, আমার অভিভাবক এবং বন্ধুও। বাড়িতে গিয়ে যে কদিনই থাকতে পারি না কেন, ওর সাথে আমার কী যে সুন্দর সময় কাটে! শ্বশুর-শাশুড়ির সে অনেক প্রিয়, এমন খুড়িয়ে হাঁটা মেয়েটিকে তাঁরা কেন যে এতো আদর করেন আমি বুঝি না।
আমার অনেক সাধ হয় ঢাকার শহরে একটা ছোট বাসা নিয়ে থাকি, যেখানে শিমু আর আমাদের দু-বছরের মিনু-মণি থাকে। সেখানে মাঝে মধ্যে সুহৃদ আসবে, আরো অনেক বন্ধু-বান্ধবী আসবে, জমজমাট সাহিত্যের আড্ডা বসবে; কৌশিককেও হয়তো ডাকা যাবে। ওদের পরিবারের সবাই একমত হলেও বিয়ের পর বহুদিন অব্দি সে অভিমান করে ছিল- আমি কেন শিমুকে বিয়ে করলাম। ওর ধারণা, আমি করুণা করেই শিমুকে বিয়ে করেছি- নিপার বিয়ে হয়ে যাবার পর দীর্ঘদিন ধরে বাসায় পড়ে থাকতে থাকতে ওরা ধরেই নিয়েছিল যে শিমুর কপালে আল্লাহ্ বিয়ে-ভাগ্যটি হয়তো রাখেননি। শিমুকে বিয়ে করাটা কৌশিক সহজভাবে নিতে পারেনি, যদিও তা নিয়ে আমাদের মধ্যে এখন আর কোন মনোমালিন্য নেই।
শিমু আমাকে অনেক অনেক কবিতা লিখতে বলে। আমার এই মেধায় আমি বুঝি আমি যা লিখি তা কবিতা হয় না, কিন্তু শিমুর কাছে তা সর্বদাই শ্রেষ্ঠ কবিতা।
স্খলন পড়ে সে বলেছে, এটা একটা দারুণ উপন্যাস, লেখকের নাম না দেখে কেউ বইটি পড়লে অবাক হয়ে বলতো, বাহ্, হুমায়ূন আহমেদ তো দেখি অনেকদিন পর একটা অসাধারণ উপন্যাস লিখে ফেলেছেন!
গত বইমেলায় শিমুকে আনতে চেয়েছিলাম, মিনুর ঠাণ্ডা লাগবে ভেবে সে আসেনি। এবারের বইমেলার কথা যখন বললাম, সে বললো, আসছে মেলায় সুহৃদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের দিন আসবো। তবে তার আগেই জাহিদ যে আমার একটা বই বের করতে যাচ্ছে এই কথাটা আমি প্রকাশ করি না।
খ্যাতির জন্যই মানুষের জন্ম, আমারও জন্ম খ্যাতির জন্য। শিমুকে বিয়ে করে অন্তত ওর কাছে আমি আমার ভালোবাসার খ্যাতিটুকু অর্জন করতে পেরেছি।
আমাদের অখণ্ড জীবনটা খণ্ড খণ্ড কতো ঘটনায় ভরপুর! সবকথা কি সবাইকে বলা হয়? ছোট ছোট কোন ঘটনাও কখনো কখনো এমনভাবে প্রকাশ পায় যে মনে হয় এটিই সর্বাপেক্ষা বড় ঘটনা। এমনও তো হতে পারে যে জীবনের সর্বোজ্জ্বল ঘটনার কথাটি কাউকে কখনোই বলা হয় না। শিমুকে নিয়ে এমনি কতো সুখের সমৃতি সঞ্চিত হয়ে আছে, প্রতিদিন রচিত হয়, হচ্ছে- তা কেবল বিরলে বসে আমি আর শিমুই উপভোগ করে থাকি।
ইতোমধ্যে পিংকির জীবনে একটা হৃদয়-বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে। ওর আট বছরের মেয়ে রুনু বাড়ির ছাদ থেকে নিচে পড়ে মারা গেছে। রুনু ওর দাদীর কাছে ছিল। সে-বাড়ির তিনতলার ওপর আরেকটা ফ্ল্যাট করা হয়েছিল, যার ছাদের চারধারে তখনো রেলিং করা হয়নি। এক বিকেলে রুনু অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে ছোটাছুটি করে সেই ছাদে খেলছিল। খেলতে খেলতে দৌড়ের ঝোঁকে ছাদের কিনার গলে দড়াম করে নিচে পড়ে যায় রুনু। ইট-পাথরের ওপর পড়ে ওর মাথাটি ফেটে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গিয়েছিল। আত্মজার প্রতি নাড়ীর টান আগে সে কোনদিন অনুভব করেনি, কিন্তু মৃত্যুর খবর পেয়ে পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিল পিংকি- তার বহু আগেই রুনুর প্রাণপাখি হাওয়া হয়ে উড়ে গিয়েছিল। এই ঘটনার পর থেকেই দ্রুত পিংকি আমূল বদলে গেল। সে কথা বলে কম, সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে, রুনুর জন্য কাঁদে। প্যান্ট-শার্ট ঝেড়ে ফেলে শাড়ি ধরলো। কোরান পড়ে, নামাজ পড়ে, সে একেবারে বদলে গেল।
বিয়ে করার মানসে জাহিদ বহু মেয়ে দেখেছিল, শেষ পর্যন্ত সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং তাতে আমরাও দারুণ খুশি হয়েছিলাম। জাহিদ বলেছিল, পিংকির এই দীর্ঘ জীবনটা এভাবে পুড়ে পুড়ে শেষ হতে দেয়া যায় না, আমি ওকে বিয়ে করবো। কিন্তু পিংকি বেঁকে বসলো- না, জীবনে স্বামী একজনই হয়। জেনে না জেনে পাপ তো আর কম করা হলো না, এবার তা শোধরে নিতে চাই। তোরা আমাকে ক্ষমা করিস।
সমাপ্ত
খ্যাতির লাগিয়া, উপন্যাস, প্রকাশিত একুশে বইমেলা ২০০৪
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-১
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-২
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৩
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৪
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৫
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৬
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৭
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৮ (শেষ পর্ব)